ভালোবাসি তারে পর্ব-১৫

0
6203

ভালোবাসি তারে

১৫.
বসন্তের আগমন ঘটেছে আজকে। সে হিসেবে আজকে পহেলা বসন্ত। বসন্তের আগমনে প্রকৃতি যেন তার অপরুপ সৌন্দর্যে খেলা করছে। সেই প্রকৃতির সৌন্দর্য ক্যামেরা বদ্ধ করছে নিঝুম। কালো রঙের থ্রি-কোয়াটার প্যান্টের সঙ্গে সাদা রঙের টি-শার্ট পড়ে আছে সে। গলায় ক্যামেরা ঝুলানো।

বৃহৎ আকারের একটি গাছের ডালে ময়না পাখি বসে আছে। ঠোঁট দিয়ে কি যেন খুঁড়ছে ডালে। নিঝুম সে দৃশ্যের ছবি তুলে। আড়চোখে ঝুমকে একবার দেখে নেয়। স্কার্টের সঙ্গে ফতুয়া পড়া মেয়েটা। এদিক-ওদিক তাকানোতে দু’পাশের বেণুনি লাফাচ্ছে। দৃশ্যটা সুন্দর! ঝুমের অগোচড়ে তার একটা ছবি ক্যামেরায় তুলে নিলো নিঝুম। পরক্ষণেই বিস্ময়ে নিজেই স্তম্ভিত হয়ে গেলো। এ নিয়ে দু’বার ঝুমকে না জানিয়ে ছবি তুলেছে নিঝুম। কাজটা কি ঠিক? মোটেও না। পার্মিশন নেওয়া উচিত ছিল নিঝুমের। নিঝুম তো এমন ছিল না! নিজের অদ্ভুদ কান্ডে হাসি পেলো নিঝুমের। ঠোঁট কামড়ে হাসলো সে।

ঘোরাফেরা প্রায় শেষের দিকে। জঙ্গলের সরু রাস্তায় পাশাপাশি হাঁটছে নিঝুম আর ঝুম। নিঝুম ঝুমকে ডাকে,
— “ঝুম?”
পাশ থেকে চোখ সরিয়ে নিঝুমের দিকে তাকায় ঝুম। নিঝুম বলে,
— “কাল থেকে একটা বেসরকারি হাসপাতালে জয়েন করছি আমি। অভিনন্দন জানাবে না?”
ঝুম একগাল হেসে বলল,
— “অবশ্যই, আপনাকে অভিনন্দন। কিন্তু আপনি তো এখানে একটা হাসপাতাল তৈরি করে সেখানে জয়েন করতে চেয়েছিলেন। ওটার কি হলো?”
— “হাসপাতাল তৈরি হতে অনেক দেড়ি। ততদিন বসে থাকতে চাইনি।”
— “ওহ্!”
একটু থেমে ঝুম আবার জিজ্ঞেস করে,
— “কোথায় জয়েন করছেন?”
— “পাশের শহরের একটা হাসপাতালে।”

ঝুম একপলক নিঝুমকে দেখে নেয়। মনে মনে ভাবে, নিঝুম তো আজকের পর থেকে ব্যস্ত হয়ে যাবে। তখন কি নিঝুমের সাথে তার এভাবে ঘোরাঘুরি হবে? হয়তো, আবার হয়তো না। মুহুর্তেই ঝুমের মনটা বিষণ্ণ হয়ে যায়। তবে প্রকাশ করে না। মুখে স্বাভাবিকতা বজায় রেখে ঝুম বলল,
— “চলুন নৌকায় উঠব।”
নিঝুম প্রশ্ন করে,
— “এখানে নৌকা কোথায়?”
— “সামনের নদীতে নৌকার পাল বসে। চলুন!”
নিঝুম কথা বাড়ায় না। ঝুমের পিছু পিছু হাঁটতে শুরু করে। ঝুম মাঝে মাঝে পেছন ফিড়ে আড়চোখে দেখছে নিঝুমকে। ঝুমের বাচ্চামো দেখে মনে মনে হেসে উঠে নিঝুম। মেয়েটা এত চঞ্চল কেন? অদ্ভুদ রকমের!

নিঝুম আগে আগে উঠে পড়ে নৌকায়। পরক্ষণেই হাত বাড়িয়ে উঠতে বলে ঝুমকে। ঝুম একবার নিঝুমের দিকে তাকিয়ে তারপর নিঝুমের বাড়িয়ে দেওয়া হাতের দিকে তাকায়। মনের ভেতর একরাশ অনুভূতি আর মায়া নিয়ে নিঝুমের হাতে হাত রেখে উঠে পড়ে নৌকায়। পাশাপাশি বসে দু’জন। নিঝুম প্রশ্ন করে,
— “নৌকা দিয়ে কোথায় যাবে?”
— “বাজারের কাছাকাছি যে নদী-টা আছে? ওখানে! মাঝিকে বলে দিন তো কথাটা।”
নিঝুম ভ্রু কুঁঞ্চিত করে তাকায়। কিছুক্ষণ চুপ থেকে মাঝিকে বলে দেয় কথাটা।

চলন্ত নৌকায় বসে হাত বাড়িয়ে পানি স্পর্শ করছে ঝুম। মুখে লেগে আছে প্রাণ খোলা হাসি। নিঝুম সেদিকে তাকায়। একবার ভাবে, ছবি তুলবে। পরক্ষণেই আবার ভাবনাটা বদলে ফেলে। হঠাৎ প্রশ্ন করে,
— “আজ তো বসন্ত। শুনেছি মেয়েরা শাড়ি পড়ে এদিনে। তুমি পড়বে না?”
ঝুম মলিন হেসে বলল,
— “আপনার ভুলে যাওয়ার রোগ হয়েছে ডাক্তার! ভুলে যাচ্ছেন, আমি আর শাড়ি পড়ি না।”

হঠাৎ-ই একরাশ অধিকার বোধ এসে জেকে বসে নিঝুমের মধ্যে। আদেশের সুরে বলে,
— “না পড়লেও তোমার আজকে শাড়ি পড়তে হবে।”
ঝুম অবাক হয় যেন। বলে,
— “কেন?”
— “কারণ, আমি বলছি।”

ঝুমের অবাকের মাত্রা বেড়ে যায়। মাঝে মাঝে নিঝুম এত অধিকার বোধ নিয়ে কথা বলে কেন? উত্তরটা অজানা তার। শুধু ‘হা’ হয়ে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছে নিঝুমের পানে। নিঝুমের ছোট ছোট চুল কপালে এলোমেলো ভাবে উড়ছে। রোদের আলোয় তার তীক্ষ্ণ চোখজোড়া বুকে বিঁধছে ঝুমের। ভেতরটা অনুভূতিতে পরিপূর্ণ হয়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে। এহেন চাহনীতে নিঝুমের অস্বস্তি হয়। হালকা কেঁশে বলে,
— “মুখ বন্ধ করো। মশা ঢুকবে।”

ঝুমের চেতনা ফিরে। কিছুক্ষণ আগে সে কি করেছে মনে পরতেই লজ্জায় মাথা নত করে ফেলে ঝুম। ঝুমের লজ্জা পাওয়া অদ্ভুদভাবে নিঝুমের অনেক ভালো লাগে। মন ভালো করার মতো একটা জিনিস। অন্যদিকে ফিরে নিঝুম মুচকি হাসে। দীর্ঘ সেই হাসি। তবে ঝুমের অগোচড়ে।

_______________

ঝুমের আজকে শাড়ি পড়ার কোনো মনোভাব ছিল না। পড়তোও না সে। কিন্তু নৌকা থেকে নামার পড়ে নিঝুম স্পষ্ট বলে দিয়েছে, তাকে শাড়ি পড়তে হবে। আর এমন ভাবে বলেছে যে ঝুম সেটা শুনতে এবং মানতে বাধ্য!

অতঃপর বাসন্তি রঙের একটা শাড়ি পড়ে জমিদার বাড়ি উপস্থিত হয় ঝুম। মিসেস সানজিদাও শাড়ি পড়েছিলেন। ঝুমকে দেখেই তিনি তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
— “বাহ্! বেশ সুন্দর লাগছে তো তোকে।”

ঝুম লজ্জায় পায়। মুচকি হাসে। মেঘলা দাঁত কেলিয়ে বলল,
— “ঝুম দিদি? শাড়ি যখন পড়ছেনই তখন নিঝুম ভাইয়ার দেওয়া শাড়ি পড়তেন। আপনারে আরো মানাইতো।”
ঝুম চোখ বড় বড় করে তাকায়। মেঘলা তার মতোই হাসছে। মিসেস সানজিদা এবার ধমক দিয়ে উঠলেন,
— “ফাজিল! হাসছিস কেন এভাবে? আজ বাদে কাল বিয়ে, ভুলে গেছিস?”

মেঘলা এবার একটু লজ্জা পায় যেন। ঝুমের সেদিকে খেয়াল নেই। তার দু’চোখ বারবার এদিক-ওদিক তাকিয়ে কাউকে খুঁজছে। কেউ-টা হয়তো নিঝুম। ঝুমের পাশেই নিধা দাঁড়িয়ে ছিল। ঝুমকে এদিক-ওদিক তাকাতে দেখে বলল,
— “কি খুঁজছেন ম্যাম? ভাইয়ু তো বাসায় নেই। পাপার সঙ্গে বাহিরে গেছে।”

বলেই মুখ টিপে হাসে নিধা। ঝুম চোখ রাঙিয়ে তাকায়। মেয়েটা মাত্রারিক্ত পাকনা হয়ে গেছে। কিন্তু পরক্ষণেই মন খারাপ হয়ে যায় তার! যার জন্য শাড়ি পড়েছিল ঝুম, সে-ই বাড়িতে নেই। প্রচন্ড মন খারাপে কান্না পায় ঝুমের। তীব্র অভিমান হয়। কেমন মানুষ নিঝুম? নিজে শাড়ি পড়তে বলে নিজেই উধাও!

কিন্তু, নিধাকে পড়ানোর পর যখন ঝুম ড্রইংরুমে আসে, স্পষ্ট নিঝুমকে সোফায় বসে থাকতে দেখে। ঝুমকে শাড়ি পড়া দেখে নির্লজ্জের মত সবার সামনে নিঝুম শুধু বলে,
— “ঝুমময় পিচ্চি? তোমাকে তো অনেক সুন্দর লাগছে আজকে।”

ব্যাস! পিচ্চি ঝুমের বিশাল হৃদয়ের অভিমান নিমিষেই মিলিয়ে যায়।

__________________

চলবে…
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা