বেলির কথা পর্ব-১০

0
361

#বেলির_কথা (১০)

_______________
“Time and tide wait for none.”
(সময় ও স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না।)

সময় আপন গতিতে চলে যায়।শুধুমাত্র থেকে যায় স্মৃতিগুলো।কেউ ভুলে যায় কেউ আবার যুগের পর যুগ মনে রাখে।

বেলি আগের চেয়ে স্বাভাবিক হয়েছে।তবে মায়ের জন্য বুকটা হাহাকারে ভরে থাকে।ঘুমানোর সময় বিছানার পাশে মাকে খুঁজতে থাকে।তবে আগের মতো কাঁদেনা।কিছুদিন হলো পুরানো ঘর ছেড়ে পাকা ঘরে এসেছে।যে ঘরের স্বপ্ন মা দেখতো সে ঘরে থাকার সৌভাগ্য তার হয়নি।পুরানো ঘরটা ভাঙ্গা হয়নি।ওখানে মায়ের গন্ধ পাওয়া যায় তাই।মন খারাপের সময় বেলি মায়ের বিছানায় বসে থাকে।

সেদিন শাহেদ ছাতা নিয়ে এসেছিল বেলির জন্য।বেলিকে বসে থাকতে দেখে বলে,
‘থাপ্পড় খাবি নাকি?বাড়ি যাবি না?’

বেলি উঠে দাঁড়ায়।সেদিন বেলির আবারো জ্বর এসেছিলো।মা মা করেছিলো।তবুও মা আসেনি।শাহেদ সারারাত বোনের পাশে বসেছিল।
.
তারপর বেলি আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়।দেখতে দেখতে এইচএসসি পরীক্ষা ও শেষ।সীমা,রিয়া,প্রিয়া সবার ই বিয়ে হয়ে গেছে।রামিম আগে যেমন শহরে থাকতো ভার্সিটি পড়ার জন্য আবারো শহরে চলে গেছে।রামিমের বাবা তার বন্ধুর মেয়ের সাথে ঘরোয়াভাবে বিয়ে দিয়েছে।রামিমের জব হলে তারপর ধুমধাম করে বিয়ে করিয়ে ঘরে বউ তুলবে।সবাই যে যার মতো ভাল আছে।

শাহেদ বেলিকে ভার্সিটি ভর্তি করায়।বেলি দু তিনটা টিউশনি করে।গ্রামের বাচ্চাদের পড়ায়।
.
গল্প পড়তে বেলির খুব পছন্দ।সাথে কল্পনায় গল্পের মানুষদের ভাবতে ও বেলির পছন্দ।অতিরিক্ত মন খারাপে কল্পনা তার মন ভাল করে।

বেলি বসে বসে কি যেন ভাবছিল তখন গ্রামের এক মহিলা এসে বলে,
‘শাহেদ বাড়ি আছে?’

বেলি তখনো ভাবনাতে তাই মহিলার কথা খেয়াল করেনি।মহিলা বেলির দিকে তাকিয়ে বলে,
‘মেয়েতো বড় বেয়াদব হচ্ছে।’

বেলি চমকে যায়।মহিলাকে সালাম দেয়।
‘জ্বি বলুন চাচি?’
‘মন কোথায় থাকে?’
‘এইতো পড়ায়।’
‘এতো পড়ে কি আর হবে,সেই চুলায় ত যায়তে হবে।’

বেলি চুপ করে থাকে।
‘যেজন্য আসছিলাম।তোমার ভাই নাই ঘরে?’
‘নাহ।’
‘আসলে আমার সাথে দেখা করতে বলো?
‘আমাকে বলা যাবে?’
‘বলতেই পারি।আমার কাছে একজন ভালা পাত্রীর সন্ধান আছে?মেয়ে সুন্দরী খুব।তোমার ভাই ও সুন্দর ভাল মানাবে।’

বেলি বলে,
‘আমার ভাই কি কি করে সেসব বলছেন?ভাই ত এখন লোকদের দিয়ে চাষ করায়,আর অনেক জমি তে ধান চাষ করে।আগের চেয়ে অনেক ভাল ইনকাম হয়।’
‘আরে বলছি ওরা মেয়ে দিতে রাজি।তোমরা রাজি থাকলে সব ঠিকঠাক হবে।এক বাপের এক মেয়ে,ভাইবোন নাই।’
‘আচ্ছা আমি ভাই আসলে বলবো।

মহিলাটি চলে যায়।শাহেদ বাসায় আসলে বেলি মহিলাটির সাথে দেখা করতে বলে।বিকেলের দিকে শাহেদ মহিলাটির বাড়ি যায়।বেলিদের বাড়ির পাশের মহিলাটির বাড়ি।

মহিলা শাহেদকে সব বুঝিয়ে বলে,
‘আমার বোন পছন্দ করলে আমার কোনো আপত্তি নেই।’


পরেরদিন বেলি সহ শাহেদ আর মহিলাটি সহ অভিভাবক হিসেবে যায়।এই গ্রামে শাহেদ দের আর কেউ ই আপন নেই।বাবার পক্ষের ও কেউ বেচে নেই।নানার পক্ষের ও তেমন কেউ নেই যে তাদের দেখবে।তাই দুইভাইবোন ই যাচ্ছে।
.
পাত্রীর বাবা মা বেলিদের অনেক আদর- সমাদর করেন।পাত্রীকে নিয়ে আসা হয়।পাত্রী সত্যি ই খুব ই সুন্দর।গোলগাল মুখ,লম্বা ও না বেটে ও না।মোটা ও না আবার চিকন ও না।একদম পারফেক্ট।সবচেয়ে বড় কথা কণ্ঠস্বর টা অনেক সুন্দর। প্রথম দেখায় বেলির পছন্দ হয়।বেলি জিজ্ঞেস করে,
‘নাম কি আপুর?’

মেয়েটি জবাবে বলে,
‘মিতা।সবাই মিতু বলেই ডাকে।’
‘আচ্ছা।’

বেলি ভাইয়ের মত জানতে চায়।কেমন লেগেছে তার?
শাহেদ বলে,
‘তোর ভাল লাগলে আমার বলার কিছুই নাই।’

বেলিদের পছন্দ হয়েছে বলে জানায়।
.
.
পরের সপ্তাহে এ শাহেদের বিয়ে হয়ে হয়।গ্রামের সবাইকে দাওয়ায় দেয়।প্রতিবেশিরা বেলিদের অনেক সাহায্য করেছে।রামিমের বাবা মা ও উপস্থিত ছিলেন বিয়েতে।
.
বেলি মিতুর হাত ধরে ঘরে ডুকায়।যে কাজ তার মা করতো সে কাজ বেলি করে।তারপর শাহেদের রুমে বসিয়ে দেয়।

বেলি বলে,
‘আমি তোমাকে তুমি করেই বলবো কেমন?আচ্ছা তুমি আমার বড় নাকি ছোট?’

মিতু বলে,
‘বড় হবো।তবুও সমস্যা নেই।’
‘আচ্ছা।’
‘কিন্তু আমি তুই করেই বলবো, রাগ করবে?’

বেলি হেসে বলে,
‘আরেহ না।আরো ভাল হবে।’

মিতুর সাথে কথা বলে বুঝেছে সে ভারি মিশুক প্রকৃতির।অল্পতে বেলির সাথে ভাব জমেছে।শাহেদ ঘরে এসে দুজনকে হাসতে দেখে সস্থি পায়।বেলি অনেকদিন পর এভাবে হাসলো।একজন কথা বলার সঙ্গি পেলো।

শাহেদ আসলেই বেলি চলে যায়।

মিতু শাহেদকে সালাম করে।শাহেদ বলে,
‘আলমারি তে তোমার অনেক কাপড় রাখা আছে।শাড়িতে অভ্যস্থ না হলে ত্রিপিস পড়তে পারো।’

শাহেদ আবারো বলে,
‘আমি তোমাকে কিছু কথা বলতে চাই?’
‘বলুন?’
‘আমার একমাত্র বোন বেলি।আজ থেকে তুমি ও ওকে বোন ভাববে।’
‘আমি তো ওকে বোন ই ভেবেছি।’

মিতুর দিকে তাকিয়ে শাহেদ সস্থি পায়।

.

ভোরে বেলি নামাজ পড়তে উঠে।নামাজ পড়ে বেলি আবার ঘুম দেয়।মিতু আর ঘুমায় না।সকালের নাস্তা বানায়।
তারপর বেলিকে ডাকতে যায়।
‘বেলি উঠ?’

বেলি ঘুম ঘুম কন্ঠে বলে,
‘আম্মা আরেকটু ঘুমায়?’

বেলির বয়স অনুযায়ী মনেই হয়না সে বড় হয়েছে।এখনো কেমন যেন বোকা স্বভাবের মেয়ে।ভাবিকে মা বলে ফেলছে?মিতু এসব ভাবল মনে মনে।

‘আমি আম্মা না,তোর ভাবি?’

বেলি চট করে চোখ খুলে।তারপর মনে পড়ে কাল ভাইয়ের বিয়ে হয়েছিল।
‘হায় হায় তুমি উঠে গেছো ঘুম থেকে?আমি যাই চা নিয়ে আসি?’

মিতু বেলির হাত ধরে বলে,
‘আমি সব বানিয়েছি,মুখ ধুয়ে খেতে আয়?’
‘তুমি সব কাজ জানো?’
‘হ্যা সব পারি।আমি তোর বড় না?’

বেলি মুখ ধুয়ে আসে।শাহেদ ও ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে খেতে বসে।মিতু নুডলস করেছে।
‘ভাবি তুমি দেখছি রান্নাঘর থেকে সব খুঁজে ও পেয়ে গেছো।আমি তো কিছুই খুঁজে পাইনা।আম্মা থাকার সময় ও কিছু একটা খুঁজে আনতে বললে আমি খুঁজেই পেতাম না।’

মিতু হাসে।
‘আম্মা এখন..!

বেলির আবার মনে পড়ে আম্মা নেই।চোখ ছলছল করে উঠে।মিতু কথা পালটে বলে।
‘আচ্ছা বেলি কি খেতে ভালবাসিস?’

বেলি আস্তে করে বলে,
‘মায়ের হাতের সব খাবার ই আমার পছন্দ।’
‘আচ্ছা এগুলা রান্না করেছি মজা হয়নি?’
‘হয়েছে তো।’

সবার খাওয়া শেষে শাহেদ বাইরে চলে যায়।আর
বেলি চুল এলোমেলো করে রেখে বারান্দায় চুপচাপ বসে আনমনে ভাবে।

উঠানে হাল্কা কাদা আছে,মাটির উঠান।রাতে হয়ত হাল্কা বৃষ্টি এসেছিল।এরকম কাদা মাটিতে কেউ পড়লে বেলির এত হাসি পায় বলার মতো না।একবার মায়ের সামনে সে দৌড়ে আসতে পড়ে গেছিল।নিজে পড়ে নিজেই হেসেছিল সেদিন।আম্মার সে কি ভয় কোথাও ব্যথা পেল কিনা।বেলি অস্ফুট স্বরে বলে,

‘অথচ আমাকে নিয়ে এত যার ব্যথা,
কেমন করে কবর দেশেতে ঘুমিয়ে রয়েছে একা।’

বেলি দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

মিতু নিজের রুমে গিয়ে চিরুনি আর তেল নিয়ে আসে,আর বেলির পাশে বসে।

বেলি মিতুর হাতে এসব দেখে বলে,
‘এসব কেন?’
‘ তোর মাথা দেখে ত মনে হচ্ছে ভাল করে চুল আছড়াস ও না।’
‘ভাল লাগেনা।এমন থাকতে ই ভাল লাগে।’
‘তাই নাকি,অগোছালো আর অপরিষ্কার চুলে উকুন হয় যে জানিস?’
‘হ্যা।’
‘তোর ও হবে।’
‘তো?’
‘তারপর এগুলা ভেজে দুইভাইবোনকে খাওয়াবো।’
‘ইয়াক্ক ভাবি?কি সব বলো?’
‘তাহলে মাথা আছড়ে নে?’
‘তুমি বেধে দাওনা চুল?’

মিতু বেলির মাথা আছড়ে সুন্দর করে বিনুনি করে দেয়।হঠাৎ তাদের সামনে আম গাছ থেকে টুস করে আম পড়লো একটা।

মিতু সেটা দেখে বেলির হাতে চিরুনি দিয়ে বলে,
‘এই আম পড়েছে।আমি যাই নিয়ে আসি?’

বেলি হাসে।মিতু শাড়ির কুচি ধরে দৌড় দেয়,
‘তুমি তো দেখি বাচ্চাদের মতো করছো?’
‘বাপের বাড়ি এমন ছিলাম,স্বভাব পাল্টাতে সময় লাগবে বুঝলি?’

মিতু আম নিয়ে দৌড়ে আসতে ই ধুম্মম্ম,পা পিছলে কাদায় পড়ে বসে রয়েছে।

এদিকে মিতুকে এভাবে পড়তে দেখে বেলি হাসতে হাসতে শেষ।মিতু ও হেসে ফেলে।

চলবে…

(ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখা উচিৎ)

#তাহরীমা,