ভালোবাসি তারে পর্ব-৪০

0
5868

ভালোবাসি তারে

৪০.
কেটে গেছে কিছু দিন। ঝুমের গায়ে হলুদ আজ। বাসায় আত্মীয়-স্বজনে ভরপুর। কিছুদিন আগেও যে গ্রামবাসী ঝুমকে নিয়ে বাজে মন্তব্য করতেন তারাও এসেছেন গায়ে হলুদে। তাদের কাজই তো মানুষের নামে কথা ছাঁড়ানো কিংবা চাটুকারিতা করা।

ঝুম রুমে বসে নিজের চুল আঁচড়াচ্ছিল। হঠাৎ ফোন বেজে ওঠে তার। নিঝুম কল করেছে। কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে নিঝুম বললো,
— “তোমার বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। দরজা খুলো।”
ঝুম বিস্মিত হলো। বিস্ময় নিয়ে বললো,
— “মানে? আপনি এখন এখানে কি করছেন?”
— “এসে দেখতে পাবে। দ্রুত আসো।”

বলেই কল কেটে দেয় নিঝুম। ঝুম বিপদে পরে যায়। এতগুলো মানুষের সামনে নিঝুমের সঙ্গে কিভাবে দেখা করবে সে? কেউ দেখলেও তো লজ্জা দিবে। লম্বা নিশ্বাস ফেলে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো ঝুম। দরজা হালকা ফাঁক করে উঁকি দিলো বাহিরে। না! ড্রইংরুমের আশপাশে মানুষ নেই তেমন। যারা আছে, তারাও কাজে ব্যস্ত। ঝুম ভাবলো, ‘এ ফাঁকে বাসা থেকে বের হওয়া যাবে।’
যেই ভাবা সেই কাজ! আলতো পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে চুপিচুপি সদর দরজার কাছে যেতে লাগলো ঝুম। সদর দরজা খুলবে, তখনই পেছন থেকে মিসেস শ্রেয়া বাজখাঁই গলায় হাঁক দিয়ে উঠলেন,
— “ঝুম? এই ভর-দুপুরে কোথায় যাচ্ছিস?”

ধরা পরে যাওয়ায় ঝুম চোখ-মুখ কুঁচকে ফেলে। আশেপাশে তাকায় একবার। ড্রইংরুমে এতক্ষণ যারা, যারা কাজে ব্যস্ত ছিলেন তারা এখন ঝুমের দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে। ঝুমের কেমন লজ্জা লাগছে। মিসেস শ্রেয়া আবার বললেন,
— “কথা বলছিস না কেন? কোথায় যাচ্ছিলি?”
ঝুম পেছনে ফিরে তাকায়। হাসার চেষ্টা করে বলে,
— “একটু বাহিরে যাচ্ছিলাম আম্মা।”
ওমনি মিসেস শ্রেয়ার ধমক,
— “বাহিরে যাচ্ছিস মানে? আজ বাদে কাল বিয়ে, আর তুই বাহিরে যাওয়ার কথা বলছিস। মাথা ঠিক আছে?”

ঝুম অনুরোধ করে বললো,
— “যাই না আম্মা প্লীজ। এখনই চলে আসবো সত্যি!”
— “না।”

কাঠকাঠ গলায় ‘না’ বলে চলে গেলেন মিসেস শ্রেয়া। ঝুম মুখ ফুলিয়ে ফেলল। পিছু নিলো মিসেস শ্রেয়ার। মিসেস শ্রেয়া রান্নাঘরে গিয়ে হালুয়া বানাচ্ছিলেন। রান্নাঘরের দরজার সামনে ঝুম অসহায় মুখ করে দাঁড়িয়ে রইলো। কেননা রান্নাঘরে আরো মানুষ আছে। তারা যেতেই মিসেস শ্রেয়ার কাছে এসে ঝুম কাতর গলায় ফিসফিসিয়ে বললো,
— “নিঝুম এসেছে আম্মা। আমাকে বাহিরে যেতে বলেছে।”

তিনি অবাক হয়ে বললেন,
— “কখন এসেছে?”
— “একটু আগে।”
মিসেস শ্রেয়া আবারো ধমক দিলেন,
— “আহাম্মক! ভেতরে আসতে বলবি না? বাহিরে দাঁড় করিয়ে রেখেছিস কেন?”
মায়ের বকা কানে নিলো না ঝুম। বরং খুশি হয়ে বললো,
— “আমি তাহলে যাই আম্মা?”
— “যা! নিঝুমকে আসতে বলিস।”
— “আচ্ছা।”

বার কয়েক বার মাথা নাড়ালো ঝুম। আত্মীয়-স্বজনদের চোক্ষু আড়ালে দ্রুত বেড়িয়ে পরল বাসা থেকে।

______________________

বাড়ির মূখ্য গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে নিঝুম। হাতে কিছু ব্যাগ। ঝুমকে দেখেই হাসলো সে। ঝুমও হাসলো। কাছাকাছি আসতেই নিঝুম ভরাট গলায় প্রশ্ন করল,
— “এত দেড়ি হলো কেন আসতে?”
— “আম্মু আসতে দিচ্ছিল না। অনেক কষ্ট করে এসেছি।”
নিঝুম হাসে। বলে,
— “বাহ্! পিচ্চি দেখি কষ্ট করতেও জানে।”
নিঝুমের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ঝুমও বললো,
— “প্রেমিকা হয়ে যদি একটু কষ্টই না করি, তাহলে প্রেমিকা হলাম কিসের?”

শুনে হাসির রেশ আরো তীব্র হয় নিঝুমের। লজ্জায় রাঙা ঝুমের মুখ পানে তাকিয়ে রয় কিছুক্ষণ। পরপরই হাতের ব্যাগ গুলো এগিয়ে দিয়ে বলে,
— “তোমরা জন্য।”
ঝুম ব্যাগগুলো নিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়। জিজ্ঞেস করে,
— “কি এখানে?”
— “শাড়ি। আম্মু পাঠিয়েছে।”

উৎফুল্ল মনে ব্যাগগুলো একবার ছুঁয়ে দেখলো ঝুম। নিঝুম আদেশের সুরে আবার বললো,
— “কাছে আসো তো ঝুম। একটু জড়িয়ে ধরি।”
ঝুম চোখ বড় বড় করে তাকালো। আতঙ্কিত গলায় বললো,
— “পাগল হয়েছেন? আমরা উঠোনে! আশেপাশের মানুষ দেখলে কি বলবে?”
— “আশেপাশের মানুষ কি আমাদের এখন দেখছে না?” শান্ত গলায় প্রশ্ন করলো নিঝুম।
ঝুম কিছু একটা ভাবলো। বিড়বিড় করে বললো,
— “তাই তো!”

পরক্ষণেই নিঝুমকে টেনে দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড় করালো। চারদিক ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে নিলো সে। এখন আর কেউ দেখবে না তাদের। ঠোঁটে হাসি ফুঁটিয়ে ঝুম গর্ব করে বললো,
— “এখন আর কেউ দেখতে পারবে না আমাদের।”
— “তাহলে আসো, জড়িয়ে ধরি।”

নিঝুমের কথায় দুষ্টুমির আভা। ঝুম ভ্রু কুঁচকালো। কথা ঘুড়িয়ে বললো,
— “আম্মা আপনাকে বাসায় যেতে বলেছে ডাক্তার।”
— “অন্য একদিন যাবো। হস্পিটালে কিছু কাজ আছে আমার। ছুটিও নিতে হবে।”
ঝুমের মন খারাপ হয়ে গেল নিমিষেই। নিচু গলায় বললো,
— “আচ্ছা।”

বলেই খানিক্ষণ চুপ রইলো ঝুম। নিঝুমও কিছু বলছে না। নিঝুম কেমন গম্ভীর চাহনি নিয়ে গভীর ভাবে তাকিয়ে আছে ঝুমের মুখপানে। চোখে একরাশ মাদকতা মিশিয়ে। হঠাৎ ঝুমকে জড়িয়ে ধরল নিঝুম। বুকের বা’ পাশটায় গভীর ভাবে মাথা চেপে ধরে অস্থির গলায় বলে উঠলো,

— “তুমি আমায় উম্মাদ বানিয়ে ফেলেছো ঝুম। কঠিন উম্মাদনায় অসুস্থ করে ফেলেছো। তোমাকে ভালোবাসা ছাড়া কোনো কাজই এখন ভালো লাগছে না আমার। অসহ্য মনে হচ্ছে!”

_____________________

চারদিকে বহুল মানুষের সমাগম। আলোতে আলোকিত চারপাশ। ঝুম স্টেজের ঠিক মাঝখানটায় বসে আছে। এক এক করে সবাই হলুদ ছুঁইয়ে দিচ্ছে তাকে। ইতোমধ্যে বরযাত্রীর মানুষও এসে গেছেন এখানে। বরযাত্রীর ভীড়ে হঠাৎ স্নিগ্ধ, স্নেহা আর স্নিধাকে দেখতে পায় ঝুম। তারা তিনজনই এগিয়ে আসছে ঝুমের দিকে। কাছাকাছি আসতেই স্নিধা মৃদু চেঁচিয়ে উঠলো,
— “ওয়াও ভাবী। কি সুন্দর লাগছে তোমাকে। একদম পরীর মতো। নিঝুম ভাইয়া দেখলে তো হার্টফেল করবে।”

ঝুম লজ্জায় পায়। লজ্জায় মাথা তুলে তাকাতে পারছে না সে। স্নেহা ঝুমের গালে হলুদ ছুঁইয়ে মিষ্টি হেসে বলে,
— “সত্যি, অসম্ভব সুন্দর লাগছে তোমাকে।”
ঝুম লাজুক হেসে বললো,
— “থ্যাংকিউ।”
পরপরই কিছু একটা ভেবে নিচু স্বরে আবার বললো,
— “আচ্ছা? সে কি এসেছেন?”

তৎক্ষণাত সবাই ‘সে’ বলে টেনে টেনে চেঁচিয়ে উঠলো। পর মুহুর্তে আবার কিছু বলবে তার আগেই স্নিগ্ধর ফোন বেজে উঠে। কল রিসিভ করে স্নিগ্ধ তার ফোন ঝুমের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
— “তোমার সে তো আসে নি ভাবী। কিন্তু তোমাকে দেখার জন্য ভিডিও কল দিয়েছে। নাও! কথা বলো।”

তীব্র লজ্জায় ঝুম মিইয়ে যায়। কাঁপা হাতে ফোন হাতে নেয়। ফোনের স্ক্রিনে নিঝুমের বিরক্তিমাখা মুখ ভেসে উঠছে। টিস্যু দিয়ে গালে লেগে থাকা হলুদ গুলো মুছতে মুছতে নিঝুম বিরক্তি নিয়ে বললো,
— “দেখলে ঝুম? কি সব লাগিয়ে দিয়েছে আমার মুখে। উফ! এসব হলুদের অনুষ্ঠান কি করতেই হতো? সরাসরি বিয়ে করা যেত না? কত কষ্ট করাচ্ছো আমাকে দিয়ে।”

ঝুম লাজুক হাসলো। নিঝুম আবার বললো,
— “হাসবে না। আমার রাগ লাগছে।”
নিঝুমের গম্ভীর কণ্ঠ। ঝুম অবাক হয়। ফ্যালফ্যাল করে তাকায় নিঝুমের দিক। নিঝুম হালকা হাসে। আদুরে গলায় বলে,
— “মজা করছিলাম। হাসো। ভালো লাগছে।”

ঝুম হাসলো না। অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নিলো। প্রচন্ড অভিমান জমেছে ঝুমের মনে। কৃত্রিম অভিমান! নিঝুম এবার শব্দ করে হাসলো। নরম সুরে বললো,
— “এত সুন্দর লাগছে কেন? তোমাকে এখনই উঠিয়ে নিয়ে বিয়ে করতে ইচ্ছে করছে। আসি?”

ঝুম বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে তাকালো। রাগী গলায় বললো,
— “দিন দিন আপনি চূড়ান্ত রকমের অসভ্য হচ্ছেন ডাক্তার। আপনার সঙ্গে একদম কথা নেই।”

নিঝুমকে আর কিছু বলার সুযোগ দিলো না ঝুম। দ্রুত ফোনটা ফিরিয়ে দিলো স্নিগ্ধকে। তা দেখে হাসলো স্নিগ্ধ।

_____________________

চলবে…
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
Ishanur Tasmia