ভয়ংকর সে পর্ব-৩৮+৩৯

0
239

#ভয়ংকর_সে #পর্ব_৩৮
#M_Sonali

চাঁদনীর এমন কান্না দেখে আর কথা শুনে অবাক এর সাথে সাথে বেশ কষ্ট পেলেন রতন মিয়া। একমাত্র মেয়ে কে এভাবে কাঁদতে দেখে যেন বুকটা জলে পড়ে যেতে লাগল তার। সে এবার ওর কাছে এগিয়ে এসে পাশে বসলো। মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,

“এসব কি আবোল তাবোল বলছিস মা। তোর তো শ্রাবণের সাথেই বিয়ে হয়েছে। এই ছেলের নাম তো শ্রাবণ’ই। কিন্তু আগে কবে বিয়ে হল তোর? এমন পাগলের মত কি বলছিস তুই।”

ওনার কথা শুনে যেন অবাক হয়ে গেল চাঁদনী। সে দ্রুত পিছনের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকালো। না সেই আগের লোকটি দাঁড়িয়ে আছে। এটা তো শ্রাবণ নয়। তাহলে তার বাবা কেন বলছে তার শ্রাবণের সাথে বিয়ে হয়েছে?

এসব কথা ভেবে আবারো চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগল চাঁদনীর। সে রেগে কিছু বলতে যাবে তার আগেই লোকটি এগিয়ে এসে বলল,

“বাবা আপনারা চিন্তা করবেন না, গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন। অনেক রাত হয়েছে। ওকে আমি সামলে নেব।”

ছেলেটির কথা শুনে রতন মিয়া রত্না বেগমের দিকে তাকালেন। সে চোখ দিয়ে ইশারা করে ঘরে যেতে বলল। তারা দেড়ি না করে একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে যে যার রুমে চলে গেল। ওনারা যেতেই লোকটি চাঁদনীর কাছে এসে দাঁড়ালো। ওকে কোনো কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই কোলে তুলে নিল। চাঁদনী বেশ অবাক হলো তার এমন কান্ডে। সেইসাথে বিরক্তও হলো। ওকে কোলে নিয়ে সোজা নিজের রুমে গিয়ে বিছানায় বসিয়ে দিল। তারপর দরজা লাগিয়ে দিয়ে ওর কাছে এগিয়ে গেল। এদিকে চাঁদনী রাগে যেন বজ্রপাত এর মত গুম মেরে যাছে। যখন তখন হয়তো বজ্রপাত আছড়ে ফেলবে লোকটির ওপর।

ওর এমন রাগি চেহারা দেখে লোকটা ফিক করে হেসে দিল। ওর পাশে বসে আস্তে করে বললো,

“শ্রাবনকে এত ভালবাসেন আপনি? তা তো জানতাম না। এই ভালোবাসাটা এতদিন কোথায় ছিল?”

চাঁদনী এখনো চুপ। কোন উত্তর দিচ্ছে না। তার তো রাগে শরীর জ্বলে যাচ্ছে। তাকে চুপ থাকতে দেখে লোকটি এবার ওর হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নিল। ও হাতটা ঝাড়ি মেরে ছাড়াতে গেলে লোকটি বলে উঠলো,

“এবার অন্তত একটু শান্ত হও চাঁদ পাখি। এতটা রাগ ভালো না। এই দেখো আমি তোমার পাশেই আছি।”

লোকটার মুখে চাঁদ পাখি ডাক টা শুনে যেন মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল চাঁদনীর। সে বড় বড় চোখ করে লোকটার দিকে ফিরে তাকাল। এই মুহূর্তে অবাকের শীর্ষে পৌঁছে গেছে সে। এই ডাক টা তো শুধু শ্রাবণ ছাড়া অন্য কেউ তাকে ডাকে না। তাহলে এই লোকটা কিভাবে জানলো? কিন্তু লোকটার চেহারার সাথে কোন রকম মিল নেই শ্রাবণের। তবে তিনি এভাবে কথা বলছেন কেন?
চাঁদনী অবাক হয়ে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

“কে আপনি আর এই ডাকটা কিভাবে জানলেন?”

ওর কথার উত্তরে মৃদু হাসল লোকটা। ওর পাশ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে সামনে মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসলো। ওর দুই হাত নিজের দুই হাতের মুঠোয় নিয়ে ওর দিকে আবেগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

“তুমি কি এখনো আমায় চিনতে পারছ না চাঁদ পাখি? ভালো করে তাকিয়ে দেখো। আমি তোমার শ্রাবণ। তোমার ভ্যাম্পায়ার বর শ্রাবণ।”

ওর কথায় চাঁদনী মুহূর্তেই থমকে গেল। ভ্রু কুঁচকে অবাক নয়নে তাকিয়ে রইল ওর দিকে। না চাঁদনী এখনো তাকে চিনতে পারছেনা। তার শ্রাবণ যতটা সুন্দর ছিল তার বিন্দু পরিমাণ সৌন্দর্য এর মাঝে নেই। তবে তার কথাবার্তা আচার আচরন সবকিছুই শ্রাবণের মত। কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব? সে কিভাবে জানলো যে তার শ্রাবণ একজন ভ্যাম্পায়ার ছিল? কথাগুলো যেন ভীষন ভাবে তার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু সে মুখে কিছু বলতে পারছে না। তাকে চুপ থাকতে দেখে শ্রাবণ আবারও মৃদু হাসল। ওর হাত ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে কয়েক পা পিছিয়ে গেল। তারপর চোখ বন্ধ করে দুই হাত সামনে মেলে দিতেই ওর পিছন থেকে বেরিয়ে এলো বিশাল দুটি ডানা। ঠিক শ্রাবণের মত।

চাঁদনী এখনো চুপ, কি বলবে তার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে সে। তার চোখ দিয়ে শুধু অঝোরে পানি গড়িয়ে পড়ছে। এক নজরে তাকিয়ে আছে সামনে থাকা লোকটির দিকে। সে এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না এটা তার শ্রাবণ। চেহারা এতো অমিল কিভাবে সম্ভব? ওকে এখনও চুপচাপ থাকতে দেখে শ্রাবণ একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। নিজের মুখের উপর দুই হাত রেখে পাঁচ মিনিট পর হাতটা সরিয়ে নিল। এবার চাঁদনী তার শ্রাবনকে দেখতে পাচ্ছে। এখানে অন্য কেউ নয় তার শ্রাবণ’ই দাঁড়িয়ে আছে। নিজের আসল চেহারায়। ভয়ংকর রূপে। চাঁদনীর #ভয়ংকর_সে। যাকে চাঁদনী ভালোবেসেছে।

চোখের সামনে এমন অবিশ্বাস্য ঘটনা দেখে বেশ অবাক হলো চাঁদনী। অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সামনের দিকে। শ্রাবণ মৃদু হেসে দু হাত সামনের দিকে এগিয়ে দিয়ে ইশারায় চাঁদনীকে কাছে ডাকলো। আর অপেক্ষা করতে লাগলো ওকে বুকে জরিয়ে নেওয়ার।

চাঁদনী চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালো। কিছুক্ষণ এক নজরে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। তাকিয়ে থেকে এগিয়ে যেতে লাগল ওর কাছে। এতে শ্রাবনের মুখের হাসিটা আরও বেশি প্রশস্ত হলো। সে অপেক্ষা করতে লাগলো তার ভালোবাসার মানুষটিকে অনেকদিন পর বুকে জড়িয়ে নিতে। কিন্তু চাঁদনী তার কাছে ছুটে গিয়ে জড়িয়ে না ধরে ঠাস করে চড় বসিয়ে দিল গালে। শ্রাবণ গালে হাত রেখে অবাক হয়ে ওর দিকে তাকাল। চাঁদনী আর দেরি না করে ইচ্ছেমতো কিল ঘুষি দিতে লাগলো ওর বুকে। যেন তার সারা শরীর রাগে জ্বলে যাচ্ছে।

ওর এমন কান্ডে শ্রাবণ যেন হতবাক হয়ে গেল। ওর থেকে কিছুটা দূরে যেতে চাইলে চাঁদনী আরও রেগে গেলো। ইচ্ছামত গালের উপর থাপ্পড় দিতে লাগলো। এভাবে বেশ কিছুক্ষন মেরে কান্না করতে করতে ফ্লোরে বসে পড়লো সে। ওকে এমন করতে দেখে শ্রাবণও ওর পাশে বসলো। আবেগি কন্ঠে বলল,

“চাঁদপাখি আর কান্না করো না প্লিজ। তোমার কান্না আমার আর সহ্য হচ্ছে না। এই দেখো কান ধরছি আর কখনো এমন করবো না।”

কথাটি বলেই দুইহাতে নিজের দু কান ধরল শ্রাবণ। ওর কথার কোন উত্তর না দিয়ে দাঁত কিড়মিড়িয়ে ওর দিকে তাকাল চাঁদনী। দুই হাতে ওর কলার চেপে ধরে রাগী গলায় দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

“কি ভাবেন কি আপনি নিজেকে? সবকিছু আপনার ইচ্ছেতেই হবে? যখন যা খুশি তাই করবেন আর আমি সবকিছু মেনে নিব? আপনি জানেন এ কদিন কতটা কষ্ট হয়েছে আমার। যখন দেখলাম আপনার সাথে নয় আমার অন্য কারো সাথে বিয়ে হয়েছে। আমার সকল স্বপ্ন আশা ভরসা সবকিছু ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। কিভাবে পারলেন আপনি আমার সাথে এমন টা করতে। আপনার কি একবারও বিবেকে বাধলোনা? এই ছিল আপনার ভালোবাসা? চলে যান। চলে যান এখান থেকে। আর কখন আসবেন না। আমি আপনার মুখ দেখতে চাই না।”

কথাগুলো বলেই ওকে ধাক্কা দিয়ে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দিল চাঁদনী। ওর কথায় শ্রাবণ কিছু বললোনা। মৃদু হেসে উঠে দাড়িয়ে বললো,

“আচ্ছা ঠিক আছে চলে যাচ্ছি। আবার কিন্তু আমাকে ডেকে নাকের পানি চোখের পানি এক সাথে করো না।”

কথাটি বলে দুপা সামনে এগোতেই চাঁদনী লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল। পিছন থেকে প্রথমে কয়েকটা কিল ঘুষি মেরে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,

“আর এক পা সামনে এগিয়ে দেখুন। এখানেই খু-ন করে রেখে দিব বলে দিলাম।”

ওর কথায় ও কান্ডে শ্রাবণ আবারও মৃদু হাসল। এ হাসি তার তৃপ্তির হাঁসি। সে নিজের ভালোবাসাকে আঁকড়ে ধরতে পেরেছে। এ হাসি তার বিজয়ের হাসি। সে এবার পিছনদিকে ঘুরে দাঁড়ালো। ওকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে কপালে চুমু একে দিল। বেশ কিছুক্ষণ এভাবে থাকার পর, মাথায় হাত বুলিয়ে আবেগি কন্ঠে বলল,

“বড্ড ভালোবাসো আমায় তাই না চাঁদপাখি? এই ভালোবাসা গুলো এতদিন কেন লুকিয়ে রেখেছিলে? আগে যদি এই ভালবাসাটা দেখাতে তাহলে আজ এত কিছু সহ্য করতে হতো না তোমার।”

চাঁদনী কিছুই বলছে না। একইভাবে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে ওকে। যেন ছেড়ে দিলেই পালিয়ে যাবে। তাই কিছুতেই তাকে ছাড়তে চায় না সে। বুকের মধ্যে মুখ গুঁজে শক্ত করে ধরে আছে চোখ বন্ধ করে। ওর কাছ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে শ্রাবণ হাসল। আবারো বলে উঠল,

“আমার জান টা যে আমায় এতটা পরিমাণ ভালবাসবে সেটা আমি কখনো কল্পনাও করিনি। তোমার থেকে দূরে থাকাটা তাহলে বিফলে যায়নি আমার। শুনেছিলাম দূরে থাকলে নাকি ভালোবাসা বারে। আজ তার নিজ চক্ষে প্রমাণ পেলাম। ভাবছি আবারও দূরে হাড়িয়ে যাবো। তাহলে যদি আরো বেশি ভালবাসা পাই।”

শেষের কথাটা বলতেই চাঁদনীর রাগ উঠে গেল। এবার সে রাগ দেখিয়ে ওর বুকে কামড় বসিয়ে দিল। শ্রাবণ ব্যথায় ককিয়ে ওঠলো। আহ শব্দ করে উঠলো। চাঁদনী ওকে ছেড়ে দিয়ে আবারও কলার চেপে ধরে চোখে চোখ রেখে বলল,

“আর একবার আমার থেকে দূরে গিয়ে দেখেন। পা কে-টে এখানেই রেখে দিবো। এক মুহুর্ত আমার চোখের আড়াল হলে খবর আছে আপনার। অনেক কষ্ট দিয়েছেন। আর নয়। আপনি যা-ই হোন না কেন। আপনি আমার স্বামী। আমি আপনাকে ভালোবাসি। বড্ড বেশি ভালোবাসি। আপনার থেকে এক মুহুর্ত দূরে থাকা সম্ভব নয় আমার শ্রাবণ। আপনি কেন করলেন আমার সাথে এমন? আপনার কি আমার কষ্ট দেখে একটুও খারাপ লাগেনি?”

কথাগুলো বলে শেষ হতেই চাঁদনীর দু চোখ দিয়ে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পরল। সেটা নিচে পড়ার আগেই শ্রাবণ নিজের দুই হাতে ধরে ফেলল। তারপর সেটা নিজের শার্টে মুছে বললো,

“আমি ইচ্ছে করে তোমার থেকে দূরে থাকি নি চাঁদ পাখি। নিরুপায় ছিলাম। সবকিছুই বলবো তোমায়। আর কোন কিছু লুকাবো না তোমার থেকে। আমায় একটু সময় দাও প্লিজ।”

চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,

#ভয়ংকর_সে #পর্ব_৩৯
#M_Sonali

শ্রাবণের বুকে মাথা রেখে গভীর ঘুমে ঘুমিয়ে আছে চাঁদনী। আর এক নজরে তার দিকেই তাকিয়ে আছে শ্রাবণ। যেন কত জনমের দেখার সাধ মিটিয়ে নিচ্ছে তার চাঁদ পাখিকে দেখে। এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচাইতে বেশি মায়াবতী লাগছে চাঁদনীকে তার কাছে। যেন মনে হচ্ছে সারা পৃথিবীর সকল মায়া ঢেলে দেওয়া হয়েছে এই মেয়েটির মুখে। এক নজরে তার দিকে তাকিয়ে আছে আর কিছুক্ষণ পরপর মুখের উপর পড়ে থাকা চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে কপালে চুমু এঁকে দিচ্ছে। এ যেন এক আকাশ সুখ। যে সুখের কোন তুলনা হয় না। এই মুহূর্তে নিজেকে পৃথিবীর সব চাইতে সুখী মানুষ বলে মনে হচ্ছে শ্রাবনের।

চাঁদনীর মাথায় হাত বুলিয়ে চুলগুলো ঠিক করে দিয়ে আবারও কপালে একটি চুমু একে দিল। তারপর একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মনে মনে বলতে লাগল,

“তোমাকে পাওয়ার জন্য কত কিছুই না সহ্য করতে হয়েছে আমায় চাঁদ পাখি। শুধুমাত্র তোমাকে সকল বিপদ থেকে বাঁচাতেই নিজের সাথে যুদ্ধ করে তোমার থেকে এতটা দূরে সরে থাকতে হয়েছে। তোমার গায়ে কোন রকম আচর লাগতে দেবো না আমি। নিজের সর্বস্ব খুইয়ে হলেও তোমাকে সারাজীবন আগলে রাখবো বুকের মাঝে। তুমি যে আমার জন্য কি সেটা যদি বুঝতে পারতে, তাহলে হয়তো আনন্দে পাগল হয়ে যেতে। আমি সত্যিই জানিনা কিভাবে আমি তোমাকে এতটা বেশি ভালোবেসে ফেললাম। শুধু জানি তুমিই আমার সব। আমার ভালবাসা আমার জান। আর কখনো নিজের থেকে দূর করবো না তোমায়। সারাক্ষণ এভাবেই বুকে আগলে রাখবো।”

কথাগুলো মনে মনে বলে ওকে বুকের মাঝে নিয়ে ঘুমের রাজ্যে পাড়ি দিলো শ্রাবণ।
,
,
,
মাঝরাতে হঠাৎ কিছু একটার শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে গেল চাঁদনীর। সে ধরফরিয়ে উঠে বসে আসে পাশে তাকাতেই দেখলো শ্রাবণ বিছানার এক কোনায় বসে জানালা খুলে এক নজরে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। যেন চোখ দিয়ে বাইরের কারো সাথে ইশারায় কথা বলছে সে। চাঁদনী বেশ অবাক হয়ে একবার ওর চোখের দিকে আর একবার জানালার বাইরের দিকে তাকাল। কিন্তু সে তেমন কিছুই দেখতে পেল না। সে কিছুটা ভয় পেলেও শ্রাবণের কাছে এগিয়ে গেল। কাঁধে হাত রেখে শান্ত গলায় বলল,

“কি হয়েছে শ্রাবণ? এভাবে চুপচাপ এখানে বসে আছেন কেন? আর এত রাতে জানালা খুলে রেখেছেন কেন? কি আছে বাইরে?”

চাঁদনীর স্পর্শ পেতেই ওর শরীরটা ঝাকুনি দিয়ে উঠলো। সাথে সাথে জানালাটা আপনা থেকেই বন্ধ হয়ে গেল। এতে চাঁদনী কিছুটা ভরকে গেলো ব্যাপারটা দেখে। কিন্তু কিছু বললো না। শ্রারণ এবার শান্ত চোখে ওর দিকে ফিরে তাকাল। ওকে দেখতেই চাঁদনীর বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল। কারন ওর দুচোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রুজল। সে উত্তেজিত কণ্ঠে বলল,

“কি হয়েছে আপনার? আপনি কাঁদছেন কেন শ্রাবণ? আমার কি কিছু ভুল হয়েছে? প্লিজ আপনি কাঁদবেন না। আমাকে বলুন কি হয়েছে।”

ওর কথার উত্তরে কিছুক্ষণ চুপ থাকলো শ্রাবণ। তারপর ওর দিকে পুরোপুরিভাবে ঘুরে আচমকাই ওর দুহাত নিজের দুই হাতের মুঠোয় নিয়ে নিল। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল,

“চাঁদপাখি আমার একটি অনুরোধ রাখবে প্লিজ? আমি কখনই কোন বাচ্চা চাইনা। তুমি কখনোই মা হতে চাইবে না। সারা জীবন আমরা এভাবেই থাকবো। কখনো মা হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করবে না মনে। মা হওয়ার ইচ্ছাটাকে এখনই মেরে ফেলো। আমি চাইনা তুমি এটা নিয়ে পরবর্তীতে কষ্ট পাও। প্লিজ চাঁদ পাখি আমার কথাটা রাখ!”

ওর এমন কথা শুনে বেশ অবাক হয়ে যায় চাঁদনী। সে ভ্রু কুঁচকে করুন চোখে ওর দিকে তাকায়। সে ওর কথার কি উত্তর দেবে কিছুই বুঝতে পারছেনা। তাই করুন গলায় বলে,

“আপনি এসব কি বলছেন শ্রাবণ? প্রতিটি মেয়েরই মনের সবচাইতে বড় চাওয়া থাকে নিজের সন্তানের মা হওয়া। যে তাকে মা মা বলে ডাকবে। কিন্তু আপনি আমাকে মা হতে নিষেধ করছেন? আপনার তো বাবা হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করার কথা। কিন্তু আপনি কি না আমায় এমন কথা বলছেন? কেন শ্রাবণ কেন আপনার বাচ্চা চাই না?”

“কারন আমি তোমাকে হারাতে পারবো না। আমার মা আমাকে জন্ম দিতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। আমার বাবা একজন সাধারন ভ্যাম্পায়ার হওয়া সত্বেও তার সন্তান গর্ভে ধারণ করে মৃত্যুবরণ করেছে আমার মা। সেখানে আমি এত শক্তিশালী ভ্যাম্পায়ার। আমার সন্তান তোমার গর্ভে ধারণ করলে তুমি বাঁচতে পারবে না চাঁদপাখি। সন্তান প্রসবের আগেই মারা যাবে। যেটা আমি কখনোই সহ্য করতে পারবো না। আমার শুধু তোমাকে চাই। অন্য কিছু নয়। আমি সারা জীবন সন্তান ছাড়া থাকতে পারব। কিন্তু তোমাকে ছাড়া থাকা আমার জন্য অসম্ভব। আমি মরে যাব। প্লিজ চাঁদপাখি আমার কথাটা বোঝার চেষ্টা করো। আমি শুধু তোমাকে চাই অন্য কিছু নয়।”

ওর এমন কথায় কিছুক্ষন চুপ করে বসে থাকে চাঁদনী। কোন উত্তর দেয় না। তারপর আবারও কিছু একটা ভেবে করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে ওঠে,

“এতটাই যখন ভালবাসেন আমায়, তাহলে এতদিন আমাকে এভাবে শাস্তি দিলেন কেন? কেন আসেন নি আমার কাছে? কত পাগলের মত আপনাকে খোঁজার পরেও কেন আমার থেকে এতটা দূরে ছিলেন শ্রাবণ? কেন দেখা দেননি।”

শ্রাবণ একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। উঠে দাঁড়ায়, রুমের মাঝে কিছুক্ষণ পায়চারি করে। আবার দৌড়ে এসে চাঁদনীর পাশে বসে। ওর কোলের মাঝে মাথা দিয়ে শুয়ে বলতে শুরু করে,

“তোমার মনে আছে চাঁদপাখি আমি তোমাকে ভ্যাম্পায়ার বানাতে চেয়েছিলাম। প্রতিরাতে তোমার গলায় কামড় দিয়ে তোমার রক্ত চুষে নিজের শক্তি তোমার মধ্যে দিতাম। তোমাকে ভ্যাম্পায়ার রানীতে পরিবর্তন করতে চেয়েছিলাম। মনে আছে তোমার?”

“হুম মনে আছে।”

“কিন্তু শেষ অব্দি আমি নিজের কাজে সফল হতে পারেনি। কারণ তুমি পুরোপুরি রূপে ভ্যাম্পায়ার হওয়ার আগে সবকিছু জেনে যাও। আর আমাকে ভুল বোঝো। তোমাকে নিয়ে যখন ভ্যাম্পায়ার রাজ্যে গিয়েছিলাম, তখন তোমাকে দুজন ভ্যাম্পায়ার কামড়ে ছিল। মনে আছে তোমার?”

” হ্যা মনে আছে শ্রাবণ। এখনো সে কথা মনে পরলে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে ভয়ে। কিন্তু এর সাথে আমাদের বাচ্চার কি সম্পর্ক?”

“সম্পর্ক আছে চাঁদ পাখি। সেদিন যদি তুমি আমাকে ভুল না বুঝে আমার কাজ সফল করতে দিতে। যদি নিজেকে পুরোপুরি ভ্যাম্পায়ার রানীতে পরিবর্তন করতে তাহলে তোমার আমার বাচ্চা নিতে কোন অসুবিধা হতো না। কারণ তখন তুমি নিজেও একজন ভ্যাম্পায়ারে পরিণত হতে। যার কারণে আমার বাচ্চা তোমার গর্ভে গেলে কোন সমস্যা হতো না। কিন্তু ওই দু’জন ভ্যাম্পায়ার সুযোগের সদব্যবহার করে তোমাকে আক্রমণ করার কারণে তুমি সেদিন নিজের শক্তি হারিয়ে ফেলো। আর কখনো ভ্যাম্পায়ার রানী তে রুপান্তর হওয়ার ক্ষমতা হারাও। এমনকি ঠিক সময় মত তোমার থেকে সকল শক্তিকেরে না নিলে তুমি হয়তো মারা যেতে। সেদিন ওদের দুজনকে শাস্তি দেওয়ার পর আমি তোমার সকল শক্তি ফিরিয়ে নেই চাঁদের আলোর সাহয্যে।”

এতোটুকু বলে থামল শ্রাবণ। ওকে থামাতে দেখে চাঁদনী উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠল,

“সব কিছুই বুঝলাম শ্রাবণ কিন্তু এখন পর্যন্ত আপনি এটাই বললেন না যে এতদিন আমার সাথে দেখা না করার কারণ কি? কেন এতদিন আমার কাছে আসেন নি? এত ডাকা সত্ত্বেও আমার সাথে একটিবারও দেখা করেননি।”

শ্রাবণ আবারো একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। উঠে দাঁড়িয়ে জানালার কাছে চলে যায়। জানালাটা খুলে দিয়ে বাইরের দিকে দৃষ্টি রেখে গম্ভির গলায় বলে,

“আমি নিজের দাদুকে হ-ত্যা করেছি চাঁদ পাখি। নিজের হাতে খু-ন করেছি তাকে।”

কথাটা শুনতেই চাঁদনী চমকে ওঠে। ছুটে যায় শ্রাবণ এর কাছে। উত্তেজিত কণ্ঠে বলে,

“এসব আপনি কি বলছেন শ্রাবণ? আপনি কি পাগল হয়ে গেছেন? দাদুকে মে-রেছেন মানে? কেন করেছেন আপনি এমন?”

“এ ছাড়া আমার কোন উপায় ছিল না চাঁদপাখি। দাদু তোমাকে এবং তোমার দাদি ও বাবাকে মে-রে ফেলার সকল প্ল্যান করে ফেলেছিল। সে খুব শীঘ্রই তার ভ্যাম্পায়ার সেনা দের পাঠিয়ে তোমাদের সবাইকে মে-রে ফেলত। আমি চাইলেও এতগুলো ভ্যাম্পায়ারের সাথে পেরে উঠতাম না। কারণ ভ্যাম্পায়ার রাজ্যের রাজা তখন অব্দি দাদু ছিল। তাই কোনো উপায়ান্তর না দেখে দাদুকে মে-রে ফেলতে বাধ্য হয়েছি আমি। যার কারণে এখন আমি ভাম্পায়ার রাজ্যের রাজা। তাই সকল ভ্যাম্পায়ার আমার ইশারায় চলতে বাধ্য।”

এতোটুকু বলে একটু দম নেয় শ্রাবন। তারপর চাঁদনীর দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে ওর চোখে চোখ রেখে আবার বলতে শুরু করে,

“ভ্যাম্পায়ার রাজ্যের নিয়ম অনুযায়ী রাজ্যের রাজা মরে যাওয়ার পর সেই রাজ্য ছেড়ে আগামী ৭ দিনের মধ্যে কেউ কোথাও যেতে পারে না। আর সদ্য রাজা তো কখনোই না। কারণ ওই সময়টায় রাজ্যের সবাই অনেক হিংস্র হয়ে ওঠে। তাই আমি চাইলেও সেখান থেকে তোমার কাছে আসতে পারতাম না। কিন্তু তোমাকে না দেখে থাকা আমার জন্য অসম্ভব ছিল। তাই আমি নিজের শক্তি দিয়ে ওইখান থেকে অদৃশ্য রূপে তোমার কাছে এসেছি। তোমার আশে পাশেই থেকেছি সারাক্ষণ। শুধু তোমার সামনে প্রকট হতে পারিনি। নিজের অস্তিত্ব তোমাকে জানান দিতে পারিনি। তুমি যখন জঙ্গলের মধ্যে আমাকে খুঁজতে খুঁজতে চলে গিয়েছিলে। তখনও আমি তোমার কাছে ছিলাম। ওই লোকগুলো যখন তোমার দিকে খারাপ নজরে তাকিয়ে ছিল। তখন আমার হিংস্রতা এতটাই বেড়ে যায় যে আমি তোমার সামনে প্রকট হই। কিন্তু তুমি চোখ বুঝে থাকায় আমাকে দেখতে পাওনি। আমি হাওয়ার বেগে তাদেরকে নিয়ে গিয়ে হ-ত্যা করি। তারপর ওই পুকুরের মাঝে কাদায় পুতে ফেলি। ওদের সাহস হলো কিভাবে তোমার দিকে খারাপ নজর দেওয়ার। তার পরেও আমি তোমার সাথে ছিলাম। রাতে যখন তুমি মাথায় আঘাত পেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলে। সারারাত তোমার মাথাটা নিজের কোলে নিয়ে বসেছিলাম। তোমার মাথায় জরিবুটি লাগিয়ে দিয়েছিলাম। কারন ঐ মুহূর্তে নিজের শক্তি খাটিয়ে তোমার আঘাত ঠিক করে দিতে পারতাম না। এতে তুমি আমার অস্তিত্ব টের পেয়ে যেতে। তাতেই তোমার বিপদ হতো। সকাল হওয়ার আগেই তোমার থেকে সরে পড়ি। তুমি যখন ওই গ্রামে গিয়ে খারাপ লোকটির পাল্লায় পরো। তখনও আমি তোমার সাথে ছিলাম। তোমাকে আমি এই বাড়ি অব্দি রেখে যাই। তারপরে ওই লোকটিকে ও শাস্তি দিয়েছি।”

“হুম সব কিছুই বুঝতে পারলাম শ্রাবণ। কিন্তু এখনো এটাই বুঝলাম না আপনি যখন আমাকে বিয়ে করেছেন তাহলে নিজের আসল চেহারা পাল্টে অন্য একজনের চেহারা নিয়ে কিভাবে ছিলেন? আপনি কি নিজের রূপ পরিবর্তন করতে পারেন?”

ওর কথার উত্তরে কিছু বললো না শ্রাবণ। ওর আর একটু কাছে এগিয়ে এসে ওর কোমর জড়িয়ে ধরলো। দু গালে হাত রেখে কপালের পাশে পড়ে থাকা চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে কপালে চুমু এঁকে দিয়ে বলল,

“আমার এই চেহারাটাই সবাই দেখছিল। তোমার বাবা দাদী সবাই। শুধু তুমি ঐ চেহারাটা দেখছো যেটা আমি দেখাতে চেয়েছি। বলতে পারো তোমার চোখে আমার শক্তি দিয়ে পর্দা ফেলে দিয়েছিলাম। শুধুমাত্র আমায় কতটা ভালবাসো তা বোঝার জন্য।”

চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,,,,