#ম্লান_সন্ধ্যায় (০৩)
সুশোভিত কক্ষে কোয়েলিয়া অনিকের অপেক্ষা করছিল। খাটের পাশে রাখা ফুলদানি থেকে তাজা গোলাপ আর রজনীগন্ধার ঘ্রাণ কক্ষের পরিবেশ মনোরম রেখেছে।যদিও বাসরঘরের মতো করে সাজানো হয়নি। আর পাঁচটা সাধারণ কক্ষের মতো একটা।ড্রিম লাইটের মৃদু আলো ঘরে। খোলা জানালা দিয়ে মৃদুমন্দ বাতাস আসছে। এখানে আসার পর থেকে মনের কোণে বারবার উঁকি দিচ্ছে, অনিকের সাথে ওর বিয়ে হবার কারণ কি!এ বাড়িতে প্রবেশটাও ভালো ছিল না। ওকে বরণ করে তোলা হয়নি। গাড়ি থেকে নেমেই অনিক সোজা বাড়িতে ঢুকে গিয়েছিল। আফসার শিকদারের সাথে ও ড্রয়িং রুমে প্রবেশ করে একজন মহিলার দেখা পেয়েছিল।ফর্সা গোলগাল মুখ,পরণে শাড়ি, চেয়ে থাকার মতো সৌন্দর্য। চেহারা দেখে বয়স আন্দাজ করা কঠিন।সে কিন্তু ওর সাথে একটা কথাও বলেনি, শুধু ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে ছিল। মহিলাটি কি ওর শাশুড়ি?
এতবড় বাড়িতে আর কাওকে না দেখে ও খুব অবাক হলো।বাবা ওকে কোথায় বিয়ে দিয়েছে।ও এতটুকু নিশ্চিত, ওকে এ বাড়ির বৌ করে আনার পিছনে কোন না কোন কারণ আছে। উদ্দেশ্যটা কি হতে পারে?
ওর ভাবনার সুতো ছিঁড়ে বেশ জোরেই দরজা খুলে অনিক ভেতরে ঢুকলো।বাতি জ্বালিয়ে বিছানায় কোয়েলিয়াকে দেখে বিরক্তিতে নাকমুখ কুঁচকে ফেললো। চড়চড়ে গলায় বলল,
‘বিছানা থেকে নামুন।’
কোয়েলিয়া দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেল, কিন্তু বিছানা থেকে নামল না।অনিক দাঁতে দাঁত চেপে মনে মনে ভাবলো,
‘বটে অধিকার ফলানো শুরু হয়ে গেছে।শাখা প্রশাখা ছড়ানোর আগে গোড়া উপড়ে ফেলতে হবে।’
ও খাটের কাছাকাছি গিয়ে বললো,
‘এক্ষুনি রুম থেকে বের হন। নয়তো আমার থেকে কেউ খারাপ হবে না।’
কোয়েলিয়া অবাক হয়ে অনিকের মুখের দিকে তাকালো। লম্বা চওড়া গোফদাড়ি কামানো এক সুপুরুষ।ফর্সা মুখ রাগে লালচে হয়ে গেছে। কেউ মুখের দিকে তাকালে অনিকের এমনিতেই বিরক্তি লাগে।ও এবার বেজায় ক্ষেপে গিয়ে কোয়েলিয়ার হাত ধরে হিড়হিড় করে টেনে কক্ষের বাইরে বের করে জোরে দরজা বন্ধ করলো। তারপর বেডশিট তুলে ছুড়ে ফেলে দিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
‘নারীতে আসক্ত হয়ে দ্বিতীয়বার ভুল করছি না।’
কোয়েলিয়া হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বিয়ের প্রথম রাতে স্বামী ওকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছে,এটা ভেবেই লজ্জায় অপমানে ওর চোখে জল আসলো কিন্তু গড়িয়ে পড়লো না।ও নির্বাক দৃষ্টিতে দরজার দিকে তাকিয়ে রইল। আফসার শিকদার হয়তো কিছু আঁচ করতে পেরেছিল, ওপরে এসে কোয়েলিয়াকে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
‘আমার সাথে এসো।’
ভদ্রলোক ওকে নিয়ে নিচে গেলেন। কোয়েলিয়াকে বসতে বলে নিজে ওর মুখোমুখি বসলেন। কোয়েলিয়া জবুথবু হয়ে বসে ভদ্রলোককে একবার অবলোকন করলো। লোকটা খাটো, কিন্তু সুদর্শন, মাথায় টাক পড়েছে।যদিও ওনার পেটে ভুড়ি নেই।টাকপড়া লোকদের ভুড়ি না থাকা বেমানান। কোয়েলিয়ার মনে হলো এতো সাদা চামড়ার ভেতর ওর গায়ের রঙটা বেশি কালো দেখাচ্ছে।যদিও বাংলাদেশে কুচকুচে কালো মানুষ বিরল। ওর রঙটা শ্যামলা, তবুও সবাই এ রঙকে কালোই বলতে চায়।
আফসার শিকদার গলা খাঁকারি দিয়ে আনমনা মেয়েটার মনোযোগ আকর্ষণ করে বললেন,
‘তোমার মনে অনেক প্রশ্ন জমে আছে,তাইতো?’
কোয়েলিয়া মাথা নিচু বসে রইল। আফসার শিকদার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে বলল,
‘সোজাসুজি বলে দিই।অনিক আমার একমাত্র ছেলে।ওর ১৩ বছর বয়সে ওর মা মারা যায়। স্বাভাবিক মৃত্যু।ওই বয়সী ছেলেমেয়েরা এমনিতেই আবেগপ্রবণ থাকে।ওর কাছে ওর মা ছিলো বেস্টফ্রেন্ড।ব্যবসায়িক কাজে আমি ব্যস্ত থাকতাম, তখন আমার ব্যবসা কেবলমাত্র দাঁড়াতে শুরু করেছে। ওকে সময় দিতে পারতাম না। দুজনের ভেতর দূরত্ব তৈরি হতে শুরু করলো। তখন যাকে দেখলে ও আমার ছোট বোন নাজমা।ও সংসারটা দেখে রাখা শুরু করলো। কিন্তু অনিকের সাথে ওর সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে পারলো না।নিজেও ওকে সময় দিতে পারতাম না। উচ্চ মাধ্যমিক শেষ হতেই একদিন বললো,ও বাইরে গিয়ে পড়াশোনা করতে চায়। আমি খুশিমনেই ওকে পাঠালাম। সেখানে গিয়ে ও অনেকটা বদলে গেল। ছুটিতে আসলে আগের মতো আর বিষন্ন থাকতো না। আমার সাথে অনেক সময় ধরে কথা বলতো। গ্রাজুয়েশনের পর দেশে এসে ও বিয়ে করলো বিভাকে। মেয়েটা ঢাবির ছাত্রী, অনলাইনে প্রেম হয়। অনিক আমাকে ব্যবসায় সাহায্য করতে শুরু করে। সবমিলিয়ে সময়টা ভালো যাচ্ছিল। এরপর ওদের ফুটফুটে একটা মেয়ে হয়। জানিনা ওদের ভিতর কি হয়েছিল, কিন্তু বিভা একদিন মেয়েকে নিয়ে অনিকের বন্ধু রিফাতের সাথে চলে যায়। আমি অনুরোধ করার পরও অনিক কিছু বলেনি।বিভাও সবরকম যোগাযোগের রাস্তা বন্ধ করে দেয়।বিভার চলে যাবার পরও অনিককে স্বাভাবিক দেখাতো। কিন্তু ভেতরে ভেতরে ও ততদিন ভেঙ্গে পড়েছিল। এরপর হঠাৎ করে ও সবকিছু থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলো। রগচটা স্বভাব, কথায় কথায় গায়ে হাত তোলা,বারে গিয়ে মদ খাওয়া,এখন তো বাড়িতেও খায়। আমি ওর ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব চিন্তিত।’
আফসার শিকদার থামলেন। বুঝলেন কথাগুলো কেমন খাপছাড়া শোনাচ্ছে, তবুও বললেন,
‘আমার ব্যবসা অনেক বড় হয়েছে, কিন্তু উত্তারিধাকার নেই। আমার বোনের ছেলে মেয়েরা ভালো অবস্থানে আছে। কিন্তু আমার একমাত্র ছেলের ভবিষ্যৎ বেঁচে থাকাকালীন গুছিয়ে না রাখতে পারলে,মরেও শান্তি নেই। তোমাকে আমার ছেলের বৌ করার একটাই কারণ, ওকে শুধরাতে হবে।ও ভালো হলে, তোমার ভবিষ্যৎ ও উজ্জ্বল।’
‘এটা কিভাবে সম্ভব?’
কোয়েলিয়া আনমনেই বলে উঠলো। এতক্ষণে বোধহয় ও আসল কারণ বুঝতে পারলো। কল্পনা করলো,এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের।যেখানে ও কখনো সুখের দেখা পাবে না।
আফসার শিকদার নিজেকে ধাতস্থ করলেন। এরপরের বলা কথাগুলো শুনে মেয়েটা ওকে নিষ্ঠুর স্বার্থপর মনে করবে। করলে করবে! ছেলেকে ভালো রাখতে এতটুকু করতে ওনার বাঁধবে না। কন্ঠে গাম্ভীর্য বজায় রেখে বললো,
‘তোমাকে ছেলের বৌ করার জন্য তোমার বাবাকে অনেকগুলো টাকা দিয়েছি।আশা করি,ঋণ শোধ করার পরও অনেকগুলো টাকা হাতে থাকবে। এখন তুমি সিদ্ধান্ত নেও,আমার ছেলের সাথে থাকবে নাকি চলে যাবে। ইচ্ছে হলে যেতে পার, তবে তোমার বাবাকে টাকাগুলো ফেরত দিতে হবে। সিদ্ধান্ত তোমার। আজকে রাতটা গেস্ট রুমে কাটাও। আগামীকাল যা হবার হবে।’
আফসার শিকদার একজন মহিলাকে ডেকে উঠে চলে গেলেন। কোয়েলিয়া ঠায় বসে রইল।এ কি প্রহসন ওর সাথে! ভাগ্য ওকে নিয়ে আর কতো খেলবে। পৃথিবীর প্রত্যেকটা নিষ্ঠুরতা কেন ওর সাথে দেখানো হয়?
*
মাঝরাতে কোয়েলিয়ার খুব কান্না পেল।কান্নার দমকে ও থেকে থেকে কেঁপে উঠছিল।এ কেমন বাড়িতে এসে পড়লো। মানুষ কি আদৌ মানুষকে পরিবর্তন করতে পারে? এমন এক বাড়িতে এসেছে যেখানে ওর খেয়াল রাখার মতো কেউ নেই। বিয়ের প্রথম দিনেই যেসকল ঘটনার সাক্ষী হলো,সেসব কি ওর প্রাপ্য ছিল?শেষমেশ একজন মাতাল কিনা ওর স্বামী,যে কিনা ওকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছে। ভদ্রলোক কতটা স্বার্থপর হলে একজন মেয়ের জীবন নিয়ে খেলতে পারে।এসব ভাবতে ভাবতে ও কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল।দরজার ঠকঠকানিতে ধড়ফড়িয়ে শোয়া থেকে উঠলো।মাথাটা ওর খুব ধরে আছে। গতকাল সারাটা দিন না খেয়ে থাকার ফল।এবাড়িতে আসার পর কেউ এবিষয়ে কিছু বলেনি। পেটের ক্ষুধা, মনের অশান্তি, ভাগ্যের নিষ্ঠুরতা সবকিছু ফলাফল ওর মাথা ধরা। উঠে দাড়াতেই চোখে অন্ধকার দেখলো। দরজায় আবার কড়াঘাত পড়লো।ও তড়িঘড়ি করে দরজা খুললো। মাথায় কাপড় দেওয়ার কথা মনে এলো না।নাজমা নাকমুখ কুঁচকে বললো,
‘একদিনেই এত পরিবর্তন। বাহ্!’
কোয়েলিয়া ওনার কথা বুঝতে পারলো না। ঠিক কি কারণে এই কথাগুলো শুনতে হচ্ছে।ও মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকলো।
ভদ্রমহিলা খেকিয়ে উঠলেন,
‘ফুফু শাশুড়ির সামনে মাথায় কাপড় দেবার কথা বলে দিতে হবে?’
কোয়েলিয়া নিজের ভুল বুঝতে পারলো। সবকিছু ওর মস্তিষ্ককে অসাঢ় করে রেখেছে।তার প্রভাব এতটাই যে,ও উপস্থিত বুদ্ধি হারিয়ে ফেললো।ও মাথায় কাপড় তুলে মাথা নিচু করে রইল।
‘দেখে তো ভদ্র মনে হয়। সালাম দেওয়াটা শেখোনি।’
কোয়েলিয়া নিজের বোকামির জন্য লজ্জিত হলো। মুচকি হেসে সালাম দিলো।নাজমা ভ্রু কুঁচকে আপাদমস্তক ওকে দেখে বললো,
‘ফ্রেশ হয়ে কিচেনে এসো।এ বাড়ির বৌ হয়ে যখন এসেছো, দায়িত্বটাও সেভাবে পালন করবে।’
ভদ্রমহিলার কন্ঠে কি ছিল, কোয়েলিয়া আসন্ন বিপদের আশঙ্কায় কুঁকড়ে গেল। নাজমার মুখ দেখে স্পষ্ট বুঝেছে, কোয়েলিয়াকে তার পছন্দ হয়নি।
*
রান্নাঘরের সমস্ত কাজ শেষে ওর খুব ক্লান্ত লাগছিল।ঘরে ঢুকে ক্লান্তিতে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো।যত যাই হোক ও জৈবিক একজন মানুষ। ভাইবোন টেবিলে নাস্তা করতে বসলো। অথচও ওকে একবার ডাকার প্রয়োজন ও মনে করলো না। কোয়েলিয়া এতটুকু বুঝলো,এ বাড়িতে থাকতে হলে নিজের মতো থাকা শিখতে হবে। অবশ্য না থেকেই কি করবে।ওর এখান থেকে বের হওয়া মানেই পাঁচটা সদস্যের জীবনে দূর্বিষহ ডেকে আনা। মা-বাবার কথা নাহয় বাদ। ভাইবোন গুলো বিনা দোষে কষ্ট পাবে।আর ও ই বা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? আত্মীয়স্বজন স্বামীর ঘর ছেড়ে আসা মেয়েকে ভালো চোখে দেখেনা। এতো ওর নিজের চোখে দেখা। কোয়েলিয়া মনে মনে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো।এই স্বার্থপর বাড়িতে মনকে পাথর বানাতে হবে। নয়তো এখানকার প্রতিটা মূহুর্ত ওকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেবে। কিন্তু ও মনকে শান্ত করতে পারছে না। বারবার মনে হচ্ছে ও এখানে থাকলে মরে যাবে।২৪ঘন্টা অতিবাহিত হয়নি, অথচো ওর মনে হচ্ছে, কতদিন ও এখানে আছে।
‘বৌ।’
কোয়েলিয়া চমকে উঠে বসলো। রুবিনা ওর সামনে খাবারের প্লেট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রুবিনা এবাড়িতে কাজ করে। সকালে রান্নার সময় হাতেহাতে সাহায্য করেছিল। কোয়েলিয়া প্লেটটা ধরছে না দেখে রুবিনা জোর করে ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
‘দেহো বৌ।এবাড়িতে ভাবসাব দেখালি চলবে না। সারাদিন না খাইয়া থাকলিও কেউ জিগাইবো না,খাইছসনি।এবাড়ির সবাই যার যার তালে থাহে।যে তোমার সুখদুঃখের সাথী,সেথি তো ।বাদ দেও। নতুন আসছো, কতকিছু দেখতি হবে।এহন খাইয়া নেও।লাজ শরমে পেট ভরে না ।’
রুবিনা ঘর থেকে চলে যায়। কোয়েলিয়া এতক্ষণের চাপা শ্বাস ফেলে খাবারের দিকে তাকায়। এরকম জীবনতো ও চায়নি। না কখনো এতো বড় ঘরের বৌ হবার স্বপ্ন ও দেখেছে।
চলবে..
®️ সুমি খানম