বিষাদনীড়ে মায়াতরী পর্ব-২+৩

0
189

বিষাদনীড়ে মায়াতরী [২]
প্রভা আফরিন

শালুগঞ্জ

রবিউল খন্দকার এক পুত্র এবং এক কন্যার জনক। বড় ছেলে হিমাদ ও ছোট মেয়ে চিত্রা। দুজনেরই পিঠোপিঠি বয়স। হিমাদ স্বভাবে শান্তশিষ্ট। কারো সাতেপাঁচে থাকে না, কেউ তার সাতেপাঁচে থাকুক তাও চায় না। দশম শ্রেণির বোর্ড পরীক্ষা দিয়ে টইটই করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। চিত্রা দশম শ্রেণিতে উঠেছে। স্বভাবে হিমাদের সম্পূর্ণ বিপরীত। কখনো বাধভাঙা ঝর্ণার মতো ছুটে চলে আবার কখনো স্রোতশূন্য নদীর মতো টলটলে। সকালে বিদ্যালয়ের জন্য তৈরি হওয়ার সময় চোখে গাঢ় করে কাজল মাখতেই চিত্রার দাদি মেহরুন বানু খেকিয়ে উঠলেন,

“ওই ছেড়ি, তুই পড়তে যাবি না কি রঙঢঙ করতে?”

“রঙঢঙ করতে করতে পড়তে যাব। সমস্যা কি বুড়ি?”

নাতনির কথায় মেহরুন বানু বাঁকা চোখে তাকালেন। বললেন,
“আদব রাইখ্যা কথা ক। আমি তর বাপেরও মা।”
“বাপের মা, আমারতো না। বুবুর সাথে মন খুলে কথাও বলতে পারবো না?”

মেহরুন বানু একটু দমে গেলেন। নরম গলায় বললেন,
“সাজগোজ হইলো জামাইয়ের লইগ্যা। বিয়ার পরে যত ইচ্ছা সাজবি। এহন সাইজ্জা কি করবি? দেহানের মানুষ আছে? বাইরের মাইনষেরে দেহাইলে পাপ হইবো।”

চিত্রা হাসে। আয়নায় নিজেকে ঘুরে ঘুরে দেখে বলে,
“নিজের জন্যও সাজতে পারবো না? রঙঢঙ করতে কী এখন রঙের মানুষ জোটাবো?”

“লাজ-লজ্জা ধুইয়া খাইতাছে।”

মেহরুন বানু কড়া চোখে তাকিয়ে মুখে পান গোজেন। একসময় ভীষণ জাদরেল মহিলা ছিলেন তিনি। বয়সের সাথে নরম হলেও আর পাঁচটা দাদি-নানিদের মতো প্রাণখুলে হাসিতামাশা করতে পারেন না। শাসন করার স্বভাবটা অভ্যাসে রয়ে গেছে। ছেলেটা এখনও ওনার দিকে চোখ তুলে কথা বলেন না। এদিকে নাতনিটা দিনদিন লাগামছাড়া হয়ে যাচ্ছে। তিনি কয়েকবার বিয়ের কথা বলেছেন। কিন্তু রবিউল খন্দকার মেয়ে অন্ত প্রাণ। ছেলে-মেয়ে উভয়কে উচ্চশিক্ষা দেবেন। ওনার মুখ উজ্জ্বল করবে তারা। এমনটাই ওনার ভাবনা।

মেহরুন বানু উঠে চলে গেলেন। রান্নাঘরের সামনের উঠানে বসে পুত্রবধূ জুলেখাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“ছেড়ি বড় হইছে। ইস্কুলে যাইতে মেলাখানি পথ হাটতে হয়। মাইনষের নজর লাগবো। একখান বোরকা বানাইয়া দেও।”

জুলেখা উত্তর দিল না। সে মুখ কালো করে রান্না করছে। যেদিন পরিশ্রম একটু বেশি হয়ে যায় জুলেখার মুখে হাসি ফোটে না। কাউকে সহ্যও করতে পারে না। যেমনটা এখন শ্বাশুড়িকে পারছে না। মেহরুন বানু কিছুক্ষণ নীরবে তাকিয়ে থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রস্থান করেন।

রবিউল খন্দকারের সকালের খাওয়া শেষ হয়েছে। চিত্রা গুটিগুটি পায়ে এসে আব্বার পাশে দাঁড়ায়। তিনি দেখে বলেন,
“কিরে? এহনো ইস্কুলে যাস নাই?”
চিত্রা বলল,
“এখনই যাবো। কিন্তু তোমাকে একটা কথা বলতে আসছি।”
“কি কথা?”
“আমার ঘরে বাতিটা সমস্যা করে আব্বা। রাতে পড়তে বসতে পারি না। নতুন বাতি লাগিয়েও কাজ হয় না। মনে হয় তারে সমস্যা। ভাইয়াও ঘুরতে চলে গেছে। একটু সারায় দেওয়ার ব্যবস্থা করো।”

রবিউল খন্দকার চিন্তায় পড়লেন। বললেন,
“এই তল্লাটে তো বিদ্যুৎতের কাজ সবাই জানে না। মানুষ না পাইলে নিবাসপুর থাইকা মেকানিক আনাইতে হইবো।”

চিত্রা তড়িঘড়ি করে বলল,
“কালকে তোমার রাইস মিলের যেই কর্মচারীটা টিভির এন্টেনা ঠিক করে দিল তাকে একটু বলো। যদি পারে বাতিটা দেখে দিতে। মনে তো হয় কারেন্টের কাজ জানে।”

রবিউল খন্দকার মেয়ের কথায় মাথা নেড়ে বললেন,
“আইচ্ছা কইয়া দেখি যদি পারে।”

চিত্রা মুচকি হেসে আব্বার থেকে বিদায় নিয়ে স্কুলের পথে হাটা দেয়। দিনটা বেশ ফুরফুরে কা’টবে আজ।
_____________

খিলানচর

প্রমত্ত নদীর বুকে এক খন্ড বালুময় জমি খিলানচর। এই চর পূর্বে টালিপাড়ার মাতবরের দখলে ছিল। মাতবরের মৃত্যুর পর তার বংশধরদের কারো মাঝে দখলদারি নিয়ে মাতামাতি দেখা যায়নি। বর্তমানে চরখানা দখলদার মুক্ত। এখানে সতেরোটি পরিবার বন্যা, নদীভাঙন ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে সর্বস্ব হারিয়ে এই চরে বসবাস করছে। করবী অবশ্য বিয়ের পর থেকে এই চরের বাসীন্দা। দশ বছর আগে মহসিনের হাত ধরে ষোড়শী করবী খিলানচরে পা রাখে। পরিবারহারা ভবঘুরে মহসিনের নির্দিষ্ট কোনো পেশা নেই। যখন হাতে যে কাজ পেতো তাই করতো। কখনো বা কিছুই করতো না। করবীকে বিয়ে করার পর সে কাজের তাগিদ অনুভব করে। বউকে চরে রেখে কাজের সন্ধানে ছুটে যায় টাউনে।

প্রথম প্রথম দিনগুলো খুব কষ্টের ছিল। করবী বড় ঘরের মেয়ে। হেসে-খেলে জীবন পার করেছে। সেখান থেকে চরে এসে মানিয়ে নিতে ভীষণ কষ্ট হয়েছে তার। মহসিনও তার সুন্দরী বউ রেখে দূরে সর্বদা শঙ্কায় থাকতো। কিন্তু করবীর বেপরোয়া সাহস ও আশ্বাস তাকে ভরসা দেয়। জীবন ধারণের তাগিদে একসময় দুজনেই মানিয়ে যায়। মহসিন পনেরো থেকে বিশ দিন পর পর দুইহাত ভরে বাজার ও কিছু নগদ টাকা নিয়ে বাড়ি ফেরে। দুই থেকে তিনদিন থেকে আবারও চলে যায় কাজে। এমন করেই চলছে করবী ও মহসিনের সংসার। তবে এবার মহসিন দেড় মাস হলো বাড়িতে আসেনি। সে কোথায় আছে তাও অজানা। ঘরে খাবার নেই। হাতে টাকা নেই। এমনটা আগেও কদাচিৎ হয়েছে বটে। চরে কর্মসংস্থানের একাধিক সুযোগ নেই। করবী পালিত মুরগিটা কিংবা মাচার লাউটা টালিপাড়ার হাটে বিক্রি করে কয়েকদিন চালিয়ে নিয়েছে।

কিন্তু এবার পরিস্থিতিটা একটু বেশিই ভিন্ন। করবী আটমাসের অন্তঃসত্ত্বা। এমন সময় পালিও জ্বরে পড়লো। তাই আগেই মুরগিগুলো বেঁচে মেয়েকে ডাক্তার দেখাতে হলো। এখন আবার নদীর পানিও বাড়ছে। দুর্যোগটা যেন ওদের ঘাড়েই এসে পড়েছে। সেই ষোল বছরের করবী এখন ছাব্বিশ বছর বয়সী মা। স্বভাবে ভীষণ জেদি ও অভিমানী। শত অভাবেও সে বাপের বাড়ির সাহায্য নেয়নি। এমনকি দশ বছরে কখনো বাপের বাড়িতে পা ও রাখেনি। বড়ো ঘরের অপরূপা মেয়েটি গরীবের হাত ধরে কেন স্বেচ্ছায় নির্বাসন নিয়েছিলো তা সকলেরই অজানা।

কালো মেঘেরা ছাড়াছাড়া ভাবে সম্পূর্ণ আকাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। থেমে থেমে মেঘ গুড়গুড় করছে। করবী আকাশের অবস্থা দেখে রাতের রান্নার তোড়জোড় শুরু করে। চরে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা নেই। হারিকেন, কুপিই আধারে একমাত্র সম্বল। তাই অন্ধকার হয়ে আসার আগে রান্না শেষ করতে হয়। ঘরে চাল নেই। চাল ঝারা ক্ষুদের ভাত রান্না হবে আজ।

করবী চুলায় হাড়ি চাপিয়ে গলা উঁচিয়ে বলল,
“পালিরে, দিন ভালো না। আলো থাকতে পড়তে বস।”
পালি বায়না করে বলে,
“এখন সবাই খেলবো। আমিও খেলমু। রাতে পড়ি?”
“ওরা পড়ালেখা করে না। যখন তখনই খেলতে পারবে। তুইও কি তাই করবি? রাতের বেলা পড়া লাগবে না। বইপত্র নিয়ে এখানে আয়।”

পালির চোখেমুখে আধার নামলো। বিকেলটা খেলার সময়। এখন পড়তে বসতে কারোই মন চায় না। সে মন খারাপ করে বই আনতে গেল। সেদিকে তাকিয়ে করবী চাপা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। কেরোসিন বাঁচাতে মেয়েকে বিকেলেই পড়তে বসতে বলা। পালির পুরো নাম আম্রপালি। সে চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী। টালিপাড়ার একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তাকে ভর্তি করিয়েছে করবী। নৌকা পথে দুই ঘন্টা সময় লাগে যেতে। করবীই মেয়েকে আনা নেওয়া করে। এখন আর শরীরে কুলোচ্ছে না। তাই বাড়িতে বসেই পড়াচ্ছে।

ছনের ছাউনি দেওয়া উন্মুক্ত রান্নাঘরের সামনে চটের বস্তা বিছিয়ে বই নিয়ে বসলো পালি। করবী চুলায় অনবরত খড়ি-পাতা দিতে দিতে মেয়েকে ইংরেজি কবিতা মুখস্ত করায়। সে নবম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা পেয়েছে। এরপর ভাগ্যের ফেরে কিংবা নিষ্ঠুরতায় পড়াশোনা ছেড়ে এই চর জীবন বেছে নিতে হলো তাকে। করবীর অপার্থিব সৌন্দর্য, গায়ের রঙ, গঠন, চালচলন নিঃসন্দেহে সবার থেকে আলাদা এবং শৌখিন। কথার ধরনে শুদ্ধ ভাষার প্রচলনটাই বেশি। পালি তার মায়ের প্রতিটা আচরণে মুগ্ধ। এই চরে তার মা একাই শিক্ষিত এটা ভেবে ভীষণ গর্বও হয়। পালির ছোট জীবনে দেখা সেরা মানুষটা তার মা। শুধু একটু বকাবকি ও মা’রধোর করে এই যা দোষ। তবুও মাকে সে ভীষণ ভালোবাসে। মায়ের যত্ন নিতে চায়। তার কল্পনায় বিচরণ করা রুপকথার রাজ্যের সুন্দরী রানিটি তার মা। যার সর্বাঙ্গে আভিজাত্যের ছোঁয়া। পালির অবশ্য মাঝে মাঝে মন খারাপও হয়। করবীর কাছে অবুঝ মনে প্রশ্ন করে,
“তোমার মেয়েও হয়েও আমি ক্যান সুন্দর হইলাম না?”
করবী ঠাট্টা করে বলে,
“তোর বাপ যে কালো।”
“আব্বা কালো তাই আমি কালো!”
করবী তখন আহ্লাদ করে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“কালো না, তুই আমার একখন্ড আষাঢ়ি মেঘ।”

সন্ধ্যা নামতে শুরু করেছে। আলো কমে আসছে। পালি বইয়ের দিকে ঝুকে গুনগুন করে পড়ছিল। এমন সময় সোলেমানের পা পড়লো বাড়িতে। সে এসেই গলা খাকারি টেনে বলল,
“করবী দেহি আন্ধারে মাইয়ারে এক্কেরে জজ-ব্যারিস্টার বানায় লাইবো।”

করবী মাথায় আঁচল তুলে পেছনে তাকাতেই সোলেমান তার পানের কালচে প্রলেপ পড়া দাতগুলো বের করে হাসলো। লোকটার সন্ধ্যারাতে এদিকটায় আনাগোনা বাড়ে। করবী পালিকে বলল,
“আর পড়া লাগবে না। হাত-পা ধুয়ে ঘরে ঢোক।”

পালি বই নিয়ে চঞ্চল পায়ে ভেতরে চলে গেল। সোলেমান রান্নাঘরের উঁচু ভিটা থেকে কয়েক হাত দূরত্ব নিয়ে দাঁড়ায়। পাতিলে উঁকি দিয়ে বলে,
“ক্ষুদের ভাত? বাইত্তে চাইল, বাজার-সদাই নাই?”

“যা আছে আমাদের মা-মেয়ের দিন চলে যাবে।”

সোলেমান চুকচুক করে আফসোস করলো। বলল,
“মহসিনডার জ্ঞান-বুদ্ধি কম। নাইলে ভরা পোয়াতি বউরে ফালায় দূরে থাহে। তোমার তো রানির হালে থাকনের কথা। মনে লয় টাউনে বিয়া-শাদি কইরা আরেকখান ঘর সংসার পাতছে হেয়। টাউনের মাইয়ারা তো তাবিজ-কবজ ভালা পারে। খোঁজ খবর নিয়া দেইক্ষো।”

করবী কোনো উত্তর দিল না। তাকে দেখে মনে হলো সোলেমানের কথাকে সে গুরুত্বই দিচ্ছে না। সোলেমানের কন্ঠ আরেকটু খাদে নামে।
“তুমি শিক্ষিত মানুষ। হের আশায় থাইকো না। যহন যা দরকার লাগবো আমগোরে ডাকবা। রাইত বিরাইতে আঁতকা অসুখ করলে জানাইবা। শরম পাইবা না। নিজে না পারলে পালিরে পাডায় দিবা। তাছাড়া আশেপাশে তো কু-মতলবের মানুষ মেলা। সাহায্যের নামে ক্ষ’তি করতে চাইবো।”

বলে উঠানের এক কোনের কচু গাছগুলোয় ফিচ করে পানের পিক ফেলল সোলেমান। সেদিকে তাকিয়ে করবীর মেজাজ খারাপ হয়। কচুগুলো কাল রান্না করবে বলে মনস্থির করেছিল সে। এখন সেগুলোর দিকে তাকালেই গা ঘিনঘিন করছে। রান্না হয়ে এসেছে। সে চুলার জ্বাল কমিয়ে দিয়ে সোলেমানের দিকে ঘুরে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বলল,

“সেই দরকার পরবে না সোলেমান ভাই। আমার এই অবস্থা দেখে কেউ আমারে দুর্বল ভাবলে মস্ত ভূল করবে। আমার বা আমার পালির ক্ষতি করতে আসলে ধর থেকে মাথাটা আলাদা করে দিতে আমার হাত কাঁপবে না। সাধে তো আর প্রতিদিন দা-ব’টি ধার দিয়া রাখি না! জায়গামতো এক কোপই যথেষ্ট। তাছাড়া হামিদ তো আছেই। আপনার চিন্তা করা লাগবো না।’

সোলেমানের ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে ওঠে। মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে হাত নেড়ে বলে,
“পুরুষ আর মহিলা মাইনষের গায়ের জোর কি আর সমান হইলোনি। তোমার জোর আছে। কিন্তু একটা পুরুষপোলা ধইরা বইলে শইল্যা কুলাইবো না। এরজন্যই কই আরকি। বিপদ-আপদের তো হাত পাও নাই। কহন কোনদিক দিয়া হাজির হইয়া যাইবো। তহন মহসিনের বদলে আমরাই কামে আমু।”

করবী আগুনের দিকে তাকিয়ে থাকে। প্রায়ান্ধকারে চুলার নিভু নিভু আলোয় তার ঘর্মাক্ত মুখের জৌলুস আলাদা দীপ্তি ছড়াচ্ছে। সে শীতল কন্ঠে বলল,
“সব বিপদের হাত-পা নাই। কিন্তু মানুষের তৈরি বিপদের মাথা ঠিকই আছে। মাথা ছাড়া তার উৎপত্তি হয় না। আর মাথা কাজ করলে হাত-পা হইতে সময় লাগে না। যেই মাথা থেকে কু-মতলব বের হয় সেই মাথা না থাকাই ভালো। এইসব আগাছা পরিষ্কার করলে চরে বসবাস করাও নিরাপদ হবে।”
এরপর সোলেমানের কিছু বলেনি। কিন্তু তার চোখে ক্রোধের ছায়া আধো অন্ধকারেও করবীর নজর এড়ায়নি।

সময় তখন নিমগ্ন রাতের গভীর থেকে গভীরতার যাত্রাপথে। বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। একটু আগে হামিদ বলে গেছে নদীর অবস্থা ভালো না। পানি ঘাটে উঠে গেছে। বৃষ্টি হতে থাকলে অবস্থা খারাপ হতে সময় লাগবে না। হামিদ মহসিনের সৎ ভাই। তবে তাদের সম্পর্ক আপন ভাইয়ের চেয়ে কম না। হামিদ বয়সে করবীর ছোট। তাকে যথেষ্ট সমীহ করে চলে। করবীও ছোট ভাইয়ের মতোই স্নেহ করে তাকে।

পালি মায়ের গা ঘেঁষে শুয়ে স্ফীত পেটে হাত রাখলো। মায়ের পেটের ভেতর ছোট্ট ছানাটা ইদানীং বেশ নড়াচড়া করে। পালির তখন কি যে ভালো লাগে! এখানে তার একটা ভাই বা বোন আছে। একদম হামিদ চাচার ছেলের মতো ছোট। করবীর চোখের নিচে কালি পড়েছে। সে রাতে বেশিরভাগ সময়ই জেগে থাকে। পালি তা জানে। সে জিজ্ঞেস করলো,
“মা, তুমি রাইতে ঘুমাও না ক্যান?”

করবী হতাশ গলায় বলল,
“যে বাড়িতে পুরুষ মানুষ থাকে না সে বাড়িকে মানুষ কর্তৃত্বহীন বিরানভূমি মনে করে। বাড়ির দিকে চোখ তুলে দেখার সময় মানুষের নজর বদলে যায়রে মা। রাতেই তো মানুষের আসল রুপ বাইর হয়। আন্ধারে মানুষের মুখোশ থাকে না। নিজের সুরক্ষার জন্য নিজেকেই লড়তে হয়। মনে কর আমি ঘুমের সাথে লড়ি, বড় লড়াইয়ের মোকাবিলা করতে।”

পালি একটু ভাবুক হলো। তারপর বলল,
“আমি চাই আমার একটা ভাই হোক। তাইলে রাতে তুমি আরাম করে ঘুমাইতে পারবা। বাড়িতে পুরুষ মানুষ থাকবো।”

মেয়ের কথায় হেসে ফেলল করবী।
“আল্লাহ তোর দোয়া কবুল করুক। আমি যেন নিশ্চিন্তে রাতে ঘুমাতে পারি আর তোরেও নিরাপদ রাখতে পারি।”

মেয়েকে আরো কিছুটা কাছে টেনে নিল করবী। ইদানীং অল্পতেই তার বুক কাঁপে। মেয়েটা বড় হচ্ছে। তারমধ্যে সামনে বর্ষা আর বন্যা আসছে। তখন এই ছোট খাটের ওপরই কাটবে ওদের দিন। এই খাটেই রান্না করবে, থাকবে। এই দুর্যোগের মধ্যে যে আসছে তাকে সামলাবে নাকি মেয়েটাকে দেখবে বুঝে উঠতে পারছে না করবী। একবার পানিবন্দী হলে কতদিন সে দশায় কাটাতে হবে তাও অজানা। পেট যেহেতু আছে, খাবারও জোটাতে হবে। তারচেয়েও বড় শঙ্কা যখন তখন যে কেউ দুর্বলতা বুঝে মা-মেয়ের ক্ষতি করতে পারে। এই ঘুটঘুটে আধারে করবীর নিজেকে জগতের সবচেয়ে অসহায় মানুষটি মনে হয়। মহসিনের ওপর রাগ হয়, তীব্র রাগ। লোকটা থাকলে তার এমন দুর্দশায় পড়তে হতো না। কিন্তু সে কোথায়? কিভাবে কাটবে এই দুঃসময়?

শুনশান রাতে টিনের চালে টুপটাপ ছন্দ ছাড়া আর কোনো সাড়াশব্দ নেই। ঘুটঘুটে আধারে করবী ঘুমন্ত মেয়েকে গা থেকে ছাড়িয়ে উঠে বসে। মৃদু তেজে হারিকেন জ্বালায়। পালির বইপত্র ঘেটে একটি সাদা পৃষ্ঠা ও কলম নিয়ে অনেক দিনের লালিত অভিমান ভেঙে সে লিখতে বসে,

শ্রদ্ধেয় ভাইজান,

আমার সালাম নিবেন। আশাকরি আল্লাহর রহমতে আপনারা সবাই ভালো আছেন। আপনি জানলে অত্যন্ত খুশি হবেন যে, আপনি দ্বিতীয়বার মামা হতে চলেছেন। আপনার নতুন ভাগ্নে বা ভাগ্নির আগমনের সময় অতি নিকটে। বিলম্বে জানানোর জন্য মার্জনা করবেন। দুঃখের বিষয় হলো এবার জৈষ্ঠ্য মাসেই নদীর পানি বাড়তে শুরু করেছে। হুড়হুড় করে উজানের পানি বাড়ছে। বোধহয় এবার বন্যা কিছুটা জলদিই আসতে চলেছে। এমন দুর্যোগের সময় আপনার ভগ্নিপতি পুনরায় দেড়মাস যাবত নিখোঁজ। এই অবস্থায় আপনার ভাগ্নীকে নিয়ে পানিবন্দী হয়ে পড়লে খুবই বিপদে পড়বো। আমার নিজেকে নিয়ে কোনো চিন্তা নেই। কিন্তু একটা নতুন প্রাণ আসলে পালিকে যত্নে রাখা বড়ই দুঃসাধ্য হয়ে পড়বে। তাছাড়া মেয়েটা কখনো মামাবাড়ি দেখেনি। আপনি যদি মাস তিনেকের জন্য পালিকে নিজের কাছে নিয়ে রাখেন খুবই উপকৃত হব। নিশ্চয়ই আমার মেয়ে আপনার নিকট যত্নে থাকবে, যেমনটা থাকতো আপনার বোন। আপনার সাক্ষাতের অপেক্ষায়।

ইতি,
আপনার স্নেহের করবী।

চলবে…

বিষাদনীড়ে মায়াতরী [৩]
প্রভা আফরিন
_
শালুগঞ্জ

মেঘাচ্ছন্ন ভোর। বর্ষণপ্রেমি মেঘেরা সমগ্র আকাশে একটি ধূসর পর্দা তৈরি করেছে। গ্রীষ্মের অগ্নিস্নাতা খরা এখন কোমল বৃষ্টিস্নাতা রূপ ধারণ করেছে। ভেজা মাটিতে পা ফেলে সাবধানে হাটছেন রবিউল খন্দকার। অন্ধকার ম্লান হয়ে আলোর গর্ভে বিলীন হচ্ছে। কাকডাকা ভোরে হাটে পাইকারি ক্রেতা-বিক্রেতা ছাড়া খুচরা ক্রেতা নজরে আসে না। রবিউল খন্দকার অবশ্য পাইকারি ক্রেতা-বিক্রেতা কোনোটাই নয়। তিনি এসেছেন মাছ কিনতে। বাজার-সদাই অন্যদের দিয়ে করালেও ভোরে তাজা মাছটা তিনি নিজে দেখে-বেছে কেনেন। প্রতি সপ্তাহে এখানে বিরাট হাট বসে। দূরের গ্রামগুলো থেকে নৌকা, ট্রলার বোঝাই করে মালামাল আসে। ব্যাবসা হয় জমজমাট। গ্রামের প্রভাবশালীদের মাঝে নিজের নামে হাট-বাজার করার একটা চল আছে। এই হাটের জমির একটা বিরাট অংশ খন্দকারদের দান করা। তারাই হাটের নাম রাখে খন্দকারের হাট। কয়েকযুগ পুরোনো খন্দকারের হাটের জন্যই এই অঞ্চল ও খন্দকার গোষ্ঠী লোকমুখে খ্যাত।

শালুগঞ্জ ও আশেপাশের অঞ্চলগুলো এখনো উন্নত নয়। সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা এখানে পৌঁছায়নি। এককালে এই অঞ্চলে নদী ভাঙনে শত শত কৃষি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যেত। আশ্চর্যের ব্যাপার হল বছরের পর বছর জমি গ্রাস করা এই সর্বনাশা নদী তার নিকটবর্তী এই হাটকে কখনো বন্যা কিংবা ভাঙনের দ্বারা স্পর্শ করেনি। অথচ এর আশেপাশের স্থানগুলো ভেঙেছে গড়েছে। কিছু বছর পূর্বে নদীতে বাঁধ নির্মাণ করার পর আর ভাঙন দেখা যায়নি। সেই সঙ্গে বেঁচে গেছে দরিদ্র কৃষকদের সম্পদ। খন্দকারের হাট তখনো জমজমাট ছিল এখন তা আরো বেড়েছে।

বর্তমানে হাটখানা রবিউল খন্দকারের জিম্মায়। খাজনা তোলা, দোকান বরাদ্দ সবকিছুতে ওনার একচ্ছত্র আধিপত্য রয়েছে। তবে হাটের অবস্থানটি নিয়ে দ্বিমত আছে। বৃহৎ এই হাটের বিস্তৃতি শালুগঞ্জ ছাড়িয়ে নিবাসপুরেও অবস্থিত। যার ফলে নিবাসপুরের প্রভাবশালী মোক্তার বংশের লোকেরা পূর্বে অনেকবার হাটের দখল নিয়ে ঝামেলা করেছে। তাদের মতে হাটে নিবাসপুরের সম্পত্তিও আছে। খন্দকারদের একচেটিয়া ভোগ নিয়ে তাদের আপত্তি আছে। এই দখলদারকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষে রেষারেষি ছিল। বর্তমানে তা প্রকাশ্যে প্রকট আকারে দেখা না গেলেও চাপা রেষারেষির আঁচ পাওয়া যায়। রবিউল খন্দকার অবশ্য ঝামেলা এড়িয়ে চলা মানুষ। রাজনীতিতেও জড়াননি। সবজির দোকানদার থেকে মাছের আড়তদার, জেলে, মাঝি সবার সঙ্গেই উনি সহজভাবে মেশেন, কথা বলেন। গ্রামবাসীও ওনাকে সমীহ করে, আলাপের সময় সহজভাবে গ্রহন করে। এই গ্রামের চেয়ারম্যান বদরুল আলমও ওনাকে মান্য করে চলে। বদরুল আলমকে চেয়ারম্যান বানানোর পেছনে ওনার অবদানটাই বেশি কিনা।

রবিউল খন্দকার একটা চার কেজি ওজনের কাতলা মাছ কিনে ওনার সার্বক্ষণিক সহযোগী এনামকে দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন বাড়িতে। এরপর ধীরপায়ে হেটে গেলেন নদীর ঘাটে। ঘাটে এখন ছোট-বড় নৌকা, ট্রলার এসে ভীর করছে। মালামাল নামছে হাতে হাতে। যার ফলে ঘাটে হাটু সমান কাদা হয়ে আছে। রবিউল খন্দকার দেখে দেখে কাদা থেকে খানিক দূরে উঁচু জায়গায় দাড়ালেন। নবু মাঝিকে দেখে হাক ছেড়ে বললেন,
“কিরে নবু, এদিকের কী খবর?”

নবু তার ছোট নৌকা ঘাটে ভিরিয়ে উত্তর দিল,
“গাঙ্গের পানি বাড়তাছে খন্দকার সাব। মনে অয় এইবার বাইষ্যার শুরুতেই উজানের ঢল নামবো।”

রবিউল খন্দকারকে চিন্তিত দেখালো। তিনি সময় নিয়ে বললেন,
“টালিপাড়ার দিকে খ্যাপে যাস এহন?”
“বড় খ্যাপ পাইলে যাই মাঝে-মইদ্য। নাইলে এতদূর গিয়া পোষায় না।”
“গেলে একবার খোঁজ নিয়া দেখিস হেইদিকে গাঙ্গের কি খবর।”
নবু মাথা দোলায়। এরপর ঘাটে নেমে হাত-মুখ ধুয়ে উঠে আসতেই রবিউল খন্দকার অন্যমনস্ক হয়ে হঠাৎ বললেন,
“হুনলাম তর বাড়িত চোর আইছিলো? সিঁধ কাটছে আর তরা নাকি টেরও পাস নাই?”
নবু মাথা দুলিয়ে বলল,
“গরমের মইদ্যে মরার ঘুম যে কইত্তে আইলো হেদিন! তয় আমার মতোন গরীবের বাড়িত চোর পড়লো কোন দুক্কে বুঝলাম না।”
রবিউল খন্দকার ভ্রু কুচকে বললেন,
“কথাতো তাই। কিন্তু তর বউ কইতাছে চোরে নাকি দুই ভরি স্বর্ণ নিয়া গেছে?”

নবু লজ্জিত মুখে বলল,
“মাইয়া মাইনষের কথারে গোনায় ধরতে আছেনি? হেরা কথার আগে-পিছে একশডা গপ জুইড়া দেয়। আমার চোইদ্দ গুষ্টির সব স্বর্ণ এক করলেও দুই ভরি হইতো না।”

মেঘলা চাদরের একফাঁকে সূর্য একটু উঁকি দিতেই রনির কাঁদামাখা পা পড়লো খন্দকার বাড়িতে। বাইরে থেকে ডাকলো,
“চাচি, বাড়িতে আছেন?”
জুলেখা ভেতর থেকে তাকে দেখেই নাক কুচকে এগিয়ে এল। বলল,
“এত সকালে কি দরকারে?”
রনি নিচু স্বরে বলল,
“চাচা পাঠাইছে। কইছে বাড়িতে একটা বৈদ্যুতিক তার ঠিক করতে হইব।”
জুলেখা বলল,
“অ… আগে পুশকুনিরতে পাও ধোও গিয়া। পায়ে জানি কেদা না থাহে। তারপরে ঘরে ঢুকবা।”
রনি বাড়ির একপাশে অবস্থিত বিশাল পুকুরটার দিকে এগিয়ে গেল।

চিত্রা বিরস মুখে ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। আজকে বৃষ্টির দোহাই দিয়ে সে স্কুলে যায়নি। কিন্তু বাড়িতেও মন টিকছে না। কোথায় গেলে অস্থিরতা কমবে সেটাও বুঝতে পারছে না। আনমোনে চিত্রার চোখ চলে গেল পুকুরপাড়ে। সেখানে ঝুকে কাউকে পা ধুতে দেখে সে চমকে উঠলো। চঞ্চল পায়ে ছুটে সিড়ির দিকে যেতেই পা পিছলে গেল। চিত্রা সিড়ির দেয়াল ধরে নিজেকে সামলায়। এরপর আবারো ছুটে নিচে নেমে যায়। তার চলার পথে কাচের চুড়িগুলো টুংটাং শব্দ ফেলে যায়।

রনি পুকুরে পা ধুয়ে আসতেই এনামকে দেখতে পেল।খন্দকারের বিশ্বস্ত ও পুরোনো কর্মচারী এনাম। তার থাকা খাওয়া সবই এই বাড়িতে। সে রনিকে নিয়ে গেল ভেতরে। একটা ঘরে নিয়ে বাতি দেখিয়ে বলল,
“এইডার লাইনে নাকি ঝামেলা আছে। জ্বলে না। দেহো তো কি ঝামেলা। আমি আবার এডি বুঝি না।”
এনাম দরজার আমনে দাঁড়িয়ে রইলো। রনি চারিদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিতেই বুঝলো এখানে একজন মেয়ে থাকে। ঘরে সব মেয়েলি জিনিসের ছড়াছড়ি।

শালুগঞ্জে বিদ্যুৎ এসেছে বছর কয়েক পূর্বে। তাও সম্পূর্ণ গ্রামে নয়। অনেকের বিদ্যুৎ সংযোগ নেওয়ার সামর্থ্যও নেই। ফলে বৈদ্যুতিক কাজ জানা মানুষ খুব একটা নেই। রনি বাতির সুইচে মনোযোগ দিতেই একটা মেয়েলি কন্ঠ এসে কানে ধাক্কা খেল। চিত্রা দরজায় দাঁড়িয়ে বলছে,
“চাচা, আপনি তো এখনো সকালের খাবার খান নাই। গিয়ে খেয়ে নেন।”
“আগে তোমার ঘরের বাত্তির কামডা হোক। রনিরে বিদায় কইরা যাই।”
“আব্বার কাছে যাবেন না? ওনাকে বিদায় করে, খেয়ে যেতে যেতে তো দেরি হবে। তারচেয়ে উনি থাকতেই খেয়ে নিন। একসাথে বের হতে পারবেন।”

এনাম একটু দ্বিধায় পড়লো। তার ভীষণ খিদে পেয়েছে। এদিকে রনিকে পাহারা দিতে জুলেখা তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে বলেছে। বাইরের কাজের ছেলেদের ওনার বিন্দুমাত্র ভরসা নেই। এনাম অবশ্য রনিকে ভরসা করে। সে চিত্রার জোড়াজুড়িতে খেতে চলে গেল। রনির খেয়াল করল বাতির তারটা সুইচের কাছে কাটা কিংবা ছুটে গেছে। তাই বাতি জ্বলছে না। এমন সময় চুড়ির শব্দ শোনা গেল খুব কাছে। সে পাশ ফিরতেই দেখল চিত্রা টেবিলে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে হাত নাড়াচ্ছে। রনি চোখ ঘুরিয়ে একবার দরজার দিকে তাকায়। কপাট মিলিয়ে রাখা। তাকে ঢোক গিলতে দেখে চিত্রা মুচকি হেসে বলল,
“পানি খাবেন?”
রনি ক্ষীণ স্বরে বলল,
“গরম লাগে। দরজার কপাট আলগা করে দেন।”

চিত্রা তা করল না। বরং রনির কাছে চলে এল। রনি রুদ্ধশ্বাস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মনে হচ্ছে এই বুঝি কেউ দরজা ঠেলে এসে ওর গলা চেপে ধরে পি’টানো শুরু করবে। চিত্রা হাত বাড়িয়ে ফ্যানের সুইচ চালু করে আবার সরে গেল।
“বাতাসের অনেক ব্যবস্থা আছে।”

রনি শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাত ঘেমে গেছে। বুকের ভেতর রেলগাড়ি ছুটছে উর্ধশ্বাসে। সে কি করবে বুঝতে পারছে না। চিত্রার মাঝে কোনো ভয়ের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। সে মনোযোগ দিয়ে তার কাজল লেপা সুন্দর চোখে রনিকে দেখছে। একসময় অসন্তুষ্ট গলায় বলল,

“সারা গালে তো দাড়ি নাই। থুতনিতে ওইটুকু কেন রেখেছেন? একদম রাম ছাগলের দাড়ির মতো লাগছে। আজকে গিয়ে দাড়ি কামাবেন।”

রনি থতমত খেয়ে গেল। খন্দকার চাচার মেয়েটার আচরণ অস্বস্তিকর। মাথায় কোনো সমস্যা আছে না কি জেনে-বুঝে ভয়ংকর কান্ড ঘটাচ্ছে বুঝতে পারছে না। চিত্রা মৃদু ধমকের গলায় বলল,
“শুনেছেন তো?”
“জি আচ্ছা।”

চিত্রা দরজার দিকে এগোতে এগোতে বলল,
“কাজ শেষ করুন। এনাম চাচার খাওয়া শেষ হল বলে। আর হ্যাঁ, মাঝেমধ্যে বিদ্যুতের লাইনে সমস্যা হলে এরকম সুবোধ বালকের মতো চলে আসবেন, কেমন?”

রনি মনে মনে বলল, “ভুলেও না।”

___________

খিলানচর

করবীর হাতে একটি দাঁড়াশ সাপ। সে পাটের একটি ব্যাগের মাধ্যমে সাপটার মাথা ও লেজ চেপে ধরে রেখেছে। পালি দূরে গুটিসুটি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সাপটাকে মায়ের হাতে দেখে তার যেমন ভয় হচ্ছে, তেমন ঘেন্নাও হচ্ছে। আজ দুপুরে পালির চাচা হামিদের ঘরে ঢুকে পড়েছিল সাপটা। হামিদ চাচার বউ রোকসানা দেখেই গগনবিদারী চিৎকার করে কোলের বাচ্চা নিয়ে ছুট লাগায়। চরের এক জেলে ফজলু সাপটাকে কয়েকটা আঘা’ত করে বস্তায় ভরে এনে সবাইকে বলছিল এটা ভয়ংকর কালসাপ। এক ছোবল দিলে মুহূর্তেই মুখে ফেনা উঠে মা’রা যাবে। কিন্তু করবী দেখেই চিনতে পেরেছে এটা নির্বিষ দাঁড়াশ। ফজলু সাপটিকে মারতে উদ্যত হওয়ার আগেই করবী সবাইকে ভড়কে দিতে ফজলুর হাত থেকে পাটের বস্তাটা কেড়ে নিয়ে, কৌশলে মাথা চেপ ধরে দেখিয়ে বলল,
“এটা নির্বিষ দাঁড়াশ। আপনি না জেনে ভুল তথ্য ছড়িয়ে সবাইকে ভয় দেখাচ্ছেন।”

না জেনে নয়। সাপটির পরিচয় ফজলুর জানা। সে ইচ্ছে করেই সবাইকে বোকা বানিয়ে বাহাদুরি দেখাতে চাইছিল। সাপ সম্পর্কে অজ্ঞ চরের মানুষ তার কথা বিশ্বাসও করছে। মাঝখান দিয়ে বাধ সাধলো করবী। ফজলু মাথা নেড়ে বলল,
“তোমার ভুল হইতাছে। এইডা ভয়ংকর সাপ। আমার কাছে দেও জলদি। পোয়াতি মানুষ সাপ ধরন ভালা না।”
করবী হেসে বলল,
“এই সাপ কৃষকের বন্ধু। এরা ফসলের খেতের ইদুর ও সেরূপ ছোটখাটো প্রাণী খায়। আমি নিশ্চিতভাবেই চিনি। আপনার জানায় ও জানানোয় ভুল আছে।”

ফজলু চুপসে গেল। রোকসানা ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে আছে। তার মনে হয় সম্পর্কে জা নামক এই মানুষটাকে মাঝে মাঝে জ্বীন-ভূতে আছর করে। অদ্ভুত সব কান্ড করে বসে। সে বলল,
“ভাবী, এইডা কিয়ের সাপ আমগো জাইনা কাম নাই। ফজলু ভাইয়ের হাতে দিয়া দেন। মাই’রা দূরে ফালায় দিয়া আহুক।”
“উহু, এটাকে ছেড়ে দেব।”

সকলে চমকালো। ফজলু প্রতিবাদ করে বলল,
“ছাড়বা মানে কি? আমি এইডারে দুইবার বারি দিছি। এইডারে ছাইড়া দিলে ক্ষেইপা আমার উপরে বদলা নিতে আইবো। দুশমন বাঁচাইয়া বিপদ ডাকতে পারুম না।।”
করবী হেসে বলল,
“দুশমন ভেবে মা’রতে যাওয়ার আগে দুশমনের ক্ষমতা সম্পর্কেও জানতে হবে ফজলু ভাই। এটার বিষ নাই। কামড়ে বিপদজনক কিছুই হবে না। সবচেয়ে বড় কথা, সাপের স্মৃতিশক্তি খুবই দুর্বল। কে তাকে মেরেছে সেটা মনে রেখে মানুষের মতো বুকে প্রতিশোধের আগুন চেপে ঘোরার ক্ষমতা এর নেই। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন।”

চরের সরল মানুষরা ওত কথার মারপ্যাঁচ বোঝে না। তাদের কাছে সাপ মানেই ভয়ংকর কিছু। বর্ষায়, বন্যায় অনেক সময় পানিতে ভেসে মানুষের ঘরে ঢুকে যায় সাপ। বিষ-নির্বিষ, উপকারী-অপকারী বিচার করার বুদ্ধি তখন থাকে না। সেটাকে মে’রে তবেই শঙ্কামুক্ত হয়। তাই করবীর কথায় কেউই ভরসা পেল না।
সকলের অসন্তোষ ও নিষেধের পরও করবী সাপটাকে নদীতে ছেড়ে দিল। সাপটির এঁকেবেঁকে ঢেউ তুলে চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে করবী ভাবল, যদি মানুষের মাঝেও এমন বিষ-নির্বিষ চেনার সহজ উপায় থাকতো! তাহলে বোধহয় বিষধর মানুষগুলো থেকে আগেই সতর্ক হয়ে যেতে পারতো। আফসোস! সাপের মতো মানুষের চামড়া দেখে তার নিষ্ঠুরতা বোঝা যায় না। সেটা লুকিয়ে থাকে ভালো মানুষের থেকে নকল করা কিছু নিপুণ ব্যবহারের আড়ালে।

পালি মায়ের আঁচলে টান দিল। করবী পেছন ফিরে দেখল পালি দুইহাতে অনেকগুলো কচু আগলে দাঁড়িয়ে আছে।
“আমাগো উঠানের কচু তো খাওয়া যাবে না। তাই খুদিবুর বাড়ির পেছন থেকে তুলে আনছি। জলদি রান্ধা চড়াও। এতবেলা না খেয়ে থাকলে বাবুর কষ্ট হবে।”

করবী সন্তুষ্ট মনে মেয়ের দিকে তাকায়। সকালে নামমাত্র শুকনো মুড়ি খেয়েছিল পালি। সেই অর্থে পালিও না খেয়ে আছে। তবুও অভিযোগ না করে মায়ের কথা, বাচ্চার কথা ভাবছে। করবী পালিকে একহাতে জড়িয়ে বাড়ি যেতে যেতে বলল,
“দুয়েকটা দিন সহ্য কর মা। এই কষ্ট থাকবে না।”
“আব্বা আসবে?”
“উহু, তুই যাবি। মামাবাড়ি।”
“সেখানে কি কষ্ট নেই?”
পালির সরল প্রশ্নে করবী থমকে গেল। উত্তর দিতে পারল না। কিছু উত্তর হয়তো প্রকৃতিই দেবে।

চলবে…
(কপি নিষেধ)