ভুলে যেতে ভালোবাসিনি পর্ব-০৪(বোনাস পার্ট)

0
4790

ভুলে যেতে ভালোবাসিনি
পর্ব-০৪(বোনাস পার্ট)
রোকসানা আক্তার

নাতাশা ডাইনিং-এ যেতেই ছোট এক পিচ্চি বলে উঠে,
——ওই দেখ,ভাবি ভাবি?
পিচ্চিটির হাতের ইশারায় ডাইনিং-এ বসা সবাই নাতাশার দিকে তাকায়।এক বৃদ্ধা বলে,
—–দাদু বোন,তুমি এতক্ষণ কিচেনে ছিলে?
নাতাশা থমকে বৃদ্ধার দিকে তাকায়।বৃদ্ধাকে নাতাশা ভালোভাবে চেনতে পারেনি।আসলে এ বাড়ি আসার পর এখনো নাতাশার কারো সাথে পরিচয় হয়নি।ভেতরে চেনলে এ বাড়ির লোকদের এবং বাহিরে নীরের নানার বাড়ির লোকদের।পাশ থেকে নীরের মামি বলে উঠে,
—–নাতাশা ইনি হলেন তোমার ফুঁপির শ্বাশুড়ি।
নাতাশা বৃদ্ধাকে সালাম করে। বৃদ্ধা খুশিমনে সালাম নিয়ে ঢকঢক করে বলেন,
—–মাশাল্লাহ আমগো নীর খাসা একটা মেয়ে বিয়ে করে আনলো।পুরো বাড়িটায় যেন প্রদীপ ঝলে উঠেছে।

সবার মাঝে ফারিনও ছিল।সে এই প্রশংসা সহ্য করতে না পেরে মুখ ভেংচি দিয়ে বলে,
——মাকাল ফলতো অনেক সুন্দর,কিন্তু ভেতরটা তো ধোঁয়াশার ছাই।ওরকম যেন আবার না হয়ে বসে!
—–তা কইস না বোন।এই মেয়ে এইরকম হইব না।মানুষদের চেহারা দেখলেই বুঝা যায়।(বৃদ্ধা)
—–হু দেখবো তো।এখন শুধু সময় গোনা।
—–ফারিন এত্তকথা না বলে খাওয়াটা শেষ কর বোন।এমনিতেই সবার আগে তোর ক্ষিধে পেয়েছে বেশি খাবার ঠান্ডা হয়ে গেলে পরে আবার কাদিস না।
—-আমি খাবারের জন্যে বুঝি কান্না করি!?আমি কি ছোট বাচ্চা?
—–নাহ তুমি বুড়ো বেটি!হিহিহিহিহি….
প্রিয়ার কথা শুনে সবাই খিলখিলিয়ে হেসে উঠে।প্রিয়া নীরের চাচাতো বোন।প্রিয়ার কথায় ফারিনের মেজাজটা বিগড়ে উঠে।সে কাউকে কিছু না বলে নিচের দিকে মাথা রেখে চামচে আঙ্গুল লাগায়।আর খাওয়ায় মনোযোগ দেয়।
নাতাশা সবাইকে এক্সকিউজ বলে নীরের জন্যে এককাপ চা,একটি ডিমের অমলেট,দুটো পরোটা একটি ট্রেতে সাজিয়ে নেয়।পাশে বসা নীরের কাজিনগুলা একে -অপরকে কানাকানি করে প্রিয়া হাক ছেড়ে বলে,
——ভাবি মানুষতো তোমরা দু’জন।বুঝলাম না এককাপ চা,একটি ডিমের অমলেট,আবার দুটো পরোটাও..ব্যাপারকি ভাবী?টাকা বাঁচাতে এখনই উঠে লেগে গেছো নাকি?
নাতাশা বিষম খায়।
—নাহ মানে সেরকম না।খাবারটা তোমাদের ভাইয়ার জন্যে নিতেছি।
—–বাব্বাহ!সবে বিয়ে হলো এখনই এত্ত কেয়ার।সামনের দিনগুলোতে তো মনে হয় মাথাতুলে রাখবে।
—–তোরা এত্ত কথা বলিস না তো।যাও দাদুবোন তুমি নীরকে গিয়ে উপরে খাবারগুলো দিয়ে আসো।
—–জ্বী,দাদী যাচ্ছি।

নাতাশা ট্রে হাতে নিতেই নীরের আরেক কাজিন বলে উঠে,
——ভাবী আমরা কিন্তু মজা নিয়েছি।আবার সিরিয়াস ভেবো না।
—–আরেহ না।আমি বুঝেছি।
—-ওকে!নীর ভাইয়াকে খাবারগুলো দিয়ে এসে এখানে আবার চলে আসবে কিন্তু।আজ তুমি আমাদের সাথে নাস্তা করবে।কারণ,তোমাকে আমাদের ভীষণ মনে ধরেছে কিউট ভাবী!

নাতাশা ওদের কথায় মুঁচকি হেসে সিড়ি বেয়ে উপরে চলে আসে।দরজাটা ঠেলে ভেতরে ঢুকে।নীর এখনো শুয়ে আছে।আর শুয়ে শুয়ে মোবাইল ঘাটাঘাটি করছে।নাতাশা হালকা একটা কাশি দেয় নীরের দৃষ্টি আকর্ষনের জন্যে।নীর সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে নিজকাজে মগ্ন।আসলে মগ্ন বললে ভুল হবে নাতাশার উপস্থিতি জেনেও এখন না জানার ভানে আছে।
নাতাশা গলার আওয়াজ টেনে বলে,
—–আপনার নাস্তা রেখে গেলাম।খেয়ে নিবেন।
—–যেখানের খাবার সেখানে রেখে আসো।(পূর্বদৃষ্টি বজায় রেখে)
—–যার জন্যে এখন এনেছি সে খাবে।আবার পূর্ব জায়গায় রাখবো মানে?এসব কেমন কথা?

নীর চোখের সামনে দেখে মোবাইলটা নিচে এনে নাতাশার দিকে তাকায়।খানিক বিরক্তি নিয়ে বলে,
—-কিছুক্ষণ আগেতো বললে আমি জোর করে অধিকার খাটাই।এখন উল্টে ভাজা মাছটি তো আমার উপরঔ খাচ্ছো!আমি একবার যেহেতু বলেছি খাবো না তাহলে বার বার কথা বাড়ানো কোন বদভ্যাস!
—-“খাবো না ” পৃথিবীতে এরকম কোনো শব্দ নেই।নিয়ে এসছি খাবেন,আর কি খাবেন!শুনতে পেয়েছেন!

নীর এবার ক্রুদ্ধ হয়ে কম্বলটা একসাইডে ফেলে বিছানা থেকে নেমে নাতাশাকে বলে,
—–তুমি আর কখনো আমার সামনে আসার চেষ্টা করবে না।যতটা সম্ভব দূরে থাকবে,তোমার জন্যে ততটাই ভালো হবে।আমি এসব উটকো ঝামেলা মাথার উপর নিয়ে ঘুরি না।
কথা শেষ করেই নীর বাথরুমে চলে যায়।নাতাশা গম্ভীর মনে নীরের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে।কষ্ট পেলেও কষ্টকে সে কিছুতেই সায় দিবেনা।আবার স্বাভাবিক হয়ে বিছানার দিকে হেটে আসে।অগোছালো রুমটাকে গোছাতে কাজে লেগে যায় নাতাশা।ডলগুলো বিছানায়,ড্রেসিং টেবিলে সুন্দর করে তাকে তাকে সাজিয়ে নেয়।ফুলদানি গুলো টি-টেবিল এবং ওয়াড্রবের উপরে রাখে নিঁখুতভাবে।তাছাড়া রুমটা গোছানোর সময় নাতাশার আরেকটা দিক নজরে আসে। গ্লাসের জানলা ভেদ করে ওপাশে একটা পাখির খাঁচা।খাঁচার মধ্যে কোনো পাখি নেই।খাঁচাটির ভেতরে পাখির পানাহার করার বাসন আছে।
নাতাশার মাথায় একটা প্রশ্ন আসে।সবকিছুই ঠিক আছে তবে পাখি নেই কেন এরমধ্যে?
খাঁচাটির ভেতরের প্রস্তুতি বলছে আগে নিশ্চয়ই এখানে কোনো পাখি পালন করা হয়েছিল।নীর কি তাহলে পাখি পোষতে পছন্দ করে?সবার জীবনে তো এক একটা শখ থাকে।নীরের কি পাখি পালন করা শখ?তবে কোন পাখি??

এসব ভাবতে ভাবতে নীরের কথায় নাতাশার ধ্যানভাঙ্গে।নাতাশা নীরের দিকে তাকিয়ে থতমত খায়।তোতলে তোতলে বলে নাতাশা,
—–জ্ব-জ্ব-জ্বী কিছু বলছেন?
—–এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে আমি তোয়ালেটা নিব কিভাবে?!
নাতাশা এতক্ষণ যে কাবাবের সামনে দাড়িয়ে ছিল তা তার খেয়ালই ছিলনা।সে তড়িঘড়ি সরে দাড়ায়।নীর কাবাব থেকে একটা তোয়ালে নিয়ে হাতমুখের পানি মুছতে থাকে।তারপর একটা ক্রিম কালার গেন্জি পরে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।আর নাতাশার দৃষ্টি যায় ট্রে তে সাঁজানো নাস্তাগুলোর দিকে।নাতাশা মুখে হাসি এনে বলে,
—–ভালোবাসি না বললেও যে আমি ভুলে যাবো তা না!আমি তোমাকে ভুলে যেতে ভালোবাসিনি নীর!

নাতাশা কাপড়ের আঁচল টেনে নিচে আসে।সিড়ি থেকে নামার পরই ফাহাদ এসে সামনে দাঁড়ায় নাতাশার আকুতি স্বরে বলতে থাকে,
—–কাকীমা,আমার পায়েস খেতে ভীষণ ইচ্ছে হয়েছে।তুমি আমায় পায়েস রান্ন করে খাওয়াবা?

ফাহাদের ফুটিফুটি মুখে একথা শুনে নাতাশার হৃদয়ে ভীষণ মায়া জমে।সে ফাহাদকে কোলে তুলে বলে,
—–বাবা তুমি একটু অপেক্ষা করো।এইতো আমি তোমার জন্যে পায়েস রান্না করতে যাচ্ছি।ঠিক আছে?
—-আচ্ছা কাকীমা।

নাতাশা ফাহাদের কপালে একটা চুম্বন দিতেই শিরিন শাহের দিকে নজর যায়।সে দুষ্টহাসিতে নাতাশার দিকে তাকিয়ে আছে।নাতাশা যে তার দিকে তাকিয়ে আছে তা তার ঠাহরে আসতে তাড়াতাড়ি চোখদুটো নিচে নামিয়ে ফেলে।নাতাশা বুঝতে পেরেছে উনিই ফাহাদকে শিখিয়ে দিয়েছেন তাকে এসব বলার জন্যে।শিখিয়ে দিলেও কি ফাহাদের জন্যে নাতাশা এমনিতেও পরে নিজ থেকে পায়েস রান্না করতো।
নাতাশা কিচেনে গিয়ে কাউকে দেখতে পায়নি।আড়াল থেকে রহিমা খাতুনকে ডেকে নেয়।আর পায়েস রান্নার উপকরণাদি গুলো কালেক্ট করে।পায়েস ছড়ানোর পর ডাইনিং থেকে সবার চিৎকার,হৈ-হুল্লোড়ের আওয়াজ আসে কিচেনে।নাতাশা মাথাটা এগিয়ে হালকা উঁকি মারে।নীরকে সবার মাঝে দেখতে পায়।একগাদা কাজিন নিয়ে গল্প জুড়ে দিয়েছে ও!তবে একটা জিনিস নাতাশার মনকে ধেয়ে নেয়। ফারিন নীরের কোল ঘেষে বসে আছে।এমনভাবে নীরের পাশে বসেছে যেন তার বউ!।
তা দেখে নাতাশার ভ্রু কুঁচকে আসে।সে ফারিনকে ঠিকভাবে চিনতে পরাতেছে না।ও নীরের কেমন রিলেটিভ হতে পারে।
—–হায় আপা,দুধতো উৎরে পইড় গেলো!!
পেছন থেকে রহিমা খাতুনের কথা শুনে মাথাঘুরে তাকায় নাতাশা!
—–হু!সত্যিইতো!অনেকগুলা দুধ নিচে পড়ে গেছে।আসলে আমার খেয়ালে ছিলনা।
—-খেয়াল থাকবে কেমনে আপা!এহন খেয়াল তো ভাইয়ার দিগে!যেভাবে মাথা উঁচিয়ে ভাইয়ার দিগে তাকাইলেন মনতো চুরি হইয়া গেছে আপনের!

নাতাশা লজ্জ্বা পেয়ে যায়।হাই তাই করে বলে,
—-আচ্ছা আমাকে একটা কথা বলবেন?
—-কি জানবার চান, কন?
—-আপনার নীর ভাইয়ার পাশে যে মেয়েটা বসে আছে ও নীরের কি হয়?
—-হায় আপনে জানেন না?
—-নাহ।
—-ওই মাইয়া আমগো নীর ভাইয়ার বেয়াইন।ওই মাইয়া তো নীর ভাইয়ার লিগ্গা পাগল!

এরই মাঝে কোহিনুর বেগম কিচেনে চলে আসেন।উনি রহিমা খাতুনকে ধমকে বলেন
—-এই তোকে না বললাম ছাদে জামাকাপড় গুলো দিয়ে আসতে?তুই এখানে কি করছিস?
—-ছরি খালাম্মা!মনে ছিলনা।
—-রাখ তোর স্যরি।তাড়াতাড়ি যা।

রহিমা কিচেন থেকে চলে যায়।কোহিনুর বেগম নাতাশার দিকে আড়নয়নে তাকিয়ে বলেন,
—-কি ব্যাপার তুমি কিচেনে কি করো?সবাই ওখানে আড্ডা দিচ্ছে আর তুমি এখানে একা….
—-মা আসলে ফাহাদের জন্যে পায়েস রান্ন করতে এসেছি।ভাবির অবশ্য দোষ নেই আমি নিজেই রান্না করতে এসছি।ফাহাদ ছোটতো।ছোট মানুষের আবদার আমি ফেলতে পারিনা।

কোহিনুর বেগম একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে নাতাশার কাঁধে হাত রেখে ক্ষীণস্বরে বলেন,
—-দেখ মা আবদার পালন করা ভালো।তবে সুযোগে কাজে লাগানো আবদার থেকে দূরে থাকা ভালো।

এ কথা বলে কোহিনুর বেগম চলে যান।নাতাশা উনার কথার অর্থ বুঝতে পারেনি।নাতাশা এখন ওই ভাবনায় নেই,সে এখন নীর এবং ফারিনের ভাবনায়।আর রহিমা খাতুন বলে যাওয়া দোটানা বুলির ভাবনায়।কেনজানি নাতাশার মনটা খারাপ হয়ে যায়। চোখভরে অশ্রু টলমল খায়।পানিটা কি প্রিয় মানুষটিকে একমুহূর্তে হারানোর ব্যথায়!
নাহ নাহ নীর কারোই না!নীর শুধুই নাতাশার!শুধুই নাতাশার!

চলবে…