ভালোবাসি তারে
১৬.
বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে নিঝুম। দৃষ্টি তার আকাশের টিপটিপ করা তারাগুলোর দিকে। মিসেস সানজিদা নিঝুমের রুমেই আসছিলেন। দরজার কাছে এসেই ডাক দিলেন,
— “নিঝুম? আব্বা, আছিস?”
মিসেস সানজিদার কণ্ঠস্বর শুনে দ্রুত সিগারেট বারান্দা গলিয়ে উঠানে ছুঁড়ে মারে নিঝুম। পরপরই স্প্রে ছিঁটে দেয় সম্পূর্ণ বারান্দায়। তারপর উঁচু গলায় বলে,
— “আসো মা।”
মিসেস সানজিদা ঢুকে পড়লেন রুমে। নিঝুমকে রুমে না পেয়ে পা বাড়ালেন বারান্দার দিকে। নিঝুম খালি গায়ে দাঁড়িয়ে ছিল। মিসেস সানজিদাকে দেখে বলল,
— “মা? চেয়ারে গেঞ্জি আছে। দাও তো!”
মিসেস সানজিদা গেঞ্জি দিতেই সেটি পড়ে নিলো নিঝুম। প্রশ্ন করল,
— “হঠাৎ রুমে এলে যে? শরীর ঠিকাছে?”
তিনি চেয়ারে বসতে বসতে বললেন,
— “রোগী হয়েই কি সবসময় ডাক্তারের কাছে আসি নাকি? মা হয়ে সন্তানের কাছে গল্প করতে আসতে পারি না?”
জবাবে নিঝুম হাসে। মিসেস সানজিদা আবার বলেন,
— “তোর জয়েনিং কখন?”
— “কালকে।”
— “ফিরবি কখন?”
— “রাত হবে।”
— “ওহ্!”
নিঝুম পাশ থেকে পানির বোতল নিয়ে কয়েক চুমুক পানি পান করে। হঠাৎ বলে উঠে,
— “আমার বিয়ে করতে ইচ্ছে করছে মা। বউ খুঁজো তো!”
বিস্ময়ে মিসেস সানজিদার চোখ বড় বড় হয়ে গেল। এ ছেলে বলে কি? স্কুল থেকে কলেজ জীবন পর্যন্ত যে ছেলে একটা প্রেমও করতে পারে নি লজ্জায়! সে কি-না এখন নির্লজ্জের মতো নিজের মাকে বউ খুঁজতে বলছে? বিশ্বাস হচ্ছে না মিসেস সানজিদার। তিনি উত্তেজিত হয়ে মৃদু চেঁচিয়ে বললেন,
— “কি বললি?”
এ পর্যায়ে শব্দ করে হেসে উঠল নিঝুম। বলল,
— “তোমার এক্সপ্রেসন দেখার জন্য মজা করছিলাম মা। উত্তেজিত হওয়ার কিছু নেই।”
মিসেস সানজিদার তবুও বিশ্বাস হলো না যেন। তিনি নিঝুমের পানে তীক্ষ্ণ চাহনি নিক্ষেপ করে সন্দিহান কণ্ঠে বললেন,
— “সত্যি করে বল আব্বা। তোর কি কোনো মেয়ে পছন্দ আছে?”
নিঝুম আনমনে বলে,
— “কি জানি!”
মিসেস সানজিদার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আরো প্রখর হয়। নিঝুমকে চেপে ধরে প্রশ্ন করেন,
— “নিঝুম আব্বা, মায়ের সঙ্গে মিথ্যা বলতে নাই। তাড়াতাড়ি বল, কারে পছন্দ করিস?”
নিঝুম আবার বলে,
— “জানি না তো মা। জানলে তো সর্বপ্রথম তোমাকেই বলতাম। তাই না?”
বলেই নিজের সেই মিষ্টি হাসিটা উপহার দেয় নিঝুম। মিসেস সানজিদা হাল ছেড়ে দেন। ছেলের এই হাসিটা দেখে কখনোই ছেলেকে জোড় করতে পারেন না তিনি। তার ছেলেটা আরেকটু কম সুন্দর হলে কি হতো? পরক্ষণেই ভাবেন, না! না! তার ছেলে সুন্দরই ভালো।
______________________________
ঝুমের দিনগুলো বিভীষিকা স্বপ্নের মতো চলে যাচ্ছে। ভালো লাগছে না কিছুই। নিঝুম হাসপাতালে জয়েন করেছে কিছুদিন হলো। এ কিছুদিন নিঝুমের সাথে একপলকও দেখা হয় নি তার। ঝুম কয়েকবার ইচ্ছে করে নিধাকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পড়িয়েছে। শুধু মাত্র নিঝুমকে একপলক দেখার জন্য। কিন্তু তবুও নিঝুমের দেখা পাওয়া যায় নি। ভাবতেই কান্না পায় ঝুমের। সবকিছু বিষাক্ত লাগে। বিষণ্ণতা সর্বদা টের পায় নিজের মাঝে।
রাতের বেলা বিছানায় ফোন হাতে বসে আছে ঝুম। মিসেস সানজিদার থেকে বহুকষ্টে নিঝুমের কেবিনের ল্যান্ডলাইন নম্বর নিয়েছে সে। নিঝুমকে কল করবে বলে মন স্থির করেছে। শরীর প্রবল ভাবে কাঁপছে ঝুমের। কাঁপা কাঁপা হাতে ডায়াল লিস্টের ল্যান্ডলাইন নম্বরে কল করে ঝুম। প্রথম বারে নিঝুম কল ধরে না। দ্বিতীয় বার কল করার এক সেকেন্ড পরই নিঝুমের বিরক্ত সহিত কণ্ঠ ভেসে উঠে,
— “হ্যালো, ডাক্তার নিঝুম বলছি। আপনি কে?”
ঝুমের বুকের ভেতর তোলপাড় শুরু হয়ে যায় মুহুর্তেই। কতদিন পর মানুষটার কণ্ঠ শুনেছে সে! কোনোমতে ধীর গলায় কাঁপা কণ্ঠে বলে,
— “জ-জ্বী, আ-আমি..!”
কথা শেষ করতে পারে না ঝুম। তার আগেই শান্ত গলায় নিঝুমের প্রশ্ন,
— “ঝুম? এটা কি তুমি?”
ঝুম হকচকিয়ে যায়। ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে রীতিমতো বুক,হাত,পা মারাত্তক ভাবে কেঁপে উঠে। ঝুম কণ্ঠ পরিবর্তন করতে ভুলে গিয়েছিল। দ্রুত নাকে হাত চেপে কণ্ঠ পরিবর্তন করে ভীতু স্বরে জবাব দেয়,
— “ক-কে ঝ-ঝুম? আ-মি তো রুপালি।”
নিঝুম মনে হয় আবারো বিরক্ত বোধ করছে। শান্ত কণ্ঠটা মুহুর্তেই পাল্টে কাঠকাঠ গলায় বলল,
— “জ্বী, বলুন কি দরকার।”
— “আ-আসলে বলতে চাচ্ছিলাম আপনি তো ডাক্তার তাই না? আপ…আপনার ডিউটি টাইম কখন শুরু এবং শেষ হয়?”
নিঝুমের এবার ভ্রু কুঁচকে গেল। বিরক্তিতে তপ্ত নিশ্বাস ফেলল সে। বলল,
— “কেন?”
— “আমার দাদী অসুস্থ তো, তো! তাই ভাবছিলাম কাল রাতে দাদীকে নিয়ে আপনার সঙ্গে দেখা করব। এর জন্য আপনার ডিউটি টাইম-টা জানা প্রয়োজন ছিল। যদি বলতেন?”
নিঝুম একটু সময় নিলো উত্তর দিতে। মিনিট খানেক পর বলল,
— “আপাতত সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। তবে কালকে আমার হাফ-ডে। আমি ডাক্তার মিরাজকে বলে দেবো আপনার কথা। রিসিভশনে গিয়ে উনার নাম বললেই দেখিয়ে দেবে। বুঝেছেন?”
কাল নিঝুমের হাফ-ডে শুনে আনন্দে মুখে হাসি ফুটে উঠে ঝুমের। তাড়াতাড়ি বলে উঠে,
— “মিরাজ, ফিরাজকে বলতে হবে না ডাক্তার। আমার দাদী একদম সুস্থ। ধন্যবাদ এত উপকার করার জন্য। আচ্ছা, বাই তাহলে।”
কলটা খট করে কেটে দিলো ঝুম৷ খুশির উত্তেজনায় কি বলেছে সে জানে না। জানার প্রয়োজন বোধও করছে না। বুকের মাঝে ফোন চেপে ধরে এক মনে তাকিয়ে আছে সিলিংয়ের দিকে। মুখে হাসি রেখে শুধু প্রার্থনা করছে যেন, কালকে নিঝুমের সাথে একটু হলেও দেখা হয় তার!
নিঝুম ভ্রু কুঞ্চিত করে তাকিয়ে আছে ল্যান্ডফোনের দিকে। কি অদ্ভুদ মেয়েটা। এভাবে কল কেটে দিলো কেন? কল করলই বা কেন? ঘাড়ের পেছনে ডান হাতটা রেখে কয়েকবার ঘঁষলো নিঝুম। ঘাড় ডানে-বামে নাড়িয়ে, কয়েকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবারো কাজে মন লাগালো।
______________________________
জমিদার বাড়িতে খুশির আমেজ। নিধার ছোট ফুফি এসেছে এখানে। নির্জন বাড়িটা মুহুর্তেই কোলাহলে পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। ঝুম জানতো না নিধার ফুফি এসেছেন। প্রতিদিনকার মতো বিকেলে জমিদার বাড়ি এসে উঠানে তার সমবয়সী অচেনা কিছু ছেলে মেয়েদের দেখে চমকে যায় ঝুম। নিধাও ছিল তাদের সঙ্গে। তবে নিঝুম নেই। ঝুম আস্তে আস্তে এগোতে থাকে। নিধার কাছাকাছি আসতেই নিধা ‘ম্যাম’ বলে দৌঁড়ে চলে আসে ঝুমের কাছে। ঝুমের এক হাত ঝাকাতে ঝাকাতে মুখে হাসির রেখা টেনে বলে উঠে,
— “ম্যাম, আপনি এসেছেন? দেখুন আমি কত মজা করছি। আমার ছোট ফুফি আজকে এসেছে। আর ওই যে ওরা? ওরা আমার ভাই-বোন। আপনার বয়সী তাই না?”
ঝুম ভ্রু কুঁচকে তাকায় নিধার দিকে। দৃঢ় গলায় বলে,
— “এত কিছু আমাকে বলছো কেন? পড়তে না বসানোর জন্য?”
নিধা কিছু বলার আগেই দু’টো মেয়ে আর একটা ছেলে এসে হাজির হয় তাদের সামনে। মেয়েদের মধ্যে একজন বলে উঠে,
— “তুমি নিধার টিউটর, তাই না? তোমার সম্পর্কে অনেক কিছু শুনেছি নিধার কাছ থেকে। আর, তুমি বলায় মাইন্ড করো না। তুমি আর আমি সমবয়সী। তাই আপনিটা ঠিক মানাচ্ছে না। বাই দ্যা ওয়ে, আমি স্নেহা।”
অন্য একটা মেয়ে বলে উঠে,
— “আমি স্নিধা।”
পাশের ছেলেটা সূক্ষ্ণ হেসে বলে,
— “আর আমি স্নিগ্ধ।”
ঝুম এক এক করে সবার দিকে তাকালো। মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল,
— “আমি ঝুম। আপনাদের সাথে দেখা হয়ে ভালো লাগলো।”
স্নেহা বলে উঠল,
— “ফর্মালিটি দেখাতে হবে না ঝুম। আমরা আমরাই তো।”
সবার এত সুন্দর আচরণে ঝুম মুগ্ধ হয়। জমিদার বাড়ির সবাই-ই অনেক ভালো। শুধু নিঝুম বাদে। নিরামিষ একটা! নিঝুমের কথা মনে পড়তেই ঝুম ব্যস্ত হয়ে পড়ে। নিঝুম হয়তো এখন বাড়ির ভেতরেই আছে। নিঝুমের সঙ্গে দেখা করতে মন উতলা হয়ে উঠে ঝুমের। এখান থেকে যেতে পারলেই বাঁচে সে। ধীর গলায় নিধাকে বলল ঝুম,
— “পড়বে না নিধা? চলো!”
স্নিগ্ধ নামক ছেলেটা মাঝ দিয়ে বলে উঠল,
— “তোমরা টিচার-রা পড়া ছাড়া কিছু বোঝো না? আমরা এসেছি, এখন কি ও আর পড়বে? এক কাজ করো, আমাদের সঙ্গে তুমিও জয়েন করো। সময় ভালো কাটবে।”
ঝুমের বিরক্ত লাগছে এখন। ভদ্রতার খাতিরে মলিন হাসলো সে। স্নিগ্ধর কথায় বিদ্রুপ করে নিধা জোড় গলায় বলে উঠল,
— “একদম না! আমি পড়ব। যত পড়ালেখা করব, তত জীবনে এগিয়ে যাবো। বুঝেছো ভাইয়া? চলুন তো ম্যাম!”
ঝুক অবাক হয়ে তাকায় নিধার দিকে। মেয়েটা মাঝে মাঝে বড়দের মতো কথা বলে। ব্যাপারটা ঝুমের জন্য বিরক্তিকর হলেও এখন আনন্দের। ‘সাব্বাশ’ দিতে ইচ্ছে করছে নিধাকে। নিজের অজান্তেই ঝুমের অনেক বড় উপকার করেছে সে।
_______________
চলবে…
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
~অনুগ্রহ করে গঠনমূলক মন্তব্য করুন।