বিষাদনীড়ে মায়াতরী পর্ব-৪+৫

0
237

বিষাদনীড়ে মায়াতরী [৪]
প্রভা আফরিন

_
খিলানচর

আকাশ কালো মেঘে ঢাকা। দুইদিন যাবত সূর্যের দেখা নেই। থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। কখনো ঝিরিঝিরি কখনো বা ঝমঝম। প্রকৃতি একবার শব্দমুখর হচ্ছে আবার থম মেরে যাচ্ছে। এ যেন শব্দের খেলা। যে খেলা ফিসফিস করে বলে যায় চরবাসীর আগাম দুর্ভোগের গল্প। টানা বৃষ্টিতে একটা শীত শীত আমেজ বিরাজ করায় কাঁথা মুড়িয়ে সুখনিদ্রায় ডুবে থাকা চরবাসী মাঝরাতে ফজলুর চিৎকারে জেগে উঠেছে। এরপর আর কারো চোখে ঘুম নেই। আছে শুধু উৎকন্ঠা। গতকাল রাত থেকে হুট করেই নদীর জল ফুলে-ফেঁপে উঠতে শুরু করেছে। ফজলুর ছনের ঘরটা ঘাটের নিকটে। তার ঘরে শোয়ার জন্য কোনো উঁচু চৌকি বা মাচা নেই। মেঝেতে খড়ের বিছানা পেতে ঘুমায় সারাবছর। মাঝরাতে আচমকা ঘুম ভেঙে সে নিজেকে ভেজা আবিষ্কার করে। বুঝতে বাকি নেই পানি ভিটায় উঠে এসেছে। এরপর থেকে পুরো চরবাসীর চোখে আতঙ্ক। আবারো ঘরে পানি উঠবে, অনিশ্চয়তায় কাটবে জীবন।

করবী মাঝরাতেই বিশুদ্ধ খাবার পানি এনে রাখে। ঘরে তেমন জিনিসপত্র নেই। ঘরের একপাশে চৌকি পাতা, যেটা কিনা ঘরের অর্ধেক যায়গা দখল করে আছে। কাপড় রাখার জন্য মহসিনের বানিয়ে দেওয়া বাশের আলনা, মাঝে খাওয়া ও বসার জন্য কিছুটা উন্মুক্ত মেঝে। এরপর উঁচু করে বানানো একটা মাচা।
তার এক তৃতীয়াংশ জূরে একটা বড় রঙহীন কাঠের বাক্স স্থান পেয়েছে। সেই বাক্সের ভেতর নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্র ব্যতীত সবকিছু তুলে রাখে করবী। এমন বাক্স শুধু করবী নয়, চরের প্রতিটা ঘরেই রয়েছে। বন্যার সময় সকল জিনিস তার ভেতর সংরক্ষণ করা হয়। বন্যার সময় এই মাচাতেই আলগা মাটির উনুনে রান্না করা হয়। আর সেই সুযোগ না পেলে জোটে শুকনো চিড়া, মুড়ি, ছাতু ইত্যাদি।

ভোর হতে চলল। বাইরে আবারো ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। করবী জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। মেঘাচ্ছন্ন কালো এই ভোর যেন এক অশনি বার্তা নিয়ে আসছে। করবী শঙ্কিত। দীর্ঘ দশ বছরে এমন সময় কখনো আসেনি তার জীবনে। খাবারের সঙ্কট, পেটে আট মাসের অনাগত সন্তান, বাড়ন্ত বয়সের মেয়ে। এমন সময় প্রকৃতি আরেকটু নিষ্ঠুর হয়ে যোগ করছে থৈথৈ জল। স্বামীর খোঁজ নেই দেড় মাস। লোকটা কোথায় আছে, কেন খোঁজ নিতে আসছে না কিছুই জানা নেই তার। মহসিন কোথায়, কী কাজ করে কেউ জানে না। শুধু জানে সে টাউনে কাজ করে। ছুটিছাটা পেলে বাড়িতে আসে। চরের অনেকেই তাকে বলেছিল নিজের সঙ্গে নিয়ে কাজের ব্যবস্থা করে দিতে। মহসিন তা করেনি। যার ফলে অনেকে আড়ালে তাকে অপছন্দ করে, অহংকারী ভাবে।

করবী দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে উথলে ওঠা কান্না আটকে ফেলে। বিছানায় তাকিয়ে দেখে পালি কাঁথা মুড়িয়ে ঘুমাচ্ছে। মেয়েটা আগের চেয়ে শুকিয়েছে। করবীর শরীরও হালকা হয়েছে অনেকটা, পেটের বাচ্চাটাও হয়তো। করবী বড় স্টিলের গামলা মাথার ওপর দিয়ে বৃষ্টি আড়াল করে ঘর ছেড়ে বের হয়। বৃষ্টির ছাঁট, প্যাচপ্যাচে কাদা মাড়িয়ে অতি সাবধানে পা ফেলে উঠানের শেষপ্রান্তে চলে যায়। মুষড়ে পড়া ঝিঙে মাচায় কয়েকটা দুর্বল ঝিঙে হয়েছে। একদমই ছোট সেগুলো। আজ এগুলো দিয়ে কষ্ট করে চালানো যাবে। তেল-নুনও ফুরিয়ে আসছে। চালের খুদে একবেলা হবে হয়তো। করবী না খেলে পালির দিনটা চলে যাবে। এই চরে কেউ কারো না খেয়ে থাকার খোঁজ নিতে ভয় পায়। অভাবের খোঁজ নিতে ভয় পায়। পাছে কিছু চেয়ে বসে। যেখানে নিজেদেরই পেট চলে না, অন্যদের খোঁজ নেওয়া সেখানে বিলাসিতা, চরম উদারতা।

করবী একহাতে মাথায় গামলা ধরে রেখে অন্যহাতে ঝিঙেগুলো ছিড়ে নেয়। থেমে থেমে মেঘ গুড়গুড় করছে। কাছে কোথাও বিকট শব্দে বাজ পড়তে করবী চমকে গিয়ে পা পিছলে পড়ে গেল উঠানে। কণ্ঠনালী ফুঁড়ে বের হয় গগনবিদারী চিৎকার। হাতের গামলা ও ঝিঙেগুলো ছিটকে পড়েছে কাদায়। ঠিক যেমনটা করবী ও তার ভাগ্য।
____________

উঠানের একমাত্র কাঁঠাল গাছটার নিচে জুবুথুবু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে পালি৷ পা দুটি হাটু অবধি কাদায় মাখামাখি। থেমে থেমে ফোঁপাচ্ছে সে। বর্তমান পরিস্থিতিটা ওর ছোট মস্তিষ্ক হজম করতে পারছে না। আজকের সকালটা আর পাঁচটা সকালের মতো আসেনি তাদের জীবনে। ঘুমের মাঝে মায়ের চিৎকার শুনে ধড়ফড় করে উঠেছে সে। ছুটে বেরিয়ে দেখে তার মা কাদায় পড়ে কাতরাচ্ছে। মুখ ব্যাথায় নীল বর্ণ ধারণ করেছে। সেই দৃশ্য দেখে পালিও হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। ভেজা চোখদুটি আর শুকায়নি। পিছলে পড়ে করবীর পানি ভাঙতে শুরু করেছে। রোকসানা চিৎকার শুনে ছুটে এসে তাকে ধরে ধরে ঘরে নিয়ে গেছে। পালি ছুটে গিয়েছিল খুদিবুর বাড়িতে। খুদিবু হলেন চরের সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ মহিলা। বাচ্চা থেকে বুড়ো সবাই তাকে খুদিবু বলেই ডাকে। তিনি একজন অভিজ্ঞ দাইমা। পাশাপাশি টুকটাক কবিরাজি করেন। পালির জন্মও ওনার হাতে। তিনি করবীকে দেখেই বললেন,
“এই সর্বনাশ কেমনে ঘটলো? সময়ের আগেই পানি ভাঙলো!”
রোকসানা পাশ থেকে বলল,
“অবস্থা কী বুঝতাছেন বু?”
“বিপদ যহন আহে দরজা-জানলার খিল দিয়া আহে। জানি তারে বিদায় না করন যায়।
পালি কান্নাভেজা গলায় জিজ্ঞেস করে,
” আমার মায়ের কী হইছে?”

মেয়ের গলা শুনে করবী তার যন্ত্রণাকাতর চোখদুটি মেলে তাকায়। পালির দুইচোখ ভরা ভয়। খুদিবু ধমকে বলেন,
“বাইরে যা ছেড়ি। বড় মাইনষের কথা হুনোন লাগে না।”
তাকে বের করে আরো কিছুক্ষণ সময় নিয়ে করবীকে দেখলেন খুদিবু। এরপর মাথা নেড়ে বললেন,
“বাচ্চাতো পেটের মইদ্যে উল্টা হইয়া আছে। আমার পক্ষে এহন কিছু করা সম্ভব না।”
করবী শুয়ে আছে পাটিতে। খুদিবুর কথা সে স্পষ্ট শুনতে পেয়েছে। আটকে রাখা কান্নাটা বাধন ছেড়ে বেরিয়ে এল। খুদিবু মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“কান্দিস নারে করবী। আল্লাহ আল্লাহ কর।”

সারাটা দিন কাটলো উৎকন্ঠায়। করবীর কোমড় থেকে পা অবধি চিটচিটে হয়ে আছে। সম্পূর্ণ শরীর অসাড়। অবস্থার অবনতি ঘটছে ধীরে ধীরে। ঘরে উনুন জ্বলেনি। মা-মেয়ে কারোই খাওয়া হয়নি। রোকসানা একবার সেধেছিল অবশ্য। পালি খায়নি। তার সম্পূর্ণ রাগ গিয়ে পড়েছে পেটের বাচ্চাটির ওপর। আজ অবধি জ্বর কিংবা কোনো অসুখ তার মাকে বিছানায় ফেলতে পারেনি। অথচ আজ কি করুণ দশা। সে তীব্র অভিমান নিয়ে মায়ের কাছে ছুটে গিয়ে বলল,
“ও মা, আমার ভাই-বোন লাগবে না। তুমি আগের মতো হয়ে যাও।”

করবী নিভু নিভু চোখে তাকায়। বলে,
“ভেজা জামা বদলাস নাই কেন? অসুখ বাধাবি? এক্ষুণি জামা বদলা গিয়ে।”
পালি সরে না। মায়ের একটা হাত চেপে ধরে হেচকি তুলে কাঁদে। করবী ব্যাথায় হাসফাস করছে। দুইহাতে মাটি খা’মচে ধরার চেষ্টা করছে। তার কেন জানি মনে হচ্ছে ভাগ্যকে সে যতটা নিষ্ঠুর ভেবেছিল, তার চেয়েও নিষ্ঠুর রূপে ধরা দেবে। এরমাঝে মেয়ের কান্না তার কাছে আরো বেশি পীড়াদায়ক। মেয়েটা যে মায়ের এমন করুণ রূপ দেখে ভয় পেয়েছে। করবী ধমকে বলে,
“অসহ্য, অসহ্য লাগে এই কান্নার শব্দ। সামনে থেকে যা বললাম।”
পালি এই প্রথম মায়ের অবাদ্ধ হয়। সে ঘর থেকে বের হয় না। মায়ের পাশে উপুর হয়ে শুয়ে দুইহাতে গলা জড়িয়ে ধরে।

রাতের মধ্যে সম্পূর্ণ চরে পানি উঠে গেল। নদী ফুলে-ফেঁপে দানবের মতো ধেয়ে আসছে জনজীবনে। করবীর উঠান, রান্নাঘর এখন ঘোলা পানির দখলে। ঘরের ভিটে উঁচু বিধায় এখনো স্পর্শ করতে পারেনি। তবে রাতের মাঝে ঘরে পানি উঠবে না এর নিশ্চয়তা নেই। সন্ধ্যায় খিদের জ্বালা সইতে না পেরে পালি নামমাত্র কিছু পান্তা ভাত খেয়েছে চাচার ঘরে। করবী পানি ছাড়া অন্যকিছু মুখে তুলতে পারেনি। খুদিবু পালিদের ঘরেই ছিল। কখন কি হয় বলা যায় না। তিনি নিজেও চিন্তায় পড়েছেন। সেই রাতটি তাদের নির্ঘুম কা’টলো। সারা দিন-রাত যুদ্ধ করে আশ্চর্যজনকভাবে পরেরদিন ভোরে করবী একটি ছেলে সন্তানের জন্ম দিল। নিয়তির নি’র্মমতায় ধবধবে সুন্দর দেখতে হওয়া বাচ্চাটি জন্মালোই মৃ’ত। তাকে এক পলক দেখে করবী একদম শান্ত হয়ে গেল। আর একবারও ফিরে তাকালো না। পালিকে কাছে ডেকে বলল,
“তোর খিদা লাগছে রে মা? আরেকটু কষ্ট কর। তোর মামা মনে হয় রওনা দিয়ে দিছে। তিনি আসলে আর কষ্ট করতে হবে না।”

পালি কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“কোত্থাও যাব না আমি। আব্বা আসলে আব্বার সাথেও কথা বলব না। তারা আগে আসলে তোমারে বড় ডাক্তারের কাছে নিতে পারতো।”

করবী কথা বলার শক্তি হারাচ্ছে৷ চোখ বুজে আসছে। সে ক্ষীণ স্বরে বিড়বিড় করল,
“তোর আব্বা না আসুক। না আসুক সে।”

____________

শালুগঞ্জ

করবীর চিঠি শালুগঞ্জ পৌঁছেছে। সেই চিঠিখানা হাত ঘুরে গিয়ে পড়েছে খন্দকার গিন্নি জুলেখার হাতে। জুলেখা অক্ষরজ্ঞানহীন হলেও খাম দেখেই বুঝতে পারল চিঠির মালিক কে। সঙ্গে সঙ্গে সে মুখ কালো করে ফেলল। প্রতিবছর অন্তত একটা খাম আসে এ বাড়িতে। রবিউল খন্দকার এখন বাড়িতে নেই। হিমাদ, চিত্রা কিংবা মেহরুন বানুও জানে না চিঠির কথা। জুলেখা না বললে আপাতত কারো জানার অবকাশও নেই। সকলের অগোচরে সে চিঠিটা নিজের ঘরের তোষকের নিচে রেখে দিল।

চলবে…

বিষাদনীড়ে মায়াতরী [৫]
প্রভা আফরিন

_
খিলানচর

পালি তার ডাগর দুই চোখ বিস্ময়ে মেলে ধরেছে। সম্মুখের কাপড়ের পুটলিতে মোড়ানো বাচ্চাটির থেকে দৃষ্টি সরাতেই পারছে না সে। সাধারণত জন্মের পর বাচ্চাদের গায়ের রঙ বা গড়ন কোনোটাই শুরুতে একদম নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। এই বাচ্চাটির বেলায় তা ঘটেনি। কা’টাকা’টা গড়ন নিয়েই সে ভূমিষ্ঠ হয়েছে। পালির দৃষ্টি সরতেই চায় না। অবিকল তার মায়ের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাচ্ছে। একই গড়নের নাক, মুখ, ঠোঁট। এ যেন করবীর শৈশবের রূপ। চোখদুটিও হয়তো করবীর মতোই। কী জানি! পালি চোখদুটি দেখতে পায়নি। সেই নিষ্পাপ চোখদুটি চিরনিদ্রায় ডুবেই পৃথিবীতে এসেছে। এই নিষ্ঠুর পৃথিবীর বাস্তবতা তাকে জন্মানোর আগেই স্পর্শ করেছে।
পালির ছোট মনটা ভেঙে চুরে কান্না পেল। করবী তা দেখে মুখ ফিরিয়ে নেয়। সে শুয়ে আছে চৌকির ওপর। ফ্যাকাশে মুখ, দেহে কোনো বল নেই। কোমড়ের নিচটা এখনো ভেজা, চটচটে। র’ক্তক্ষ’রণে হচ্ছে বেশি। করবী তার শূন্য দৃষ্টি ঘোলা জলে নিবদ্ধ করে। কাল রাতে যে পানি উঠানে ছিল আজ তা সারা ঘরে থৈ থৈ করছে। এক দিনের ব্যবধানে উঠানে হাটুপানি হয়েছে। ক্রমেই উচ্চতা বাড়ছে। ক্ষুদার্থ নদী আগ্রাসী রূপে সমগ্র খিলানচরকে গ্রাস করতে আসছে যেন। সকাল হয়েছে অনেকক্ষণ আগে। তবে বাইরে তাকালে মনে হচ্ছে সদ্য ভোরের আধার কাটছে। আকাশের কোথাও একখন্ড ফাঁকা স্থান নেই। সবটাই কালো মেঘেদের দখলে। খুদিবু কাল থেকে পালিদের ঘরেই আছেন। তিনি উদ্বেগ নিয়ে বললেন,
“ছেড়াডা কি মাডিও পাইব না?”

কথাটা শুনে করবীর বুকটা ধক করে ওঠে। চরের কোথাও একখন্ড শুষ্ক জমি নেই। সব পানির নিচে। তাহলে তার ছেলেটার কবর কি করে হবে? খুদিবু আবার বললেন,
“হুনলাম টালিপাড়াও অহন পানির নিচে। ওইহানে নিয়া যে মাডি দিবি হেই সুযোগও নাই। ছেড়াডা পোড়া কপাল লইয়া আইছিল। না পাইলো দুনিয়ার স্বাদ, না পাইবো মাডি। আহারে! এমুন কপাল শত্রুরও না হোক।”

পালি থেম থেমে ফোঁপাচ্ছিল। খুদিবুর কথা শুনে অবাক গলায় প্রশ্ন করল,
“তাইলে কি করবো?”

“কি আর করবো? এই সময় যা করে, ভাসাইয়া দিবো পানিতে।”

“নাহ!” পালি আঁতকে ওঠে।

খুদিবু মাথা নেড়ে বলেন,
“এইডাই হয়রে বুবু। বন্যার সময় কেউ মরলে তারে মাডি দিবো কই? চাইরধারে খালি পানি আর পানি। পানি কয়দিনে নামবো হেইডা কেউ জানে? নাইম্যা যাওনের আশায় বইয়া থাকলে ম’রা পঁচবো না? ম’রার গন্ধে টিকন যাইবো? তাজা মানুষ নিজেরাই মাথা গোজার ঠাই পায় না, ম’রা কই থুইবো? হের লইগ্যা জানাজা দিয়া পানিতে ভাসাইয়া দেয়। হেগো কপালে মাডি জোটে না। গাঙই হেগো কবর।”

করবী এবার ছেলেটির দিকে মুখ ফেরায়। জন্মের পর দ্বিতীয়বার ছেলের মুখ দেখলো সে। এইতো খুব কাছেই ঘুমাচ্ছে বাচ্চাটি। তার গায়ের গন্ধ করবীর কাছে জাগতিক সুবাসের চেয়েও স্নিগ্ধ মনে হচ্ছে। কিন্তু সেই স্নিগ্ধতা তাকে শান্তি দিচ্ছে না। বুকের ভেতরটা জ’খম করছে প্রতিক্ষণে। জীবিত অবস্থায় আপন মানুষের গন্ধ আমাদের যতটা প্রিয়, ম’রে গেলে ততটাই অসহনীয়। বাচ্চাটির দিকে তাকাতে করবীর ভয় হয়। তীব্র ভয়। কেন জানি মনে হয়, অবিকল তার রূপ নিয়ে এসেছিল বলেই হয়তো করবীর মন্দভাগ্য গর্ভেই বাচ্চাটিকে স্পর্শ করে ফেলেছে।

করবীর চোখের ধার ঘেঁষে জল গড়ায় নিরবে। তা দেখে পালি হু হু করে কেঁদে ওঠে। মৃ’ত্যু কতটা নিষ্ঠুর সে জানে না। একজন সন্তানহারা মায়ের কতটা কষ্ট হয় তাও অনুধাবন করতে পারে না। শুধু জানে এই ঘুমন্ত ভাইটা তার খুব আপন। তার চেয়েও আপন মা। মায়ের কষ্ট দেখে দম বন্ধকর অনুভূতি হচ্ছে তার হৃদয়ে। করবী মেয়ের কান্না শুনে দাত কিড়মিড় করে ওঠে। চোখ বুজে ক্ষীণ স্বরে ধমকে বলে,

“আহ! তখন থেকে কানের কাছে প্যানপ্যান করছে৷ আমারে একটু শান্তি দে। দয়া করে শান্তি দে।” পালি মায়ের ধমকে নিজের মুখ চেপে ধরে। তবুও কান্না থামে না।

আকাশ ভেঙে আবারো বৃষ্টি নেমেছে। নদীর স্রোত বাড়ছে। ঘর-বাড়ি ভেসে যাওয়ার ভয়ে কয়েকটি পরিবার ইতিমধ্যে ঘরের টিন খুলে চর ছেড়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে। কিছু পরিবার এখনো পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছে। আর কিছু পরিবার পানি বিপদসীমার কয়েকফুট উপরে দিয়ে প্রবাহিত হলেও নিজের ভিটে ছাড়বে না। দরকার হলে ঘরের চালে আশ্রয় নেবে। পালিদের পরিবারও তাই। তাদেরও বাড়িটা ছাড়া আর কোনো কূল নেই। পালিদের ঘরটা ছনের তৈরি। ছাদ টিনের। উত্তাল স্রোতে এই ছনের বেড়া ভেঙে ভেসে যাওয়া কঠিন কিছু না। করবী যন্ত্রণার মাঝে শুধু মনে মনে প্রার্থনা করে ভাইজান আসা অবধি যেন মেয়েটাকে নিয়ে সুস্থ থাকতে পারে। তার এখন একটাই আশা, ভাইজান আসবে। যে কোনো সময় চলে আসবে। এরপর আর আক্ষেপ থাকবে না। তার ছেলেটা আজীবন শান্তিতে ঘুমানোর জন্য একটু মাটি পাবে। মেয়েটা খেতে পাবে। কিন্তু সময় চলে যায়, অপেক্ষার অবসান ঘটে না। ভাইজান আসে না।

বিকেল নাগাদ করবীর অবস্থার আরো অবনতি ঘটে। সে একদম মিইয়ে পড়েছে। আশঙ্কা এখনো কাটেনি। ডাক্তারের কাছে নেওয়া প্রয়োজন। কিন্তু সেই উপায় নেই। না আছে নৌকা আর না নৌকা ভাড়া করার টাকা। চরে কেউই এখন করবীর সমস্যা নিয়ে পড়ে নেই। সকলেই প্রাকৃতিক দুর্যোগে নিজেদের বিপন্ন জীবন নিয়ে উদ্বিগ্ন। খুদিবু অভিজ্ঞ মানুষ। পেট দেখেই কয় মাস চলছে বলে দিতে পারেন। জীবনে বহু গর্ভবতী মায়ের সন্তান প্রসব করিয়েছেন। মৃতপ্রায় বাচ্চা এবং মাকে সুস্থও করেছেন। কিন্তু করবীর বেলায় এসে তিনি হোচট খেয়েছেন। অভিজ্ঞ মানুষেরও কখনো কখনো অভিজ্ঞতায় ঘাটতি দেখা দেয়। তখন তারা ভড়কে যান, অসহায় হয়ে পড়েন। খুদিবুও তাই। করবীর জন্য দোয়া ছাড়া বেশি কিছু করতে পারবেন না।

খুদিবু একলা জীবনযাপন করা মানুষ। জগতে তার দুটি নাতনি আছে। দুজনেরই ভালো ভালো যায়গায় বিয়ে হয়েছে। নাতজামাইরা খাওয়া-খরচা পাঠায় মাঝে মধ্যে। তা দিয়ে কোনোরকম ওনার দিন চলে যায়। খুদিবু পালিদের এমন অবস্থার মাঝে ছেড়ে যেতে পারেননি। ক্ষুদার্থ মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে ঘর থেকে ছাতু এনে মাখিয়ে দুপুরে পালিকে নিয়ে খেয়েছেন। করবী অবশ্য এক দলা মুখে দিয়ে আর খেতে পারেনি। সে একটু পর পর পানিই খাচ্ছে শুধু। রাত গড়িয়ে যেতে খুদিবু বেশ কয়েকবার বলেছেন ম’রা নরম হয়ে যাচ্ছে। বেশি সময় ঘরে রাখা ঠিক হবে না। করবীর চোখ দরজা থেকে সরে না। মনে হয় হুট করে ভাইজান এসে বলবেন,
‘একটা সমস্যায় পইড়া দেরি হইয়া গেল। আর কোনো চিন্তা নাই। আমি আইসা গেছি।’

অপেক্ষায় মাঝরাত পেরিয়ে সময় ভোরের দিকে গড়ায়। মৃ’ত বাচ্চাটি একেবারে নরম হয়ে গেছে। তাকে আর কোনোমতেই রাখা যাবে না। ঘরে একটা হারিকেন জ্বলছে। আলোটাও মৃ’তপ্রায়। বাইরে এখনও ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি হচ্ছে। ছনের ঘরের ফাঁক-ফোকর দিয়ে হাওয়া আসছে। পালি ঘুমের মাঝে কুকড়ে আরো কিছুটা কাছে এগিয়ে আসে। মায়ের কাছে উষ্ণতা খোঁজে। করবী তাকে সরিয়ে শরীরের সবটুকু জোর খাটিয়ে উঠে বসে। কাপড়ের পুটলিতে মোড়ানো রাজপুত্রটাকে কোলে নিয়ে আবছা আলোয় তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। নিঃশব্দে চোখের জল ফেলে। এরপর ধীরপায়ে পানিতে নেমে পড়ে।

ঘরে পানি হাটুর কাছাকাছি প্রায়। উঠানে নামতেই তা কোমড় ছুঁইছুঁই হলো। ঘোলা পানির মৃদু স্রোতে করবীর চলনে অদ্ভুত ছমছমে শব্দ তৈরি হয়। উঠানের কাঁঠাল গাছটার কাছে এসে তাতে হেলান দিয়ে অনেকটা সময় চুপ করে পুটলিটা বুকে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সে। শরীর অস্বাভাবিক কাঁপছে। রাত্রির শেষভাগে দুর্বল হাতে একটা সময় সবচেয়ে নিষ্ঠুর কাজটি করতে হয় তাকে। পৃথিবীর প্রতি এক বুক অভিমান নিয়ে নদীর জলে তার দীর্ঘ আট মাসের লালিত উষ্ণতা, ভালোবাসাকে বিসর্জন দিতে হয়। স্রোতের সঙ্গে তা ভেসে যায় দূরে…বহুদূরে। একসময় অন্ধকারে তা আর নজরে আসে না। করবীর ঝাপসা চোখ বাধ মানে না। স্তব্ধ তমসায় চিৎকার করে কাঁদে। এই পৃথিবীতে এত জমি থাকতেও তার সন্তান জমি পেল না। এই আক্ষেপ কি জীবনেও ঘুচবে? অভাগা মায়ের কান্না নির্জন নদীর বুকে কেউ দেখে না, জানে না। বৃষ্টির ফোঁটার মতোই তা গড়িয়ে পড়ে ঘোলা পানিতে।

সকালে পালি ঘুম ভেঙে প্রথমেই বলল,
“ভাই কই?”

করবী শোয়া অবস্থায় আওড়ায়, “চলে গেছে।”

“তুমি ওরে…”

“এই নদীতেই আছে সে। নদীই তোর ভাইয়ের কবর।”

বেলা বাড়তেই পালির চাচা হামিদ একটা চিড়ার কৌটা এনে পালির হাতে দিয়ে বাইরে থেকে বলল,
“নদীর অবস্থা তো ভালা না। দক্ষিণের গেরামগুলাতে নাকি বাড়ি-ঘর ভাসাইয়া নিয়ে গেছে। এইহানেও এইরম হইবো না তা কওন যায় না। বাবুর শইলডাও ভালা না। তাই ভাবতাছি রোকসানারে বাপের বাড়ি পাডামু। আপনে চিন্তা কইরেন না ভাবী। আমি ওইদিকের অবস্থা বুইঝা পরে আইসা আপনেগোরেও নিয়া যামুনে।”

এরপর পালিকে বলল, “খিদা লাগলে চিড়া খাইস। চিন্তা করিস না। তোর আব্বায় আইয়া পড়বো।”

হামিদ চলে গেল পরিবার নিয়ে। করবী জানে হামিদ তাদেরকে নিতে আসবে না। অভাবের মাঝে কেউই নিজের বোঝা বাড়াতে চাইবে না। পরিজনরা ছেড়ে গেলেও খুদিবু অবশ্য তাদের ছেড়ে গেল না। চর ছেড়ে অনেকেই চলে গেছে। কাছের বাড়িগুলো ফাঁকা। কেউ কেউ আশ্রয় কেন্দ্রে উঠবে। নির্জন নদীর বুকে জলের স্রোত ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। পালিদের রান্নাঘরটা ভেঙে ভেসে গেছে। মা-মেয়ে ঘরের ভেতর উৎকন্ঠায় দিন কাটায়।

পানি বন্দী জীবনে সকাল, সন্ধ্যা, প্রথম প্রহর, দ্বিতীয় প্রহর বলে কিছু নেই। সবটাই জলপ্রহর৷ সেই জলপ্রহরে এখন আলো আধারির মিলনক্ষণ। করবী নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে। শরীর ক্রমশ র’ক্তশূণ্য হয়ে ফ্যাকাসে রূপ ধারণ করছে। পালি পানি পান করতে গিয়ে দেখে কলসে পানি নেই। খুদিবুও এই সময় নিজের বাড়িতে গেছে। সে চৌকি থেকে ঝপাৎ করে পানিতে নেমে মাকে বলল,

“মা, আমি পানি আনতে গেলাম। এক্ষুণি চলে আসবো।”

করবী যতক্ষণে মেয়ের কথা শুনে চোখ মেলে তাকিয়েছে পালি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেছে। ঘরে পানি ওঠার পর খুদিবুই পানি আনতেন। বিশুদ্ধ পানির কলটা নিচু জমিতে হওয়ায় সেটা ডুবে গেছে। এখন চরে বিশুদ্ধ পানি আনার একটাই কল আছে। সোলেমানের বাড়ির কল। সে কথাটা মাথায় আসতেই করবীর র’ক্ত ছলকে ওঠে। পালি পানি আনতে সে বাড়িতেই যাবে। সোলেমান যদি বাড়িতে থাকে! করবীর বুক ধড়ফড়িয়ে ওঠে।

চলবে…
[কপি নিষেধ]