বিকেলের শেষ আলো পর্ব-০৯

0
243

#বিকেলের_শেষ_আলো
#লেখনীতে_নূরকথা
#পর্ব_৯

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তাআলার মেহেরবানিতে অবশেষে হোটেল হিল টাউনে পৌঁছাতে পেরেছি। প্লেন থেকে নামার পরও আমার অস্বস্তি কাটেনি। আমি তাকে ধরেই রেখেছিলাম আর এই সুযোগে তিনি ফোঁড়ন কাটতে কিন্তু একদম ভোলেননি। রাগ হলেও তখন দেখাতে পারিনি‚ ভয়েই যে আমার জান বেরিয়ে যাচ্ছিল। এদিকে রুমে এসেই আমি বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছি। তিনি একটু বেরিয়েছেন কোথাও আর মায়ের সাথে কথাও বলবেন‚ দূরসম্পর্কের বোন এলো কিনা।

দুপুরের খাওয়া শেষ করতেই তিনি জিজ্ঞেস করলেন‚ “বের হবে এখন?”

“কোথায়?”

“কোথায় আবার? চলো সিলেট ঘুরে দেখি।”

“মাথা খারাপ!” আমি প্রায় চেঁচিয়ে বললাম। তিনি জানতে চাইলেন‚ “মাথা খারাপ হবে কেন? ঘুরতে এসে ঘুরবে না?”

“সেসব কালকে দেখা যাবে। আজকে আমি হোটেল রুম থেকে কোথাও নড়ছি না। আমার মাথা এখনো ঘুরছে। প্লেনেও মানুষ চড়ে!”

দুপুরের খাবার তিনি কিনে এনেছিলেন। আমাদের হোটেলে গিয়ে খেতে হয়নি বলে আমি অনেক খুশি হয়েছিলাম‚ আলহামদুলিল্লাহ। কারণ আমার যা অবস্থা ছিল এতে কোথাও বের হওয়া খুব মুশকিল। খাওয়া শেষে যেই শশার টুকরোগুলো পড়েছিল তার থেকে এক পিস মুখে দিয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন‚ “তাহলে বাড়ি ফেরার সময় প্লেনে যাবে না? অন্য কিছুর ব্যবস্থা করতে হবে দেখছি। আমি জানতাম এসব হবে। তাই বুদ্ধি করে শুধু সিলেট আসার টিকিট কে*টেছিলাম।” তার কথায় অবাক হওয়ার গলায় বললাম‚ “বাব্বা! আপনি দেখছি সবজান্তা চাঁপাফুল। তা জানতেন যখন এসব হবে। তাহলে সিলেট আসার টিকিটও কা*টতে গেলেন কেন? বাস বা ট্রেনে আসতে পারলেন না?” এবার একটু রাগ প্রকাশ পেয়ে গেল আমার। বসে রইলাম না আর বিছানায়। একটু চটপটে ভাব দেখিয়ে ওয়াশরুমের দিকে যেতে লাগলাম। অন্যদিকে তিনি হো হো হাসছেন। আজকে এত পরিমাণ হাসছেন যেন কেউ তার নাকের কাছে লাফিং গ্যাস ধরে রেখেছে।

ঘুম ভাঙলো আমার। চোখ মেলে তাকাতে সবকিছু অচেনা লাগলো। শোয়া অবস্থায় এদিক সেদিক তাকিয়ে তাকে দেখতে পেলাম; জায়নামাজে বসে তবজি পড়ছেন। চোখাচোখি হতেই খুব মিষ্টি করে হাসলেন। আমার মাথা এখন ঝিম মেরে আছে। তাই তার সুন্দর হাসির বিপরীতে আমি কিছুই করতে পারলাম না। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ঘুম জড়ানো কন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম‚ “এখন কি সকাল?”

“না বউ। আসরের ওয়াক্ত চলে এখন। উঠে নামায পড়ে নাও।” আমি শুনে ঘরটা দেখতে লাগলাম। আস্তে আস্তে হুঁশ ফিরলো আমি সিলেটে আছে। এত বয়স হওয়ার পরও এই স্বভাব যে কেন বদল হয় না তা বুঝতে পারি না।

“আমাকে ডাকলেন না কেন?” একটু সময় নিয়ে আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম। অভিমান করার মতো প্রশ্ন হলেও প্রশ্ন অভিমান নয়‚ ঘুম ফুটে উঠলো।

“তুমি ক্লান্ত ছিলে। হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়লে কখন আমিও টের পাইনি। তোমার ওপর দিয়ে অনেক ধকল গেছে তাই আর ডাকিনি।”

“আমাকে ফেলে নামায পড়ে নিলেন?” জবাব দিলেন না। মৃদু হেসে উঠে এলেন। আমার পাশে বসে পবিত্র এক ভালোবাসা লেপ্টে দিলেন আমার কপালে। এরপর জিজ্ঞেস করলেন‚ “একসাথে নামায পড়া মিস করলে বলে অভিমান হচ্ছে নাকি এটার জন্য?” তার এমন প্রশ্ন শুনে ঘুম জড়ানো মুখে আমার লজ্জার মেঘ জমলো গাঢ় হয়ে৷ চোখ বুজে দিলাম; হুটহাট আমাকে অপদস্ত করা এই মানুষটার দিকে এখন তাকিয়ে থাকা আর কোনোভাবেই সম্ভব না।

বুঝতে পারছি তিনি উঠে যাচ্ছেন। তবে যেতে যেতে বললেন‚ “ফ্রেশ হয়ে নামায পড়ে নাও নয়তো কাযা হয়ে যাবে।”

নামায শেষ করে আমি জায়নামাজ গুছিয়ে রেখে বিছানায় বসলাম। প্রায় সাথে সাথেই তিনি আমার মুখখানা দেখে জিজ্ঞেস করলেন‚ “কিছু বলবে মিষ্টি?”

মুখে না বলে আমি মাথা নাড়িয়ে “না” জানাতেই তিনি আধশোয়া থেকে সোজা হয়ে বসলেন। জানতে চাইলেন‚ “কী ব্যাপার? তোমার কি মন খারাপ? এমন লাগছে কেন?”

“না। মন খারাপ হয়নি।”

“তাহলে এমন লাগছে কেন?”

“আপনি আমাকে বিয়ে করলেন কেন বা কীভাবে করলেন— তা নিয়ে কিন্তু কোনোকিছুই বলেননি। আমি জিজ্ঞেস করার পর বারবার এড়িয়ে গেছেন।” আমার কথা শুনে তিনি ২/৩ মিনিট ঝিম মেরে বসে রইলেন। এরপর মুখের ভঙ্গিমায় সারল্য মিশিয়ে জিজ্ঞেস করলেন‚ “এগুলো জানতেই হবে?”

“জি।” আমি ছোট্ট করে জবাব দিয়ে তার দিকে তাকিয়েই রইলাম। তিনি ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে প্রশ্ন করলেন‚ “প্রথম যেদিন আমরা মুখোমুখি বসেছিলাম‚ সেদিন আমাদের চোখাচোখি হয়েছিল— এটা তোমার মনে আছে?”

“হ্যাঁ। আমি সেদিনই প্রথম আপনাকে দেখেছিলাম।” তিনি আমার কথায় সহমত পোষণ হিসাবে বললেন‚ “আমিও।” একটু থামলেন। এরপর নতুন দমে শুরু করলেন‚ “সেদিন থেকেই মনের মধ্যে একটা শুরু হয়। তোমাকে দেখার‚ তোমাকে নিয়ে ভাবার এমনকি স্বপ্নেও তুমি আমাকে তাড়িয়ে বেড়াতে। সত্যি বলতে সেই সময়টাই আল্লাহর প্রতি মনোযোগ ধরে রাখতে কষ্ট হচ্ছিল। আমি তোমাকে ভুলে তাঁর পথে হাঁটার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু অদৃশ্য ভাবে বারবার তুমি এবং তোমার চেহারা যেন আটকে দিতে। আমি বুঝতে পারছিলাম এমন কেন হচ্ছে? এরপর একজন বড়ো আলেমের সাথে বিষয়টা শেয়ার করি। এরপর তিনি বলেন আল্লাহ তাআলার কাছেই ফয়সালা চাও। আমি তাই করলাম। নামায পড়ে পড়ে বারবার আল্লাহর কাছে জানতে চাইলাম‚ আমি কেন আপনার পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে একজন পরনারীর প্রতি চিন্তা অনুভব করছি? এরপর হঠাৎ একদিন স্বপ্নে তোমাকে আমার স্ত্রীর রূপে দেখতে পেলাম। বুঝতে পারলাম আল্লাহ হয়তো আমাদের বৈবাহিক সম্পর্ক নিশ্চিত করে রেখেছেন। এরপর আবারও সেই আলেমের কাছে এই বিষয়ে বললাম। তিনি বললেন‚ এবার তবে আল্লাহর কাছে চাও তিনি যেন ওই নারীকে তোমার জন্য হালাল করে দেন।” একটু থেমে তিনি মুচকি হাসলেন। মাশাআল্লাহ‚ কী মনমাতানো তার হাসি!

“এরপর?” আমি জিজ্ঞেস করতে তিনি বললেন‚ “এরপর থেকে কত-শত নামাযে তোমাকে হালাল হিসাবে চাইতে শুরু করলাম। অন্যদিকে খোঁজখবরও নিতে লাগলাম। কারণ বিয়ের আগে পাত্রপাত্রীর একে অপরকে জেনে নেওয়া। তাই গোপনে তোমার অনেক খোঁজ নেওয়ার পর তোমার বাড়ির হদিস পেলাম। কিন্তু যখন জানলাম যে তুমি আমার বয়সে বড়ো‚ তখন ভেবেছিলাম মা হয়তো আপত্তি করবেন। কিন্তু তিনি আরও উৎসাহ দিয়ে বলেছিলেন‚ ‘আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও নিজের থেকে বয়সে বড়ো নারীকে পত্নী হিসাবে গ্রহণ করেছেন। তাহলে তুমি কেন করবে না?’ আর কোনো বাঁধা আল্লাহ তাআলা রাখেননি। আমি শুধু পড়াশোনা শেষ হওয়ার অপেক্ষায় ছিলাম আর তোমার খোঁজখবর পেতে যেন সহজ। তাই তো ম্যানেজমেন্ট নয়‚ ইকোনমিকস নিয়ে অনার্স করলাম। এরমাঝে আবার দেখলাম তুমি আচমকা নিজেকে কেমন বদলে ফেলছো‚ গুটিয়ে নিচ্ছো নিজেকে‚ আড়াল করলে পর্দা নামক আল্লাহর দেওয়া এক নিয়ম। আলহামদুলিল্লাহ‚ এটা দেখে আরও নিশ্চিত হয়েছিলাম তুমি আমার জন্য হালাল হচ্ছো আল্লাহ তাআলার ইশারায়। আমার খুশি যদি সেদিন দেখতে মিষ্টি!”

“এসব না হয় বুঝলাম। কিন্তু আমার আম্মু আব্বু এই বিয়ে নিয়ে……….” আমাকে বলতে দিলেন না। থামিয়ে নিজেই শুরু করলেন‚ “সত্যি বলতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠানোর পর একটু বেগ পেতে হয়েছিল। বিশেষ করে শ্বাশুড়ি মায়ের আপত্তি ছিল যে পাত্রের বয়স কম পাত্রীর তুলনায়।” তার এমন কথা আমি চমকে উঠলাম‚ “সে কি! আম্মুর আপত্তি ছিল? কিন্তু আম্মুকেই তো দেখলাম এই বিয়ে নিয়ে সবচেয়ে বেশি আগ্রহী।”

তিনি হাসলেন; রহস্য ভরা যেন সেই হাসি। বললেন‚ “তোমার চাচী আমার দূরসম্পর্কের খালা হোন— এটা অবশ্য আমাদের জানা ছিল না। তোমার চাচা চাচীর আমাদের এই বিয়ে হওয়ার পিছনে অনেক অবদান আছে। মূলত তার পরামর্শ অনুযায়ী আমরা এগিয়ে ছিলাম। এরপর তোমার চাচী মানে আমার খালা গিয়ে শ্বাশুড়ি মাকে কীসব বুঝিয়েছেন। এরপর আর আপত্তির বিষয় আসেনি। কিন্তু মিষ্টি……….”

……….চলবে ইন শা আল্লাহ