ভালোবাসি তারে
১১.
নিঝুমদের ছাদটা অনেক বড় এবং সুন্দর। গাছগাছালিতে ভরপুর। ঝুম একবার উঠে ছিলো ছাদে। ছাদটা বেশ লাগে ঝুমের কাছে। নিঝুম ছাদেই ছিল। মিসেস সানজিদা উঁচু স্বরে নিঝুমকে ডাকেন,
— “নিঝুম? নিঝুম বাবা?”
কোনো সারাশব্দ পাওয়া যায় না। তিনি গলার স্বরটাকে আরেকটু বাড়িয়ে বলে উঠেন,
— “নিঝুম? কোথায় তুই?”
এবারো সারাশব্দ নেই। মিসেস সানজিদা বিরক্ত হন। ঝুমকে বলেন,
— “ঝুম মা? নিঝুমকে একটু চা-টা দিয়ে আসতে পারবি? ও ছাদে আছে।”
ঝুমের মুখে হাসি ফুটে উঠে। উৎফুল্ল মনে ঝুম বলে,
— “পারবো, আন্টি।”
যাওয়ার আগে একবার মেঘলার রুমের দিকে তাকায় ঝুম। লজ্জায় রুম থেকে বেরই হচ্ছে না সে! ঝুম ধীর পায়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে। ছাদে আসতেই দেখতে পায়, নিঝুম আকাশের দিকে তাকিয়ে সিগারেট ফুঁকছে। ঝুমের রাগ হয়। নিঃশব্দে নিঝুমের পেছনে দাঁড়িয়ে অভিমানি কণ্ঠে বলে,
— “সিগ্রেট ভালো না। ফালতু! মানা করা সত্ত্বেও খান কেন? গন্ধটাও কি বিশ্রী!”
নিঝুম চমকে উঠে। ঝুমের দিকে তাকায়। আবারো চোখ ফিরিয়ে গম্ভীর স্বরে বলে,
— “আমার সিগ্রেট নিয়ে বাজে মন্তব্য করতে মানা করেছি!”
ঝুম মনে মনে নিঝুমকে ব্যাঙ্গ করে,
— “কি সুন্দর ভাষা! আমার সিগ্রেট! সিগ্রেট আবার কারো হয় নাকি? যতসব বাজে জিনিস।”
তারপর নিঝুমকে বলে,
— “সিগ্রেটকে বিয়ে করে ফেলুন। আপনার জন্য ভালো হবে।”
নিঝুম আফসোসের সঙ্গে বলে,
— “ভুল বলো নি। মানুষ হলে ঠিকই করতাম।”
শুনে ঝুম খিলখিল করে হেসে উঠে। তা দেখে নিঝুমও মুচকি হাসে। বলে,
— “তোমার মা এখন কেমন আছে?”
— “একদম ফিটফাট!”
হাতের চায়ের কাপটি দেখিয়ে নিঝুম বলল,
— “চা কি আমার জন্য এনেছো?”
ঝুমের হাসি থেমে যায়। ঝুম তো ভুলেই গিয়েছিল চায়ের কথা। দ্রুত চায়ের কাপটা নিঝুমের দিকে এগিয়ে বলে,
— “হ্যাঁ! আন্টি পাঠালো।”
নিঝুম কাপটা নেয়। কাপে এক চুমুক দিতেই আবার রেলিংয়ে রেখে দেয়। চা ঠান্ডা হয়ে গেছে। খেতে ভালো লাগছে না। হঠাৎ ঝুম ক্ষীণ স্বরে বলল,
— “আমি কাল শাড়ি পড়ব।”
নিঝুম অবাক হয় যেন। পরপরই হেসে বলল,
— “এত গরমে?”
ঝুম মাথা ঝাঁকায়। তারপর কেউই আর কথা বাড়ালো না। বেশ কিছুক্ষণ চুপ থাকে। ঝুম অনুভব করতে থাকে নিঝুমের সঙ্গ। আর নিঝুম ভাবতে থাকে কিছু একটা। তিন মিনিট পর ঝুম প্রবল আগ্রহ নিয়ে আবার বলল,
— “আপনি কি কালকে পাঞ্চাবী পড়বেন?”
— “হঠাৎ এ ভাবনা?”
— “আপনি কি তাহলে পাঞ্চাবী পড়বেন না?”
নিঝুম ভ্রু কুঁচকে বলে,
— “আমার বিয়ে হচ্ছে নাকি আমি পাঞ্চাবী পড়ব?”
ঝুমের মন খারাপ হয়ে যায়। মুখ ফুলিয়ে রাখে। নিঝুম সেদিকে আড়চোখে তাকায়। কি মনে করে বলে,
— “ঠিকাছে। পড়ব।”
ঝুমের খুশিতে চোখ বড় বড় হয়ে যায়। মুখে ফুটে উঠে চমৎকার হাসি। নিঝুম সেদিকে মুগ্ধ হয়ে তাকায়। পরক্ষণে নিজেকে দেখে নিজে অবাক হয়। ঝুমের এই আনন্দটার জন্য নিঝুম এত গরমে পাঞ্চাবী পড়বে বলেছে। অদ্ভুদ!
_________________
গাঢ় নীল রঙের একটা শাড়ি পড়ে আছে ঝুম। সেই সকালে জমিদার বাড়ি এসেছে সে। শাড়ির আঁচল কোমড়ে গুঁজে মিসেস সানজিদাকে সাহায্য করছে। নিজেকে কেমন গিন্নি গিন্নি মনে হচ্ছে ঝুমের। নিঝুমের গিন্নি!
দুপুরের দিকে করিম চাচার ছেলে আকাশ মেঘলাকে দেখতে আসে। মেঘলা একটা লাল শাড়ি পড়ে লজ্জায় পঞ্চমুখ হয়ে বসে আছে পাত্র পক্ষের সামনে। আকাশ তাকিয়েই রয়েছে মেঘলার দিকে। চোখাচোখি হতেই কিছু একটা ইশারা করছে আকাশ। যার ফলে মেঘলা লজ্জায় আরো লাল হয়ে যাচ্ছে। ঝুমের হাসি পাচ্ছে ওদেরকে এভাবে দেখে। পাশাপাশি খুশি, খুশি অনুভূতিও হচ্ছে। এদিক-ওদিক তাকিয়ে নিঝুমকে খোঁজার চেষ্টা করে ঝুম। কিন্তু পায় না। নিঝুম কোথায়? এখনো এখানে আসে নি কেন? আরো কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর নিঝুমের দেখা মিলে। সাদা পাঞ্চাবী পড়ে সিঁড়ি বেয়ে নামছে নিঝুম। সঙ্গে সঙ্গে ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠে ঝুমের। উফ! নিঝুমকে দেখে চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে তার। ইচ্ছে করছে তাকিয়েই থাকতে। নিঝুম এসে ঝুমের পাশাপাশি দাঁড়ায়। প্রশ্ন করে,
— “কি দেখছো?”
ঝুম হকচকিয়ে যায়। সামান্য তোতলিয়ে বলে,
— “ক-কিছু ন-না তো!”
নিঝুম ভ্রু কুঁচকে বলে,
— “আমি তো দেখলাম আমার দিকে তাকিয়ে কি যেন দেখছো।”
— “ও-ই, ম-মানে সিঁ-ড়ি, সিঁড়ি দেখছিলাম। সিঁড়িটা আজকে অনেক চকচক করছে, তাই না?”
নিঝুম সরু চোখে তাকায়। সন্দিহান কণ্ঠে বলে,
— “তুমি সিঁড়ি দেখছিলে? সত্যি?”
ঝুম অন্যদিকে তাকিয়ে বলল,
— “তো কি আপনাকে দেখব? তবে আপনাকে আজকে সুন্দর লাগছে।”
কথাটা বলেই চুপ হয়ে গেল ঝুম। বুক ধুকধুক করছে তার। হাত, পা কাঁপছ। নিঝুম ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে। মৃদু স্বরে বলে,
— “তোমাকেও সুন্দর লাগছে।”
ঝুমের মন ভালো হয়ে গেল নিমিষেই। লজ্জা পেয়ে মাথা নত করে ফেলল। গাল গরম গরম অনুভব হচ্ছে। নিঝুমের মুখে নিজের প্রশংসা শুনতে তার এত ভালো লাগে কেন? ঝুমের হঠাৎ মনে পড়ে, সে তো নিঝুমের জন্য আজকেও খিচুড়ি বানিয়ে এনেছে। নিঝুম কি খাবে সেটা? ঝুম কিছু মনে আসার ভান করে বলে,
— “ওহ! আপনাকে তো জিজ্ঞেসও করা হয় নি! ওইদিন আপনার খিচুড়ি কেমন লেগেছিল?”
নিঝুম চমৎকার করে বলে,
— “ভীষণ ভালো লেগেছে।”
ঝুম খুশি হয়। প্রশ্ন করে,
— “আজকে খাবেন?”
— “খিচুড়ি এনেছো নাকি?”
ঝুম মাথা ঝাঁকায়। নিঝুম হাসে। মুচকি হাসি। ঝুম বলল,
— “সকালে আপনার রুমে লুকিয়ে রেখে এসেছি আমি। কাঠের টেবিলে কাপড় দিয়ে ঢেকে রেখেছি বক্স। খেয়ে নিবেন বুঝেছেন?”
নিঝুম বাধ্য ছেলের মতো মাথা নাড়ায়। হঠাৎ খেয়াল করে একটা ছেলে ঝুমের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সম্ভবত আকাশের বন্ধু। অদ্ভুদ ভাবে নিঝুমের রাগ হয়। হাত মুঠো করে ফেলে সে। কঠিন গলায় বলে,
— “আমার পার্মিশন ছাড়া আমার রুমে ঢুকেছিলে কেন? আর ঢুকবে না।”
ঝুম অবাক হয়ে তাকায়। কথাটা বুকে বিঁধেছে তার। মুহুর্তেই চোখ জলে ভরে গেছে। নিঝুম যাওয়ার আগে আবার বলল,
— “নিজেকে সামলাতে না পারলে শাড়ি পড়ো কেন? বাজে দেখায় তোমায়। আর পড়বে না।”
আদেশের সুরে কথাটা বলে নিঝুম চলে যায়। ঝুমের চোখের জল বাঁধা মানে না আর। তরতর করে জল গড়িয়ে পড়ে ঝুমের চোখ থেকে। নিঝুম এমন করছে কেন?
______________
চলবে…
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা