#ভয়ংকর_সে #পর্ব_২৮
#M_Sonali
মহিষের রক্ত খাওয়া শেষ হতেই আশেপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিল শ্রাবণ। তারপর ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা রক্তটুকু জিভ দিয়ে চেটেপুটে খেয়ে নিল। মুখে ফুটে উঠল বিশ্রী এক ভয়ঙ্কর হাসি। সে এদিক ওদিক তাকিয়ে আবারো বাঁদুড়ের রূপ নিয়ে উড়াল দিলো আকাশ পানে।
পুরো বাড়িটা খুঁজেও শ্রাবণকে কোথাও খুঁজে পায়নি চাঁদনী। শুধু শ্রাবনকেই নয়, বাসার কোন কাজের লোক কেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সবাই হঠাৎ কোথায় উধাও হয়ে গেল সেটা ভেবেই যেন বারবার ভয় করছে তার। সে এদিক-ওদিক খুঁজতে খুঁজতে দোতালার একটি রুমের সামনে গিয়ে থমকে দাঁড়ায়। বাসার প্রতিটা রুম খোলা থাকলেও এ রুমের দরজাটা ভেতর থেকে লাগিয়ে দেওয়া। চাঁদনী এর আগেও এখানে এসেছে। কিন্তু এখানে তালা লাগানো ছিল বাইরে থেকে। যদিও এ ব্যাপারে তেমন কিছু জিজ্ঞেস করা হয়নি কাউকে। কিন্তু এখন তো তালা দেওয়া নেই। ভেতর থেকে লাগিয়ে দেওয়া। চাঁদনীর মনে সন্দেহ জাগলো। তাই সে এবার সিদ্ধান্ত নেয় রুমে ঢুকে দেখবে। বেশ কয়েকবার দরজায় টোকা দেয়। কিন্তু ভেতর থেকে কোনোরকম সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না।
চাঁদনী আবারও দরজায় টোকা দেওয়ার জন্য হাত বাড়ায়। তখনই তার মনে হয় তার পিছনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। পরক্ষণেই থমকে যায় সে। ভয়ে ভয়ে পিছন ফিরে তাকাতেই যেন পায়ের নিচের মাটি সরে যায় তার। তার সামনে ভয়ংকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল বড় এক বাদুড়। বাদুড় টাকে দেখতে একদম কালো কুচকুচে রঙের। ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আছে সুচালো দুটো দাঁত। পাখা দুটো মেলে আছে সে। অসম্ভব ভয়ংকর লাগছে বাঁদুড় টাকে। বাদুড়টা প্রায় চাঁদনীর সমানই হবে। সে ভয়ে পিছিয়ে যায়। সাথে সাথে আটকে যায় পিছনে থাকা দরজার সাথে। কোন দিকে পালাবে ভেবে পায়না সে। মুহূর্তে তার শরীরের রক্ত যেন হিম হয়ে যেতে থাকে। শরীরের প্রতিটি লোম দাঁড়িয়ে যায় ভয়ে। বাদুড়টা অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে আছে তার দিকে লোভাতুর দৃষ্টিতে। যেন এখনি গিলে খাবে তাকে।
চাঁদনী এবার প্রচন্ড রকম ভয় পেয়ে জোরে চিৎকার দিয়ে উঠে। ওর চিৎকার শুনে বাইরে থেকে কেউ একজন ছুটতে ছুটতে উপরে আসে। সে আর কেউ নয় বাইরের বাগানের পরিচর্যায় থাকা একটি বয়স্ক লোক। যাকে কাজের লোক হিসেবে রাখা হয়েছে। লোকটি এসেই বাদুরের পিছনে দাঁড়িয়ে এতবড় একটি বাদুড় দেখে ভয় পেয়ে যায়। চাঁদনী তাকে দেখে মনে কিছুটা সাহস ফিরে পায়। তখনই বাদুড়টা ওর দিক থেকে চোখ সরিয়ে পিছনে থাকা লোকটির দিকে তাকায়। তারপর মুহূর্তেই ছুটে যায় তার দিকে। লোকটিকে আঁকড়ে ধরে গলায় নিজের ধারালো দাঁত বসিয়ে দেয়। মুহূর্তের মাঝে লোকটি ঢলে পরে মৃত্যুর কোলে।
লোকটির রক্ত পান করা শেষে বাদুরটি এবার চাঁদনীর দিকে ফিরে তাকায়। তার মুখটা রক্তে ভরা। মুখের চারিপাশ দিয়ে রক্ত টপটপ করে গড়িয়ে পড়ছে। এমন বীভৎস দৃশ্য দেখে চাঁদনী আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেনা। গল গল করে বমি করে দেয়। এদিকে ভয়ে তার অবস্থা খুব খারাপ। বাঁদুরটা এবার মুখে বিশ্রী হাসি নিয়ে এগিয়ে আসতে থাকে তার দিকে। চাঁদনী কি করবে ভেবে না পেয়ে দৌড়াতে থাকে। কিন্তু দৌড়িয়ে কোথায় পালাবে। বাঁদুড়টা উড়াল দিয়ে গিয়ে তার সামনে দাঁড়ায়। চাঁদনী বুঝতে পারে আজ হয়তো তার শেষ দিন। সে আর বাচবেনা বাদুরের হাতেই জীবন যাবে তার। যদিও সে জানে না এই বাদুড় রুপি ভ্যাম্পায়ার টা আসলে শ্রাবন নাকি অন্য কেউ।
ঘটনার আকস্মিকতায় চাঁদনী কিছু বুঝে ওঠার আগেই বাদুরটি ঝাঁপিয়ে পড়ে তার উপর। মুহুর্তেই তার গলায় বসিয়ে দেয় সুচালো দুটি দাঁত। মরণ যন্ত্রণায় চিৎকার করে ওঠে চাঁদনী। সারা শরীরে যেন অসম্ভব রকম যন্ত্রণা শুরু হয় তার। সে নেতিয়ে পরে সেখানেই। তারপর আর কিছু মনে নেই তার।
যখন জ্ঞান ফিরে তখন নিজেকে বিছানায় আবিষ্কার করে চাঁদনী। সারা শরীরে অসম্ভব ব্যথা তার। উঠে বসার মতো শক্তি নেই বিন্দুমাত্র। হাত-পা যেন নাড়াতে পারছেন। সে টিপটিপ করে তাকিয়ে এদিক ওদিক দেখার চেষ্টা করে। দেখে পুরো রুমটাই খালি। সে একাই বিছানায় শুয়ে আছে। শরীরের যন্ত্রণায় যেন অসহ্যকর অবস্থা তার। কষ্টে চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে দুফোঁটা অশ্রু জল। সে নিজের ডান হাতটা খুব কষ্টে নিজের গলার কাছে নিয়ে আসে। গলায় আলতো করে হাত রেখে দেখে সেখানে ব্যান্ডেজ করা।
তীব্র যন্ত্রণায় কুকিয়ে ওঠে সে। কিন্তু একটু জোরে কান্নার মত যেন শক্তি নেই তার। তখনই সে বুঝতে পারে রুমের মাঝে কেউ প্রবেশ করছে। খুব কষ্টে সামনের দিকে দৃষ্টি রাখে সে। দেখে শ্রাবণ হাতে এক গ্লাস গরম দুধ নিয়ে এগিয়ে আসছে তার দিকে। চাঁদনী এবার ছোট্ট করে একটি নিঃশ্বাস ছাড়ে। উঠে বসার চেষ্টা করে। কিন্তু কিছুতেই পেরে ওঠে না। তাই চুপচাপ শুয়ে থাকে। শ্রাবন গ্লাসটা হাতে নিয়ে তার পাশে এসে বসে। গ্লাসটা টেবিলের উপর রেখে ওর ডান হাতটা নিজের দুই হাতের মুঠোয় নিয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলে,
“আই এম সো সরি চাঁদ পাখি। আমি ভাবতেও পারিনি কিছুক্ষণের জন্য তোমাকে চোখের আড়াল করায় এত বড় বিপদে পড়ে যাবে তুমি। ঠিক সময় মত আমি না আসলে হয়তো তোমাকে আজ হাড়িয়েই ফেলতাম।”
চাঁদনী ওর কথার কোন উত্তর দেয় না। চুপচাপ তাকিয়ে থাকে ওর দিকে। আসলে কিছু বলার মত শক্তিটুকুও তার মাঝে অবশিষ্ট নেই। ওকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে শ্রাবণ এবার ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
“একটু কষ্ট করে উঠে বসার চেষ্টা করো চাঁদ পাখি। এই দুধটুকু খেয়ে নাও। এটা খেলে দেখবে তুমি একদমই সুস্থ হয়ে যাবে।”
কথাটি বলেই ওর পিছনে হাত রেখে ওকে জোর করে তুলে বসায় শ্রাবণ। যদিও চাঁদনীর প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছিল উঠে বসতে। তবুও সে উঠে বসে। কিন্তু মুখে কিছু বলার মত শক্তি পায় না। শুধু হালকা কোঁকিয়ে ওঠে। শ্রাবণ দুধের গ্লাসটা হাতে নিয়ে ওর মুখের সামনে ধরে আবেগী গলায় বলে,
“ধীরে ধীরে কষ্ট করে এই সবটুকু দুধ খেয়ে নাও। দেখবে তুমি একদম সুস্থ হয়ে যাবে।”
কথাটি বলে এক প্রকার জোর করে ওর মুখের সামনে দুধের গ্লাস টা চেপে ধরে শ্রাবণ। চাঁদনী এতে বেশ বিরক্ত হয়। কিন্তু বাধা দেওয়ার মতো শক্তি নেই তার। তাই বাধ্য হয়েই দুধে চুমুক দেয়। কিন্তু মুখে একঢোক যেতেই যেন ভিতর থেকে উল্টে বোমি বের হয়ে আসার উপক্রম হয় তার। কারণ দুধটা একদম বিশ্রী খেতে। কেমন যেন নোনতা নোনতা এবং হালকা গন্ধ। যেন এটা দুধ নয় অন্য কিছু। সে একবার দুধের গ্লাসের দিকে ভাল করে চোখ বুলিয়ে নেয়। নাহ এটাতো দুধ’ই তাহলে তার কাছে এমন লাগছে কেন। ওকে এভাবে তাকিয়ে থালতে দেখে শ্রাবণ মৃদু হেসে বলে,
“এটা শুধু দুধ নয় চাঁদপাখি। এতে দুধের সাথে জড়িবুটি মেশানো আছে। এটা সম্পূর্ণ খেলে তুমি সুস্থ হয়ে যাবে। তাই একটু কষ্ট হলেও খেয়ে নাও প্লিজ।”
দুধের স্বাদ পাওয়ার পর সেটা দ্বিতীয় বার মুখে নেওয়ার মতো একদমই রুচি নেই চাঁদনীর। কিন্তু তার এখন শক্তি বলতে কিছু নেই। আর শ্রাবণ তাকে এটা জোর করে খাওয়াবে সে ভালোভাবে বুঝতে পারছে। তাই কোনো উপায়ান্তর না দেখে দুধ যেভাবেই হোক খাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সে। তাই চোখ বন্ধ করে ফেলে। সাথে সাথে শ্রাবণ দুধের গ্লাসটা ওর মুখে ধরে। চাঁদনী এক নিঃশ্বাসে পুরোটা দুধ সাবার করে দেয়। খাওয়া শেষে ওর মুখটা যেন নোনতা নোনতা একটি স্বাদে ভরে যায়। ভেতর থেকে বমি হয়ে বেরিয়ে আসতে চায়। কিন্তু বমি হয় না। কিছুক্ষণ পরেই চাঁদনী খেয়াল করে তার শরীরের শক্তি ফিরে আসছে। সে ধীরে ধীরে যেন সুস্থ হয়ে উঠছে। প্রায় ১০ মিনিট পরেই আগের মত পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যায় সে।
তখনই শ্রাবণের থেকে কিছুটা দূরে সরে বসে। গম্ভীর গলায় প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে বলে,
“এসবের মানে কি শ্রাবণ? নিজেই মারতে চান আবার নিজেই বাঁচিয়ে তোলেন কেন? আমি দিন দিন অসহ্য হয়ে যাচ্ছি আপনার উপর। কি চান আপনি? কেনই বা আমার রক্ত চুষে আমাকে মারতে চাই ছিলেন। আর কেনই বা এখন আবার বাঁচালেন।”
“এসব তুমি কি বলছ চাঁদপাখি? আমি তোমাকে কিভাবে মারতে পারি। তোমার গায়ে একটি ফুলের স্পর্শ করার মতো সাহস নেই আমার। কারণ তোমাকে আমি ভালোবাসি। বড্ড বেশি ভালোবাসি। আর তুমি কিভাবে ভাবলে আমি তোমার রক্ত চুষে খেতে চাইবো? ওটা অন্য একটা ভ্যাম্পায়ার ছিল। সে অনেক শক্তিশালী। আমার শত্রু পক্ষের ভ্যাম্পায়ার। যে কি না আমার শক্তি ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল। এর আগেও যে তোমার ওপর আক্রমণ করতে চেয়েছিল ভুলে গেছো তার কথা? আজকে সময় মতো না আসলে হয়তো তোমাকে আমি হারিয়েই ফেলতাম। আর তুমি আমাকে এভাবে বলছ? প্লিজ আমাকে ভুল বুঝনা। আমি তোমাকে ভালোবাসি। আর কি করলে বিশ্বাস করবে আমি তোমায় ভালোবাসি চাঁদপাখি?”
ওর মুখে এভাবে বলা কথা শুনেও যেনো চাঁদনীর মন গলেনা। সে আবারও গম্ভীর গলায় দাঁত কিড়মিড় করে বলে ওঠে,
“আপনার এসব কথায় আমার মন গলাতে পারবেন না। আমি আপনাকে আর বিন্দু পরিমাণ বিশ্বাস করি না। আপনি সবকিছু করতে পারেন। প্লিজ এখান থেকে চলে যান। আমাকে একটু একা থাকতে দিন। আমি মরে গেলেই ভালো হত। কেন বাঁচালেন আমায়? এই আতঙ্কের জীবনের চাইতে মৃত্যু অনেক ভাল ছিল।”
ওর কথার উত্তরে শ্রাবণ কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায়। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে গ্লাস টা নিয়ে চলে যেতে যেতে বলে,
“তোমার শরীর এখন অনেক দুর্বল। শুয়ে থেকে একটু রেস্ট নাও। আমি আর তোমায় বিরক্ত করতে এখানে আসবো না।”
কথাটি বলে রুম থেকে বেরিয়ে যায় সে। চাঁদনী চুপচাপ সেখানেই বসে থাকে। আর ভাবতে থাকে, “তার সাথে এসব কি হচ্ছে আর কেনইবা হচ্ছে। শ্রাবণ যে সব বলছে তা কি আদৌ সত্যি। নাকি এসবের পিছনে ওর কোন প্ল্যান রয়েছে।”
চুপচাপ বসে থেকে আকাশ-পাতাল ভাবে চাঁদনী। কিন্তু কোন কিছুতেই কোন কূলকিনারা খুঁজে পায়না সে। এবার সে নিজের গলা চেক করার জন্য ডান হাতটা স্পর্শ করে। সেখানে আগের মতই ব্যান্ডেজ করা। কিন্তু ব্যথা নেই। সবকিছুই যেন স্বাভাবিক হয়ে গেছে। তখনই তার মনে পড়ে সেই কাজের লোকটির কথা। যে কিনা তার চিৎকার শুনে বাঁচাতে এসে মারা গিয়েছিল। মনে পড়তেই বুকের মধ্যে ধরফর ওঠে তার। সে দ্রুত বিছানা থেকে নেমে দাড়ায়। ছুটে যায় বাইরে। তাকে জানতে হবে লোকটা কি বেঁচে আছে। নাকি সেই মুহূর্তেই মরে গেছে।
লোকটি যদি মারা গিয়ে থাকে তাহলে নিজেকে কখনোই ক্ষমা করতে পারবেনা চাঁদনী। কারণ ঐ লোকটির জীবন তাকে বাঁচাতে গিয়েই গিয়েছে। কথাগুলো ভেবে যেন বুকের মাঝে ব্যথা শুরু হয়ে যায় তার। সে দ্রুত দোতলা থেকে নিচে নেমে আসে। শ্রাবণ সোফার উপর বসে কি যেন ভাব ছিলো। ওকে নেমে আসতে দেখেই সে উঠে দাঁড়ায়। ওর কাছে এগিয়ে এসে বলে,
“এই অসুস্থ শরীর নিয়ে এভাবে নিচে আসলে কেন চাঁদ পাখি? আমাকে ডাকলেই পারতে আমি চলে আসতাম।”
“ওই লোকটা, ঐ লোকটার কি হলো শ্রাবণ? তাকেও তো ওই ভ্যাম্পায়ারটা রক্তচুষে খেয়েছিল। সে কোথায়? সে আমাকে বাঁচাতে এসেছিল। সে কি মারা গেছে? নাকি বেঁচে আছে। সে মারা গেলে আমি নিজেকে কখনোই ক্ষমা করতে পারবোনা। প্লিজ বলুন না শ্রাবন কোথায় সে? সে ঠিক আছে তো?”
ওকে এত উত্তেজিত হতে দেখে শ্রাবণ ওকে আলতো করে বুকে জড়িয়ে নিয়ে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
“শান্ত হও চাঁদ পাখি। শান্ত হও। সে সুস্থ আছে। তোমার মত তাকেও আমি জরিবুটি খাইয়ে দিয়েছি। তাই সে এখন অনেকটাই সুস্থ। তবে তোমার মতো এতটা সুস্থ এখনো হয়নি। তার বয়স বেশি হওয়ায় জরিবুটি একটু ধীরে ধীরে কাজ করবে। তুমি হাই পার হয়ো না। তার কিছু হবেনা। আমি তাকেও সুস্থ করে তুলবো।”
ওর কথা শুনে যেন মনে শান্তি ফিরে পেল চাঁদনী। এবার সে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে শ্রাবণকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলো। মনে মনে অসম্ভব রকম খুশি সে। মুহূর্তে যেন শ্রাবণের ওপর থেকে সব রাগ চলে গিয়ে ভাললাগায় পরিনত হল।
চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
#ভয়ংকর_সে #পর্ব_২৯
#M_Sonali
ছাদের উপর চুপচাপ বসে আছে চাঁদনি। আকাশ পানে তাকিয়ে আছে সে। কেন জানিনা মনটা আজ ভীষণ খারাপ লাগছে তার। বাবা এবং দাদিকে বড্ড বেশি মনে পড়ছে। তার সামনে একটি টেবিলের উপর রাখা আছে ঝুড়ি ভর্তি নানা রকমের ফল। চাঁদনী সেগুলো ছুয়েও দেখছে না। সকাল থেকে সারাটা দিন শুধু এদিক-ওদিক ঘুরে ঘুরেই সময় কাটে তার। কিছুতেই যেন সময় পার হতে চায় না এভাবে। বারবার দাদি এবং বাবার কথা মনে পড়ে মন খারাপ হয়। শ্রাবণ ও তেমন বাড়িতে থাকে না। ওকে বিরক্তও করে না। ভালোবাসার অধিকার নিয়ে কাছেও আসে না। ইদানিং চাঁদনীর খুব বেশি ইচ্ছে করে শ্রাবণ তাকে ভালোবাসার কথা বলুক। আবারো আগের মত তাকে কাছে টেনে নিক। কিন্তু সে তেমন কিছুই করে না। এতে বেশ মনঃক্ষুণ্ণ হয় চাঁদনীর। সে না পারে মুখ ফুটে কিছু বলতে না পারে এসব মেনে নিতে। তাই সারাক্ষণ এমন গোমরা মুখে এদিক-ওদিক বসে থাকে সে।
প্রায় একঘন্টা হলো এভাবে ছাদের উপর চুপচাপ বসে আছে সে। এবার বেশ বিরক্ত লাগছে তার। সে উঠে দাঁড়ায়। নিচে নেমে যাওয়ার জন্য। তখনই তার মনে হয় তার পিছনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ মনের ভেতর কিছুটা ভয় কাজ করে তার। তবুও মনে সাহস নিয়ে ধীরে ধীরে পিছন দিকে ফিরে তাকায়। দেখে শ্রাবণ দাঁড়িয়ে আছে আকাশের দিকে তাকিয়ে। ওকে এভাবে পিছনে দেখে বিরক্তির সাথে সাথে বেশ ভালো লাগাও কাজ করে তার মনে।
“আপনি কখন এলেন? আর এখানে এভাবে দাড়িয়ে আছেন কেন?”
ওর কথার উত্তরে আকাশের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে ওর দিকে তাকায় শ্রাবণ। মৃদু হেসে বলে,
“তুমি যখন থেকে ছাদে বসে আছ। আমিও তখন থেকে তোমার পিছনেই এভাবে দাঁড়িয়ে আছি। তোমাকে পাহারা দেওয়ার জন্য। কিন্তু আমার দিকে নজর দেওয়ার সময় কি আছে তোমার?”
চাঁদনী কোন উত্তর দেয় না। মাথা নিচু করে ফেলে। তারপর কিছু একটা ভেবে আবারো ওর দিকে তাকিয়ে ওর কাছে এগিয়ে আসে। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে,
“আমার না হয় সময় নেই। কিন্তু আপনারও তো মনে হয় সময় নেই। আপনিও তো এখন আগের মত আমার সাথে কথা বলেন না। সব সময় পালিয়ে বেড়ান।”
ওর কথার উত্তরে শব্দ করে হেসে দিল শ্রাবণ। তারপর ওর দিকে মায়াভরা চোখে তাকিয়ে আবেগী কন্ঠে বললো,
“সত্যিই কি তাই চাঁদপাখি?”
ওর এমন প্রশ্নে চাঁদনী কি উত্তর দেবে ভেবে পেল না। সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে ওর প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করল। তখনই সে আবারো বলে উঠলো,
“আমি তো সবসময় তোমাকে কাছে টেনে নিতে চেয়েছি। কিন্তু তুমি আমাকে সারাক্ষণ দূরে ঠেলে দিয়েছো। ভুল বুঝেছো। তাহলে নিজে কেন কাছে টেনে নিতে পারছ না? কেন আমাকে বারবার তোমার কাছে আসতে হবে? আমার কি অধিকার নেই তোমার কাছ থেকে একটু ভালোবাসা পাওয়ার?”
ওর এমন কথায় এবার বেশ কষ্ট পেল চাঁদনী। সে করুন দৃষ্টিতে তাকাল ওর দিকে। দেখল সেও করুন চোখে তাকিয়ে আছে। চাঁদনী কি বলবে বা করবে ভেবে পায়না। তাই কোন কথা না বলে চুপচাপ তাকিয়ে থাকে। তখনই শ্রাবন ওর হাত ধরে হ্যাচকা টানে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়। কোমর জড়িয়ে ধরে মুখের উপর পড়ে থাকা চুলগুলো কানের পিঠে গুঁজে দিয়ে বলে,
“ঠিক আছে তুমি যেহেতু কাছে টেনে নিবে না। তাহলে না হয় আমি’ই নিলাম। কিন্তু কথা দাও আর কখনো আমার থেকে দূরে যাবে না। যা কিছুই হয়ে যাক না কেন আমাকে কোনদিন ভুল বুঝবে না। সারা জীবন আমার পাশে থাকবে। আমাকে ভালবাসবে।”
চাঁদনী মুখে কোন উত্তর দিল না। ওর বুকে মাথা রেখে আলতো করে দুহাতে জড়িয়ে ধরলো ওকে। এতেই শ্রাবণ বুঝে নিল তার মনের কথা। ওর মুখে ফুটে উঠল বিশ্ব জয় করা হাসি।
হঠাৎ করে চাঁদনীকে কোলে তুলে নিল শ্রাবণ। তারপর মুহুর্তের মাঝে তাকে নিয়ে পৌছে গেল বেডরুমে। চাঁদনী বেশ লজ্জা ও ইতস্ততায় পড়ে গেল। কি করবে বা বলবে ভেবে পাচ্ছেনা সে। তাকে বিছানার উপর বসিয়ে দিয়ে শ্রাবণ এসে দরজা লাগিয়ে দিল। তারপর তার একদম কাছে চলে গিয়ে কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,
“তুমি জানো চাঁদপাখি এই দিনটির জন্য আমি কতদিন হল অপেক্ষা করে আছি। তোমার কোন ধারনা আছে?”
চাঁদনী কোন উত্তর দিল না। সেভাবেই চুপচাপ বসে রইলো মাথা নিচু করে। লজ্জায় যেন লাল হয়ে যাচ্ছে সে। তাকে এত লজ্জা পেতে দেখে শ্রাবণ আবার বলে উঠলো,
“চাঁদ পাখি আজ যদি তোমাকে পরিপূর্ণভাবে নিজের করে নিতে চাই। ভালোবাসা দিয়ে রাঙিয়ে দিতে চাই। তবে কি তুমি আমায় বাধা দিবে? নাকি তুমিও আমাকে গ্রহন করে নেবে। প্লিজ আজকে অন্তত আমাকে দূরে ঠেলে দিও না। আমি তোমার সম্মতি চাই। তোমার অনেক কাছে যেতে চাই। তোমাকে নিজের ভালোবাসায় ভরিয়ে দিতে চাই। স্বামীর অধিকার চাই তোমার থেকে। বলো দিবে না আমায় সে অধিকার?”
ওর কথার উত্তরে চাঁদনী কিছুক্ষন চুপ করে থাকে। তারপর কিছু একটা ভেবে ওর দিকে মায়া ভরা দৃষ্টিতে তাকায়। করুন গলায় বলে,
“আমি আরেকটু সময় চাই শ্রাবণ। শুধু আর কয়েকটা দিন সময় দিবেন আমায়? নিজেকে একটু গুছিয়ে নিতে চাই। একটু মানিয়ে নিতে চাই আপনার আর আমার জীবনে থাকা অবস্থার মাঝে। কথা দিচ্ছি আমি নিজে থেকেই আপনার কাছে আসব। আমার ভালোবাসা দিয়ে আপনাকে কাছে টেনে নিবো। প্লিজ আমাকে আর একটু সময় দিন।”
শ্রাবণ একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। ওর থেকে কিছুটা দূরে সরে গিয়ে মন খারাপ করে বলল,
“ঠিক আছে সময় দিলাম তোমায়। আমিও সেদিনের অপেক্ষায় থাকবো।”
কথাটি বলে ওর কাছ থেকে উঠে গিয়ে দরজা খুলে বাইরে চলে গেল সে। চাঁদনী বুঝতে পারলো ওর মনটা অনেক খারাপ হয়ে গেছে। তবুও সে কিছু বলল না। সে নিজেকে আরেকটু প্রস্তুত করে নিতে চায়। কারন শ্রাবণ একজন ভ্যাম্পায়ার আর সে মানুষ। এই কথাটা ভাবতেই যেন তার কাছে যেতে নিজের ভীষন ভয় হয়। চাঁদনীর মনে হয় এই বুঝি হিতের বিপরীত কিছু হয়ে যাবে। যদিও সে শ্রাবনকে মনে মনে অত্যান্ত ভালোবেসে ফেলেছে। তাকে মেনেও নিয়েছে স্বামী হিসেবে। তবুও কেন যেন ওর কাছে যেতে ভয় হয়। বারবার মনে হয় কোন বিপদ উৎ পেতে আছে চারিপাশে। হয়তো সে হার মেনে নিলে তাকে গ্রাস করে নেবে মুহুর্তে।
,
,
,
তিন দিন পর,
কালো রঙের অসাধারণ একটি গাউন জামা পড়ে আয়নার সামনে বসে নিজেকে অসম্ভব সুন্দর করে সাজাচ্ছে চাঁদনী। চোখে গাঢ় করে কাজল। আর ঠোঁটে খয়েরি লিপস্টিক। হাতে একটি পাথরের ব্রেসলেট। কানে কালো পাথরের দুল ও গলায় ম্যাচিং হার। চুলগুলো উঁচু করে বেধে ছেড়ে রাখা। মুখে হালকা মেকআপ। এতেই যেন পরীর মত লাগছে চাঁদনীকে।
সে নিজের সাজগোছ কমপ্লিট করে উঠে দাঁড়ালো। আয়নাতে ভালো করে নিজেকে একবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে নিল। সত্যিই নিজের দিক থেকেই নিজের চোখ ফেরাতে পারছে না সে। মনে মনে কিছু একটা ভেবে লজ্জায় লাল হয়ে গেল সে। তারপর দু’পাশে গাউনটা ধরে উঁচু করে ধরে এগিয়ে যেতে লাগল দরজার দিকে। দরজার কাছে যেতেই হঠাৎ কিছু মনে পড়ে দৌড়ে এলো আবারো আয়নার সামনে। নিজেকে ভালো করে দেখে নিয়ে আয়নার সামনে থাকা একটি সাদা গোলাপ চুলে গুঁজে নিলো।
“আজকে আমাকে মেরে ফেলার প্লান আছে নাকি তোমার চাঁদপাখি?”
হঠাৎ পিছন থেকে এই কথাটি শুনে কেঁপে উঠল চাঁদনী। আয়নার দিকে তাকাতেই দেখলো শ্রাবন এক পলকে তার দিকেই তাকিয়ে আছে পিছনে দাঁড়িয়ে। তার চোখে নেশা ভরা। যেন চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছে ওকে। সে বেশ লজ্জা পেয়ে গেলো। লজ্জা মাখা মুখে ওর দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল,
“আপনি কখন এলেন?”
“যখন তুমি আমাকে পাগল করার জন্য এতটা সেজেছো তখন।”
কথাটা বলেই একদম ওর কাছে চলে এল মুহূর্তেই। ওর কোমর জড়িয়ে ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে নিল। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে নেশা ভরা গলায় বলল,
“এমনিতেই কি তোমার জন্য কম পাগল ছিলাম, যে এভাবে সেজে পুরোপুরি মেরে ফেলার ব্যবস্থা করেছো?”
ওর কথার উত্তরে চাঁদনী লজ্জা পেলে বলল,
“আজ আপনাকে আমি আমার সবকিছু সঁপে দিতে চাই শ্রাবণ। তাইতো এত সাজ। অনেক কষ্ট দিয়েছি আপনাকে, কিন্তু আর নয়। আপনি তো আমার স্বামী। আপনি যেই হোন না কেন আপনার অধিকার আছে আমার উপরে। আমি আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি শ্রাবণ। আমিও আপনার কাছে যেতে চাই। নিজেকে রাঙাতে চাই আপনার ভালবাসার রঙে।”
ওর কথা শুনেই ওকে দ্রুত কোলে তুলে নিল শ্রাবন। কোলে নিয়ে হাটা দিল সামনের দিকে। চাঁদনী বেশ অবাক হল। বলল,
“এত রাতে আমাকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন? অনেক রাত হয়ে গেছে তো এখন বাইরে কোথাও যেতে ইচ্ছে করছেনা। সজ তো আমি আপনার জন্য সেজেছি।”
শ্রাবণ ইশারায় ওকে চুপ করতে বলল। তারপর মুহূর্তের মাঝে ছাদে চলে গেল ওকে নিয়ে। কোল থেকে নামিয়ে দিলো ওকে। চাঁদনী আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখল মস্ত বড় একটি চাঁদ মাথার উপর যেন তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। চারিদিকে চাঁদের আলোতে আলোকিত হয়ে আছে। সেই আলোতে দেখা যাচ্ছে পুরো ছাদের উপর গোলাপের পাপড়ি বিছানো।
আর ছাদের ঠিক এক পাশে একটি সাদা পর্দায় ঘেরা খাটপাতা। যার চারিপাশে সাদা পর্দা দিয়ে ঘেরা এবং সাদা চাদর এর উপরে ফুলের পাপড়ি বিছানো রয়েছে। চাঁদনী বেশ অবাক হয়ে শ্রাবনের দিকে তাকাল। বলল,
“এসব কি শ্রাবণ? আপনি কি আগে থেকেই জানতেন আজকে আমি আপনার কাছে আসতে চাইবো। এত কিছু ব্যবস্থা কখন করলেন আপনি?”
শ্রাবন ওর হাতটা ধরল। বিছানার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলল,
“আমি সব জানি চাঁদ পাখি। তোমার মনের সবকিছু বুঝতে পারি আমি। আমিও যে এই দিনটার অপেক্ষায় ছিলাম। আর কথা নয় আমি তোমাকে আপন করে পেতে চাই। আমার আর সহ্য হচ্ছে না। তোমার থেকে দূরে থাকা।”
কথাটি বলেই ওকে নিয়ে বিছানার উপর চলে গেল শ্রাবণ। ওকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে নিজে ওর পাশে বসল। চুলগুলো খুলে দিয়ে কপালে চুমু এঁকে দিলো। চাঁদনী চোখ বন্ধ করে ফেলল লজ্জায়। শ্রাবণ এবার কিছুটা উপরে উঠে বসল। ওকে আদর করার ভান করে গলার কাছে মুখ নিলো। নিজের সুচালো দুটি দাঁত বের করে ওর গলায় কামড় বসিয়ে দিল। চাঁদনি যেন এমন অবস্থার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না। মরণ যন্ত্রণায় জোরে চিৎকার দিয়ে উঠল সে। কিন্তু শ্রাবনের সেদিকে দেখার সময় নেই। সেতো চাঁদনীর গলায় দাত বসিয়ে রক্ত খেতে ব্যস্ত।
চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
লেখার পর রিচেক করা হয়নি। বানানে ভুল ত্রুটি হলে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন সবাই। ধন্যবাদ