#বিধুর_রজনী
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ৭]
___________________
১৩.
গরম জলে স্নান সেরে শেহজাদী আরওয়া খাসদাসী লতাকে নিয়ে রাজসভার দিকে গেলেন।জিন্নাতের ব্যাপারে কথাটি যে তার ভ্রম সেটি সম্রাট’কে সুনিশ্চিত ভাবে বলতে হবে, না হলে আরেক কেলেঙ্কারি ঘটে যাবে।রাজসভায় উপস্থিত হয়ে খানিক’টা চমকালেন শেহজাদী।আজ রাজসভা বসেনি
শূন্য উদ্যানের ন্যায় খা খা করছে রাজসভা।
” একি আজ সভা বসে’নি?”
” আজ্ঞে না শেহজাদী।”
” পিতা কোথায়?হঠাৎ সভা বন্ধ করলেন যে?”
” সম্রাট আজ প্রত্যুষে উদয় নগরী রাজ্য দখলের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছেন।”
গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ’টি এই মুহূর্তে পেয়ে বেশ চমকালেন শেহজাদী।চোখে মুখে অবাকের রেশ বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না।খাসদাসী লতাকে সঙ্গে নিয়ে তিনি পুনরায় ছুটলেন সম্রাজ্ঞী শাহাবার কক্ষে।সেখানে উপস্থিত ছিলেন সম্রাট আব্বাসের বোন আসমা।
” শুভ সকাল মাতা।”
“শুভ সকাল কন্যা।ঘুম কেমন হলো?”
” বেশ ভালো।ফুফু’মা কেমন আছেন এখন?পায়ের ব্যথা কমেছে?”
শেহজাদীর প্রশ্নে তার ফুফু আসমা মাথা ঝুঁকালেন।শেহজাদী মিহি হাসলেন এগিয়ে গেলেন জানলার কাছটায়।সোনা রোদের চকচকে আলোয় পুষ্পাধারে থাকা হলুদ অলকানন্দা ফুলগুলো বেশ ঝকমক করছে।একটি ফুল ছিড়ে হাতের মুঠোয় রাখলেন শেহজাদী।
” আমার একটা প্রশ্ন ছিল মা।”
” অনুমতি চাইছো?আমি তোমার মা হই যখন যা মনে আসবে নির্দ্বিধায় বলতে পারো।”
” কিন্তু তার আগে যে আপনি সম্রাট আব্বাসের স্ত্রী।এই অলকপুরী রাজ্যের সম্রাজ্ঞী।কিছু বলার আগে অনুমতি অবশ্যই নেওয়া উচিত আমার”
” এভাবে কথা বলছো যে?কি বলবে বলো।”
” শুনলাম উদয় নগরী রাজ্যে দখলে গেছেন পিতা।যুদ্ধে যাওয়ার বিষয়টি প্রাসাদের সকলে অবগত হলেও আমি জানতে পারিনি কেন?তাছাড়া যাওয়ার আগে পিতা একবার আমার সঙ্গে দেখাও করলেন না!যুদ্ধ মানেই জীবন মরণের সন্ধিক্ষণ।অন্তত…..”
শেহজাদীর মুখের কথা অবজ্ঞা’র সহিত কেড়ে নিলেন ফুফু আসমা।
” লজ্জা নেই কি তোমার?আর কতবার বললে শুধরাবে?কোন শুভ কাজে যাওয়ার আগে তোমার মুখ দেখা মানা তাহলে অমঙ্গল গায়ে লেপটে যায়।”
আসমার কথায় হতভম্ব হলেন সম্রাজ্ঞী শাহাবা।
” থামুন আপা এভাবে বলছেন কেন?মঙ্গল অমঙ্গল সব আল্লাহর উপর এভাবে বলছেন কেন মেয়েটাকে!”
” তুমি চুপ কর।আমার ভাইজান শুভ কাজে যাওয়ার আগে এমনি এমনি এই মেয়ের মুখ দর্শন করেন না এর পেছনে নিশ্চয়ই উত্তম কারণ আছে।আর শুনে নাও আরওয়া তুমি যে তোমার পিতার জন্য অভিশপ্ত তা……. ”
বুকের ভেতরটা ধুমড়ে মুচড়ে গেল এক নিমিষে।শেহজাদী ছুটে চলে গেলেন কক্ষের বাইরে।ফুরফুরে মেজাজ চোখের পলকে তার গায়েব হয়ে গেল ।
” কাঁদছেন কেন শেহজাদী?”
” খবরদার পেছন পেছন আসবে না।শাস্তি ভোগ করতে না চাইলে আমাকে একা ছেড়ে দাও।”
ঘন জঙ্গলে পাখপাখালির শব্দে কানে হাত দিয়ে অগ্রসর হলেন শেহজাদী।স্থানীয় নাম অনুসারে এই জঙ্গলের নাম হরিৎ বন।হিংস্র জন্তু জানোয়ারের ভয়ে এই জঙ্গলে মানুষ প্রবেশ নেই বললেই চলে তবুও ঘন জঙ্গলের একজন বৈরাগীর বসবাস।ঈশান কোণের দিকে জঙ্গলের মাঝে একটি কুটির আর সেখানে বৈরাগী নিজের মত করে সবটা গুছিয়ে নিয়েছে।শেহজাদী আরওয়া খাস দাসী লতার মাধ্যমে এই বৈরাগীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন,বৈরাগীর সঙ্গে বাক্যালাপে শেহজাদী বড্ড সন্তুষ্ট হন।বিশেষ করে তার একতারার সুরের গান যে সুরের মূর্ছনায় হারিয়ে যান শেহজাদী আরওয়া।তারপর থেকেই উচাটন মনে বেশ কয়েকবার ছুটে যান বৈরাগীর কাছে।
” কুটিরে আছেন বৈরাগী?”
” কে লো কে এসেছিস?”
” আমি শেহজাদী আরওয়া নূর।”
শেহজাদীর নাম শুনতে ছুটে বাইরে বেরিয়ে আসেন বৈরাগী।চোখে মুখে বিস্ময় ভাব ছড়িয়ে পড়ে মুহূর্তে।খুশিতে চোখ দু’টো করে উঠে চকচক।নত মস্তকে শেহজাদীকে সম্মান প্রদর্শন করলেন তিনি।
” ভেতরে আসুন শেহজাদী।”
শেহজাদী মৃদু হেসে কুটিরের ভেতর প্রবেশ করে।বৈরাগী তার পেছন পেছন ছুটে যায়।
” রাজ বাড়িতে যান না কেন বৈরাগী।আপনাকে আমি বলে ছিলাম অন্তত সপ্তাহে একদিন আমাকে গান শোনাতে যাবেন।”
” আপনার নির্দেশ ছিল তাই তো আর যাওয়া হয় না।”
” আমি!এমন কথা কে বললো আপনাকে?”
রুষ্ট মনে শেহজাদীর ধারালো সুরে খানিকটা ঘাবড়ে যায় বৈরাগী।
” শাহজাদা ইবনুল বলেছেন আপনি প্রাসাদে আমার প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছেন।তারপর থেকে আর যাওয়া হয়নি।”
শেহজাদী আরওয়া দু’চোখ বন্ধ করলেন।এমন মিথ্যা অপবাদ কিছুতেই হজম হচ্ছে না তার তবুও নীরব রইলেন।বিষণ্ণ মন কিছুতে কাটিয়ে উঠতে পারছেন না তিনি তাই মিহি স্বরে প্রশ্ন করেন,
” মানুষ আমায় ভালোবাসে না কেন বৈরাগী?”
বৈরাগী আড় চোখে তাকালেন শেহজাদীর পানে মেয়েটার চোখ টলমল করছে তেজস্বী মেয়েটা এই মুহূর্তে যেন সবচেয়ে দুর্বল বিক্ষিপ্ত।
” আপনি মানুষ’কে ভালোবাসেন শেহজাদী?বাসেন না।পান থেকে চুন খসলেই রেগে একাকার পরিস্থিতির সৃষ্টি করেন।অবশ্য আপনি একা নন আপনার দাদা, পিতা, ভাই সবাই এক ধাঁচের নিষ্ঠু-র বর্ব-র আর সেই রক্ত আপনার শরীরে বইছে এসব ব-র্বরতা আপনার দ্বারা হওয়া দুঃসাধ্য নয়।আমি কেমন তা আপনি জানেন কথার তালে কথা বলে ফেলেছি আমায় মার্জনা করবেন যদি শাস্তি দেওয়ার ইচ্ছে মনে জাগে তবে আপনার শাস্তি গ্রহণে আমি প্রস্তুত।”
ঝাপসা চোখ স্থির রইলো না আর এক মুহূর্তে টলটলিয়ে গড়িয়ে পড়লো সহসা।বৈরাগী এক পানির পাত্র এগিয়ে দিলেন শেহজাদীকে।ধরলেন তার সুরেলা কন্ঠের গান।একতারার সুরে মিহিয়ে গেলেন শেহজাদী ঝাপসা চোখ মুছে নিলেন বা’হাতের উলটো পিঠে।
১৪.
সম্রাট আব্বাসের দলবল নিয়ে একটি দুর্গের কাছে পৌঁছালেন।এই দুর্গ সম্রাট আব্বাস কয়েক বছর আগেই দখল করেছেন বর্তমানে রাজ্য’টির দায়িত্বে আছেন শাহজাদা ইবনুল।সন্ধ্যার বাতি জ্বালানোর ব্যবস্থা করে উজির হাযম এগিয়ে গেলেন শাহজাদা ইবনুল রাশীদের কক্ষে।
” আমায় ডেকেছিলেন শাহজাদা?”
” হুম, পিতা কোথায়?”
” তিনি কক্ষে বিশ্রাম গ্রহণ করছেন।জরুরি প্রয়োজন ছিল কী?কোন বার্তা পৌঁছাতে হবে?”
” তা নয়।তবে আমি যে ক্ষুদার্থ।”
” এক্ষুনি খাবারের ব্যবস্থা করছি আমি আপনি আরেকটু অপেক্ষা করুন।”
উজির হাযমের কথায় মুখ বাকিয়ে হাসলেন ইবনুল রাশীদ।
” কোন খাদ্যই আমার ক্ষুদা মেটাবে না।একমাত্র এই রাজ্যের রসালো তীপ্তময়ী খাদ্য ছাড়া।”
” রসালো খাদ্য!”
” আহ!মূর্খ উজির এখনো বুঝতে পারছেন না শরীরের ক্ষুধা মেটাতে চাই।কাঁখে কলসি নিয়ে নদী চরে হাটা সেই রমণীর কথা মনে আছে?”
” হ..হ্যাঁ।
“সেই মেয়েটার ব্যবস্থা করুন।যে করে হোক রাতের ভোজনের পর আমার কক্ষে মেয়েটিকে চাই।”
উজির হাযম খানিকটা বিচলিত হলেন।তবে এ আর নতুন কি?শাহাজাদা ইবনুল রাশীদের এমন নির্দেশ নতুন নয়।বাবার বয়সী একজন মানুষকে এভাবে রাতের সঙ্গী আনার ব্যবস্থার আদেশ করতে তার লজ্জা লাগতে না পারে তবে মাঝে মাঝে লজ্জায় মাথা নুইয়ে আসে হাযমের।
.
নিস্তব্ধতা ঘিরে থাকা দুর্গটি হঠাৎ একটি মেয়ের আহাজারিতে জেগে উঠলো।ঘুটে ঘুটে অন্ধকারে শেয়ালের হাঁক ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে তুলেছে।সেনাপতির নির্দেশে আজ কক্ষের বাইরে বের হওয়া সকলের নিষিদ্ধ তাই পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করতে এগিয়ে এলো না কেউ।ক্লান্ত শরীর নিয়ে গভীর তন্দ্রাচ্ছন্ন সম্রাট আব্বাস তাই তো বাইরের বিপদ সংকেত তার কর্ণ কুহুরে পৌঁছালো না।শাহজাদা ইবনুলের কক্ষের দ্বারে এসে মেয়েটিকে ধাক্কা দিয়ে কক্ষে ছেড়ে দিল একজন প্রহরী তার পেছনে ছিলেন উজির হাযম।
” আপনার নির্দেশ মোতাবেক মেয়েটিকে এনেছি শাহজাদা।”
” এবার আসতে পারুন আমার যে আর তর সইছে না।”
বিধ্বস্ত মেয়েটি চোখের পলকে জড়িয়ে ধরলো ইবনুল রাশীদের দু’চরণ।মেয়েটি প্রাণ ভিক্ষায় নিজেকে সপে দিয়েছে জা/নো/য়ারের দু’চরনে।
” আমায় ছেড়ে দিন শাহজাদা আমার পবিত্র শরীর’টায় অপবিত্রতার দাগ লাগাবেন না।একটু দয়া করুন।”
” দয়া!শাহজাদা ইবনুল রাশীদের দয়া মায়া বলে কিছু নেই।”
” আমার বিধবা মায়ের একমাত্র মেয়ে আমি তার সে বেঁচে থাকার একমাত্র সম্বল আমি অন্তত আমার মায়ের কথা ভেবে…..”
হস্তের ইশারায় মেয়েটিকে থামিয়ে দিলেন শাহজাদা ইবনুল।বেশ রাজকীয় ভঙ্গিমায় বসে পড়েন হাঁটু মুড়িয়ে।কামুক দৃষ্টিতে আরেকবার দেখে নিলেন মেয়েটিকে।তর্জনী’র আঙুল ঘুরিয়ে ছুঁয়ে দিল মেয়েটির চিবুক।সমস্ত শরীর এক নিমিষে গুলিয়ে উঠলো অভাগিনী মেয়েটির।
“সুন্দরী কত দিরহাম চাই তোমার?”
” ক..কি বলছেন!”
” স্বর্ণ, রৌপ্য,দিরহাম জায়গির কি চাই তোমার? সুখে থাকার সমস্ত উপাদানে মুড়ে দেব তোমায় শুধু এই রাতটা সহ্য করে যাও।তোমার মায়ের লাভ,তুমিও আনন্দ পাবে শুধু….”
ঘৃণায় গা গুলিয়ে এলো মেয়েটির।লোভ তার কোন কালেই ছিল না তার।শস্য ফলিয়ে যা আয় হয় তা দিয়ে দিব্যি সংসার চলে যায় অথচ শাহজাদা তাকে দেহ ব্যবসার ইঙ্গিত দিচ্ছেন ব্যভিচার করতে চাইছেন তার উপর।মেয়েটি গাল ভরতি থুথু ছুড়ে দিলেন শাহজাদার মুখে।
” জা/নো/য়ার রাজার জা/নোয়ার ছেলে তোদের ভালো কোন কালেই হবে না।”
তীব্র অপমানে হিংস্র হয়ে উঠলেন ইবনুল।রক্তিম চোখের পলক ফেলে সমস্ত শক্তি দিয়ে কষিয়ে মারলেন মেয়েটির গালে চড়।শেয়ালের হাঁক তখন ক্রমাগত বাড়ছিল।নিশাচর প্যাঁচা’র রহস্যময় ডাক অন্ধকার দুর্গটির মানুষগুলোকে কিসের ইঙ্গিত দিচ্ছে কে জানে!কেউ কেউ মনে করে প্যাঁচার ডাক অশুভের প্রতীক তাই তো উজির হাযমের শিউরে উঠলো শরীর।
#চলবে___
#বিধুর_রজনী
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ৮]
___________________
১৫
দুর্গে থাকা ঘুমন্ত মানুষজন পুনরায় জেগে উঠেছে।বাইরে অন্ধকার হালকা কুয়াশায় ভিজে আছে চারিদিক।সম্রাট আব্বাস ওজু শেষে ডেকে পাঠালেন উজির হাযম’কে।
” সবার ঘুম ভেঙ্গেছে?সবাইকে নামাযে পাঠাও।”
” যথা আজ্ঞা সম্রাট।”
” ইবনুলের ঘুম ভেঙ্গেছে?তাকে জানিয়ে দিও নামায শেষে আমি তার সাক্ষাৎকার চাই।”
” তিনি এখনো ঘুমে সম্রাট।আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন তার ঘুম যেন না ভাঙ্গাই।”
” আমার নিয়মের অমান্য এক্ষুনি তাকে জাগ্রত করে নামাযে পাঠাও আমি আসছি।”
” যথা আজ্ঞা।”
সম্রাট আব্বাস জায়নামাজ মেঝেতে রাখলেন।উজির হাযম এগিয়ে গেলেন শাহজাদা ইবনুলের কক্ষের দিকে তৎক্ষণাৎ দেখা পান সেনাপ্রধান ফারুকের।
” সেনাপতি মশাই আপনি ঘামছেন কেন?”
” মেয়েটা মা/রা গেছে।সে কি বীভৎস দেহ!দয়াহীন ইবনুল মেয়েটাকে খুবলে খেয়েছে বিকৃত যৌনাচারের কারণে অধিক রক্তক্ষরণে মৃত্যু হয়েছে তার।”
উজির হাযম নত মস্তকে চোখ বুঝলেন।অপরাধ বোধ তাকেও বিবশ করছে তবে তিনি করবেন বা কি? তিনি শাহজাদার কথা মান্য করেছেন ব্যস এইটুকু।
” উজির মশাই শাহজাদা’র কথা মত মেয়েটির লা/শ জঙ্গলে ফেলে এসেছে দাস’রা।শাহজাদা চাইছিলেন জঙ্গলের হিংস্র জ/ন্তু জা/নো/য়া/রের ভোজন যেন এই মেয়ের মৃত দেহ হয় ভাবতে পারছেন পা/ষা/ণের এ কেমন আদেশ!”
উজির হাযম ঠোঁট বাকিয়ে কিঞ্চিৎ হাসলেন।দু’পা এগিয়ে এলেন সেনাপতি ফারুকের সামনে।কানের কাছে মুখ নিয়ে বলেন,
” শাহজাদা ইবনুল নিজেও হিং,স্র জ/ন্তু,জানো/য়ার।জঙ্গলের জা/নো/য়ারের আগে তো তিনি ভোগ করেছেন মেয়েটাকে।তবে জঙ্গলের জা/নো/য়ার আর তার মাঝে পার্থক্য কই?তিনি দেহের ক্ষুধা মেটালেন আর জঙ্গের অবলা প্রাণী পেটের ক্ষুধা মেটাবে।
১৬.
অলকপুরী’র প্রাসাদে আজ আবার হইচই বেঁধেছে।প্রত্যুষে শেহজাদী আরওয়ার জানলা বেয়ে এক আগন্তুক কক্ষে প্রবেশ করার চেষ্টা করেছে।দুর্ভাগ্যবশত বিষটি চোখে পড়েছে প্রহরী’র।শাহজাদা ইবনুল যু/দ্ধে যাওয়ার আগে বেশ কয়েকজন প্রহরী’কে নির্দেশ দিয়ে গেছেন সর্বাবস্থায় শেহজাদীর কক্ষের আনাচে-কানাচে নজর রাখতে আর প্রহরী’রা সেই নির্দেশ মোতাবেক কাজ করেছে।ইতোমধ্যে সেই আগন্তুক’কে বন্দি করা হয়েছে।বিষয়টি নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন শেহজাদী কেননা সেই আগন্তুক তাসবীর!ঘটনাটি শ্রবণ হতে শাহজাদা ইদ্রিস বন্দিশালায় গিয়ে নিজেও চমকে যান।তাসবীরের কাতর চাহনী তার অন্তরে শূল বাঁধিয়েছে।কিন্তু দাস এবং প্রহরীর সামনে মুখ খুললেন না তিনি।বরং ছুটা যান সম্রাজ্ঞী শাহাবার কাছে এই মুহূর্তে যা করার তিনি করবেন।এত শত কাণ্ডের মাঝে প্রশ্ন একটা তো ঘুরপাক খাচ্ছেই ‘শেহজাদীর রুমে তাসবীরের প্রবেশ কেন?’
রাতের ঘুমের পোশাক গায়ে তার এলোমেলো কেশে ওড়না বিছিয়ে মুখের একাংশ ঢেকে বন্দিশালায় উপস্থিত হন শেহজাদী আরওয়া নূর।তাকে দেখে নত মস্তকে কুর্নিশ করলেন প্রহরী,পেয়াদা,দাস সহ সকলে।তাসবীর শেহজাদীর অবস্থা দেখে ঢোক গিলেন যদি কোন ক্রমে ইদ্রিস শেহজাদী আর তার সম্পর্কের কথা জানতে পারেন তবে কেলেঙ্কারি ঘটে যাবে।বন্ধুত্বের সম্পর্কে দানা বাধবে বিশ্বাস/ঘা-তকতার শ/ক্রতার।তাসবীর সবার অগোচরে শেহজাদীকে কিছু ইশারা করলেন তবে শেহজাদী আরওয়া তা বুঝলেন কি না কে জানে।
শেহজাদী এগিয়ে গেলেন তাসবীরের সম্মুখে তবে তাদের সামনে বাঁধা হয়ে রইলো দণ্ডায়মান লোহার শিক।যে সুপুরুষ’টির প্রণয়ে শেহজাদী হাবুডুবু খাচ্ছেন আজ সেই সুপুরুষ’টি আহত অবস্থায় সেঁটে আছে দেয়ালে।চাবুকের ভয়ংকর আঘাতে চামড়া ফেটে র/ক্তের ধারা বইছে।সারা দেহের চামড়া ছিলে র/ক্তে মাংসে একাকার অবস্থা এই দৃশ্য যে সয়না শেহজাদীর চোখে।খা খা করে উঠে বুকটা তবে ঘুমন্ত তার হিংস্র আত্মা’টা যেন জেগে উঠেছে আরেকবার ধ্বংস তাণ্ডব লীলাখেলার ভয়ে তাসবীর ঠোঁট ইশারায় শেহজাদীকে শান্ত থাকতে নির্দেশ দেন তবে তার ইশারা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করলেন শেহজাদী কুটিল হাসলেন মুহূর্তে।
” এই আগন্তুক যুবক’কে বন্দি করেছেন কে?”
একজন প্রহরী এগিয়ে এলেন শেহজাদীর সামনে এবং নির্দ্বিধায় বললেন,
” শেহজাদী আমি।”
” তাকে আহত কি আপনি করেছেন?”
“জ্বি আমি করেছি।”
” আহত করার কারণ?”
” আপনার কক্ষে তিনি কেন প্রবেশ করতে চেয়েছেন তার উত্তর জানতে তবে তিনি এখনো মুখ খুলেন’নি।”
” আমি আদেশ করেছিলাম যুবকটির গায়ে যেন একটি আঁচড় না লাগে তাহলে কেন তাকে আঘাত করলেন?আমার আদেশ কি আপনার কাছে এতই তুচ্ছ?”
” মার্জনার দৃষ্টিতে দেখুন শেহজাদী।শাহজাদা ইবনুল আমাকে আগেই আদেশ করে গেছেন এবং তার আদেশ আমি অক্ষরে অক্ষরে পালন করছি।”
প্রহরীর কথায় তীব্র অপমানের সঞ্চার হলো শেহজাদীর মনে।নিজের ক্ষমতার অপব্যবহার তিনি আগেও করেছেন সর্বদা স্বার্থপর হয়ে চলেছেন তিনি।নিজেকে রেখেছেন সবসময় আলোচনা সমালোচনা মুখর, তিনি চান রাজ্যের প্রত্যেক সদস্য তাকে ভয় করুক মান্য করুক কিন্তু এই প্রহরী স্পর্ধা দেখে শেহজাদী নিজেই হতভম্ব।
” যা হওয়ার হয়েছে আমি ছাড় দিলাম যুবকটিকে বন্দিদশা থেকে মুক্তি করুন।”
ইতোমধ্যে বন্দিশালায় উপস্থিত হন ইদ্রিস এবং শাহাবা।শেহজাদীর কথা শুনে ইদ্রিস সহ সম্রাজ্ঞী শাহাবা খানিকটা নিশ্চিন্ত হলেন।এই প্রহরীর তর্কে বির্তকে আবার না অঘটন ঘটান আরওয়া তার ভয় হচ্ছিল সকলের।খাসদাসী লতা এমন পরিস্থিতিতে রুদ্ধশ্বাস ছেড়ে ক্ষান্ত হলেন।কিন্তু পরিস্থিতি স্বাভাবিক পর্যায় থেকে অস্বাভাবিক পর্যায়ে মোড় নিল প্রহরীর উগ্রতায়।
” তা হয় না শেহজাদী যতক্ষণ না সম্রাট এবং শাহজাদা ফিরছেন আমি আগন্তুক’কে ছাড়ছি না।”
” আপনি আমার ধৈর্য্যর পরীক্ষা নিচ্ছেন।আগন্তুকের ব্যাপারে যা জানার আমি জানবো।মুক্তিদিন তাকে।”
” আমি আমার দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট…”
প্রহরীর শেষ না হওয়া কথার মাঝে গর্জে উঠলেন শেহজাদী।এত বড় স্পর্ধা আরওয়া নূরের সঙ্গে বেয়াদবি!এক দিকে আহত তাসবীরের দেহ দেখে মূর্ছা অবস্থা অপর দিকে প্রহরীর তর্কবিতর্ক কথার খেলাপ সব মিলিয়ে ক্রোধ সংযত করতে পারলেন না তিনি। দেয়ালে আটকে রাখা সাজানো শানিত তরবারি হাতে তুলে চোখের পলকে কতল করলেন প্রহরীকে।আকস্মিক কাণ্ডে রুদ্ধশ্বাস চোখে চেয়ে রইলেন সকলে।আহত প্রহরী গলা ধরে কাতরাতে কাতরাতে মেঝেতে গড়িয়ে পড়লেন।মেঝেতে যেন রক্তের ফোয়ারা বইছে।কয়েকজন দাস দ্রুত এগিয়ে এলো প্রহরীকে মাটি থেকে তুলতে কিন্তু তাদের হাত ইশারায় থামিয়ে দেন শেহজাদী চোখে মুখে ক্রোধ ফুটিয়ে বলেন,
” খবরদার কেউ ছুঁবে না তাকে।যতক্ষণ চেতনা থাকে এখানেই ছটফট করুক সে।আমিও দেখতে চাই তার তেজ কি করে থাকে।”
শাহজাদা ইদ্রীস এই ভয়টাই পাচ্ছিলেন।বোনের হাত থেকে তরবারি ছিনিয়ে নিয়ে ছুড়ে ফেললেন দূরে।
” নূর এসব কি করছো।মাথা ঠাণ্ডা করো।”
” আমার কাজে নাক গলাবে না ভাইজান।তোমাদের প্রহরীদের বলে দাও যুবক’টিকে ছাড়ানোর ব্যবস্থা করতে এবং তাকে যেন আমার কক্ষে হাজির করা হয় যত দ্রুত সম্ভব।”
“আমি কথা বলে দেখেছি তুই…..”
শেহজাদী হাত ইশারায় থামিয়ে দিলেন শাহজাদা ইদ্রীসকে।নিজের দাম্ভিকতা বজায় রেখে গটগটিয়ে হেটে চলে যান নিজের কক্ষে।
তীব্র বাতাসের কাঁপুনি ধরে যায় তাসবীরের গাত্রে অথচ শেহজাদী আরওয়া এক ধ্যানে তাকিয়ে আছেন বাইরে। চোখে মুখে রেষের ভাব একটুও কাটেনি।কাঁধের চাদর মাটিতে অনাদর অবস্থায় এলিয়ে পড়েছে।তাসবীর যত্ন হাতে চাদর তুলে এগিয়ে দেন শেহজাদীর কাঁধে।অলিন্দ থেকে চুপচাপ কক্ষে ফিরে আসেন শেহজাদী ঝাপসা চোখে কয়েক পলক তাকালেন তাসবীরের দিকে।
” আমি আপনাকে এসেছি ভালোবাসা শেখাতে অথচ আপনি আমাকে ভালোবেসে অন্যকে হত্যা করলেন!এমন টা কেন করলেন শেহজাদী?এমন করা কি খুব জরুরি ছিল?”
” আমি কাউকে কৈফিয়ত দিতে বাধ্য নই।”
কিঞ্চিৎ হাসলেন তাসবীর।ব্যথায় টনটন করা শরীর নিয়ে বসলেন শেহজাদীর পালঙ্কে।
” আমার জীবনের সেরা প্রাপ্তি কি জানেন?আমি আপনার মন জয় করেছি তা জানতাম তবে আমার আঘাত প্রাপ্ত শরীর দেখে আপনার চোখে মুখে যে দিশেহারা দেখেছি তা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ভুলা সম্ভব নয়।মৃত্যুর আগে শেষ আলিঙ্গনে হলেও আপনাকে চাই আরওয়া!”
শিউরে উঠলো আরওয়া।থম মেরে চেয়ে রইলো জানলার বাইরে নিজেকে সংযত করে দৃঢ় কণ্ঠে বলে,
” পিতা এবং ভাইজানকে কি জবাব দেবেন তা ভেবে নিন তাসবীর।তাদের হাত থেকে আপনাকে বাঁচানোর সাধ্য আমার নেই।আগেই বলেছিলাম আমার কক্ষে সময় অসময়ে আসবেন না।”
” কথার খেলাপ করায় মাফ চাইছি।শেষ রাতে যে দুঃস্বপ্ন দেখেছি আপনাকে নিয়ে তা দেখার পর নিজেকে আর সংযত রাখতে পারিনি।”
শেহজাদী কোন প্রতিক্রিয়া দেখালেন না।তাসবীরের উপর রাগ একটুও কমলো না বরং সময়ের তালে তালে তা বাড়তে থাকে।সাদা চাদরে রক্তের দাগ দেখে খানিকটা বিচলিত হয়ে পড়েন পরপরেই মনে পড়ে চাদরে তাসবীরের রক্তের দাগ লেগেছে।শেহজাদী নিজের রাগ সংবরণ করে এগিয়ে যান তাসবীরের কাছে।ছুঁয়ে দেন যুবকটির আহত গাল।
” কবিরাজ’কে ডেকে পাঠাচ্ছি তিনি ওষুধ দিয়ে সারিয়ে তুলবেন।আশা করি আপনি আপনার বুদ্ধির জোরে ভাইজান এবং ভাইয়ের হাত থেকে রক্ষা পাবেন।”
” আরওয়া এতকিছুর পরেও আপনি আমার কাছে ধরা দিতে প্রস্তুত নন!”
” অবেলায় কাছে এসেছেন।”
” সম্রাট সাঈদের সঙ্গে বিয়ে ঠিক হওয়ায় কি এই দূরত্ব?”
” ধরে নিন তাই।আসছি আমি।”
কবিরাজ আকরাম শেহজাদীর কথামত বেশ যত্ন নিয়ে তাসবীরের চিকিৎসা চালান।সম্রাজ্ঞী শাহাবার নির্দেশে তাকে অতিথি কক্ষে থাকার অনুমতি দেওয়া হয়।এতকিছুর পরেও শাহজাদা ইদ্রীসের মনে একটি প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিলো আর তা হলো শেহজাদীর কক্ষে তাসবীরের প্রবেশ কেন?আর সেই প্রশ্নের উত্তর পেতে তাসবীরের সঙ্গে একাই সাক্ষাৎ করেন তিনি।
” আমি আগেই বলেছিলাম চলে যাও এই প্রাসাদ ছেড়ে শুনলে না আমার কথা।যদি আমার কথা রাখতে তবে এই হাল হতো না।ভাইজান আর পিতা এলে কি হবে আমি ভাবতে পারছি না।”
” বাদ দাও সেসব কথা।তুমি দেখবে আমি ঠিকি সবকিছুর সুরাহা করবো।তুমি শুধু দোয়া রেখো আমার জন্য।”
ইদ্রিস সন্দিহান চোখে তাকালেন তাসবীরের দিকে।
” শেহজাদীর কক্ষে কেন প্রবেশ করতে চাইছিলে তাসবীর?”
ভড়কে গেলেন তাসবীর।জানতেন এই প্রশ্নের সম্মুখে তিনি পড়বেন তাও খানিকটা বিচলিত হয়ে পড়লেন।উপস্থিত বুদ্ধি সাজিয়ে সোজাসাপ্টা বলেন,
” আমায় বিশ্বাস করো বন্ধু?
” আলবৎ করি।”
” তাহলে যা বলছি বিশ্বাস করো।আমি জানতাম না কক্ষে শেহজাদী আছেন।শেহজাদীর কক্ষের জানলার কার্নিশ বেয়ে কেউ একজন প্রবেশ করার চেষ্টা করে আর আমি তাকে অনুসরণ করতে গিয়ে শেহজাদীর কক্ষের সামনে দাড়াই এরপর যা হওয়ার হয়েছে।”
” এসব কি বলছো বন্ধু!”
” যা বলছি ঠিকঠাক বলছি।শেহজাদীর তরবারিতে কতল হওয়া সেই প্রহরী কী বেঁচে আছেন?”
” তিনি বাঁচা ম/রা/র সন্ধিক্ষণে!”
#চলবে_____