বেলির কথা পর্ব-২২

0
294

#বেলির_কথা (২২)

.
বেলি টেবিলে বসে কাঁদছে।মেয়েটাকে মা*রতে চায়না সে।কিন্তু মেয়েটা এত অগোছালো হয়ে যাচ্ছে।হাসনাত এসব দেখে বেলির হাত মুঠোয় ধরে বলে,
‘নিজেই মেয়েকে মে**রে নিজেই কাঁদছ?’
‘ব্যথাটা শুধু ও পায়নি,পেয়েছি আমি।’
‘ব্যথাটা তুমি পাওনি,পেয়েছি আমি।আমি সবসময় তোমার হাসি দেখতে চাই।তুমি কি ভুলে গেছো আল্লাহর কথা?এত অধর্য্য কেন হচ্ছো বলোতো?আল্লাহর কাছে চাও, তিনি নিশ্চয় পথ দেখাবেন।’

বেলি উঠে দাঁড়িয়ে হাসনাতের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে।আর বলে,
‘আমার কোনো দুঃখ নেই।আপনার এ হাত দুটো যতদিন আমায় আগলে রাখবে ততদিন আমি অসুখী হবো না।’

হাসনাত বেলিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।
.
.
রাতের দিকে হেনা ভাত খেতে চায়না।কেমন যেন কাঁপছে।বেলি জ্বর মেপে দেখে,তারপর হাসনাতের দিকে চমকে তাকায়।এত জ্বর!
বেলি হাসনাতকে বলে ডাক্তার ডাকতে।

হাসনাত নিজে ড্রাইভ করে ডাক্তার নিয়ে আসে।ডাক্তার ঔষধ লিখে দিয়ে চলে যায়।বেলি অনেক কষ্টে হেনাকে খাইয়ে ঔষধ খাইয়ে দেয়।কিন্তু কিছুক্ষণ পর ই সব বমি করে ফেলে দেয়।

ভয়ে বেলি ডুকরে কেদে উঠে।কেদে কেদে হাসনাতকে বলে,
‘আমার মেয়ের কি হয়ে গেলো?আপনি কিছু করুন?’
‘আল্লাহ ভরসা ঠিক হয়ে যাবে।’

বেলি হেনার গায়ের কাপড় খুলে সারাগায়ে ভেজা কাপড় দিয়ে মুছে দেয়।হেনা চোখ বন্ধ করে আছে।

বেলি হু হু করে কাদে।আর বলে,
‘মা কে কি একটু ও শান্তি দিবি না?তুই যে আমার কলিজা রে।তোর এমন পরিণতি আমার কলিজা ছিঁড়ে যায়।সুস্থ হয়ে যা প্লিস?’

বেলি অসহায় হয়ে হাসনাতের দিকে তাকায়।
‘জানেন আম্মা আমাকে নিয়ে এরকম ভয় পেত।আজ আমি আম্মার ভয় পাওয়ার কারণ বুঝতে পারছি।আম্মা ও সারারাত আমার জন্য বসে থাকতো কিন্তু আমি কখনো আম্মাকে সেভাবে সেবা করিনি, আগলে রাখিনি।তাই বুঝি আম্মা চলে গেছিলো?

হাসনাত বেলির পাশে বসে।
‘উল্টাপাল্টা চিন্তা করো না।’

বেলি দৌড়ে যায় ওযু করতে।তাহাজ্জুদ এর নামাজ পড়ে নেয়।তারপর কেঁদে কেঁদে আল্লাহকে বলে,
‘আমার মেয়ের অসুখ ভাল করে দাও আল্লাহ।ওর যদি কিছু হয়ে যায় আমি যে বাঁচব না।’

রাতের শেষের দিকে হেনার জ্বর কমে।হাসনাত ও তাহাজ্জুদ এর নামাজ শেষ করে ফজরের নামাজের জন্য অপেক্ষা করে।
.
.
ভোরের আলো ফুটে উঠলো।হাসনাত জানালা সব খুলে দিলো যাতে মৃদু বাতাস ঘরে ঢোকে।ভোরের হাওয়াটা হাসনাতের অনেক পছন্দের।হেনা ঘুমাচ্ছে।বেলি সারারাত আর ঘুমায় নি।বেলি হেনার কপালে চুমু একে রান্নাঘরের দিকে যায়।
.
তখন হাবিবা হাসনাত কে কল করে।রোজ কল করে হাবিবা, ভাই ভাবির খোজ নেয় আজ ও ব্যাতিক্রম নয়।
হাবিবা বলে,
‘ভাইয়া কেমন আছো?’
‘আলহামদুলিল্লাহ।তোরা কেমন আছিস?হাসিব কেমন আছে?কি করে?’
‘আছে ভালই সবাই।ওর সামনে এক্সাম ঘুম নাকি আসেনা তাই সকালে উঠেই পড়তে বসে গেছে।’
‘ভাল তো।’

হাসনাত হেনার অসুখের কথা বলে।হাবিবা চিন্তিত হয়ে বলে,
‘এখন কেমন আছে?’
‘এখন আগের চেয়ে ব্যাটার,ঘুমাচ্ছে।’
‘আমি আজকে দেখতে আসবো।’

হাসনাত কল রাখতেই ফোনে আবার কল আসে।হাসনাত দেখে নাম্বারটা তার বাবার বন্ধুর নাম্বার।

হাসনাত সালাম দেয়।তখন বাবার বন্ধু বলেন,
‘বউ বাচ্চা পেয়ে আমাদের একেবারে ভুলেই গেছো দেখছি।একটা সময় আমাদের কত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল।’

হাসনাত হাসে,
‘না আংকেল ভুলিনি।কেমন আছেন?’
‘আছি ভালই।তোমার বন্ধু দেশে ফিরতেছে।সে বলছে তোমাকে সহ যেতে,ইয়ারপোর্টে রিসিভ করতে।’
‘অহ হ্যা আংকেল আমাকে বলেছিল সিহাব।মেয়ের অসুখে বেলিকে ও এ কথা বলতে ভুলে গেছিলাম।’
‘আচ্ছা আজ বিকেলে আমরা যাচ্ছি তাহলে?এত বছর পর ও দেশে ফিরছে।’
‘হ্যা আংকেল এবার আসলে আর টাকা টাকা না করে একটা বিয়ে করিয়ে দিয়েন।’
‘তোমার বন্ধু বুঝিয়ে বলিও,দেখো?’

হাসনাত কল কেটে বেলির কাছে গিয়ে সব খুলে বলে।বেলি আগে থেকে সিহাব এর বাবা মা কে চিনে।ওদের বিয়ের পর আংকেল আন্টির সাথে কয়েকবার দেখা সাক্ষাৎ হয়।

বিয়ের পর থেকেই হাসনাতের মুখে ওর বাবার বন্ধুত্বের কথা শুনে মুগ্ধ হতো বেলি।কিন্তু সময়ের সাথে সাথে ব্যস্ততার ভীড়ে ভালবাসা চাপা পড়ে গিয়েছিল।আগে বেশি আসা-যাওয়া থাকলেও এখন তেমন নেই এই আরকি।
.
হাসনাত বিকেলে রওনা দিবে সেটা শুনে বেলি অবাক হয়ে বলে,
‘আজ ই যাবে?’
‘হ্যা আংকেলরা আমাদের বাসার সামনে গাড়ি নিয়ে আসবে।আর আজকে হাবিবা ও আসবে।’
‘আপু আসবে?তাহলে ত রান্নাবান্না বসাতে হবে।’
‘আমি কলেজ থেকে আমাদের দুজনের ছুটি নিয়ে নিচ্ছি।’
.
হেনা ঘুম থেকে উঠে বসে।

হাবিবা ছেলেকে নিয়ে চলে আসে ততক্ষন এ।হাবিবার একটায় ছেলে।হাসিব অনেক শান্ত আর ভদ্র।হাবিবা হেনার কাছে যায়।
‘এখন কেমন লাগছে আম্মু?’

হেনা শান্তস্বরে বলে,
‘ভাল ফুফু।’
.

বেলি হাবিবাদের নাস্তা পানি দেয়,তারপর কাজ করতে করতে তারা গল্প করে।তারপর তারা দুপুরের ভাত খেয়ে নেয়।

হাবিবা তখন হাসনাত থেকে জিজ্ঞেস করে,
‘ভাইয়া কোথাও বের হবে নাকি?’

হাসনাত তখন হাবিবাকে সিহাবের কথা বলে,
‘অহ আচ্ছা অবশেষে সিহাব ভাইয়া দেশে আসতেছে।আংকেলরা এখানে আসবেনা?’
‘হ্যা এখানে বেলি আর হেনাকে দেখে তারপর আমাকে সহ নিয়ে যাবে।’
__

কিছুক্ষণ পর সিহাবের বাবা মা তাদের গাড়ি নিয়েই আসে।বেলি সিহাবের বাবা মা কে সালাম করে।তারপর হাবিবা সালাম করে।সবাইকে একসাথে দেখেই সিহাবের বাবা মা অনেক খুশি।

সিহাবের বাবা হেনাকে আদর করে।
‘দাদুভাই এখন কেমন লাগছে?’

হেনা শান্তস্বর এ বলে,
‘ভালো।’
‘নাও তোমাদের জন্য অনেক চকলেট এনেছি।হাসিবকে সহ দিবে কেমন?’

বেলি বলে,
‘এসবের আবার কি দরকার ছিল আংকেল?’
‘আমি আমার নাতি-নাত্নিকে দিচ্ছি তুমি কিছু বলিও না।’

হেনা চকলেট পেয়ে খুব খুশি হয়।চকলেট গুলো নিয়ে রুমে যেতেই হাসিব বলে,
‘তুই কি সব একা খেতে পারবি?আমাকে দিবি না?’
‘নাহ।সব আমি নিবো।’

বেলি তখন এগিয়ে এসে বলে,
‘একা খাওয়াতে কোনো আনন্দ নেই।আনন্দ আছে ভাগাভাগি তে।ভাগ করে দেখো একবার?’

মায়ের কথায় হেনা কি যেন ভেবে হাসিবকে অর্ধেক চকলেট দেয়।

হাসিব হেসে ফেলে।আসলেই ভাইয়ের হাসি দেখে হেনার ভাল লাগে।

দুজনে চকলেট গুলো নিজেদের সুরক্ষিত জায়গায় রেখে আবার চলে আসে।
.
হাসনাত হেনাকে আদর করে।কপালে গালে চুমু দিয়ে হাসনাত বলে,
‘বাবাইকে পাপ্পি দাও?’

হেনা হাসনাতের কপালে চুমু দেয়।

তারপর হাবিবা বেলির কাছ থেকে বিদায় নেয়।বেলি তখন ছোট করে বলে,
‘সাবধানে থাকবেন।’
‘ইন শা আল্লাহ আমি ফিরব তাড়াতাড়ি।’
.
.
দেখতে দেখতে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়।হাবিবা আজকে বেলিদের এখানে থাকবে।
বেলি হাসনাতকে কিছুক্ষণ পর পর কল করে,
‘কোথায় আপনারা?’
‘এইতো বেশি সময় লাগবেনা।তোমার জন্য বেলিফুলের মালা নিয়েছি।’

বেলি খুব খুশি হয়।রাত গভীর হয় হাসনাত আসে না।কিন্তু এতক্ষণ এ আসার কথা।বেলি খুব চিন্তিত।হেনা হাসিব এরা ঘুমিয়ে পড়ে।

হাবিবা বলে,
‘এত টেনশন করো না ভাবি।’
‘আমার খুব ভয় লাগছে এত লেইট করছে কেন ফোন এ ও রিং হচ্ছেনা এখন।ওখানে কি নেট নেই?বন্ধ বলে কেন?’

হাবিবা তখন কি মনে করে নিউজ দেখতে যায়।সেখানে ব্রেকিং নিউজ এ স্পষ্ট লিখা,
‘ইয়ারপোর্ট থেকে ফেরার পথে এক গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাছের সাথে ধাক্কা খেয়ে আগুন ধরে যায়।তারপর গাড়িটি নদীতে পড়ে যায়।গাড়িতে কতজন ছিল শনাক্ত করা যায়নি।’

হাবিবা থরথর করে কাপে।চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।
বেলি দৌড়ে আসে খবরটা পরে।অনেক পরে জানতে পারে এটা হাসনাত দের ই গাড়ি।সাথে গাড়িতে যারা ছিল সবাই পুড়ে গিয়ে পানিতে তলিয়ে গেছে।

বেলি খবর টা দেখে বেহুশ হয়ে পড়ে যায়।

হাবিবা নিজের বরকে কল করে।তারপর কাদতে কাদতে বলে,
‘আমার ভাইয়া।’

হাবিবার বর সব শুনে বাবা মা কে নিয়ে ছুটে আসে।সাথে ডাক্তার ডেকে আনে।
.
হুশ হওয়ার পর বেলি আবারো কেঁদে উঠে।হাবিবা কাদতে কাদতে বেলিকে বুকে জড়িয়ে নেয়।
‘শান্ত হও ভাবি।’

বেলি তখন বলে,
‘যেখানে যাকে আঁকড়ে ধরি,সেই চলে যায় ছাড়ি।’

চলবে……

#তাহরীমা

(ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখা উচিৎ)