বিষাদনীড়ে মায়াতরী পর্ব-৬+৭

0
147

বিষাদনীড়ে মায়াতরী [৬]
প্রভা আফরিন

মেঘলা দিনের ম্লান আলো রাতের বুকে লুকাতে শুরু করেছে। প্রায়ান্ধকারের নির্জনতা ফুঁড়ে একটা কলকল শব্দ তুলে দুটি রুগ্ন পা এগিয়ে যাচ্ছে। উঠানের ঘোলা জল পালির প্রায় বুক সমান। সে কলস মাথায় তুলে পথ ঠাহর করে হাটছে। ওদের বাড়ি থেকে তিন বাড়ি পর সোলেমানের বাড়ি। পথিমধ্যে থাকা তিনটে বাড়ি এখন আর নেই। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি বানভাসি পরিবার জানমালের ভয়ে চর ছেড়েছে। অবশ্য নদীভাঙন, বন্যায় নিঃস্ব হওয়া যাযাবর চরবাসী এক নীড় ছেড়ে অন্য নীড়ে ছোটাছুটি করে অভ্যস্ত বলেই তাদের তল্পিতল্পা গোটাতে সময় লাগে না।

কয়েকদিনের একটানা বৃষ্টিপাত দুপুরে থেমেছে। এরপর থেকে প্রকৃতি ও নদী উভয়ই শান্ত। ঠান্ডা বাতাসের কোমল তেজে ঘোলা পানিতে নরম স্রোত বইছে। তিন বাড়ি পেরোতে পালি হাঁপিয়ে ওঠে। বুক সমান পানিতে হাটতে পরিশ্রম একটু বেশিই হয়। পালি সোলেমানের ভিটায় উঠে কয়েকবার জোরে দম ছাড়লো। এখানে পানির উচ্চতা কোমড়ের নিচে নেমে এসেছে। সোলেমানের ভিটা বাকি সব জমি থেকে তুলনামূলক অনেকটা উঁচু। চতুর সোলেমান বন্যার কথা চিন্তা করে মাটি কেটে বছর কয়েক আগে বাড়ির জামিটুকু উঁচু করেছে।

পালির ভেজা জামা গায়ের সঙ্গে লেগে আছে। সেই ভেজা অংশে বাতাস লাগতেই শরীর কেঁপে ওঠে। চারিদিকে আধার মেলানো ছমছমে পরিবেশ। বাড়িতে কোনো সাড়াশব্দ নেই। সন্ধ্যার আলোও দেখা যাচ্ছে না। পালি চারিদিকে চোখ বুলিয়ে দুরুদুরু বুকে এগিয়ে যায় কলের কাছে। একমাত্র এই কলটাই এখনো বন্যার পানি থেকে অক্ষত আছে। কিন্তু পানি নিতে গিয়ে বাধলো বিপত্তি। কলস নিচে রেখে কল চাপার উপায় নেই। আবার একহাতে কলস ধরে অন্যহাতে শক্ত কল চাপার মতো শক্তি বা সামর্থ্য কোনোটাই পালির হয়নি। এদিকে আলো ফুরিয়ে আসছে। আধারে তার ভীষণ ভয়। এমন অবস্থায় পড়ে পালির ভীষণ কান্না পেল। গত বছর বন্যার সময় আব্বা ছিল। ময়লা পানিতে হাত-পায়ে ঘা হয় বলে মহসিন পালিকে চৌকি থেকে নামতে দিত না। কোথাও যেতে হলে আব্বার কোলে চড়েই যেত। এবার সে মেয়েটা বুক সমান পানি ভেঙে খাবার পানি নিতে এসেছে। এবার কোলে নেওয়ার কেউ নেই কেন?

পালি বারকয়েক কলসে পানি ভরার চেষ্টা করে। পেরে ওঠে না। ভারসাম্য রাখতে না পেরে হাত ফসকে কলসটা দুইবার ময়লা পানিতে পড়ে। সে হাল ছাড়ে না। নিস্তব্ধতা ভেঙে হুট করে একটি ফ্যাসফ্যাসে স্বর বলে ওঠে,
“তর নরম শইল্যে এহনো এত জোর আহে নাই রে ছেড়ি।”

পালি পেছন ফিরে দেখলো সোলেমান দাত বের করে দাঁড়িয়ে আছে। ঠোঁটের ফাঁকে একটা জলন্ত বিড়ি গোজা। সে বিড়িতে লম্বা একটা সুখটান দিয়ে এগিয়ে আসতে আসতে আবার বলল,
“তর মায় হুনলাম বিছনায় পড়ছে? পড়বোই তো।মাইয়া মাইনষের এত অহংকার ভালা না। দুনিয়াতে চলতে ফিরতে পড়শীগোও লাগে। আমগোরে হেডম দেহাইছে। এহন ম’রতে বইছে না? কেউ নাই দেহনের।”

পালি মায়ের বিরুদ্ধে বলা কথা সহ্য করতে পারে না। প্রতিবাদ করে বলল,
“খারাপ কথা বলেন ক্যান, চাচা? আমার মায়ের কিচ্ছু হবে না। জলদিই ঠিক হয়ে যাবে।”

“রাখ ছেড়ি। মায়ের মতোন হইছ না। কথা কবি নরম গলায়। মিহি সুরে। তইলে না মাইয়া মনে হইবো।”

সোলেমানকে কাছে আসতে দেখে পালি অজানা কারণে কুঁকড়ে গেল। অন্ধকারের চেয়েও সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিটিকে তার বেশি ভয় করছে। সোলেমান এগিয়ে এসে মুখ ভর্তি বিড়ির ধোঁয়া পালির মুখে ছুড়ে দেয়। পালি সরে যাওয়ার আগেই হাত ধরে বলে,
“মুখ দেহি হুকায় গেছে। পানি খাইয়া পেট ভরবো? শফিকের মায় সকালে রাইন্ধা থুইয়া গেছে। আয় আমার লগে। পেট ভইরা খাবি।”

পালি ছটফটিয়ে ওঠে। হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে,
“আমাদের বাড়িতে খাবার আছে। আমারে যাইতে দেন চাচা।”

“যাবি ক্যান? পানি নিবি না?”

সোলেমান পালির ছোট্ট নরম হাতটা আরেকটু শক্ত করে ধরে। আশপাশ সুনসান। বাড়ি একদম ফাঁকা। আজ দুপুরেই ছেলে-বউকে শালার বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছে সে। সোলেমানের র’ক্ত টগবগিয়ে ওঠে। চোখে ধিকধিক করে লালসা। এমন সুযোগ হাত ছাড়া করার মতো বোকা সে নয়। করবী চরে আসার পর থেকে সোলেমানের নজর ছিল তার প্রতি। কিন্তু হাজার ইঙ্গিত দিয়ে ফুসলিয়েও করবীকে কাবু করতে পারেনি। এখন সে ম’রার পথে। তার মেয়েকে হাতে পেয়ে ছেড়ে দেওয়ার মানুষ সে নয়। পালি হাঁসফাঁ’স করে, শব্দ করে কেঁদে ওঠে। এলোমেলো গলায় বলে,
“আমার মায়ের অসুখ চাচা। আমারে যাইতে দেন।”

সোলেমান নিঃশেষ প্রায় বিড়িটা পানিতে ছুড়ে ফেলে একহাতে পালির মুখ চেপে ধরে। অন্যহাতে পলকা দেহটি শূন্যে তুলে গায়ের সঙ্গে চেপে ধরে। হাতে ধরা কলসটা ভেসে গেল পানির স্রোতের সঙ্গে। সোলেমান আশেপাশে তাকিয়ে ফিসফিসানি স্বরে বলে,
“আরে করছ কী? আমি কি তর খারাপ চাই? মায়েরে সুস্থ দেখতে চাস না তুই? আমার কথা হুনলে তর মায়েরে আমার নাওয়ে কইরা ডাক্তরের কাছে নিমু। তরে হাটেরতন রস গজা আইনা দিমু।”

পালি থরথর করে কাঁপছে। চোখ দিয়ে অঝোরে উজানের ঢল নেমেছে। এই ঢল স্বচ্ছ, অসহায়তার। বানের জলের মতো অস্বচ্ছ কিংবা আগ্রাসী নয়। সোলেমানের কোনো কথা পালির কানে ঢোকে না। শুধু মনে হয় তার সঙ্গে খারাপ কিছু হতে চলেছে। এই জন্যই মা সোলেমানের কাছ থেকে তাকে দূরে থাকতে বলতো! সোলেমানের শক্ত হাতের নোংরা স্পর্শ পালির শরীরের কোমল বাঁক ছুঁয়ে ফেলেছে। পি’ষে ফেলতে চাইছে যেন। কি অসহ্য অনুভুতি! এক একটা স্পর্শ পালির মস্তিষ্কে তীরের মতো বিঁ’ধতে থাকে। সোলেমান উত্তেজিত হয়ে তাকে একহাতে তুলে ধরেই নিজের ঘরের দিকে নিতে থাকে। পালি চিৎকার করতে গিয়েও পারে না৷ বাতাসের সঙ্গে তার অসহায়ত্ব মিশে পরিবেশ থমথমে করে তুলেছে। দাওয়ায় পৌঁছাতে পেছন থেকে ছলাৎ ছলাৎ শব্দ কানে এলো। আবছা আধারে দুর্বল করবীর নড়বড়ে দেহটি এগিয়ে আসছে। পালির মনে হলো সে আধার থেকে বেরিয়ে আসছে। ওইতো..ওইতো আলোর রোশনাই, তার মা। আর কোনো ভয় নেই।

সোলেমানের কোলে পালিকে দেখে করবীর বুকের র’ক্ত ছলকে ওঠে। হৃদয়ে অপ্রতিরোধ্য ভয় জেকে বসে। মেয়েটা ঠিক আছে তো! সোলেমান প্রথম দফায় যারপরনাই চমকায়। কিন্তু করবীর ভঙ্গুর, নুইয়ে পড়া দেহটি তার সেই অভিব্যক্তি সরিয়ে দেয় ক্ষণেই। পালিকে দাওয়ার মাচার ওপর নামিয়ে দিতেই পালি মুক্তি পাওয়া পাখির মতো ডেকে ওঠে,
“মা, ও মা।”
মেয়ের ভয়ার্ত কন্ঠস্বর করবীর দেহে উৎকন্ঠার উষ্ণতা ছড়ায়। খারাপ কিছু ঘটতে পারে বুঝেই সে ভেঙে পড়া দেহটি নিয়ে আল্লাহ আল্লাহ করতে করতে পথটুকু ছুটে এসেছে। সোলেমান কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে তার কালচে দাত বের করে বলে,

“কষ্ট কইরা আইতে গেলা ক্যান? আমিই তো একটু পরে যাইতাম। অসুইক্কা মানুষের সেবা করাও পরম আনন্দের।”

করবী সোলেমানের কাছাকাছি এসে একদলা থুতু ছুড়ে দেয়। তার শরীর যতটা না কাঁপছে দুর্বলতায় তার চেয়েও বেশি ক্রোধে। সে দাতে দাত পি’ষে মুখ বি’কৃত করে বলল,
“বলেছিলাম না, আমার অবস্থা দেখে কেউ আমারে দুর্বল ভেবে ক্ষতি করতে আসলে মস্ত ভুল করবে।”

“খাড়াইতে পারতাছো না। এহনো এত দেমা’গ! মাইয়ারে বাইন্ধা থুইয়া আগে নাহয় মায়ের সেবা করি।”

কথাটা শেষ করা মাত্রই করবীর পেছনে থাকা হাতটা দুর্বার গতিতে সোলেমানের কাধে ওঠে। মুহূর্তেই ফিনকি দিয়ে বের হয় তাজা র’ক্ত। সোলেমান অবাক চোখে ফিরে তাকায়। থেমে থেমে উচ্চারণ করে,
“করবী…”
“র’ক্তকরবী।” তড়িৎ ও তেজি উত্তর করবীর। “করবীরা শুধু ফুল হয়ে সৌন্দর্য ছড়ানোর জন্য নয়, নোংরা লোকের জন্য তাদের র’ক্তকরবী হতে হয়।”

পালি যখন আবছা আলোয় বুঝলো তার মা সোলেমান চাচার কাধে দা’ চালিয়েছে সঙ্গে সঙ্গে থরথর করে তার সর্বাঙ্গ কেঁপে ওঠে। বিভৎস দৃশ্য দেখে আত’ঙ্কে কেঁদে ফেলে। সোলেমান আর্ত’নাদ করে পানিতে পড়েছে। চোখ উল্টে এসেছে। আবছায়ায় বোঝা গেল পানির রঙে পরিবর্তন এসেছে। করবী দা ফেলে মেয়ের দিকে এগোয়। সে জানে সোলেমানকে কেউ বাঁচাতে আসবে না। নৌকা থাকতেও নিয়ে ডাক্তারের কাছে ছুটবে না। ধীরে ধীরে একসময় সে মৃ’ত্যুর কোলে ঢলে পড়বে। এরপর ভেসে যাবে জোয়ারে। যেমনটা ভেসে গেছে করবীর নাড়ি ছেড়া ধন। শুধু নিষ্পাপই নয়, প্রকৃতির বৈচিত্র্যতায় কখনো কখনো নরপশুও মাটি পায় না।
____________

রাত গড়িয়েছে অনেকটা। মা-মেয়ে নিস্তেজ হয়ে চৌকিতে শুয়ে আছে। ঘরে একফোঁটা আলো নেই। করবীর শরীর সম্পূর্ণ ছেড়ে দিয়েছে। জ্বরে গা পু’ড়ে যাচ্ছে। পালি মায়ের উষ্ণ বুকে মুখ লুকিয়ে থেমে থেমে ফোঁপাচ্ছে। আজকের সন্ধ্যা তার মস্তিষ্কে যে ভয়াবহ অভিজ্ঞতা দিয়েছে তা সহজে ভুলতে পারবে না সে। করবীও নিঃশব্দে কাঁদে। শরীরের যন্ত্রণার চেয়েও মেয়ের জন্য তার বেশি যন্ত্রণা হচ্ছে। এই বয়সেই মেয়েটাকে জগতের এক নোংরা দিক অনুধাবন করতে হলো। মেয়েটা এত সহজে কি এসব ভুলতে পারবে? মা হিসেবে তার নিজেকে অপরাধী মনে হয়। এমন বিভৎ’সতা থেকে আগলে রাখতে পারেনি নিজের মেয়েকে। কিন্তু আদৌ কি তার অপরাধ ছিল! করবী এতকিছু ভাবতে চায় না। পালিকে সময় দেয় ধাতস্থ হতে। এরপর ধীরে ধীরে বলে,

“মেয়ে হওয়ার অনেক জ্বালারে, মা। এই জগতে মেয়েদের অনেক বুঝেশুনে চলতে হয়। প্রতি পদে বিপদের আশঙ্কা থাকে। কোনো পরিস্থিতিতে ভেঙে পড়া যাবে না। জীবনের শেষ সময় অবধি লড়তে হবে। মনে রাখবি, তুই আমার একখন্ড আষাঢ়ি মেঘ। আর যে মেঘ যত কালো তার বর্ষণ তত ভারী।”

খুদিবু এলেন আরো কিছুটা সময় পর। পালি ততক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে। করবীর ঘরে কেরোসিন না থাকায় খুদিবু নিজের ঘর থেকে কেরোসিন এনে কুপি ধরিয়েছেন। করবীর গায়ে হাত দিয়ে বুঝলেন তাপমাত্রা অধিক। খুদিবুর কোচকানো চামড়ার মাঝে চোখদুটি করবীর অবস্থা দেখে করুণ হয়। র’ক্তক্ষরণ এখনো থামেনি। অনাহারে শরীর নেতিয়ে গেছে। তারওপর জ্বর। সব বিপদ বুঝি তার ওপর দিয়েই এলো! করবী চোখ মেলে দুর্বল গলায় বলল,

“খুদিবু, তোমার ঘরে চাল আছে? আমার সোনার নথটা তোমারে দিয়ে দেব। কয়টা ভাত ফুটিয়ে নুন-মরিচ মেখে পালিরে নিয়ে খাও। মেয়েটা ভাত খায় না কতদিন। শরীরটা দুর্বল হয়ে গেছে।”

খুদিবুর মায়া হয়। তিনি করবীর মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,
“ক্যান যে এই চরে আইয়া ম’রলি? আপন মানুষের ওপর জেদ কইরা জীবনডা শেষ কইরা দিলি।”

করবীর দুই চোখের পাতা বুজে এসেছে। সে বিড়বিড় করে বলে,
“ভাইজান আসবে। পালিরে নিতে ঠিক আসবে। তিনি আমার সব কথা মানেন। সেবার কেন যে মানলেন না!”

করবীর গলার স্বর জ্বরের ঘোরে মিলিয়ে গেল। খুদিবু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে যান। তিনি ঘরের চালে বালতি রেখে বৃষ্টির পানি জমিয়েছিলেন। সেই পানি দিয়ে চাল ধুয়ে ভাত বসালেন মাচার ওপর রাখা মাটির উনুনে। ভাত হয়ে এলে খুদিবু পালিকে ডেকে তুলে খাওয়ালেন। করবী খেতে পারলো না। উঠে বসতেও পারলো না। রাতের গভীরতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার দেহটি নিস্তেজ হতে থাকলো। পরদিন চরের অবস্থার উন্নতি ঘটলো। একদিনের ব্যবধানে পানি হাটুর নিচে নেমে গেল। কিন্তু করবীর অবস্থার উন্নতি হলো না। পালি গুমোট মুখে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। করবী তার ঝাপসা, ক্ষীণ দৃষ্টি মেলে মেয়ের মুখটা দেখতে পায়। শ্যামবর্ণের মেয়েটার চোখে যেন আস্ত এক আকাশ। মায়াবী ও গভীর চাহনি। ওই চোখে তাকালে করবীর হৃদয় শীতল হয়। শাসন করার সময় সে কখনোই মেয়ের চোখের দিকে তাকাতে পারে না। তাকালেই সব রাগ মাটি হয়ে যায়। সেই চোখের দিকে তাকিয়ে করবীর ভ্রম তৈরি হয়। সে অস্পষ্ট স্বরে বিড়বিড় করে,
“মা, ওমা, কতদিন তোমারে দেখি না।”

মায়ের অদ্ভুত আচরণে পালি হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। করবী সেই কান্না থামায় না। বিরক্ত হয়ে ধমক দেয় না। পরের দিন নিয়তির প্রতি একবুক অভিমান নিয়ে করবী চোখ বোজে। পালিকে ফেলে যায় অনিশ্চিত ভবিষ্যতে।

চলবে…

বিষাদনীড়ে মায়াতরী [৭]
প্রভা আফরিন

_
শালুগঞ্জ

দুপুরে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি হয়ে এখন রৌদ্রজ্জ্বল বিকেল। বৃষ্টির পর রোদ উঠলে প্রকৃতি ঝলমল করে ওঠে।সেই সঙ্গে ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ। নির্মল প্রকৃতির স্বাদ উপভোগ করতে আর কি চাই! রবিউল খন্দকার বুক ভরে শ্বাস নেন। তিনি বসে আছেন পুকুরপাড়ের কদম গাছের নিচে। এনাম শরীর ডলে গোসল করছে পুকুরে। সাবানের ফেনা টলটলে পানিকে ঘোলা করে দিচ্ছে। রবিউল খন্দকার বিরক্ত হয়ে বললেন,
“এইডা ডুব দেওয়ার সময় হইলো?”
“পিছলা খাইয়া চিত হইয়া পড়ছি, ভাইজান। পুরা শইল্যে কেদা লাগছে। ডুব দেওন লাগতো। অনেকদিন শইল মাজি না দেইক্ষা ভাবলাম ইট্টু সাবান মাখি।” এনাম গামছার এককোণে সাবান মেখে মুখ-গলা ডলতে ডলতে উত্তর দেয়।
চিত্রা কলকল শব্দ করে বয়ে চলা স্রোতের মতো হেসে ফেলল। বলল,
“চাচা, ওইটা কাপড় ধোয়ার পচা সাবান।”
“হের লইগ্যাই বাসনা(সুগন্ধ) পাই না! হউক, পচা আর ভালা কী? ময়লা উঠলেই হইলো।”
“তাহলে বস্তা আর কাপড় কী? শরীর ঢাকলেই হলো। আজ থেকে কাপড় না পরে বস্তা পরবেন, কেমন?”

বলেই চিত্রা জিভ কাটে। পাশে আব্বা বসে আছে তা ভুলে বসেছে। এনাম অবশ্য কিছু করেনি। খন্দকার বাড়ির ছেলে-মেয়েরা তার কোলে-কাধে চড়েই বড় হয়েছে। চিত্রা প্রজাপতির মতো উচ্ছল একটি মেয়ে। তার সঙ্গে এমন অনেক রসিকতা করে যা বড়দের সামনে বলা যায় না। কিন্তু কাজের লোক বলে কখনো হেলাও করে না। চিত্রা আড়চোখে আব্বার দিকে তাকাতেই দেখলো তিনি অন্যমনস্ক হয়ে আছেন। ওর কথা তিনি শোনেনি ভেবে চিত্রার ভয় মুছে যায়। সে ডাকলো,
“আব্বা? আপনার কি গরম লাগে?”

রবিউল খন্দকার ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলেন। ওনার আসলেই গরম লাগছে। পুকুরপাড়ের ফুরফুরে হাওয়া দেহ কিংবা মন কোনোটাকেই শীতল করতে পারছে না। সকালে হাটে যাওয়ার পর থেকেই এমনটা হচ্ছে। ভেতরটা অস্থির লাগছে। সকালে নবু মাঝি তাকে জানায় সে গতরাতে টালিপাড়ার দিকে গিয়েছিল খ্যাপ নিয়ে। সেদিকে নাকি নদীর অবস্থা ভালো না। অনেকগুলো গ্রাম বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত। এই কথা শোনার পর থেকে তিনি স্থির হতে পারছেন না। তিনি চিত্রার মাথায় হাত দিয়ে বললেন,
“আত্মাডা ক্যান জানি অস্থির করতাছে।”
“শরবত বানিয়ে দেব? লেবু শরবত? আরাম লাগবে।”
আব্বার সম্মতি পেয়ে চিত্রা ঘরে ছুটে গেল। রবিউল খন্দকার এনামের দিকে ফিরে ধমকে বললেন,
“মাই’জ্ঞা মাইনষের মতোন এত সময় লাগে ক্যান ডুব দিতে?”
এনাম পর পর দুটি ডুব দিয়ে সাঁতরে ঘাটে উঠলো। লুঙ্গি বদলে উঠে এসে বলল,
“শেষ ভাইজান।”
“ফতুয়া পিন্দা আয়।”
“দূরে কোনোহানে যাওন লাগব?”
রবিউল খন্দকার গম্ভীর স্বরে বললেন,
“ট্রলার নিয়া খিলানচর যাবি।”
বাকিটুকু এনামকে আর বলে দিতে হলো না। সে মাথা কাত করে প্রস্থান করে।

রবিউল খন্দকার একা বসে রইলেন আরো কিছুক্ষণ। সূর্যের আলো ম’রে আসছে। এনামকে কিছু টাকা দিতে হবে মাথায় আসতেই তিনি উঠে ঘরে চলে গেলেন। কিন্তু আলমারি খোলার দরকারি চাবির গোছাটা নির্দিষ্ট স্থানে পেলেন না। তিনি গলা উঁচিয়ে বারকয়েক জুলেখা বলে ডাকেন। জুলেখার সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। বিরক্ত হয়ে নিজেই খুঁজতে শুরু করেন। টেবিলের ড্রয়ার, বালিসের তলা খুঁজতে খুঁজতে এক পর্যায়ে তোষকের নিচেও দেখলেন। এমন সময় অনেক কাগজের মাঝে থাকা হলুদ খামটা ওনার নজরে এলো। রবিউল খন্দকার ভ্রু কুচকান। এই খাম থাকে ওনার আলমারির ভেতর। তাহলে তোষকের নিচে কী করে এলো? তিনি খামটা নিলেন। একদমই নতুন। তারিখ চোখে পড়তেই বুকটা ধক করে ওঠে। নতুন চিঠি অথচ ওনার হাতে পড়েনি! তিনি দ্রুত হাতে চিঠি খোলেন। একবার পড়েন, বারবার পড়েন। বুকের ভেতর মিশ্র অনুভূতি হয়।

“জুলেখা? জুলেখা?”
রবিউল খন্দকার দরাজ গলায় ডেকে ঘর ছেড়ে বের হন। জুলেখা এবার একপ্রকার ছুটে এলো। স্বামীর এই স্বর তার চেনা। রবিউল খন্দকারের চোয়াল ওঠানামা করছে। তিনি খামটি দেখিয়ে বললেন,
“এই চিঠিখান তোষকের নিচে কেমনে গেল?”
হাতের খামটা দেখতেই জুলেখার আত্মা খাঁচা ছাড়া হওয়ার জোগাড়। দৃষ্টি অস্থির হয়। হাতে হাত ঘষে উত্তর খোঁজে। রবিউল খন্দকার প্রতিটি আচরণ সুক্ষ্মভাবে পরখ করেন।
“আমি কিছু জিগাইছি? গলার আওয়াজ কই?”
মেহেরুন বানুও ততক্ষণে ছুটে এসেছে। ছেলের হাতের দিকে তাকিয়ে মেহেরুন বানুর হৃদয় ব্যাকুল হয়। করবীর চিঠি! তার মেয়ের চিঠি এসেছে! জুলেখা অস্থির দৃষ্টিতে মিনমিন করে বলল,
“কামের ধান্দায় মনে হয় রাখছিলাম। পরে ভুইলা গেছি।”
“আমার দরকারি জিনিস আইলে তা আলমারিতে না গিয়া তোষকের নিচে যাইবো ক্যান?”
“আমি তো লেহাপড়া জানি না৷ দরকারি চিঠি বুঝি নাই।”

রবিউল খন্দকার দাত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরেন। জুলেখার দিকে এগিয়ে এসে চ’ড় দিতে উদ্যত হতেই চিত্রা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ভয়ার্ত গলায় ডাকে,
“আব্বা!”
মেয়ের অসহায়, আদ্র কন্ঠ থামিয়ে দেয় ওনাকে। র’ক্ত চোখে কিছুক্ষণ জুলেখার দিকে তাকিয়ে থেকে প্রস্থান করেন।

_____________

খিলানচর

সন্ধ্যা নেমেছে সবে। আবছা আধারে করবীর রক্তশূণ্য শুভ্র মুখ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তবে সেই মুখে কোনো সৌন্দর্য নেই। তীব্র বিষাদের বিবর্ণতা লেপ্টে আছে। গোলাপি ঠোঁটগুলোও সাদা। পালি মায়ের মুখে হাত বুলায়। সন্ধ্যার রহস্যময় ক্ষীণ আলোয় সে মায়ের গায়ে সাদা ব্যতীত কোনো রঙ পায় না। বুজে আসা চোখ, ঠোঁট, গাল, নখ সব সাদা। অথচ তার কোমড়ের নিচ থেকে র’ক্তে ভেসেছে গত দিনগুলো। ঘরে এমন কোনো কাপড় নেই যা করবীর র’ক্তে ভেজেনি। গতকাল রাত থেকে পালি ঘুমায়নি। তার মা বারবার জ্ঞান হারিয়েছে, বিড়বিড় করে বকে’ছে। পালি সেসব দেখে ভয়ে কেঁদেছে। খুদিবুকে জিজ্ঞেস করেছে মায়ের এমন করার কারণ। অনুরোধ করেছে কিছু করতে। খুদিবু কিছুই করতে পারেননি। শুধু অবধারিত এক পরিনতির অপেক্ষা করে গেছেন। কিন্তু সেই পরিনতির অপেক্ষা যে কতটা দুঃসহ তা কেউই জানতো না। প্রথমে খুদিবু আশা করেছেন কেউ আসুক, করবীকে উদ্ধার করুক। কিন্তু এক পর্যায়ে সহ্য করতে না পেরে এখন তিনি চান করবী এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাক। শুধু করবী নয়, পালিও এই যন্ত্রণাময় স্মৃতির দীর্ঘতা থেকে মুক্তি পাক। পালি মায়ের মুখে হাত বুলিয়ে অস্ফুট স্বরে ডাকে,
“মা।”
করবীর চোখের পাতা নড়ে। সময় নিয়ে খুবই ধীরে সে চোখ মেলে। তার চোখের মনি স্থির নয়। যেন মনে হচ্ছে সে কিছু দেখতে পারছে না।
“পালিরে..” করবীর কম্পিত, দুর্বল স্বর।
“এই যে মা। এই তো আমি।” পালি মায়ের মুখের ওপর ঝুকে আসে। করবী ঢোক গিলে কয়েকবার। কাঁপা হাতে মেয়ের হাত ধরে ঠোঁটের সঙ্গে চেপে রাখে অনেকটা সময়। যেন শুষে নিতে চায় সবটুকু মাতৃত্বের অনুভূতি। পালির অস্থিরতা কমে। মায়ের এইটুকু স্পর্শেই সে মমতার সুবাস পায়। যে তীব্র সুবাসের নিকট জাগতিক সকল সুবাস তুচ্ছ।
“পালি, খিদা লাগছেরে মা? তোর মামা এখনো আসে নাই?”
“আমার কাউকে লাগবে না। তুমি ঠিক হয়ে যাও।”

করবী নিরব থাকে। জীবনে একা চলার মতো অসহনীয় যন্ত্রণা তার চেয়ে ভালো কে জানে? কিন্তু আফসোস তার মেয়েকেও সেই যন্ত্রণা সইতে হবে। করবীর মায়া হয় মেয়েটার প্রতি, নিজের ভাগ্যের প্রতি। এই কালো মেয়েটার বেড়ে ওঠা সে দেখতে পাবে না। কৈশোরে তাকে দিকনির্দেশনা দিতে পারবে না। যৌবনে জীবনযুদ্ধে নামার জন্য তৈরি করতে পারবে না। কখনো ভেঙে পড়লে আগলে নিতে পারবে না। এই মেয়েটার জীবনযুদ্ধ শুরু হবে এখন থেকে। বেঁচে থাকার যুদ্ধ, নিজেকে রক্ষা করে টিকে থাকার যুদ্ধ। সে আদৌ টিকতে পারবে নাকি প্রকৃতি তাকেও শুষে নেবে করবী জানে না। জগত নিঃস্ব মানুষের সঙ্গেই কেন নিজের নিষ্ঠুরতা জাহির করে? করবী জানে সে ধীরে ধীরে নিজের শেষ পরিনতির দিকে এগোচ্ছে। সেই সঙ্গে পালিও এগোচ্ছে নিজের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে। ওই যে দূরে খুদিবু মুখ লুকিয়ে কাঁদছেন, তিনিও জানেন। শুধু জানে না এই অবুজ মেয়েটা। করবীর ইচ্ছে হয় পালিকে সঙ্গে নিয়ে পৃথিবী ছাড়তে। অথবা পৃথিবীর কাছে আরেকটু সময় ভিক্ষা চাইতে। কিন্তু সবটাই অতৃপ্ত মনের খেয়াল। তার নিয়তি তৃপ্তির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। করবী সময় নিয়ে ভাঙা স্বরে বলল,

“মানুষ সামাজিক জীব। চলতে ফিরতে তোর হাজারটা মানুষের সঙ্গে দেখা হবে, পরিচয় হবে। কেউ কেউ আপন হয়ে উঠবে। কেউ হবে শত্রু। কেউ ক্ষতি করতে চাইবে আবার কেউ পাশে থাকতে চাইবে। তোকে খুব বুঝেশুনে চলতে হবে। এই বোঝাশোনা বিষয়টা আসবে পারিপার্শ্বিক অভিজ্ঞতা থেকে। হো’চট খেলে পড়ে গিয়ে কাঁদতে বসলে হবে না। বরং কেন হো’চট খেলি তার থেকে শিক্ষা নিয়ে যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে সেই চেষ্টা করতে হবে।”
করবী হাপাচ্ছে। পালি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। তার মস্তিষ্ক এসব কথা বোঝে না। এত জটিলতা জানে না। করবী মেয়ের মুখে হাত বুলিয়ে আবার বলে,
“জানিস, আমার খুব শখ ছিল পড়াশোনা করার। শহরে গিয়ে পড়বো, বড় বড় ডিগ্রি আনবো। আরো কত কি! কিন্তু জীবন আমাকে ভিন্ন স্রোতে ঠেলে দিয়েছে। আমি আমার স্বপ্নের কিছুই পূরণ করতে পারিনি। অভিমান, রাগ, ক্ষোভ আমাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। তোকে নিয়েও অনেক অনেক স্বপ্ন ছিল। আহারে স্বপ্ন! জীবনে সবকিছু হারালেও স্বপ্ন হারাবি না। দেখবি সেই স্বপ্ন পূরণের আকাঙ্খা তোকে বেঁচে থাকার রাস্তা দেখাবে। মায়ের কথা এখন তোকে বুঝতে হবে না। মামা বাড়ি যাবি। সেখানেই থাকবি। সময়ের সাথে নিজেকেও বুঝবি, মাকেও চিনবি। শুধু মায়ের মতো অভিমানী হবি না।”
করবী খুদিবুর দিকে তাকিয়ে বলল,
“খুদিবু, আমার ভাইজান আসবে। তিনি আমার কোনো কথা ফেলেন না। পালিরে তুমি ভাইজানের সাথে দিয়ে দিয়ো। ওর বাপ আসলেও তাকে রাখতে দিয়ো না। শেষ অনুরোধ।”
পালি অজানা ভয়ে হু হু করে কেঁদে ওঠে। মায়ের বুকে মুখ ডুবিয়ে বলে,
“কোথাও যাব না। আমি শুধু তোমার সাথে থাকব। আব্বা জলদি আসুক। তোমারে বড়ো ডাক্তার দেখাবো।”
“তোর আব্বা না আসুক। না দেখুক আমায়।”
করবী বিড়বিড় করে বলে। চোখের কার্নিশ বেয়ে পানি পড়ে। তার নিঃসাড় দেহের প্রতিটি লোমকূপ মেয়েটাকে আগলে নিতে চাইছে। পারছে না।

পরশুদিনের পর আর বৃষ্টি নামেনি চরে। গতকাল পানি হাটুর নিচে নেমে গেছিলো। এবং আশ্চর্যজনকভাবে আজ সন্ধ্যার মধ্যে তা একেবারেই ঘাটে নেমে গেছে। সম্পূর্ণ চর এখন বিধ্বস্ত, কাদাময়। এমন আকস্মিক বন্যা অনেকবার দেখলেও দ্রুত পানি নেমে যাওয়া খুদিবু তার দীর্ঘ অভিজ্ঞ জীবনে প্রথম দেখলেন।
সন্ধ্যা মিলিয়ে ঘুটঘুটে রাত নামার কিছুক্ষণ পরই করবী মা’রা গেল। পালির নির্ঘুম চোখদুটি তখন মায়ের সান্নিধ্যে লেগে এসেছিল। “করবী” বলে ডাকা এক আর্তচিৎকারে পালির ঘুম ছুটে যায়। দেখতে পায় জীবনের সবচেয়ে নির্মম চিত্র। আব্বার কোলে মায়ের নিথ’র দেহ।

করবীর মা’রা যাওয়ার কিছুক্ষণ পূর্বে আচমকা মহসিনের আগমন ঘটে চরে। সেই সাথে দুইহাত ভর্তি বাজার। যদিও তার এত দেরি করার কথা ছিল না। পঁচিশদিন আগেও সে নগদ টাকা নিয়ে রওনা হয়েছিল খিলানচরের উদ্দেশ্যে। কিন্তু বড় নৌকায় ডাকাতের কবলে পড়ে, জীবনের ভয়ে তাকে সর্বস্ব দিয়ে দিতে হয়েছিল। তবুও ডাকাতের ছু’রিকাঘা’ত থেকে রক্ষা পায়নি সে। ডান বাহুতে লম্বা করে একটা পোঁচ দিয়ে গিয়েছিলো তারা। শূন্য হাতে, ক্ষ’ত নিয়ে মেয়ে-বউয়ের সামনে আসতে তার বিবেকে বেধেছে। তাছাড়া ক্ষ’তের যন্ত্রণা তাকে ভুগিয়েছে অনেকদিন। চিকিৎসা করতে পারেনি বলে ঘা হয়ে গিয়েছিল। এখন অবশ্য ঘা সেড়েছে। হাতে টাকা আসতেই সে পুনরায় বাজার-সদাই করে রওনা হয়েছে। অনাগত সন্তানের কথা ভেবে একটা নতুন তোয়ালে ও কিছু নতুন জামাও কিনে নিয়েছে। কিন্তু চরে এসে তাকে এমন কিছুর মুখোমুখি হতে হবে ভাবতে পারেনি।

খুদিবু তার জীবনে এতগুলো অবাক ঘটনা এই প্রথম দেখলেন। যে মানুষটার প্রতিক্ষায় এতদিন বুক বেধেছিল, সেই মানুষটাই এলো সব আশা নিভে যাওয়ার পর। করবী মৃ’ত্যু আগে মহসিনকে দেখেছে। তার সঙ্গে কথাও বলেছে। স্বামীর কোলে মাথা রেখে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে। মহসিন শুধু নির্বাক হয়ে সবটা দেখেছে। পালির ঘুম ভাবটা ছুটে যেতেই কুপির টিমটিমে আলোয় মায়ের স্থির, নিশ্চল দেহটিকে দেখে। করবীর চোখ আধ বোজা। সেই চোখের আছে শুধু শূন্যতা, অভিমান, আক্ষেপ। পালি কি বুঝলো কে জানে, সে হামলে পড়লো মায়ের বুকে। এবং এই প্রথমবার সে মায়ের বুকে কোনো উষ্ণতার আবেশ, স্পর্শ, অনুভূতি পেল না। আঁতিপাঁতি করে খুঁজেও না। মহসিন ঘোরগ্রস্তের মতো মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। দুই বাবা-মেয়ের কেউই কাঁদলো না। একে অপরের সঙ্গে কথাও বলল না। শুধু প্রান ত্যাগ করা এক শূন্য দেহকে আঁকড়ে ধরে রইলো সারাটি রাত।

পরদিন ভোরে করবীর কবর হলো উঠানের কাঁঠাল গাছের নিচে। চরের পানি নেমে যাওয়ায় গতকাল থেকেই অনেক পরিবার ফিরে এসেছে। করবীর মৃ’ত্যু সংবাদে তারা সমবেদনা প্রকাশ ছাড়া কিছুই করতে পারেনি। একের পর এক আকস্মিক ঘটনা হজম করা পালির ছোট মস্তিষ্কের জন্য বিরাট বোঝা হয়ে যাচ্ছিলো। মায়ের সীমাহীন প্রসব বেদনা, মৃ’ত ভাইয়ের জন্ম, তাকে পানিতে ভাসিয়ে দেওয়া, খাবারের অভাব, সোলেমানের হাতে যৌ’ন হয়রানির স্বীকার, মায়ের হাতে সোলেমানকে আহ’ত হতে দেখা, মাকে ধীরে ধীরে মৃ’ত্যুর কোলে ঢলে পড়তে দেখা, এতসব ঘটনায় ধুকে ধুকে অবশেষে আজ মাকে মাটির নিচে শায়িত করতে দেখে সে জ্ঞান হারায়।
__________

সকালের চড়া রোদে মাঝারি একটা ট্রলার ইঞ্জিন বন্ধ করে চরের ঘাটে এসে থামলো। সেই ট্রলারে করে এসেছেন রবিউল খন্দকার। গতকাল রাত থেকে একটানা ইঞ্জিনের শব্দে থেকে কান তব্দা লেগে আছে। ট্রলার থামার পরও মনে হচ্ছে মাথায় কেউ ভটভট শব্দ করে ইঞ্জিন চালাচ্ছে। মাথাটাও ধরে আছে খুব। বালুর ঘাট এখন কাদাময়। সদ্য পানি নেমেছে বোঝা যাচ্ছে। রবিউল খন্দকার কাদায় নামলেন। এনামকে বললেন সঙ্গে আনা ব্যাগটা নিয়ে আসতে। ব্যাগে মায়ের দেওয়া আচার, ফলমূল এবং নতুন জামা-কাপড় এনেছেন তিনি। এবার বোনকে যেভাবেই হোক বুঝিয়ে বাড়িতে নিয়ে যাবেন। না করার কোনো পথই খোলা রাখবে না। আম্মার অসুস্থতা সহ নানান দোহাই তিনি সারাপথ ভেবে এসেছেন। করবী এবার ভাইজানকে ফেরাতে পারবে না।

ঘাটে ট্রলার দেখে অনেকেই কৌতুহল নিয়ে উঁকি দিচ্ছে। এই চরে সাধারণত ট্রলার এসে ভীড়ে না৷ রবিউল খন্দকার শেষ এসেছিলেন দুই বছর আগে। তার এখানে আসা বোন একদমই পছন্দ করে না। যেচে পড়ে ভাইজানকে নিজের অভাব অনটন দেখাতে চায় না করবী। করবীর আত্মমর্যাদা বেশি। এই ব্যাপারে সে খন্দকার বংশের গুনপ্রাপ্ত। কারো থেকে সামান্য আর্থিক সাহায্য নিতে নারাজ। তবে এইবার নিজে থেকে ডাকায় রবিউল খন্দকারের মনে হলো বোনের মন বুঝি গলেছে।

বাড়ির উঠানে পা রাখতেই রবিউল খন্দকারের শরীর শিরশির করে উঠলো। আলো ঝলমলে দিনেও সুনসান নিস্তব্ধতা আঁকড়ে আছে চারিদিকে। তিনি ব্যাপারটা আমলে না নিয়ে জোরে হাক ছাড়েন।
“পালি? করবী? বাড়ির সবাই কই?”
কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। তিনি এবার ঘরের চৌকাঠে এসে পা দিতেই দেখলেন মহসিন মেয়েকে জরিয়ে ধরে বসে আছে চৌকিতে। একদম নিশ্চুপ, অবিচল, বিমর্ষ । যেন কোনো ঘোরের মধ্যে আছে। দৃশ্যটা দেখে রবিউল খন্দকারেত বুকটা ছ্যাত করে উঠলো। তিনি ঘরে ঢুকলেন।
“মহসিন? এই মহসিন? পালির কি হইছে?”

এতোক্ষণে বোধহয় মহসিনের কানে আওয়াজ ঢুকলো। সে চোখ তুলে তাকালো। সেই চোখে হাহাকার। সে কি করবে, কি বলবে জানে না। রবিউল খন্দকার উত্তরের অপেক্ষা না করে পালির গায়ে হাত রাখে। রুগ্ন, নেতানো দেহটি তাপে পুড়ে যাচ্ছে যেন। পালি তাকালো সঙ্গে সঙ্গে। চোখদুটো লাল টকটকে হয়ে আছে, চুল আলুথালু, পোষাকেও কাদা লাগানো। রবিউল খন্দকার পালির মাথায় হাত রাখলেন। বললেন,
“পালি মা। এ কি অবস্থা তোমার! মহসিন, তোমরা এমনে বইয়া আছো ক্যান? করবী কই?’

পালি মামার দিকে কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে হাতটা মাথা থেকে সরিয়ে দেয়। আব্বার কোল থেকে সরে আসে।
“তোমরা দূরে যাও। সবাই চলে যাও। আমার মাকে বাঁচাতে কেউ আসোনি। এখন কেন এসেছো? আমার মা তোমাদের জন্য ম’রেছে।”

পালি লাফিয়ে নেমে এলোমেলো পায়ে ছুটে যায় বাইরে। কাঁঠাল গাছের নিচে সদ্য হওয়া ভেজা, স্ফিত মাটি আঁকড়ে ধরে শুয়ে পড়ে। রবিউল খন্দকার চোখের সামনে অন্ধকার দেখতে শুরু করলেন। মনে হলো এই মুহূর্তে পড়ে যাবেন। দরজার কপাট আঁকড়ে ধরে দাড়াবার চেষ্টা করলেন তিনি। বুকের ভেতরটা ভারী হয়ে উঠেছে। ইহজগতের কোনো কথাই যেন আর শ্রবণ করতে পারলেন না। কেবল পালির “মা…মা” বলে চিৎকার করে কাঁদার শব্দটাই কানে বেজে উঠলো বারবার।
________

মেঘলা সন্ধ্যা ধূসর রূপ মেলেছে। আকাশ আবারো কালো হয়েছে। থেমে থেমে গুড়ুম গুড়ুম শব্দ হচ্ছে। প্রকৃতিতে বাতাসের ছিটেফোঁটাও নেই। সবই স্তব্ধ, শান্ত, নিশ্চুপ। ঠিক যেমনটা হয়ে আছে মহসিন এবং পালি। রবিউল খন্দকার বোনের কবরের পাশে খালি পায়ে বসে আছেন সকাল থেকে। যাকে নিয়ে যেতে এতো ছ’লচা’তুরী শিখে এসেছিলেন সে’ই চিরতরে বিদায় নিয়েছে। তীব্র অনুশোচনায় রবিউল খন্দকারের বুকের ভেতরটা জ্ব’লে যায়। হয়তো করবী তার আশায় পথ চেয়ে ছিল। হয়তো ওনার জন্য কোনো কথা জমানো ছিল। তিনি যদি আরো আগে আসতে পারতেন তবে বোধহয় দুর্ঘটনা ঘটতো না। করবীও বিনাচিকিৎসায় ম’রতো না। জীবনে দ্বিতীয়বার তিনি অসহায় বোধ করলেন। প্রথমবার করেছিলেন আব্বা মা’রা যাওয়ার পর। রবিউল খন্দকার মাটি খামচে ধরেন। বোনকে শেষবারের মতো দেখা হলো না। কবরে মাটি দেওয়ার হলো না।

রবিউল খন্দকার পালিকে সঙ্গে নিয়ে ফেরার ইচ্ছে পোষণ করলে মহসিন বিনাবাক্যে সম্মতি দিল। পালির জামা-কাপড় ছোট একটি ট্রাঙ্কে গুছিয়ে ট্রলারে তুলে দিল। রাত বাড়ছে। ট্রলারে দুইখানা হারিকেন জ্বলছে। মহসিন পালিকে ট্রলারে তুলে দেওয়ার আগে মেয়ের অসহায় মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে চাইলো। আশ্চর্যজনক ভাবে সে শত চেষ্টা করেও গলা দিয়ে একটা শব্দ বের করতে পারল না। সব কথা গলার কাছটায় আটকে গেছে। না পারছে গিলতে আর না পারছে ওগরাতে। পালি তখন একদৃষ্টিতে আব্বার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। সে এখনো ঘোরের মাঝে বিচরণ করছে। তার সঙ্গে কি হচ্ছে সে জানে না। মহসিন ঘাটের পা ছুঁইছুঁই পানির কাছে হাটু গেড়ে বসে পড়লো। মেয়ের সারামুখে হাত বুলায়। ফোলা ফোলা চোখ, নাক, পাতলা ঠোঁট, সবটাই তার এবং করবীর অবিচ্ছেদ্য অংশ। পৃথিবীতে তাদের ভালোবাসার একমাত্র অস্তিত্ব। সেও দূরে চলে যাবে। মহসিন পালিকে বুকের মাঝে চেপে ধরে। বাবার বুকে গুটিসুটি মেরে রইলো মেয়েটা। মহসিনের চোখ থেকে দুফোঁটা উষ্ণতা গড়িয়ে পড়ে পড়লো পালির কপালে। কত বছর পর সে কাঁদলো তা বলতে সময়ের হিসেব কষতে হবে। এই দুফোঁটা জল কতটা মায়াময়, স্নেহমাখা পালি কি তা বুঝলো? হয়তো বুঝলো। হয়তো না।

ইঞ্জিনের শব্দ তুলে ট্রলার ছুটতে লাগলো শালুগঞ্জের উদ্দেশ্যে। যতক্ষণ ট্রলারের আলোটুকু দেখা গেল মহসিন ঠায় দাঁড়িয়ে সেদিকেই তাকিয়ে রইলো। তার এবং করবীর একবুক মায়ায় গড়া তরীটি ভেসে যাচ্ছে। তার নতুন নীড়ের খোঁজে।

ট্রলারখানা দূরে মিলিয়ে যেতেই মহসিন চোখ বন্ধ করে ঘাটের কাছে বানানো বাশের মাচায় বসে পড়ে। সাথে সাথেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামতে শুরু করে। মহসিন তবুও ঠায় মাচাতেই বসে থাকে। জীবনের পাওয়া না পাওয়ার হিসেব কষে। কিন্তু সেই হিসেবের শেষে উত্তরটা অসম্পূর্ণ। বৃষ্টির ফোঁটা যেমন নদীর পানিতে পড়ে বিলীন হয়, তেমনই মহসিনেরও নিজেকে বিলীন করে দিতে মন চাইলো। কিন্তু তার বিলীন হওয়ার যায়গা কী পৃথিবীর কোথাও আছে? উত্তর যে তার নিজেরই অজানা। শুধু স্মৃতিতে ভাসে কাঁঠাল গাছতলা।

বৃষ্টি শুরু হতেই রবিউল খন্দকার পালিকে আগলে নিয়ে ছইয়ের ভেতরে বসেন। ওনার পায়ের কাছে একটা হারিকেন জ্বলছে। সেই আলোতে রবিউল খন্দকারের হঠাৎ মনে হলো ওনার পাশে পালি না, বসে আছে ছোট্ট করবী। যে প্রতি সন্ধ্যায় তিনি বাড়ি ফিরতেই ভাইজান ভাইজান করে বাড়ি মাথায় তুলতো। যার কথায় বাড়ির সবার কান ঝালাপালা হলেও বিরক্ত হতেন না শুধু রবিউল খন্দকার। তিনি দুইহাতে জাপটে ধরেন পালিকে।
পালির চোখ তখন দুই দিনের নির্ঘুম রাতের সব ঘুমেরা ভীড় জমিয়েছে। সে মামার কোলেই ঘুমিয়ে পড়লো। রবিউল খন্দকার শালুগঞ্জ পৌঁছানো অবধি পুরো পথ পালিকে বুকে আগলে রাখলেন। বৃষ্টির বেগ বাড়ছে। তবে নদীতে স্রোত বেশি না থাকায় নির্বিঘ্নে ট্রলার ছুটে চলেছে। হুহু করে ঠান্ডা বাতাস এসে ছুঁয়ে যাচ্ছে ঘুমন্ত পালি এবং জাগ্রত রবিউল খন্দকারকে। সেই ঠান্ডা বাতাসেই হোক কিংবা মাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাবার অভ্যাসবশতই হোক পালি তার মামাকে জড়িয়ে ধরলো ঘুমের ভেতর। হয়তো মামার মাঝেই মাকে অনুভব করতে চাইলো। রবিউল খন্দকারের হঠাৎ কি হলো কে জানে, তিনি হাউমাউ করে কাঁদতে চাইলেন। বৃষ্টির মতো নিজেকে ভাসিয়ে দিতে চাইলেন। খানিক দিলেনও। তবে তা অতি সন্তর্পণে। বাহিরে থেকে এনাম হারিকেনের আলোয় তা বিষ্ময় চোখে দেখে৷

চলবে…