বেলির কথা পর্ব-২৭

0
220

#বেলির_কথা (২৭)

বেলিকে নামতে দেখে হাবিবা ও নেমে যায়।লোকটি বেহুশ হয়ে গেলে সবাই ধরাধরি করে একটা বেঞ্চে শুয়ে রাখে।

হঠাৎ এক বৃদ্ধ ব্যক্তি ছুটে আসে, কেদে উঠে।আর বলে,
‘বাপজান তোর হইলো কি?অ বাপ কথা ক?’

বেলি থেমে দাঁড়িয়ে থাকে।আশেপাশে মানুষ গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।মানুষের ফাঁকে বেলি লোকটির মুখ দেখার চেষ্টা করে।তারপর বেলি চিৎকার করে হাবিবাকে ডাকে,
‘আপু! আমার উনি।’

বেলি ভীড় টেলে ছুটে যায়।
‘আপনি আপনি বেচে আছেন?কি হলো কথা বলুন?’

হাবিবা,তার বর হাসিব সবাই ছুটে আসে।হাবিবা বলে উঠে,
‘ভাইয়া।আমার ভাইয়া বেচে আছে?’

হাবিবার বর ট্যুর কেন্সেল করে হাসিবকে ধরে লোকটিকে হসপিটালে নিয়ে যায়।সাথে দুজন বৃদ্ধ পুরুষ মহিলা ও আসে।মহিলা মুখ চেপে কাঁদছে।
বেলি হাসনাতের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।চোখে যে তার প্রচুর তৃষ্ণা।

হাবিবা বৃদ্ধ লোকটিকে শান্তনার স্বরে বলে,
‘কাঁদছেন কেন?ভাল হয়ে যাবে আমার ভাই।’
‘ও আমার পুলা,কারো ভাই ডাই না।’

হাবিবা এমন কথায় অবাক হয়।তবুও বলে,
‘আচ্ছা।আপনার ই ছেলে,কিন্তু আমার ভাই।’

হাবিবা সব খুলে বলে কিভাবে কি হলো।তখন লোকটি কেঁদে দেয়।
‘হ অই তোর ভাই ই।’
‘ভাইয়াকে আপনারা কিভাবে পেয়েছেন?’
‘আমরা গরীব মানুষ।নদীর থিকা মাছ ধইরা,কাঠ বেইচ্ছ্যা সংসার চালায়।হেয়দিন নদীত মাছ ধইরতে গেছিলাম।পাড়ে দেইখলাম কি, একডা লা*শ।কাছে গিয়া দেহি আবার বাইচ্চা আছে।ধরাধরি কইরা হসপিডালে নিয়ে আইছিলাম।অনেক পানি খাইছিল পুলাডা।একদিন হর হুশ আইয়্যে।কাউরে চিনতে হারে ন,কিছু কইতে ও হারে ন।শুধু কয় আর বেলিফুলের মালা।তারপর থিকা ওরে আমাগো বাড়িতে রাখছি।ওর বয়সী আমার একডা পুলা আছিলো,গাছ থিকা পইরা ম*রে গেছিল।এই পুলারে পাইয়া ওর শোক ভুইলা গেছিলাম।আইজকা মাছ বেইচানোর(বিক্রি) লাইজ্ঞা এহানে পাঠায়ছিলাম।কি যে অইলো?’

বৃদ্ধ লোকটি আবারো কেঁদে উঠেন।পাশে উনার স্ত্রী ও মুখ চেপে কাদেন।হাবিবা লোকটিকে শান্তনা দেয়।তারপর বেলির কাছে যায়।বেলি তখনো হাসনাতের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।পাশে হেনা বসে কাঁদছে।

হাবিবা গিয়ে বলে,
‘বেলি?’
‘আপু উনাকে চোখ খুলতে বলো?’
‘তুমি সাদা শাড়ি চেঞ্জ করে ফেলো।ভাইয়া এ শাড়িতে দেখে অনেক কষ্ট পাবে।’
.
বেলি একবার হাসনাতের দিকে তাকিয়ে ড্রাইভার আংকেলকে নিয়ে বাসার উদ্দেশ্য রওনা দেয়।গিয়ে বোরকা নিকাব খুলে ওযু করে জায়নামাজে দাঁড়িয়ে যায়। শুকরিয়া আদায় করতে সিজদায় পড়ে যায় বেলি।বেলি হু হু করে কেঁদে উঠে।
.
অনেকক্ষণ পর হাসনাতের হুশ হয়।চোখ মেলে প্রথমে হেনাকে দেখতে পায়।দেখার সাথে সাথেই বলে,
‘হেনা মামনি আমার?’

হেনা ঝাপটে জড়িয়ে হু হু করে কেঁদে উঠে।
‘বাবাই তুমি আমায় ফেলে কোথায় চলে গেছিলে?তুমি খুব ই পচা।’

হাসনাত মেয়েকে বুকে নিয়ে সবকিছু মনে করার চেষ্টা করে। হাবিবার চোখে ও জল।

হাবিবা বলে,
‘কতটা বছর পর আবার আমাদের দেখা হলো।কখনো ই কল্পণা করিনি এমন টা হবে।’

হাসনাত বলে,
‘বেলিফুল কই আমার?’
‘সে বলেছে তুমি বেলিফুলের মালা না নিয়ে গেলে সে কথা বলবেনা।’
‘এখনো বাচ্চামি রেখে দিয়েছে?’

হাবিবা কান্নারত চোখে আবার হেসে ফেলে।তারপর বলে,
‘সেদিন কি হয়েছিল ভাইয়া কিছু মনে পড়ে?’

হাসনাত বলে,
‘সিহাবদের গাড়ি থামিয়ে দোকান থেকে বেলিফুলের মালা নিলাম।তারপর বেলি কল করলো সেটা বললাম ও।তারপর গাড়িটা সমস্যা করতেছিল।ড্রাইভার নেমে ঠিক ও করলো।তারপর যখন আমরা ব্রিজ এ উঠলাম গাড়ি আবারো সমস্যা দিচ্ছিল।তারপর বুঝলাম গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে।আমি সামনের সিটে বসেছিলাম।গাড়িটি প্রথমে গাছের সাথে গিয়ে ধাক্কা খায়,আমার কপালে আঘাত লাগে, হাত থেকে মালাটি বাইরে পড়ে যায়,আমি দরজা খুলে মালাটি দেখতে গিয়ে ছিটকে নদীতে পড়ে গেলাম।তারপর আর কিছুই মনে নেই।আজকে গাড়ির সংঘর্ষ দেখে আমার সব মনে পড়ে,তাই আমি মালাটা খুঁজছিলাম।’

হাবিবা বলে,
‘সেদিন সিহাব ভাইদের গাড়িটা আ*গু*ন লাগে,তারা কেউ ই বের হতে পারেনি।’

হাসনাত এটা শুনে খুবই দুঃখ প্রকাশ করে।বৃদ্ধ পুরুষ মহিলা ছুটে আসে।
‘তুই ভালা অই গেছস?আয় ঘরে চল?’

হাসনাত অনেকক্ষণ চুপ থাকে।তারপর কি মনে করে বলে,
‘ঘরে যাব।আমার নিজের ঘরে,সাথে তোমাদের ও নিয়ে যাব,আমার রাজপ্রাসাদ এ আমরা সবাই থাকবো।আল্লাহ আমাকে আবার দুজন বাবা মা দিয়েছেন।’
‘নাহ আমাগো ছোড ঘর ই ভালা।বড় ঘরে যামু না।’
‘তোমাদের বউমাকে ও দেখবে না?যে বেলিফুলকে ভালবেসে আমি ধন্য,তাকে দেখবে না?’

বৃদ্ধলোকটি মাথা নাড়ায় দেখবে।হাবিবা বলে,
‘শুধু আমার ভাইয়ার বাবা হলে চলবে না।আমার ও হতে হবে।’

সবাই হেসে ফেলে।সবাইকে নিয়ে হাবিবা বাসার উদ্দেশ্য রওনা দেয়।
____
হাসনাত বেলিফুল হাতে নিয়ে নিজের রুমে যায়।আগের চেয়ে চুল অনেক বড় হয়ে গেছে হাসনাতের।একটা গেঞ্জি আর লুঙ্গি পড়েছে।

বেলি কালো শাড়ি পড়ে জানালার দিকে তাকিয়ে আছে।চোখে অনবরত জল পড়ছে।খুশির জল।হাসনাত ফুলটা এগিয়ে নিয়ে বলে,
‘রাগ অভিমান ঝেড়ে,বলো না দুটো কথা,
এসেছি তোমার ভালবাসা,নিয়ে ফুলের মালা।’

বেলি বলে,
‘খোপায় পড়িয়ে দিন।’

হাসনাত হেসে খোপায় পড়িয়ে দেয়।বেলি ফিরে তাকায়।হাসনাতকে দেখে ঝাপটে জড়িয়ে ধরে।আর হু হু করে কেঁদে উঠে।তারপর বলে,
‘আমার রাগ অভিমান কিছুই নেই।শুধু চাই আপনি থেকে যান।’
‘কাঁদছ কেন?কান্না দেখার জন্য ই ফিরে এসেছি?’

বেলি তবুও কাদে।কেঁদে কেঁদে হাসনাতের গেঞ্জি ভেজায়।
‘দিলে তো গেঞ্জি ভিজিয়ে?’

বেলি হাসনাতকে ছেড়ে দেয়।এতক্ষণ এ তার পোশাক খেয়াল করেছে।বেলি মুহুর্তেই হেসে ফেলে।
‘আপনাকে কেমন দেখাচ্ছে বলুন ত?’
‘কেমন?’
‘কেমন যেন?আগে কখনো এমন পোশাকে দেখিনি তো?’
‘আমি আগে জীবনে ও এমন পোশাক পড়িনি।এখন বাবা যেমন পড়িয়েছে আরকি।’
‘কে বাবা?’

হাসনাত বেলির হাত ধরে বৃদ্ধ লোকটির সামনে নিয়ে যায়।তারপর বলে,
‘এই দেখো আমার ফুলটা।যে ফুলের প্রেমে পড়ে আমি ধন্য।’

বেলি দুজনকেই সালাম করে।বেলিকে দেখে বৃদ্ধ বলে,
‘তুই ত অনেক সুন্দর দেহি।এজন্য আমার পুলা পাগল হয়ছে।’

বেলি হেসে বলে,
‘আপনারা যেহেতু উনাকে ছেলে বলেছেন,তাহলে এখন থেকে এখানেই থাকবেন।আমি আর কোনো কথা শুনতে চাইনা।’
‘না আমাগো ছোড ঘর টায় আপন লাগে।শেষবয়সে ওহানে থাকবার চায়।’

বেলি তখন মন খারাপ নিয়ে বলে,
‘আচ্ছা তাহলে আপনি কথা দেন আর কাজ করবেন না।আপনাদের ভরণপোষণ এর সব টাকা আপনাদের ছেলে ই দিবে।আর আমরা কিন্তু বেড়াতে ও যাব মাঝেমাঝে।তাড়াতে পারবেন না কিন্তু।’

বৃদ্ধমহিলা এসে বলে,
‘এনে তুই কি কস।তুই আমাগো মাইয়ার মতো।তুই একশবার আইবি।’

সবাই খুশি হয়।বেলি সবার জন্য রান্না করে।বৃদ্ধ আর উনার বউ একদিন থেকে চলে যান।এদিকে হাবিবা শাহেদকে সব খুলে বলে।তারা এটা শুনে আর গ্রামে থাকতে পারেনা।হাসনাত কে দেখার জন্য ছুটে চলে আসে।
.
হাসনাত শহিদ আর মিরাকে খুব আদর করে।হাসনাত সবাইকে দেখে বলে,
‘মনে হচ্ছে এইতো কয়েকদিন।অথচ সবাই কত বড় হয়ে গেছে।’

মিরা তখন বেলির দিকে তাকিয়ে বলে,
‘জানো ফুফি আমি পাচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি,কোরআন শরীফ পড়ে দাদুমনির জন্য দোয়া করি যাতে আল্লাহ ভাল রাখেন।আমি অনেক বড় হয়ে গেছি না ফুফি?’

বেলি হেসে বলে,
‘হ্যা অনেক বড় হয়ে গেছে আমার আম্মা।’

মিতু বলে,
‘ছোট থেকে নামাজের অভ্যাস না করালে বড় হয়ে আর পড়তে চায়না।তাই আমি শহিদ আর মিরাকে ছোট থেকেয় পড়াচ্ছি।’

বেলি হেনার দিকে তাকায়,হেনা বুঝতে পেরে বলে,
‘আমি ও এখন থেকে নিয়মিত নামাজ পড়বো মাম্মাম।তোমার কথা শুনবো।’

হাসিব সেটা দেখে বলে,
‘তুই এতদিন নামাজ পড়তি না।ছে ছেহ।’

হাবিবা তখন ছেলেকে বকে।
‘হয়েছে আর বলতে হবেনা।নিজে যেন পাচওয়াক্ত পড়ে।সকালের নামাজ টা ঘুমের মধ্যে যায় গা।’

হাসিব লজ্জা পেয়ে যায়।শহিদ ই একমাত্র মুচকি হাসে।কারণ সবার চেয়ে সে এগিয়ে,নামাজ ও পড়ে, কোরআন ও পড়ে।
__________

হেনা কলেজ শেষ করে বের হতেই হঠাৎ রাফির সাথে দেখা।রাফি এগিয়ে এসে বলে,
‘কি ব্যপার?তুমি কলেজে আসো না একেবারে হাওয়া।আমাদের কি কথা ছিল ভুলে গেলে?’

হেনা ঢোক গিলে মিথ্যা বলে,
‘সেদিন মাম্মামের অসুস্থ লাগায় আর যাইনি।বাসায় ফিরে গেছিলাম।’
‘অহ আচ্ছা।আজ চলো তাহলে?’
‘আজ?কাপড় চোপড় কিছুই আনি নাই।’
‘লাগবেনা কাপড়।আগে বিয়ে করতে হবে আমাদের।এটাই ফাইনাল দেরি হয়ে যাচ্ছে চলো?’

হেনা খুব ভয় পেয়ে যায়।রাফি বলে,
‘তুমি ভয় পাচ্ছো নাকি?’
‘নাহ।’

রাফি হেনার হাত ধরে।তারপর বলে,
‘আমি গাড়ি রেডি করে রেখেছি।যাব বিয়ে করবো তারপর তুমি হয়ে যাবে আমার।তোমার অই খারাপ মাম্মাম আর আমাদের আলাদা করতে পারবে না।’

চলবে…

(ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখা উচিৎ)

#তাহরীমা