ভালোবাসি তারে পর্ব-১০

0
5969

ভালোবাসি তারে

১০.
নিঝুমের প্রসস্থ বুকে লেপ্টে রয়েছে ঝুম। নিঝুম এক দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে! ঝুমের ঘর্মাক্ত মুখে স্পষ্ট চিন্তা আর ভীতি কাজ করছে। নিঝুম দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আরো ভালোভাবে পাজাকোলে তুলে নিলো ঝুমকে। আলম খান যে গলিতে থাকেন, সে গলির সামনে এসে দাঁড়ালো নিঝুম। হাঁপিয়ে গেছে সে। একবার ঝুমের দিকে চেয়ে আবারো সামনে এগিয়ে গেল। নিঝুমের একটু দূরে কিছু লোক দাঁড়িয়ে ছিল। ঝুমকে নিঝুম কোলে নেওয়ায় তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় লোকগুলো। লোকগুলোর একজন জিজ্ঞেস করে,
— “কে তুমি? আগে তো দেখি নাই। মাস্টার মশাইয়ের ম্যাইয়ারে এভাবে কোলে নিয়া আছো ক্যান?”

নিঝুমের শান্ত সূলভ জবাব,
— “আমি নিঝুম। পেশায় একজন ডাক্তার। আসলে, মাঝরাস্তায় ঝুম জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। তাই ওকে বাসায় পৌঁছে দিচ্ছি।”
— “হাছা(সত্যি) কথা কইতাছো তো? নাকি নিজেই অজ্ঞান করছো মাইয়াডারে?”

লোকটির বাজে ইঙ্গিতে রাগে কপালের রগ টনটন করে উঠে নিঝুমের। নিজেকে যথেষ্ট শান্ত রাখার চেষ্টা করে সে। গম্ভীর গলায় বলে,
— “দেখুন। এমন কিছুই না। আপনারা ভুল ভাবছেন!”
— “মানলাম আমরা ভুল ভাবতাসি। কিন্তু তুমি মাইয়াডার নাম চেনো কেমনে?”
নিঝুম নিজের রাগ সামলাতে না পেরে বলে,
— “আশ্চর্য! একজনকে একজন চিনতেই পারে। এখানে প্রশ্নের কি আছে?”
অন্য একজন লোক বলল,
— “দেহো, বেশি কথা কইও না। নাইলে কিন্তু বিয়া করাইয়া দিমু মাইয়াডার লগে। ভালোমতন কও মাইয়াডারে তুমি চেনো কেমনে?”

নিঝুম কিছুক্ষণ চুপ থাকে। লম্বা লম্বা নিশ্বাস ফেলে মস্তিষ্ক স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে। এখন উল্টা পাল্টা কিছু বললে চলবে না। ধীরে সুস্থে সব সামাল দিতে হবে। নাহলে পরিস্থিতি হাতের নাগালে থাকবে না। ভ্রু কুঁচকে গম্ভীর ভাবে নিঝুম জবাব দিলো,
— “আমি জমিদারের ছেলে। ও আমার বোনকে টিউশন পড়ায় বিধায় আমার পরিচিত। আর কোনো প্রশ্ন?”

জমিদারের ছেলে শুনে লোকগুলো চুপসে গেলে যেন। একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে তারা। পরক্ষণেই এসবের মাঝে একটা কথাও না বলা ব্যক্তিটি বলে উঠল,
— “আমি মাস্টার মশাইয়ের পাশের বাসায়ই থাকি। আমার সাথে আসুন। আমি মাস্টার মশাইয়ের বাসায় নিয়ে যাচ্ছি।”

নিঝুম চেনে ঝুমের বাসা। তবুও মানা করল না। নতুবা যদি অন্য কিছু ভাবে? লোকটার পিছু পিছু হেঁটে ঝুমের বাসায় পৌঁছালো নিঝুম। দ্রুত বাসার ভেতরে ঢুকে সামনের রুমের সোফায় বসিয়ে দেয় ঝুমকে। আশেপাশে তাকিয়ে ঝুমের মাকে কয়েকবার ডাকে নিঝুম। সারাশব্দ না পেয়ে ঝুমের দিকে মনোযোগী হয় সে। ঝুম গরমে তরতর করে ঘামছে। নিঝুম এদিক-ওদিক তাকিয়ে বৈদ্যুতিক পাখার সুইচ খোঁজে। পেয়ে যেতেই পাখা চালু করে নিঝুম। টেবিলে থাকা পানির গ্লাস থেকে কিছুটা পানি নিয়ে ঝুমকে খাওয়ানোর চেষ্টা করে। তারপর হাতে একটু পানি নিয়ে পানি ছিটে দেয় ঝুমের মুখে। এতে বিশেষ কোনো কাজ হয় বলে মনে হয় না। এর মাঝে পাশের বাসার ওই লোকটা নিজের স্ত্রীকে নিয়ে হাজির হয় এখানে। ঝুমের অবস্থা থেকে মহিলাটি নিঝুমকে বলে,
— “আমি শুনলাম, আপনি নাকি ডাক্তার। ঝুমের কি গুরুতর কিছু হয়েছে?”

স্বামী, স্ত্রী দু’জনকেই শিক্ষিত মনে হলো নিঝুমের। নরম গলায় নিঝুম বলল,
— “ঝুম ঠিক আছে। জ্ঞান হারিয়েছে শুধু। ওর মাকে একটু ডাকবেন প্লীজ?”

তাৎক্ষণিক মহিলাটি মিসেস শ্রেয়াকে ডাকা শুরু করল। এত চেঁচামেচি শুনে ভেতরের রুমে থাকা ঝুমের ভাই নিলয় ঘুম থেকে জেগে উঠল। চোখ কচলাতে কচলাতে সামনের রুমে এসে ঝুমকে এহেন অবস্থায় দেখে দৌঁড়ে চলে এলো ঝুমের কাছে। উদ্বিগ্ন গলায় বলল,
— “আপার কি হইছে? আপা এভাবে চোখ বন্ধ করে আছে কেন?”

মহিলাটি বলল,
— “ও কিছু না। তোমার আম্মু কোথায়?”
— “উঠানে নাই?”
— “না।”
— “রান্নাঘরে মনে হয়।”

মহিলাটি এবার রান্নাঘরের দিকে গেল। যাওয়ার এক মিনিট পরই চিৎকার দিয়ে উঠল সে। চিৎকার শুনে নিঝুম ভ্রু কুঁচকাল। রান্নাঘরে গিয়ে মিসেস শ্রেয়াকে ফ্লোরে পড়ে থাকতে দেখে আতকে উঠল। দ্রুত উঠালো তাকে। মাথা ফেটে রক্ত বের হচ্ছে মিসেস শ্রেয়ার। তবে সামান্য। ক্ষত তেমন গুরুতর নয়। মিসেস শ্রেয়াকে সামনের রুমে থাকা বিছানায় শোয়ালো নিঝুম। পাশের বাসার লোকটিকে বলল,
— “আপনার কাছে ঝুমের বাবার নাম্বার আছে?”
— “জ্বী আছে।”
— “উনাকে কল করে তাড়াতাড়ি আসতে বলুন।”
তারপর মহিলাটিকে বলল,
— “ঘরে ফাস্ট এইড বক্স থাকলে নিয়ে আসুন একটু।”

মহিলাটি ফাস্ট এইড বক্স আনতেই নিঝুম প্রাথমিক ভাবে মিসেস শ্রেয়ার মাথায় ব্যান্ডেজ করে দিলো। তবে উনাকে হাসপাতালে নেওয়া প্রয়োজন।

নিঝুম গিয়ে ঝুমের পাশে বসে। ঝুমকে জাগানোর চেষ্টা করে। পাঁচ মিনিট পর ঝুমের জ্ঞান ফিরে। নিভু নিভু চোখে নিঝুমের দিকে তাকায় সে। ভাঙ্গা গলায় বলে,
— “আ-আমার ম-ম-মাকে বাঁচান ডাক্তার।”

ঝুমের গলা শুনে ঝুমের দিকে তাকায় নিঝুম। জ্ঞান ফিরতে দেখে হাসি মুখে বলে,
— “আগের বার তোমার কথা বুঝতে পারি নি। এখন বুঝেছি। আর তোমার মা একদম সুস্থ আছেন।”

ঝুম হাসার চেষ্টা করে। নিঝুমের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। হঠাৎ কি যেন হয় ঝুমের! নিঝুমকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে। নিঝুম লজ্জায় পড়ে যায়। পাশের বাসার লোকটি আর মহিলাটির সামনে প্রচন্ড অস্বস্তি হচ্ছে তার। তবুও কাঁপা হাতে ঝুমের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে শুরু করে নিঝুম। মৃদু গলায় বলে,
— “কিছু হয় নি ঝুম। হুস! কান্না বন্ধ করো।”

ঝুম থেমে থেমে কাঁদছে। কান্নার দরুণ কেঁপে উঠছে তার শরীর। নিঝুমের বুকের সাথে একদম লেপ্টে আছে। নিঝুমের অস্বস্তি কিংবা খারাপ লাগা কিছুই হচ্ছে না এখন। বরং ভালো লাগছে। বুকের বা পাশে একধরণের শিরশির অনুভূতি হচ্ছে। নাম না জানা অনুভূতি! প্রায় কিছুক্ষণ পর ঝুমের কান্না থামে। তবে ফুঁপানোর শব্দ পাওয়া যাচ্ছে একটু একটু।

দশ মিনিটের মাথায় আলম খান যখন বাসায় পৌঁছান, তখন মিসেস শ্রেয়ার এহেন অবস্থা দেখে আতকে উঠেন। ভয়ে কথা বলা হারিয়ে ফেলেছেন তিনি। বহু কষ্টে ধীর গলায় বলেন,
— “আমার স্ত্রী ঠিক আছে তো?
নিঝুম আশ্বস্ত গলায় বলে,
— ” জ্বী ঠিক আছেন তিনি। তবে আপনার স্ত্রীর তেমন ক্ষতি না হলেও হাসপাতালে নিলে ভালো হয়। চেকাপের জন্য।”

আলম খান ভরসা পান যেন। বলেন,
— “তুমি জমিদার ভাইয়ের ছেলে নিঝুম, তাই না?”
নিঝুম হেসে বলে,
— “জ্বী।”
একটু থেমে আবার বলে,
— “এবার তাহলে আসি আংকেল? মা হয়তো চিন্তা করছেন।”

আলম খান পরম মমতা নিয়ে বললেন,
— “ধন্যবাদ তোমাকে, আমাদের এত বড় উপকার করার জন্য।”
নিঝুম হেসে বলে,
— “ধন্যবাদ দিতে হবে না আংকেল। এটা আমার দায়িত্ব ছিল।”

নিঝুম চলে যেতে উদ্যোগ হতেই সকলের অগোচড়ে তার হাত ধরে ফেলে ঝুম। নিঝুম ঝুমের দিকে তাকায়। ঝুমের চোখে আকুতি স্পষ্ট। নিঝুম বুঝতে পারে না কিসের আকুতি এটা। হালকা হেসে বলে,
— “তোমার মায়ের কিচ্ছু হয় নি ঝুম। চিন্তা করো না।”

নিঝুম চলে যায়। ঝুম তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে নিঝুমের যাওয়া। দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাত্র।

__________________

সুস্থ হওয়ার দু’দিন পর জমিদার বাড়ি যায় ঝুম। মিসেস সানজিদা তাকে দেখেই জড়িয়ে ধরেন। স্নেহ ভরা কণ্ঠে বলেন,
— “কেমন আছিস ঝুম মা? তোর মা কেমন আছেন?”
ঝুম মুচকি হাসে। ধীর গলায় বলে,
— “আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি সবাই।”

ঝুমকে নিয়ে সোফায় বসেন মিসেস সানজিদা। বলেন,
— “বুঝলি ঝুম? কালকে মেঘলাকে দেখতে আসবে। আমাদের করিমের ছেলে। তুই কালকে সকালেই সেজেগুজে চলে আসবি বুঝেছিস?”

ঝুম মাথা নাড়ায়। মেঘলার দিকে তাকায় একবার। মেঘলা লজ্জায় লাল হয়ে গেছে। মাথা নত তার। লজ্জায় মাথা উঠাতে পারছে না মেঘলা। তা দেখে ঝুম হাসলো। ইশ! কি লজ্জা!

_______________

চলবে…
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

(রি-চেক করি নি। ভুল-ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। ধন্যবাদ।)