ভালোবাসি তারে পর্ব-৩১

0
5237

ভালোবাসি তারে

৩১.
বারান্দার মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে নিঝুম। একহাত রেলিংয়ের উপর রাখা। চোখ ছোট ছোট করে নির্জন, নিস্তব্ধ, কালো ছোপছাড়ের দিকে স্থির দৃষ্টি রেখেছে সে। মনটা কেমন অস্থির অস্থির লাগছে। মস্তিষ্কও বড্ড এলোমেলো! চোখ বন্ধ করে একটা বড়সড় তপ্ত নিশ্বাস ফেলল নিঝুম। সঙ্গে সঙ্গে ঝুমের কান্নামাখা মুখটা ভেসে উঠল সামনে। নিঝুমের মনটা অস্থির হওয়ার পাশাপাশি অশান্ত হয়ে গেল এবার। ঝুম মেয়েটা নিঝুমের জন্য একটা ভিন্ন কিছু। তার সুখ, শান্তি, বেদনার একটা সংমিশ্রণ। ভেবে আরো একবার সিগারেটে টান দিলো নিঝুম। দীর্ঘ টান।

এমন সময় দরজা ঠেলে রুমের ভেতর প্রবেশ করল স্নিগ্ধ। রুমের চারপাশে তাকিয়ে নিঝুমকে খুঁজলো সে। না পেয়ে হাঁটা ধরল বারান্দার দিকে। নিঝুমের পাশ ঘেঁষে দাঁড়ালো। সঙ্গে সঙ্গে নিঝুমের ধমক,
— “দূরে গিয়ে দাঁড়া!”

স্নিগ্ধ খানিকটা মন খারাপ করল। সামান্য দূরত্ব রেখে দাঁড়ালো সে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে অভিমানী গলায় বলল,
— “তুই সবসময় এমন করিস কেন?”
— “তো কি নিজের সাথে আরো লেগে লেগে দাঁড়াতে বলব? দেখ স্নিগ্ধ! জ্বালাস না। ভালো লাগছে না। কি জন্য এসেছিস বলে, চলে যা!”
নিঝুমের বিরক্ত সহিত কণ্ঠ। স্নিগ্ধ প্রশ্ন করে,
— “কি হয়েছে তোর? মন ভালো না কেন?”

নিঝুম নিশ্চুপ। জবাব দিতে ইচ্ছে করছে না তার। স্নিগ্ধ আবার বলে,
— “বলছিস না কেন? ঝুমের সাথে কিছু হয়েছে নাকি?”
নিঝুম জবাব দিলো না। উল্টো সিগারেট দেখিয়ে বলল,
— “সিগ্রেট খাবি?”
স্নিগ্ধ ভারী অবাক হয় যেন। অবাক হওয়া কণ্ঠে বলে,
— “পাগল হয়েছিস?”
— “পাগল হওয়ার কি আছে?”
নিঝুমের নির্লিপ্ত ভাব। স্নিগ্ধ ভ্রু কুঁচকায়।
— “প্রথমত, তুই ডাক্তার হয়ে এসব ছাইপাঁশ খাচ্ছিস। তারপর আবার আমাকে বলছিস সিগারেট খেতে? সিরিয়াসলি!”

নিঝুম মুখ বাঁকিয়ে হাসে। তাচ্ছিল্যের হাসি! সিগারেটের দিকে একবার তাকিয়ে আবারো খেতে শুরু করে। স্নিগ্ধ বিরক্ত হয় এবার। বলে,
— “কি হয়েছে বলবি? অস্বাভাবিক আচরণ করছিস কেন? সিগারেট টা ফালা তো।”
নিঝুম এক কথায় সিগারেট ফেলে দেয়। তারপর মৃদু স্বরে বলে,
— “কি বলবি বল।”
— “কি হয়েছে?”

শীতল চাহনী নিয়ে স্নিগ্ধর দিকে তাকায় নিঝুম। হালকা হেসে তৎক্ষণাত দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয় আকাশের পানে। স্বাভাবিক ভাবে বলে,
— “ঝুমের বিয়ে ঠিক হয়েছে। আগামী মাসে বিয়ে।”
নিঝুমের নির্লিপ্ততা দেখে স্নিগ্ধ আরেকটু মাত্রায় অবাক হয়। বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠে,
— “মানে? তুই কিছু করবি না?”
নিঝুম প্রশ্ন করে,
— “তুই কি করতি?”
স্নিগ্ধ একটু চুপ থেকে উত্তেজিত হয়ে বলে,
— “রুহিকে দরকার হলে উঠিয়ে নিয়ে আসতাম। ভালোবেসেছি ছেড়ে দেওয়ার জন্য নাকি?”
নিঝুম দূর্বল হাসলো। প্রতিউত্তর দিলো না।

কয়েক সেকেন্ড পর আবার নিজ থেকেই বলল নিঝুম,
— “এ নিয়ে পরে কথা বলব। এখন যা! ঘুম আসছে।”
নিকচ মিথ্যে! এমন পরিস্থিতিতে কারো ঘুম আসে? বুঝতে পেরেও স্নিগ্ধ কিছু বলে না। নিরবে চলে যেতে উদ্যোগী হতেই নিঝুম আবার বলে,
— “ফোনটা দিয়ে যা তো!”

স্নিগ্ধ রুম ত্যাগ করতেই ফোনের ডায়াল লিস্টে ঝুমের নম্বরে কল করে নিঝুম। ফোন বন্ধ বলছে। পরপর দুবার কল করেও একই কথা! নিঝুমের বুক ভারী হয়ে আসে। মনে হয়, কেউ পাহাড়সম বোঝা রেখে দিয়েছে বুকে। ফোনটা সোফায় ছুঁড়ে মারলো নিঝুম। আবারো সিগারেট ধরালো। আকাশের পানে ধোঁয়া উড়াতে উড়াতে ফিসফিসিয়ে উঠল,

‘দাঁড়িয়ে আছো তুমি আমার গানের ওপারে।।
আমার সুরগুলি পায় চরণ,
আমি পাইনে তোমারে।।’

___রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

____________________

ঝুমের দিনগুলো অনিমেষ কাটছে। কাল রাতে ঘুমের ঔষুধ খাওয়ায় অনেক বেলা করে ঘুম থেকে উঠেছে সে। চোখ কঁচলে বিছানায় কিছুক্ষণ থম মেরে বসে রইল ঝুম। ফ্লোরে পরে থাকা ফোনের দিকে নজর যেতেই বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। ফোনের ডিসপ্লে ফেটে গেছে। ভেতরের ডিসপ্লেও কিছুটা ফাটা। ঝুম দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোনের পার্টগুলো এক এক করে জোড়া লাগাতে শুরু করল। শেষে ফোন চালু করল সে। অথচ ফোন চালু হলেও ডিসপ্লেতে টাইপ করতে কষ্ট হচ্ছে। হ্যাং হয়ে যাচ্ছে বার বার। তবুও হার মানলো না ঝুম। ধৈর্য সহকারে নিঝুমকে কল করার চেষ্টা করল।

প্রায় এক-দশেক মিনিট ওভাবেই কাটলো। অবশেষে ডায়াল লিস্টে ঢুকতে পেরেছে ঝুম। নিঝুমের নম্বরে ‘ক্লিক’ করতে যাবে তখনই রুপকের অনেকগুলো মেসেজ আর কলের নোটিফিকেশন এক এক করে আসতে লাগল ফোনে। মেসেজ আর কলগুলো সম্ভবত কালকের। এতক্ষণ ফোন হ্যাং হওয়ায় হয়তো এখন দেখাচ্ছে! এবং তার এক মিনিট পরই আবারো রুপকের কল এলো। প্রচন্ড ক্ষোপ আর রাগে ঝুম ফোন বন্ধ করে ফেলল আবার। ছুঁড়ে মারলো বিছানায়। সে বুঝতে পারছে না, এতটা ছ্যাঁচড়া আর বেয়াদপ একটা মানুষ কিভাবে হয়? চরিত্রহীন মানুষ একটা!

ঝুম ফ্রেশ হয়ে আর রুম থেকে বেরুলো না। রুমেই ছিল। খানিকবাদ পর নাস্তা নিয়ে আলম খান ঢুকলেন ঝুমের রুমে। নাস্তার প্লেটটা টেবিলে রেখে ঝুমের পাশে বসলেন। ঝুম মাথা নত করে ছিল। আলম খান ঝুমের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। ম্লান কণ্ঠে বললেন,
— “কি হয়েছে? রুম থেকে বের হচ্ছিস না কেন?”

ঝুম নিশ্চুপ। আলন খান কিছুক্ষণ ওভাবেই বসে ছিলেন। শান্ত কণ্ঠে তিনি ঝুমকে বোঝালেন,
— “এমন করছিস কেন ঝুম? একদিন না একদিন তো বিয়ে দিতেই হতো, তাই না?”

ঝুম অতিরিক্ত নির্লিপ্ত গলায় বলে উঠল এবার,
— “কিন্তু, এই একদিনটা একটু বেশিই তাড়াতাড়ি হয়ে যাচ্ছে না আব্বা? এমন হলে তো জন্মের পরই বিয়েটা করিয়ে দিতে। এত স্বপ্ন দেখার সুযোগ দিয়ে, আবার সেই স্বপ্নটার গলা চেপে ধরছো কেন?”

জবাব দিতে পারলেন না আলম খান। নির্বাক বসে রইলেন অনেক্ষণ। যাওয়ার আগে ঝুমের হাতে নিজের ফোনটা দিয়ে লজ্জিত গলায় বলে গেলেন,
— “রুপক একটু পর ফোন দিবে। কথা বলে নিস!”

ঝুম সে সময় চোয়াল শক্ত করে মাথা নত করে ছিল মাত্র৷ ফোন হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরে ছিল।

ঠিকই রুপক কল করেছিল আলম খানের ফোনে। ঝুম ধরে নি। কিন্তু কল না ধরায় ছ্যাঁচড়া ছেলেটা আরো বেশি করে কল করছিল। ঝুম না পারছিল কিছু করতে, আর না পারছিল ফোনটা আছাড় মেরে ভাঙ্গতে! বাধ্য হয়ে কলটা ধরল ঝুম। ওপাশের ব্যক্তিকে কিছু বলতে না দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল,
— “ফালতু লোক! কি সমস্যা আপনার? বলেছি না বিয়ে করব না আপনাকে। তবুও পিছে পরে আছেন কেন? ছোটলোক, বেয়াদ কোথাকার। আর একবার ফোন দিলে থাপ্পড় মেরে গাল লাল করে দেবো। বাজে লোক!”

বলেই কল কেটে দিলো ঝুম। প্রায় সাথে সাথে আবারো ফোনটা বেজে উঠল। রুপক কল করছে। ঝুম তার জীবনে এত ছ্যাঁচড়া মানুষ দেখে নি! কল কেটে বালিশের নিচে চেপে রাখে ফোনটা। রুপককে বকে এবার যা একটু শান্তি পাচ্ছে সে।

____________________

বিকেল বেলা অপ্রত্যাশিত ভাবে নিঝুমের কণ্ঠ ড্রইংরুম থেকে শুনতে পায় ঝুম। ক্ষণিকের জন্য থমকে যায়। পরক্ষণেই দৌড়ে ড্রইংরুমে যেতেই দেখে নিঝুম সোফায় বসে আছে। আলম খানের সঙ্গে বসে বসে গল্প করছে সে। নিঝুমকে এভাবে নিজের সামনে দেখে ঝুম যেন অনুভূতি শূণ্য হয়ে যায়। বড় বড় চোখে চেয়ে রয় নিঝুমের মুখপানে।

নিঝুম আড়চোখে ঝুমের দিকে তাকায়। ঝুমকে এহেন ভাবে চমকাতে দেখে হাসে মাত্র। পরক্ষণেই উঠে দাঁড়িয়ে আলম খানকে বলে,
— “আমি একটু ওয়াশরুমে যেতাম আংকেল। ওয়াশরুমটা কোথায়?”
আলম খান কিছু বলতেই নিচ্ছিলেন, তখন নিঝুম আবারো বলল,
— “ঝুম? আমাকে একটু ওয়াশরুমটা দেখিয়ে দেবে?”
এমতাবস্থায় আলম খান ঝুমের দিকে তাকালেন। বললেন,
— “ঝুম মা, ডাক্তার সাহেবকে একটু বারান্দার ওখানে নিয়ে যা তো!”

ঝুম দ্রুত গতিতে মাথা নাড়ালো। নিঝুম হেসে ঝুমের পাশাপাশি হাঁটতে লাগলো। বারান্দার কাছাকাছি আসতেই প্রচন্ড অভিমান নিয়ে ঝুম হঠাৎ বলে উঠল,
— “আমাদের ওয়াশরুম কিন্তু আপনাদের মতো টাইলস্ করা না। সিমেন্টের এবং বারান্দার একদম শেষে।”

নিঝুম চোখ ছোট ছোট করে ফেলে। তারপর আস্তে বলে,
— “চলবে।”
ঝুম রাগ নিয়ে বলল,
— “ভাঙ্গা।”
— “চলবে।”
— “অনেক বাজে।”
— “তবুও চলবে।”

ঝুম ফুঁসে উঠল এবার। বারান্দার মাঝ বরাবর এসে দাঁড়িয়ে গেল। রাগী গলায় বলল,
— “কেন এসেছেন এখানে?”
— “তোমাকে নিজের করতে।”
ঝুম অবিশ্বাস্য চোখে তাকালো নিঝুমের দিকে। মুখ ফুটে কিছু বলার আগেই নিঝুম ম্লান হেসে আবার বলল,
— “মজা করছিলাম।”

ঝুম হতাশ হলো। নিমিষেই চোখে পানি জমে গেল তার। অভিমানী গলায় ঝুম বলল,
— “ডাক্তার? ছেলেটা আমাকে আবার ফোন দিয়েছিল।”

নিঝুম আড়ালে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল,
— “স্নিগ্ধ কি বলেছে জানো?”
ঝুম মাথা নত করে রয়। কিছু বলে না। এ মুহুর্তে তার কিছু ভালো লাগছে না। নিঝুম নিজ থেকেই বলা শুরু করে,
— “এমন পরিস্থিতিতে পরলে স্নিগ্ধ তার প্রেয়সীকে নিয়ে পালিয়ে যেত।”

সঙ্গে সঙ্গে আৎকে উঠল ঝুম। ভড়কে তাকালো নিঝুমের দিকে। আর্তনাদ করে উঠল,
— “আমি পালাতে পারবো না।”
নিঝুম হালকা হেসে বলে,
— “জানিতো।”

তারপর অনেক্ষণ নিরবতা বিরাজ করে দুজনের মাঝে। ঝুম ভাবে, ‘ডাক্তার কি রাগ করেছেন আমার কথায়? আমি তো উনাকে রাগাতে চাইনি।’
অন্যদিকে নিঝুম ভাবছে অন্য কথা। নিঝুম হঠাৎ বলে উঠে,
— “চলো।”
ঝুম একটু অবাক হয়। জিজ্ঞাসু গলায় বলে,
— “কিন্তু আপনি তো…!”
ঝুমকে বলতে না দিয়ে নিঝুম আগে আগে বলে উঠে,
— “আমি শুধু তোমার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ খুঁজছিলাম ঝুম৷”

ঝুম চুপ হয়ে যায়। প্রথম বারের মতো নিঝুমের চোখে চোখ রেখে দাঁড়ায়। কিন্তু বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারে না। ভয়ংকর নীলাভ চোখ দুটি থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। এ সুযোগে নিঝুম ঝুমের হাতের মুঠোয় একটা কাগজ গুঁজে দেয়। নিজেদের মাঝে সামান্য দূরত্ব রেখে, ঝুঁকে আলতো ভাবে অধর ছুঁইয়ে দেয় কপালে। পরক্ষণেই নিঃশব্দে চলে যায় সেখান থেকে।

ঝুম তখনো ঠায় দাঁড়িয়ে বারান্দায়। বিস্ময়ে, অনুভূতিতে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে সে। তার কপালে লেগে থাকা নিঝুমের স্পর্শে বাকশূণ্য প্রায় ঝুম! বেশ কিছুক্ষণ পর আস্তে আস্তে হাতের মুঠোয় রাখা কাগজটা খুলে, পড়ল ঝুম।

— ‘পিচ্চি? এত বেশি কাঁদবে না বুঝেছো? তোমার পাশাপাশি কিন্তু আমিও দহনে পুড়ছি। তোমার ফোলা চোখ,মুখ দেখতে আমার কিন্তু মোটেও ভালো লাগে না। আমার জন্য, আমাদের জন্য হলেও একটু শক্ত হও। একটু ধৈর্য ধরো। অপেক্ষা করো! সব ঠিক হয়ে যাবে দেখো।

আর হ্যাঁ, ভালোবাসি ঝুমময় পিচ্চি।’

ভালোবাসি লিখাটা যেন একটা শিহরণ বয়ে দিলো ঝুমের মনে। সম্পর্কের একটা নতুন নাম দিলো। ভাবতেই ঘন ঘন নিশ্বাস নিলো ঝুম। নিঝুম তাকে এতটা দূর্বল করে তুলছে কেন? শেষে যদি নিঝুমকে না পায় সে? জ্যান্ত লাশ হয়ে যাবে না তখন?

____________________

চলবে…
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
Ishanur Tasmia