ভালোবাসি তারে পর্ব-৪১ এবং শেষ পর্ব

0
5684

ভালোবাসি তারে

শেষ পর্ব.
বৈশাখ মাস। সকাল থেকেই প্রবল ঝড়-বৃষ্টি প্রকৃতি জুড়ে। লাল বেনারসি শাড়ি পরে অস্থিরতায় রুমের এপাশ থেকে ওপাশ পায়চারি করছে ঝুম। আজ ঝুম আর নিঝুমের বিয়ে। অথচ! অথচ এই ঝড় বৃষ্টিতে বর যাত্রি আসবে কিভাবে? ঝড়টা কি আসার আর সময় পেলো না? মন খারাপ করে জানালার ধারে দাঁড়ালো ঝুম। বৃষ্টি কমে গেছে অনেকটা। ঝিরিঝিরি ফোটা পরছে। সেই সাথে বইছে দমকা হাওয়া। হঠাৎ বাড়ি জুড়ে শুরু হয়ে যায় এক তীব্র শোরগোল। কে যেন চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে বলছে, ‘বর যাত্রি চলে এসেছে! বর যাত্রি চলে এসেছে!’

কথাটা বারবার ঝুমের কর্ণকুহরে প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসছে। এক অদ্ভুদ অনুভূতিতে চুপসে যাচ্ছে ঝুম। পরক্ষণেই জানালা গলিয়ে উঁকি দিলো সে। তাদের বাড়ির উঠোনে দাঁড়ানোরত বর যাত্রির ভিড়ে নিঝুমকে দেখা যাচ্ছে। ঠোঁটে চমৎকার একখানা হাসি নিয়ে স্নিগ্ধর সঙ্গে কি যেন কথা বলছে সে। ঝুম নিঝুমকে আরো ভালোভাবে দেখার চেষ্টা করলো। কিন্তু ব্যর্থ সে। এর আগেই রুমে প্রবেশ করলো ঝুমের কিছু আত্মীয়। তাড়াহুড়ো করে তাগিদা দিয়ে বললো,
— “তাড়াতাড়ি যা সাজুগুজু করার করে নাও নতুন বউ। বর যে তোমার অপেক্ষা করছে।”
বলেই একদফা হাসাহাসি হয়ে গেল রুম জুড়ে। ঝুম লজ্জা পায়। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রয় শুধু।

কিছুক্ষণ পর ঝুমকে নিয়ে বসানো হয় নিঝুমের পাশে। লজ্জায় নতজানু ঝুম বারবার আড়চোখে দেখছে নিঝুমকে। নিঝুম খেয়াল করে ব্যাপারটা। ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,
— “বেশি সুন্দর লাগছে বুঝি তোমার ডাক্তারকে?”

ঝুম থমকে যায়। চোখ বড় বড় করে ফ্লোরের দিকে তাকায়। ঘনঘন নিশ্বাস নিচ্ছে সে। কেমন হাড় কাঁপানো অনুভূতি হচ্ছে! নিঝুমের কণ্ঠে কি যেন আছে। বারবার কাঁপিয়ে তুলে ঝুমকে। নিঝুম আবার বলে,
— “মারাত্বক সুন্দর লাগছে। চোখ সরাতে পারছি না।”

ঝুম আবারো কেঁপে উঠে। লজ্জায় মাথা আরো নিচু করে ফেলে। কাঁপা গলায় বলে,
— “কথা বলবেন না আপনি।”
নিঝুম ভারি অবাক হয় যেন। বিস্ময় নিয়ে বলে,
— “কেন? কি হয়েছে?”
ঝুম মিনমিনিয়ে বললো,
— “আপনি কথা বললে কেমন, কেমন অনুভূতি হয় আমার। তাই কোনো কথা বলবেন না। চুপ থাকবেন।”
নিঝুম হেসে দিলো। মাথা ঝাঁকিয়ে বললো,
— “আচ্ছা।”

ঝুম আর নিঝুমকে কথা বলতে দেখে স্নিগ্ধ হঠাৎ-ই নিঝুমের কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললো,
— “অস্থির হচ্ছিস কেন নিঝুম? ভাবীর সাথে তো পরেও প্রাণভরে কথা বলতে পারবি। আশেপাশের আত্মীয়-স্বজনরা দেখলে কিন্তু লজ্জা দিবে।”

স্নিগ্ধর কণ্ঠে রসিকতা। নিঝুম ভ্রু কুঁচকালো। বললো,
— “আমার বউ! আমার ইচ্ছে! আমার অস্থিরতা! আত্মীয়-স্বজন লজ্জা দেওয়ার কে?”
স্নিগ্ধ ঠোঁট বাঁকিয়ে বললো,
— “বউ হয়নি এখনো।”
— “হতে কতক্ষণ?”
বলতে বলতে হেসে দিলো নিঝুম। কথায় না পেরে স্নিগ্ধ নাক কুঁচকে তাকালো মাত্র।

______________________

ঝড় কমতেই কাজী এসে উপস্থিত হন এখানে। ঝুম আর নিঝুমের সামনে বসে কাজী প্রথমেই ঝুমকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
— “জনাব শাখাওয়াত শেখের বড় পুত্র নিঝুম শেখের সঙ্গে জনাব আলম খানের বড় কন্যা মালিহা তাবাস্সুম ঝুম বিবাহ বন্ধনে রাজী থাকলে বলুন, কবুল।”

অতিরিক্ত আনন্দে ঝুমের মুখ থেকে কথা বের হচ্ছে না। চোখ টলমল করছে। বুক কাঁপছে! কাজী আবার বললেন,
— “বলো মা, কবুল।”
ঝুম ঢোক গিললো। চোখ বন্ধ করে মন স্থির করলো। ধীরে ধীরে বললো,
— “কবুল, কবুল, কবুল।”

কাজী কিছু বলার আগেই নিঝুম উঁচু গলায় বলে উঠলো,
— “আলহামদুলিল্লাহ!”
যেন এতক্ষণ শ্বাস আটকে বসে ছিল নিঝুম। ঝুম ‘কবুল’ বলতেই জানে পানি এলো তার। মন-প্রাণ শান্তিতে ভরে গেল। নিঝুমের কথা শুনে আশেপাশের সবাই তাকে নিয়ে হাসাহাসি করলো কয়েক দফা। কাজীও মুচকি হাসলেন। পরপরই আবারো বললেন,
— “জনাব আলম খানের বড় কন্যা মালিহা তাবাস্সুম ঝুমের সঙ্গে জনাব শাখাওয়াত শেখের বড় পুত্র নিঝুম শেখ বিবাহ বন্ধনে রাজী থাকলে বলুন, কবুল।”

নিঝুম এক মুহুর্তও দেড়ি করলো না। সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলো,
— “কবুল, কবুল, কবুল।”

ব্যস! বিবাহ বন্ধনের প্রখর মায়াজালে আটকে গেল দু’জন নর-নারী। প্রেমিক-প্রেমিকা থেকে একজন হয়ে গেল অন্যজনের অর্ধাঙ্গ। আর অন্যজন তার অর্ধাঙ্গিনী।

_______________________

সব রীতিনীতি শেষ করে ঝুমকে জমিদার বাড়ি আনতে প্রায় রাত দশটা বেজে যায়। ঝুমকে নিয়ে সানজিদা শেখ নিঝুমের রুমে আসেন। নিঝুমের রুমটা আজ বেশ সাজানো, গোছানো। বেলিফুল আর গোলাপ দিয়ে সাজানো হয়েছে চারিপাশ। ঘ্রাণে মৌ মৌ করছে পুরো রুমটা। ঝুম বিছানার মাঝখানটায় বসে পর্যবেক্ষণ করছে সব। পুরো রুমে ঝুম আর নিধা একা। বিয়ের শুরু থেকে শেষ অব্দি কোথাও মনোয়ারা শেখকে দেখতে পায় নি ঝুম। তিনি কি আসেন নি? প্রশ্নটা জানতে মনটা ভীষণ খচখচ করছে তার। শেষে না পেরে ঝুম বলেই ফেললো,
— “নিধা? তোমার ছোট ফুফি কি আসেন নি? উনাকে কোথাও দেখলাম না যে।”

নিধা ফোনে গেমস খেলছিল। ঝুমের কথায় তার দিকে তাকালো। বললো,
— “না! ওইদিন ঝগড়া হলো না? তারপর আব্বু ফুফিকে অনেক বকা দিয়েছিল। তাই ফুফি রাগ করে চলে গেছে। বলেছে, আর আসবে না।”
— “ওহ!”
ছোট্ট করে বললো ঝুম। নিধা আবারো গেমস্ খেলতে ব্যস্ত হয়ে পরল। ঝুমের মন খারাপ হলো এবার। তার জন্যই তো এত কিছু হচ্ছে! কিন্তু কিই-বা করার? মনোয়ারা শেখ যা করেছেন তা তো কোনো সুষ্ঠু আচরণ ছিল না!

মিনিট দশেক পর নিঝুম রুমে আসে। নিঝুমকে দেখে ঝুম জড়োসড়ো হয়ে বসে। কিন্তু নিধা ঠিকই গেমস্ খেলছে। নিঝুম খানিকটা কাঁশলো। তবুও কোনো পরিবর্তন ঘটলো না নিধার। নিঝুম ভ্রু উঁচিয়ে তাকালো। নিধাকে বললো,
— “যাচ্ছিস না কেন নিধা? আমি এসেছি দেখছিস না?”

নিধা ফোন চাপতে চাপতে বললো,
— “কেন যাবো?”
— “তোর কাজ শেষ। তাই যাবি।”
— “যাবো না আমি। ম্যাম এর সঙ্গে ঘুমাবো আজকে।”

শুনে নিঝুমের চোখ ছোট ছোট হয়ে গেল। ঝুম না চাইতেও শব্দ করে হেসে দিলো। নিঝুম ধমক দিয়ে বললো,
— “তুই যাবি?”
— “না! থাকবো।”

নিধার কণ্ঠে নির্লিপ্ততা। নিঝুম বিরক্তি হচ্ছে। অধৈর্য হয়ে নিধার কাছে গিয়ে নিধার কান মলে দিলো। ক্ষিপ্ত গলায় বললো,
— “যাবি? নাকি চড় মারবো?”
নিধা উঠে দাঁড়ায়। কানে হাত বোলাতে বোলাতে মুখ কুঁচকে বলে,
— “সব সময় এমন করো কেন ভাইয়ু?”
নিঝুম উত্তর দিলো না। চোখের ইশারায় চলে যেতে বললো। নিধাও মন খারাপ করে চলে গেল।

এদিকে ভাই-বোনের কান্ড দেখে মুচকি মুচকি হাসছে ঝুম। নিঝুম ঝুমের পাশে বসলো। তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বললো,
— “খুব হাসি পাচ্ছে তাই না?”
ঝুম নিরুত্তর। নিঝুম গম্ভীর ভাবে আবার বললো,
— “আমার অসহায়ত্বে মোটেও হাসা উচিত হয় নি তোমার। এখন শাস্তি পেতে হবে। কি শাস্তি দেওয়া যায় বলো তো?”
ঝুম হকচকিয়ে যায়। হাসি বন্ধ হয়ে যায় তৎক্ষণাত। বলে,
— “শাস্তি মানে?”

নিঝুম ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো। কিছু বললো না। উঠে দাঁড়িয়ে, কোলে তুলে নিলো ঝুমকে। ঝুম ভড়কে যায়। ভয় পায় খানিকটা। নিঝুমের গলা জড়িয়ে ধরে। জিজ্ঞেস করে,
— “কোথায় যাচ্ছেন?”

নিঝুম এবারো জবাব দেয় না। ধীর পায়ে বারান্দার দিকে এগোয়। সোফার মাঝখানটায় বসে ঝুমকে নিজের কোলে বসায়। পুরোটা সময় ঝুম অবুঝের মতো ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে ছিল। নিঝুম হাসলো। ঝুমের নাক টেনে বললো,
— “বললে না, কি শাস্তি দেবো?”

নিঝুমের চোখের গভীরতা দেখে ঝুম লাজুক হাসে। নিঝুমের বুকে মাথা এলিয়ে মৃদু স্বরে বলে,
— “আপনি বলুন। আমি মাথা পেতে নেবো।”

ঝুমের কপালে পড়ে থাকা চুল কানে গুঁজে দিলো নিঝুম। কপালে অধর ছোঁয়ালো। ঝুমের কোমড় আলতো ভাবে দু’হাতের বাঁধনে আবদ্ধ করে শান্ত গলায় বললো,
— “তোমার শাস্তি মারাত্বক হবে ঝুম। আমাকে যেভাবে উম্মাদ করেছো, তোমাকেও সেভাবে উম্মাদ হতে হবে। আকি যেভাবে ক্ষণে ক্ষণে তোমার অপেক্ষায় মিষ্টি যন্ত্রণায় ভুগেছি, তোমাকেও ভুগতে হবে। আমি যেভাবে তোমাকে ভালোবাসি, তোমাকেও তার চেয়ে হাজার গুণ বেশি আমাকে ভালোবাসতে হবে। শাস্তির এদিক ওদিক হলে কিন্তু এক বিন্দুও ছাঁড় পাবে না।”

ঝুম লজ্জায় আলুথালু ভাবে লেপ্টে আছে নিঝুমের বুকে। বুকের মাঝখানে মুখ লুকিয়ে ঝুম বললো,
— “আপনার সকল শাস্তির জন্য আমি প্রস্তুত আছি। শুধু আপনি আমার পাশে থাকলেই চলবে।”

নিঝুম প্রশান্তিময় একটা নিশ্বাস ফেললো। ঝুমের চুলে হাত বুলাতে লাগলো। তখনই ঝুম তার লজ্জায় রক্তিম মুখটা মেলে ধরল নিঝুমের সামনে। আবদার নিয়ে ডাকলো,
— “ডাক্তার?”
— “হু?”
— “আমাকে একবার চুমু খাবেন?”

নিঝুম চমকে তাকায় ঝুমের দিকে। পরক্ষণেই হাসে খানিকটা। তারপরের মুহুর্ত ছিল দু’জনের জন্য মধুরতম মুহুর্ত। ক্ষণিকের ভালোবাসা-বাসির পর নিঝুম হঠাৎ শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ঝুমকে। গলায় ঠোঁট ছুঁইয়ে অস্পষ্ট স্বরে বলে,
— “ভালোবাসি ঝুম। প্রচন্ড ভালোবাসি। এই ভালোবাসা যদি ক্ষণিকের জন্যও কমে যায়, তখন যেন আমার মরণ হয়।”

ঝুম আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেলে। হাত দিয়ে নিঝুমের পাঞ্চাবী মুঠো করে ধরে ধীর গলায় বলে,
— “আপনি আমার নিশ্বাসে মিশে যাওয়া আমার অংশ। আমার অংশ আমাকে কখনো কম ভালোবাসতে পারে না।”

সময়টা যেন থেমে গেছে। শুধু রয়ে গেছে একরাশ ভালোবাসা।

___________________

সমাপ্ত…
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
Ishanur Tasmia