বেলির কথা পর্ব-২০

0
285

#বেলির_কথা (২০)

মিতু শাহেদ হাবিবার বর সবাই বেলিকে দেখতে আসে।কিন্তু কথা বলেনা কেউ।
বেলি কিছুক্ষণ হাসনাতের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়।হাসনাত মাথা নিচু করেই বসে রয়েছে আর বেলির দিকে তাকায় না।বেলি হাবিবার দিকে তাকিয়ে বলে,
‘আপু তুমি বলো?’

হাবিবা চুপ করে আছে।বেলি মিতুর দিকে তাকায়,
‘ভাবি সবাই এমন হয়ে আছে কেন?আমার বাচ্চা আরেকটা কে এনে দিচ্ছে না কেন?’

মিতু বলে,
‘তুই শান্ত হয়ে বস আগে।মেয়েকে আদর কর না?’
‘কিন্তু আমার সন্তান আরেকটা কোথায়?’

হাসনাত বেলির মাথায় হাত বুলায়।চোখের কোণায় পানি।তবুও সে বলে,
‘আমাদের সন্তান আরেকটা আল্লাহর কাছে রেখে এসেছি।’

বেলি যেন কথাটা শুনতে পায়নি।
‘বেলি কি বলেছি শুনেছো?’
‘মিথ্যা বলছেন।আমার বাচ্চাকে এনে দিন?’
‘বাচ্চামো করো না এটাই সত্যি ই।’

বেলি ডাক্তার কে ডাক দেয়।ডাক্তার এগিয়ে এসে সব শেয়ার করে।বেলি তখন হু হু করে কেঁদে উঠে।হাসনাত বেলিকে জড়িয়ে নিয়ে বলে,
‘কেদোনা।জান্নাতে তার সাথে আমাদের দেখা হবে ইন শা আল্লাহ।’

বেলি এটা শুনে চুপ হয়ে যায়।কিন্তু ভিতরের কলিজা মনে হয় ফেটে ই যাচ্ছে।একজন মা ই জানে এমন কষ্টের কথা।কিন্তু সেই জান্নাত,সেই সন্তানের হাত ধরে হাটার লোভ বেলি ছাড়তে পারেনা।নিঃশব্দে কাদে বেলি।

.
তিনদিন পর বেলিকে বাসায় নিয়ে আসা হয়।
ছেলের শোক ভুলতে পারেনা বেলি।সবসময় চোখ ছলছল হয়ে আসে।বাসায় এসে আরেক দফা কাদে।চারদিকে দুইটা করে করে সব কিছু গুছিয়ে রাখা হয়েছিল।
হাসনাত বেলিকে অনেক কষ্টে সামলায় সান্তনা দেয়।কিন্তু ও নিজেই ত সান্তনা পায়না।

.
শাহেদের ছেলের নাম ছিল শহিদ।হাবিবার ছেলের নাম হাসিব।
হাসনাত বেলির মেয়ের নাম রাখা হয় হাসনাহেনা সংক্ষেপে সবাই হেনা বলেই ডাকবে।
বেলি হাসনাতের হাত ধরে বলে,
‘আমার ছেলের জন্য যা যা কেনা হয়েছিল আপনি অনাথদের সব দিয়ে আসবেন।ওর এসব দেখলে আমার সহ্য হয়না।’

হাসনাত চুপ করে থাকে।
.
হেনা খুব কাঁদুনি স্বভাবের।বেশিরভাগ সময় ই সে কান্না করে।মিতুরা কয়েকদিন থেকে গ্রামে চলে যায়।কিভাবে বাচ্চার যত্ন নিতে হবে বেলিকে সব শিখিয়ে দিয়ে যায়।

এরই মাঝে বেলির পরীক্ষা গনিয়ে আসে।বাচ্চা সামলিয়ে পড়তে হয়।বেলি পড়লে হাসনাত মেয়েকে নিয়ে বসে থাকে।পড়া হয়ে গেলে হাসনাত বেলিকে দিয়ে দেয়।
প্রতিদিন এমন নিয়ম পালন করে হাসনাত।বেলি তখন বলে,
‘আপনি ঘুমান।আপনার না কলেজ আছে।’
‘তোমার ও ত পরীক্ষা।তুমি না ঘুমিয়ে কাল পরীক্ষা ঠিকভাবে দিতে পারবে?’
‘আমি পারবো।মেয়েরা সব মানিয়ে নিতে পারে।’
‘এইতো কদিন আগেও বাচ্চা ছিলে।অথচ এখন কথাগুলো কেমন বলো?আমার তোমাকে বাচ্চা বাচ্চা দেখতেই ভাল লাগে।’

বেলি হাসার চেষ্টা করে।রাত গভীর হলেই বাচ্চাটার কথা মনে পড়ে।হেনাকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে রাখে।তবে হেনা রাতে ভালই ঘুমায়।এদিক থেকে বেলিকে তেমন রাত জাগতে হয়না।

.
বেলির পরীক্ষা চলাকালীন হেনাকে হাবিবায় দেখাশোনা করে।সবার সহযোগীতায় বেলি পড়ালেখায় এগিয়ে যায়।
.
হেনা দেখতে দেখতে একবছর পার করে।হাসনাত কলেজ থেকে ফিরে হেনার সাথেই খেলা করে।আজ হাসনাত কলেজ থেকে আগেই ফিরেছিল।রুমের দরজার সামনে দেখে বেলি বিছানায় বসে আছে।পাশে হেনাকে বসিয়ে ভাত খাওয়ানোর চেষ্টা করছে।

হাসনাত নিঃশব্দে দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়ায়।বেলি টের ই পায়নি যে হাসনাত এসেছে।বেলি মেইন দরজা লক করেই রুমে থাকে।একটা চাবি বেলির কাছে থাকে একটা হাসনাতের।নিরাপত্তার জন্য ই এমনটা করা হয়েছে।হাসনাত নিজের থাকা চাবিটা দিয়ে খুলেই এসেছে বলে, তাই বেলি টের পায়নি।

বেলি হেনাকে বলছে,
‘খা না মা।প্লিজ মাম্মামকে আর জ্বালাইস না।’

হেনা গাল অব্ব করে বলে,
‘কবিতা বলো।’
‘প্রতিদিন তোরে কবিতা শুনাতে শুনাতে আমি শ্যাষ।’

হেনা হাসে।
‘বাপের মতো খালি হি হি করে হাসতে পারে।আমাকে জ্বালাতে খুব মজা?’

হেনা বেলির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
‘প্লিজ খাওনা আমার ভাল মা যে না?’
‘কবিতা বলো?’

হাসনাত একবার ভাবল বেলির সামনে যাবে আবার ভাবলো কি কবিতা বলে শুনি একটু।

বেলি হেনার দিকে তাকিয়ে বলে,
‘হা করো বলছি আমি।’

হেনা হা করে এক লোকমা মুখে নিলো।বেলি কি যেন ভেবে বলে,
‘অই দেখা যায় আকাশ,আশেপাশে বাতাস।
আমরা গ্রামে থাকিনা,ভাত খায়না হেনা।’

হেনা হাত তালি দিলো।খুশি হয়ে আরেকটা মুখে নিলো।এদিকে হাসনাত হাসতে হাসতে শেষ।অনেক চেয়েছিল নিঃশব্দে হাসতে।কিন্তু হাসনাত পারেনা।হু হু করে হেসে উঠে।হঠাৎ হাসির আওয়াজ শুনে বেলি চমকিয়ে তাকায়।

হেনা খুশি হয়ে বলে,
‘বাবাই এতেছে।’

বেলি বলে,
‘হাসলেন কেন?জানেন ওকে ভাত খাওয়ানো কত কষ্ট?’
‘তাই বলে তুমি উল্টাপাল্টা কবিতা বলবে?’
‘হ্যা বলবো তাতে কি?আপনি ত তাও বলতে পারেন না।’
‘হুহ আমার কবিতা শুনে স্কুলের বান্ধবীরা হা করে তাকায় থাকতো’

বান্ধবীদের কথা শুনলে বেলি রেগে যাবে হাসনাত জানে।কিন্তু বেলিকে রাগতে দেখতে হাসনাতের ভীষণ ভাল লাগে।
‘জানো আমার বান্ধবীরা কত..।’

বেলির ডান হাতে ভাত।বাম হাত খালি হওয়ায় সে হাত দিয়েই হাসনাতের চুল টেনে ধরে।
‘আরেকবার বলুন?’
‘এই ছাড়ো কি বাচ্চাদের মতো চুলে হাত দিয়ে দাও?আমার কত সাধের চুল।’
‘সব টেনে ছিঁড়ে ফেলবো।আগে বলুন আমার কবিতা সুন্দর।’
‘আচ্ছা যাও তুমি সুন্দর।’
‘নাহ কবিতা সুন্দর বলুন?’
‘আচ্ছা সুন্দর।’

বেলি ছেড়ে দেয়।হেনা কিছু না বুঝে বাবা মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে।হাসনাত মেয়েকে কোলে নেয়।
‘মামনি ভাত খেয়ে নাও?তোমার মাম্মামকে কষ্ট দিও না হ্যা?বাচ্চামানুষ তোমার মাম্মাম।’
‘আত্তা কসত দিব লা।’
‘এইতো আমার ভাল মেয়ে।বাবাইয়ের কথা সব শুনে।’

বেলি হুট করে বলে,
‘আমার কথা শুনতেই চায়না।’
‘ঠিক হয়ে যাবে বড় হতে হতে।’
‘জানিনা।তবে ওর এত জেদ।মাঝেমাঝে থামাতেই পারিনা।’
.
হাবিবা হাসনাতের এখানে বেড়াতে আসলে হেনা আর হাসিব মিলে খেলা করে।হাসিব আবার তেমন দুষ্টু না।তাই দুজনে মিলেমিশে খেলা করে তবে শাহেদের ছেলে ভীষণ দুষ্টু হেনার সাথে একদম ই খেলে না।ঝগড়া করে আর হেনাকে চুল টেনে দেয়।

তবে তিনপরিবার ই মোটামুটি বেশ সুখে আছে।

এভাবেই সময় চলে যায়।
(প্রথম অংশ শেষ)

___________
(দ্বিতীয় অংশ শুরু)

দশটা বছর কেটে যায়।বেলি এখন একজন শিক্ষিকা।অনার্স শেষ করে মাস্টার্স করেছে।তারপর হাসনাতের কলেজে জব নিয়েছে।হাসনাত আগের মতো ই আছে।বেলিকে প্রচুর ভালবাসে।তবে বেলির এখনো ছেলের জন্য মন খারাপ হয়।তবে কাউকে বুঝতে দেয়না।কিন্তু হাসনাত সব বুঝে বেলিকে আগলে রাখে, মানিয়ে নেয়।

হাসনাতের মতে,আল্লাহ মেয়ে দিয়েছেন এটাই শুকরিয়া।
বেলির ইচ্ছা হেনাকে মানুষ এর মতো মানুষ করাবে।
তবে হেনা যত বড় হচ্ছে যেমন বদরাগীতে পরিণত হচ্ছে।তেমনি অধর্য্য হয়ে উঠছে।

বেলি শিক্ষিকা হওয়ার পর প্রায় মায়ের কবরের কাছে যায়।এই স্বপ্ন টা যে মায়ের ছিল।বেলি মায়ের কবরের কাছে গিয়ে কাদে।কাঁদলে সে শান্তি পায়।হাসনাত ই বেলিকে নিয়ে যায়।সম্ভব হলে প্রত্যেক মাসেই বেলি মায়ের কবরের সামনে দাঁড়ায়।মা তো মা ই।মা কে যে ভুলা যায় না।
.
.
আজকে সকাল থেকে খুব করে মায়ের কথা মনে পড়ছে।আজকেও কবরের পাশে দাঁড়াতে খুব করে মন চায়ছে।বেলিদের আজ অফ ডে।হাসনাত নামাজ পড়েই ঘুমিয়েছিল কিন্তু বেলি ঘুমায় না।হাসনাতের পাশে বসে হাসনাতের চুলে বিলি কেটে দেয়।
হাসনাত জেগে যায়।দেখে বেলি পাশে বসে আছে।
‘ঘুম আসেনা?’
‘নাহ।’
‘মন খারাপ লাগছে।’
‘আম্মার কথা মনে পড়ছে।’
‘আচ্ছা আজকে গ্রামে যাব।’
.
হাসনাত ফ্রেশ হয়।বেলি হেনাকে ও রেডি করে দেয়।
হেনা প্রথমে চুপচাপ ছিল।কিন্তু গাড়িতে উঠার পর থেকেই সে বেলির দিকে তাকিয়ে বলে,
‘আমার গ্রাম ভাল লাগেনা।’
‘কেন?’
‘গ্রামে হেটেই যেতে হয়।আশেপাশে কাদা থাকে।গাড়ি থেকে নেমে হাটতে আমার ভাল ই লাগেনা।জাস্ট বিরক্তিকর।’

মেয়ের অমন কথায় বেলি অবাক হয়ে তাকায়।
গাড়ি হয়ত বাড়ি পর্যন্ত যায় না ঠিক। রাস্তা ছোট বলে গাড়ি এক পাশে রেখে,অল্প হেটে যেতে হয়।এরকম হাটতে বেলির কত ভাল লাগে।এই হাটাকে মেয়ে বিরক্তিকর বলে?এত অধর্য্য?

চলবে……

(ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখা উচিৎ)

#তাহরীমা