ভালোবাসি তারে পর্ব-৩০

0
5184

ভালোবাসি তারে

৩০.
নির্জন পার্ক। বেঞ্চের এককোণে গুড়িশুটি মেরে চুপচাপ বসে আছে ঝুম। তার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে নিঝুম। এক দৃষ্টিতে ঝুমের মায়াময় মুখটা দেখছে সে। কান্নায় চোখ ফুলে গেছে ঝুমের। ঠোঁট দু’টোতেও কম অত্যাচার করে নি ঝুম। কামড়ে কামড়ে লাল করে ফেলেছে ঠোঁট দুটো। অশ্রু কণাগুলোর দাগ এখনো লেগে আছে তার গালে। নিঝুম আলতো হাতে ঝুমের বাম গাল খানিকটা স্পর্শ করল। সঙ্গে সঙ্গে ঝুমের শ্বাস যেন আটকে গেল। বড় বড় চোখে মাটির দিকে তাকিয়ে রইল সে। নিঝুম তপ্ত নিশ্বাস ফেলে বলল,
— “আজ খুব গরম পরেছে, তাই না ঝুম?”

ঝুম নিশ্চুপ। তার চোখ টলমল করছে। বাসায় অনেক ঝামেলা করে পার্কে এসেছে ঝুম। বিয়ের আগে নাকি বাড়ি থেকে বের হতে নেই। তাই মিসেস শ্রেয়া তাকে বের হতে দিচ্ছিলেন না। আটকে রেখেছিলেন। ঝুম এক প্রকার লুকিয়ে বের হয়েছে বাসা থেকে। কে জানে, একটু পর বাসায় গেলে কি করবেন মিসেস শ্রেয়া। হয়তো মারবেন, বকবেন। কিংবা কিছুই করবেন না।

ঝুমকে চুপ থাকতে দেখে নিঝুম আবার বলল,
— “ঝুম? মাথাটা ভীষণ ব্যথা করছে। চুলগুলো টেনে দাও তো।”

বলতে বলতেই ঝুমের হাত নিজের চুলের মাঝে রাখলো নিঝুম। ঝুম তখনো মাথা নত করে আছে। অনেকটা সময় লাগিয়ে নিঝুমের চুলে হাত বোলাতে লাগল সে। নিঝুম পুরোটা সময় চেয়ে ছিল ঝুমের দিকে। এক পর্যায়ে ঝুমের অন্যহাতটা নিজের হাতের মাঝে নিলো নিঝুম। স্থির দৃষ্টি ঝুমের অধর পল্লবে রেখে প্রশ্ন করল,
— “তোমার ঠোঁট কি দোষ করেছে ঝুম? কামড়ে কামড়ে ঠোঁটের এই করুণ অবস্থা কেন করেছ?”

প্রশ্নটা শোনা মাত্র ঝুমের টলমলে আঁখি থেকে অশ্রুধারা তরতর করে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়তে শুরু করল। ঝুম তার ভাঙ্গা গলা নিয়ে এতক্ষণে বলে উঠে,
— “আমার আর সহ্য হচ্ছে না ডাক্তার। পুরো শরীর ঘৃণায় জ্বলে-পুড়ে যাচ্ছে। কষ্টে মরে যেতে ইচ্ছে করছে।”

যেন কাঁদতে কাঁদতে অভিযোগ করছে ঝুম। নিঝুম ঝুমের হাতটা আরো শক্ত করে আঁকড়ে ধরল। ধীর গলায় জিজ্ঞেস করল,
— “কি হয়েছে ঝুমময় পিচ্চি? আমাকে বলো।”

ঝুম যেন এটাই চাইলো। তৎক্ষণাত কাঁপা কণ্ঠে মৃদু ভাবে বলে উঠল,
— “আ-আমার যার সাথে ব-বিয়ে ঠিক হয়েছে, সে… সে আজ সকালে আমাকে ফোন দিয়েছিল। আমাকে বলছিল আ-আমার ঠোঁট নাকি অনেক সুন্দর। তার নাকি আমার ঠোঁট খেয়-খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে হয়। তাই আমি…!”

বাকিটুকু বলতে দেয় নি নিঝুম। নিজেই ঝুমকে বলে,
— “তাই তুমি রাগ করে নিজের ঠোঁট কামড়ে কামড়ে রক্ত বের করে ফেলেছো। তাই তো?”

ঝুম ধীরে ধীরে মাথা উপর-নিচ নাড়ায়। যার অর্থ, হ্যাঁ। সে এজন্যই নিজের ঠোঁট কামড়েছে। ঝুমের মাথা নাড়ানো দেখে নিঝুম দীর্ঘশ্বাস ফেলল। পরক্ষণেই খানিকটা ধমকের সুরে চেঁচিয় উঠল,
— “কাঁদছো কেন? দ্রত চোখ মুছো।”

ঝুম মৃদু কেঁপে উঠল। অবাক হয়ে চাইল নিঝুমের দিকে। নিঝুম হঠাৎ এমন ব্যবহার করছে কেন? ভাবনার মাঝেই নিঝুম কড়া গলায় আবার বলল,
— “কি বলেছি তোমাকে? চোখ মুছে আমার চুলে ভালো ভাবে হাত বুলিয়ে দাও। কুইক!”

ভয় পেয়ে ঝুম দ্রুত দু’হাতে দু’গালের পানি মুছে ফেলল। আস্তে আস্তে আবারো চুলে হাত বোলাতে শুরু করল সে। নিঝুম আরেকটু লেগে শুলো ঝুমের সঙ্গে। ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করল। রাগ না করতে চেয়েও হুট করে রেগে গেছে সে। সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ভাবে রাগটা ঝেড়ে এবার অনেকটাই শান্ত নিঝুম। নরম সুরে ঝুমকে বলল নিঝুম,
— “ফালতু একটা মানুষের জন্য নিজেকে কষ্ট দেওয়া মোটেও উচিত হয় নি তোমার ঝুম। আমি তো বলেছি, তুমি যা চাও তা-ই হবে। তারপরও নিজেকে কষ্ট দিতে গেলে কেন?”

ঝুমের চোখ আবারো ভরে এলো। এবং সাথে সাথেই ঝুম হাত দিয়ে মুছে ফেলল চোখের পানি কণাগুলো। বলল,
— “লোকটা খুব বাজে ডাক্তার। কথাগুলো সে এমন ভাবে বলেছিল যে, আমার নিজেরই নিজের উপর খুব রাগ হচ্ছিল। আমি সহ্য করতে পারি নি।”

নিঝুম উঠে বসল। ঝুমের দু’গালে দু’হাত রাখলো সে। নরম গলায় বোঝালো,
— “তুমি জীবনে কখনো বাঁধা-বিপত্তি ছাড়া এগোতে পারবে না ঝুম। প্রতিনিয়ত বাঁধা-বিপত্তি আসবেই। তাই বলে কি হার মেনে যাবে? নিজেকে নিজে কষ্ট দিবে? মোটেও না। লড়াই করতে শেখো ঝুম। নিজের সৎ স্বপ্নের জন্য নিজেরটা নিজে আদায় করতে শেখো। ভেঙ্গে পড়লে তো হবে না ঝুমময় পিচ্চি! একটু বোঝার চেষ্টা করো।”

ঝুমের গালে রাখা নিঝুমের হাত জোড়ায় নিজের হাত রাখলো ঝুম। নাক টেনে বাচ্চাদের মতো করে বলল,
— “বুঝেছি আমি।”
নিঝুম ভ্রু কুঁচকে বলল,
— “কি বুঝেছো?”
ঝুম নত মুখে বলে,
— “এটাই যে, আপনি ডাক্তারের পাশাপাশি লেকচারারও হয়ে যাচ্ছেন।”
নিঝুমের হাসি পেয়ে গেল। নিঃশব্দে হেসে উঠল সে। সেই সঙ্গে ঝুমও হাসলো। বেদনার মুহুর্তে একটুখানি আনন্দই যথেষ্ট হয় মনটাকে সতেজ করতে। ঝুমেরও সতেজ লাগছে নিজেকে। পূর্ণ মনে হচ্ছে।

হঠাৎ নিঝুম জড়িয়ে ধরে ঝুমকে। শক্ত করে ঝুমের মাথা নিজের বুকের সঙ্গে চেপে ধরে। নিমিষেই ঝুমের হাসি বন্ধ হয়ে যায়। সর্বত্র জুড়ে শীতল হাওয়া বইতে শুরু করে যেন। শরীর ঠান্ডা হয়ে আসে। নিঝুম আলতো করে ঝুমের কপালে চুমু দেয়। বিড়বিড় করে বলে উঠে,
— “কিছু হবে না তোমার ঝুম। আমি সব ঠিক করে দেব। সব আগের মতো হয়ে যাবে। তুমি শুধু আমাকে একটু সময় দাও। নিজে একটু শক্ত হয়। একটু!”

ঝুম শুনতে পায় না কথাগুলো। শুধু ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রয় নিঝুমের মুখপানে।

গাড়ি এসে থামে ঝুমের বাসার সামনে। তখন সন্ধ্যা প্রায়। ঝুম ধীরে ধীরে বাসার দিকে এগোচ্ছে। গেট পেরোতেই আবারো পেছনে ফিরে সে। গাড়ির জানালা গলিয়ে নিঝুমের দিকে করুণ চোখে তাকায়। যার অর্থ, তার ভয় করছে। নিঝুম হালকা হাসে। চোখের ইশারায় আশ্বস্ত করে। ভেতরে যেতে বলে ঝুমকে।

ঝুম কিছুক্ষণ নিঝুমের দিকে তাকিয়ে রয়। পরক্ষণেই বুকে সাহস জুটিয়ে চলে যায় বাসার ভেতরে। নিঝুমের চোখ ঝুমের যাওয়ার পানেই স্থির ছিল। ঝুম চলে যেতেই দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। চোখ বন্ধ করে মাথা এলিয়ে দিলো সীটে। কিছুক্ষণ ওভাবে থেকে আনমনেই গাড়ি স্টার্ট দিলো নিঝুম। এলোমেলো পরিস্থিতিগুলো কিভাবে সামাল দিবে সে চিন্তায় মশগুল সে। প্রবল ভাবে মশগুল!

___________________

শুকনো ঢোক গিলে সদর দরজায় মৃদু ভাবে কারাঘাত করে ঝুম। দু’বার কারাঘাত করার পরপরই দরজা খুলে দেন মিসেস শ্রেয়া। তিনি চোখ লাল করে তাকিয়ে আছেন ঝুমের দিকে। নিজ মায়ের এমন রাগী রুপ দেখে খানিকটা ভয় পায় ঝুম। আমতা আমতা করে কিছু বলতে চায়, তার আগেই ঝুমের ডান গালে সজোড়ে একটা থাপ্পড় দেন মিসেস শ্রেয়া। ঝুম হকচকিয়ে যায়। ব্যথায় আপনা-আপনি গালে হাত চলে যায় তার। টলমলে চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
— “মা..!”

বলার আগেই মিসেস শ্রেয়ার কড়া কণ্ঠ,
— “কোথায় গিয়েছিলি? তোকে না বলেছি বাসা থেকে না বের হতে? তাও কেন বের হলি? সত্যি করে বল ঝুম! তুই কি কাউকে পছন্দ করিস? তার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলি?”

ঝুম জবাব দেয় না। কিছুক্ষণ আগে কষ্টে কান্না আসলেও এখন রাগে কাঁদতে ইচ্ছে করছে তার। কিছু না বলে মিসেস শ্রেয়াকে পাশ কাটিয়ে নিজের রুমে চলে যেতে লাগল ঝুম। মিসেস শ্রেয়া ধমক দিয়ে উঠলেন,
— “কথা বলছিস না কেন? এই ঝুম!”
ঝুম তবুও নিশ্চুপ। এবার একটু নরম গলায় বললেন মিসেস শ্রেয়া,
— “আমি বুঝতে পারছি না। রুপকের মতো এত ভালো ছেলে তোর পছন্দ হচ্ছে না কেন? ছেলেটার আচরণ দেখেছিস? কত ভালো ব্যবহার! কত খেয়াল রাখে তোর। সকাল থেকে কত শত বার ফোন দিয়ে তোর খবর নিয়েছে জানিস? আবার বলেছে তুই নাকি ওর ফোন ধরছিস না। কেন? ওর ফোন ধরছিস না কেন তুই?”

ঝুম এবারো কিছু বলল না। দরজা লাগিয়ে কান চেপে ধরে ফ্লোরে বসে পড়ল। মায়ের কথাগুলো তীব্র ভাবে আঘাত হানছে ঝুমের কানে, মস্তিষ্কে! অসহ্য লাগছে রুপকের সুনামগুলো। ঝুম সহ্য করতে পারলো না আর। চেঁচিয়ে উঠল,
— “চুপ করো মা। ওই ছেলেকে তুমি কতটুকু জানো? জানোয়ার সে! একটা জানোয়ারের সঙ্গে বিয়ে দিচ্ছো আমার। বুঝেছো? একটা জানোয়ারের সঙ্গে বিয়ে দিচ্ছো!”

মিসেয়া শ্রেয়া রেগে গেলেন ঝুমের এহেন কথা শুনে। তিনি এবার ঝুমকে বকতে লাগলেন। ঝুম নিঃশব্দে কেঁদে উঠল। ঠিক তখনই ঝুমের ফোন বেজে উঠল। ঝুম ভাবলো, হয়তো নিঝুম কল করেছে। কিন্তু ব্যাগ থেকে ফোন বের করে ফোনের স্ক্রিনে রুপকের নাম ভেসে উঠতেই রাগে ফোনটা দূরে ছুঁড়ে মারলো ঝুম। রাগে, কষ্টে শরীর কাঁপছে তার। ঠোঁট কামড়ে নিজের কান্না আটকাতে চাইলো ঝুম। ব্যর্থ হলো। কান্না আটকানোর বদলে আরো তীব্র ভাবে ডুকরে কেঁদে উঠল সে। দু’ভাগ হয়ে ফ্লোরে পরে থাকা ফোনের দিকে কিছুপলক তাকিয়ে রইল। করুণ স্বরে মনে মনে আওড়ে উঠল,
— “আমি নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছি ডাক্তার! শক্ত হতে পারছি না। আপনি আসুন না প্লীজ। আমাকে নিঃশেষ হওয়া থেকে একটু টেনে আনুন না ডাক্তার। আমি অপেক্ষায় আছি। আপনার অপেক্ষায়!”

______________

চলবে…
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
~রি-চেক করিনি। বানান ভুল হলে অবশ্যই জানাবেন।
Ishanur Tasmia