ভুলে যেতে ভালোবাসিনি পর্ব-০৫

0
4153

ভুলে যেতে ভালোবাসিনি
পর্ব-০৫
রোকসানা আক্তার

পায়েসটা ঘন হয়ে আসে।নাতাশা উদাস মনে চুলা থেকে পাতিলটা নামায়।পাতিলে খানিকটুকু রেখে বাদবাকি পায়েস পিরিচে তুলে নেয়।চামচ পিরিচের উপর রেখে মাথার ঘোমটা বড় করে টেনে কিচেন থেকে বের হয়।নাতাশার ডাইনিং-এ আসা দেখেই প্রিয়া গলা উঁচিয়ে বলে,
—-ভাবী?কোথায় ছিলে এতক্ষণ? আমরা সবাই এখানে মজা করছি আর তুমি একা একা কি করো?এখানে এসো।
নাতাশা ছলছল চোখে প্রিয়ার দিকে তাঁকিয়ে মুচকি হেসে হ্যাঁ বলে।তারপর চারপাশটা তাকায়।কিন্তু ফাহাদকে কোথাও দেখতে পায় না।রহিমা খাতুন বালতি হাতে লাফ মেরে মেরে সিড়ি বেয়ে নিচে নামে।নাতাশা তা এলখ করে রহিমা খাতুনকে উদ্দেশ্য করে বলে,
—-আচ্ছা,ফাহাদকে কোথাও দেখতে পাচ্ছি না।আপনি কি তাকে কোথাও দেখেছেন?
রহিমা বালতিটা জোড়হাতে পেছনের দিকে রেখে হেলেদুলে বলে,
—-হ্যা আপামণি,এহন তো দেইখা আইলাম ছাদে।
—-আচ্ছা তুমি বড়ভাবিকে এই পিরিচটা দিয়ে এসো।বলবে ফাহাদের পায়েস নাতাশা আপা দিয়েছেন।
—আইচ্ছা আপা।দেন।আমি দিয়া আইতাছি।
নাতাশা পিরিচটি রহিমার দিকে এগিয়ে দেয়।রহিমা পিরিচ হাতে নিয়ে ধীর পা ফেলে সিড়ি বেয়ে উপরে চলে যায়।
নাতাশা একটা প্রশান্তির দম ছেড়ে পূর্বদিকে ক্ষীণদৃষ্টি দেয়।ফারিন নীরের কোল ঘেষে এখনো বসে আছে,তাও আগ থেকে কিঞ্চিৎ বেশি।চোখদুটো স্থির না রাখতে পেরে উপরে চলে আসে।ভারী বুকটা ধুকপুক করছে নাতাশার।কণ্ঠধ্বনি গলা অব্দি আঁটকে আছে।রুমের ফ্যানটা ছেড়ে দেয়।সোফার উপর বসে নীরের কথা ভাবতে থাকে।ফারিন নীররে পাশে বসে থাকাটা নাতাশার একদম সহ্য হচ্ছে না।কোনোকিছুতেই না!ওই মেয়েটির গলা চাপড়ে কামড়াতে ইচ্ছে হচ্ছে তার।
—-এভাবে পর পর ভেবে দূরে থাকো কেন?তখন যে বললাম আমাদের সাথে আড্ডা দিতে তা না তুমি একগুঁয়ে এখানে চলে আসলে!এটা কি ঠিক করলে ভাবী?
নাতাশার টনক নাড়ে।চোখতুলে তাকায়।সামনে প্রিয়া দাঁড়িয়ে আছে।নাতাশা থতমত খেয়ে যায়।
—-আ-আ-আসলে প্রিয়া আমার মনেই ছিলনা।সত্যি আমি ভুলে গেছি।আই এম স্যরি। আর কখনো এমনটি হবে না।

প্রিয়া নাতাশার পাশে বসতে বসতে বলে,
—আরেহ তার জন্যে আবার স্যরি বলতে হয় নাকি?হু?আর কখনো স্যরি বলবে না, ওকে?আমি জাস্ট মজা করেছি।
নাতাশা মৃদু হাসে।প্রিয়া অধীর আগ্রহে নতাশার হাত ধরে জিজ্ঞেস করে,
—আচ্ছা ভাবী?তোমার বাসায় কে কে আছেন?
—আমি,মা,বাবা,আমার ছোট বোন নিতু আর ছোটভাই নিদ!
—ওয়াও!নামগুলোর হেব্বি মিল।বায় দ্য ওয়ে, তুমি এখন কিসে পড়ো?
—এইতো কিছুদিন পর ফাইনাল ইয়ার এক্সাম চুঁকাইবো।দ্যান অনার্স শেষ।
—ওয়াও!!অনার্স কি পিরোজপুরই করতেছ?
—হু!।
—ওহহ।তুমি দেখতে কিন্তু দারুণ ভাবী!গ্রামের মেয়েরা যে এত্ত সুন্দর হয় তা আমার ধারণার বাহিরে ছিল।নীর ভাইয়া সো লাকী তোমার মতো কাউকে পেয়ে।

প্রিয়ার কথায় নাতাশার কপালের ছোঁয়াল শক্ত হয়ে যায়।নিজেকে স্বাভাবিক করে প্রিয়ার সাথে তাল মিলিয়ে কৃএিম হাসে।কথা শেষ হলে নাতাশা প্রিয়ার সাথে নিচে আসে।নিচে এসে দেখে চারপাশটা সুনশান নিরবতা।প্রিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে,
—কী ব্যাপার প্রিয়া?সোফার উপর বসা পিপড়াদের দল কোথায়?
—সেন্টারে গিয়েছে সবাই!!
—সেন্টার!সেন্টারে কেন?
—ওমা কাল যে তোমার বৌ-ভাত তুমি ভুলে গিয়েছ নাকি।বৌ-ভাত এরেন্জের প্যান্ডেল সাজানো দেখতে সবাই সেন্টারে গিয়েছে।বুঝলে এখন?
—ওহহ,হু।তোমার নীর ভাইয়া কোথায় গেছেন?
—কী ভাবী?ভাইয়াকে না দেখতে পেয়ে মনটা আমচান করছে নাকি?(চোখ টিপে)
—তুমি-না..?
—আরেহ ভাবী এটাও ফল্ট,,হিহিহিহিহি।
এভাবে দিনের দু’ভাগ সময় কেটে যায়।সবাই সেন্টার থেকে বাসায় ফিরে।আর সবাই সেন্টার সাজানোর সৌন্দর্য্যতায় প্রশংসায়য় মুখর। সূর্যের আলো অন্ধকারে ডুবে কালো ছায়া চারদিক ছড়িয়ে পড়ে।তারপর সবাই রাতের ডিনার শেষ করে।নীর সকালে প্রিয়াদের সাথে আড্ডা চুঁকিয়ে বের হয়, এখন ঘড়ির কাঁটা এগোরটা ছুই ছুই।এখনো নীর বাসায় ফিরেনি।নাতাশা সবার সাথে ডিনার করেনি।নীর বাসায় ফিরলে একসাথে ডিনার করবে কোহিনুর বেগমকে তাই বলে।
নিরিবিলি একা ডাইনিং চেয়ারে বসে চোখের পাতা টলছে,মাথাটা টেবিলের দিকে ঝুঁকে আসছে নাতাশার।তন্দ্রা ঘোরে চেয়ারে আবার সরু হয়ে বসে আর সদরের দিকে বার বার তাকায়।কিছুক্ষণ পর নীর ভেতরে প্রবেশ করে।নাতাশা আঁচল টেনে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ায়।নীরের পায়ের দৃষ্টি সিড়িতে প্রদক্ষিণ হতেই নাতাশা গলা ছেড়ে বলে,
—-আপনার জন্যে টেবিলে খাবার রাখা আছে।
নীর নাতাশার কথায় ভ্রূক্ষেপ না করে নিজমনে সিড়ি বেয়ে চলে যায়।নাতাশা খানিক বুকে কষ্ট চেপে নীরের জন্যে প্লেটে খাবার বেড়ে নেয়। খাবার নিয়ে রুমে আসে।নীর গাঁয়ের গেন্জিটা খুলে বিছানার একসাইডে ফেলে রাখে।আর তোয়ালে হাতে নিয়ে বাথরুমে পা বাড়ায়
—খাবার ঠান্ডা হয়ে যাবে!গোসলটা নাহয় পরে করে নিয়েন!
—রক্ষিতা হয়ে আদেশ করতে এসছো নাকি অধিকার চাইছো!?
—খাবার রিলেটেড জবাব চাইছি।অন্যকিছু শুনতে আসিনি।

নীর নাতাশার দিকে মাথা ঘুরে তাকায়।টগবগ চোখে বলে,
—অযোগ্য মানুষও যে যোগ্যতার অধিকার নিয়ে কথা বলে, তা তোমায় না দেখলে বুঝতাম না।নিজে নিজের সীমার মধ্যে থাকার চেষ্টা করো!বরঞ্চ তোমার জন্যেই ভালো।
নাতাশা মুখ ফুটে কিছু বলেনি!মনের সঙ্গে যুদ্ধ করে নিজেকে দমিয়ে রাখে।আর চোখবুঁজে সবটা কথা শুঁকে নেয়।কারণ, এখন সে কথা বাড়াতে গেলে নীর ভাতের প্লেট এক ঝাটকায় ফেলে দেবে।নাতাশা প্লেটটি টি-টেবিলের উপর রেখে দরজা ঠেলে বাহিরে চলে যায়।নিচে নেমে ডাইনিং-এ আসে।রহিমা খাতুন প্লেটগুলো এক এক করে সাজিয়ে সাইড করছে।নাতাশা রহিমা খাতুনকে বলে,
— খাবারগুলো কিচেনে নিয়ে যাও।

রহিমা আড়নয়নে নাতাশার দিকে তাকায়।বিস্মিত গলায় বলে,
—আপনের শরীর খারাপ আপা?
—নাহ।এই মুহূর্তে খেতে ইচ্ছে করছে না।
—আমিতো আপনের প্লেট দেইখা খাবারগুলো আর গুছাই নাই।।ভাববলাম আপনি খাইবেন,কিন্তু এহন বলতাছেন খাইবেন না।

নাতাশা কিছু আর না বলে চিকেন,পোলাও, ভেজেটেবল কুকার সবগুলোর উপর ঢাকনা টেনে দেয়।
—এই নাও,আমি ঢাকনা টেনে দিলাম।এগুলো সব বড় পাতিলে ঢেলে নিয়ে রেখে দিওও।
রহিমা মুখে শব্দ না তুলে মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়।

নাতাশা আলতো হাতে সিদ্ধি কপালের ঘাম মুছতে মুছতে রুমে ঢুকে!রুমের দরজায় পা ফেলতেই নীরের ঝংকার আওয়াজ ভেসে উঠে।
—ওখানেই দাড়াও!ভেতরে আসার দরকার নেই!
নাতাশা হতচকিত হয়ে থমকে দাড়িয়ে যায়। টি-টেবিলের উপরে রাখা ভাতের প্লেট নাতাশার দিকে এগিয়ে দেয় নীর।
—-যেখানের খাবার সেখানে রেখো এসো!আমি আজ বন্ধুদের বাসা থেকে খেয়ে এসছি!আর হুমম?খাবার রেখে দেওয়ার পর আমার রুমে আর আসবে না।আমি এখন দরজা লক করে ঘুমিয়ে পড়বো।

এ বলে বলা দরজা টেনে বন্ধ করে নেয় নীর। নাতাশা নীরকে কিছু বলারও সময় পায়নি।নাতাশার মন খারাপটা এখন দ্বিগুণ বেড়ে যায়।ক্রুদ্ধ হয়ে উঠে নীরের প্রতি।কারণ,এত্ত রাতে সে এখন কোথায় ঘুমাবে!কারো যদি নজরে যায় নতুন বউ বাহিরে এভাবে দাড়িয়ে তাহলে খারাপ ভাববে!নাতাশার বুকফেটে কান্না করতে ইচ্ছে হয়।কাঁদতে পারছে না।পুরো শরীর থরথর কেঁপে উঠে।আর থরথর কাঁপুনির কারণে হাতে থাকা প্লেট নিচে পড়ে যায়।
ফ্লোরে ম্যালামাইন পড়ায় খুব জোরে শব্দ হয়।নাতাশা আতঙ্কে মনে তড়িঘড়ি ফ্লোরের ভাত প্লেটে উঠাতে শুরু করে।নাতাশাদের পাশের রুমটি প্রিয়ার ছিল।সে আওয়াজ শুনে বাইরে আসে।
—ভাবী?কিছু হয়েছে?
নাতাশা ভীতুমনে প্রিয়ার দিকে তাকায়।তোতলে তোতলে বলে,
—নাহ মানে —তোমার ভাইয়ার জন্যে খাবার নিয়ে ঢোকার সময় দরজার সাথে ঘেষে হাত থেকে প্লেটটি নিচে পড়ে যায়।
—ওহহ আচ্ছা।নীর ভাই এখন এসছেন?
—হ্যাঁ!
—ওকে তাহলে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে যেও।বায় গুড নাইট।
—গুড নাইট!
প্রিয়া রুমে ঢোকে দরজা বন্ধ করে নেয়।
বদ্ধ রুমে আওয়াজ আসাতে নীর দরজা খুলে।এরইমধ্যে নাতাশার উপচে পড়া ভাত উঠানো শেষ হয়।নীর কটু গলায় বলে,
—কি হয়েছে এখানে?এত্ত শোরগোল কিসের?
নাতাশা চতুরতা মিশ্রিত কন্ঠে বলে,
–মা এসছেন এখানে মাএ।বলেছেন আপনার সাথে কি নাকি কথা আছে সেজন্যে একটুপর এ’রুমে আসবেন।

নীর অনেকক্ষণ অব্দি চুপ হয়ে থাকে।কিছু আর না বলে দরজা চেপে দেয়।
নাতাশা শতানী মুখে একটা হাসি দিয়ে উঠে।আর মনে মনে ভাবে,
—যাক ট্রিকস টা অবশেষে কাজে লাগলো!

পরক্ষণে নিচে নেমে ভাতগুলো একটা প্যাকেট ফুরে ময়লা ঝুড়িতে রেখে দেয়।আর বেসিনে হাতদুটো ধুঁয়ে নেয়।নীরের রুমের সামনে এসে একফালি মুখে হাসি টেনে নেয়।দীর্ঘ নিশ্বাস বের করে ভেতরে প্রবেশ করে।

সড়াৎ সড়াই দরজাটা বন্ধ করে দেয়।নীর আচমকা হয়ে জিজ্ঞেস করে,
—তুমি এখানে?আর দরজা বন্ধ করছো কেন?মা নাকি রুমে আসবেন!
নাতাশা বিছানার কাছে গিয়ে বালিশ হাতে নেয়,আর বলে,
—কেউই আসবে না!
নীর নাতাশার চালাকি বুঝতে পেরে দাঁতগুলো কটমট করে এবং খামচে নাতাশার বহু ধরে ফেলে!
—তারমানে তুমি মিথ্যে বললে রুমে ঢোকার জন্যে?

নীর নাতাশার নরম বাহুতে এতটাই জোরে চেপে ধরেছে যেখানে ধড়ফড় ব্যথা অনুভূত হওয়ার উপক্রম।
–প্লিজজ ছাড়ুন!লাগছে!ছাড়ুন বলছি!
–তোকে ছাড়বো আমি?তুই যেই অধিকারে এখানে ঢুকেছিস সেই অধিকারে এখন তোকে মারবো!

এ বলে নাতাশার অপর বাহুতেও চাপ দেয়।প্রচন্ড ব্যথায় নাতাশার জান বেরিয়ে যাচ্ছে,তবুও নীর ছাড়ছে না।নাতাশার ভীষণ চিৎকার দিতে ইচ্ছে হচ্ছে!লোকলজ্জার ভয়ে চিৎকারের আওয়াজও গলা দিয়ে আসছে না।নাতাশা এবার ব্যথাকে উপেক্ষা করে নীরকে উদ্দেশ্য করে বলে,
—যেহেতু মারতে অধিকার পেয়েছেন তাহলে আদর করার অধিকারও আছে।
নাতাশার কথাশুনে নীরের দু’কান গরম হয়ে যায়।আর ঠাঁটিয়ে একটা চড় মারে।
—তোকে আদর!তাও আমি!?এই নীর চৌধুরী?হাহহাহাহা..বাঁশঝাড়ে শুয়ে আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখছিস নাকি?হু?তোকে যে স্পর্শ করে মারধর করছি এটাকেই অমাবস্যার চাঁদ ভাবিস,বুঝলি?
নাতাশার চোখমুখ খাঁড়া হয়ে যায় নীরের এরকম কার্পন্য কথায়।নীরের সাথে এখন কথা বাড়াতে ইচ্ছে হয়না নাতাশার।কারণ,কাল নাতাশার বাড়ি থেকে লোকজন আসবে,উনােদর সামনে যদি নীর মুখকালো ভাব নিয়ে থাকে তাহলে নাতাশার মা-বাবা ভীষণ কষ্ট পাবেন।।
নাতাশা নিজের মনকে সায় দেয়।আর চোখবুঁজে নিজমনকে বলে,
—প্লিজজ নাতাশা,কুল!কুল!কয়েকটা দিন যেতে দে!তারপর নাহয় জবাব তুলিস।তবে এখন না!কারণ,এখন তোর মা-বাবা!তুইতো জানিস তোর বাবা হার্টএট্যাকের রোগী।যদি এসব উনার কানে ঘেষে, তাহলে উনি মরেই যাবেন।

মুহূর্তে নাতাশা মনথেকে সব ধুয়ে ফেলে।বালিশটা নীরের পাশ থেকে নিয়ে সোফার কাছে চলে যায়।আর দু’চোখ বন্ধ করে গুটিসুটি হয়ে ঘুমানোর চেষ্টায় লেগে যায়।

চলবে…