#রঙীন ফানুস (থ্রিলার সিরিজের)
পর্ব-০১
#আফরিন ইভা
____”আগামীকাল আমার বিয়ে।
ছবি দেখেই বর ভীষণ পছন্দ করে আমাকে। আমি তো মেয়ে মানুষ ইচ্ছে করলেও অনেক কিছু আটকাতে চাইলেও আটকানো হয়ে উঠে না। ”
“আমিও না করি নি তাঁর কারণ হলো, এটা আমার ফাস্ট বিয়ে নয়,দ্বিতীয় বিয়ে বলে কথা। প্রথম বিয়েটা ভেঙে গেলো ই বা কেনো তা আপনারা পরেই জানতে পারবেন।”
“আমার বিয়ে হয়েছে জেনেও বর কোনো রকম আপত্তি করেনি, কেনো করেনি তা আমার অজানা। আল্লাহ এতো এতো রূপ দিয়েছে যে, যার জন্য বাবা আদর করে নাম রেখেছে পরী। আমাকে যে একবার দেখে সেই প্রেমে পড়ে যায়।”
“আল্লাহ কেনো যে এতো এতো রূপ দিয়েছে যার জন্য পড়াশোনা টাও ঠিকভাবে শেষ করতে পারি নি। এসএসসি, পাশের পর আর পড়াশোনা করা হয় নি। একটাই কারণ, আমার রূপ। এই রূপ টাই আমার জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে । স্কুলে যাওয়া, আসার সময় ছেলেরা পিছু নিতো, খারাপ যতো বাসনা ছিলো সবাই আমাকে প্রস্তাব করতো। নিরবে চোখের পানি ফেলা ছাড়া আমার যে আর কিছুই করার উপায় ছিলোনা। তাঁর একটাই কারণ, আমার মা খুব ছোট বেলায় মারা যায়।মনের কথা যে কাউকে বলবো, কেউই ছিলো না। একমাত্র দাদী ছিলো তা-ও কয়েক বছর আগে তিনিও আমাকে ছেড়ে চলে যান।সবই বিধাতার প্রতিদান, চাইলেও যায়না পাল্টানো।
তাই আমিও বিধির বিধান মেনে বড়ো হতে লাগলাম। ”
.
.
“এখন আমার আছে আমার
বাবা, আর আমার আল্লাহই একমাত্র আপনজন। বাবারও অনেক চিন্তা আমাকে নিয়ে। সুন্দরী মেয়ে কে বিয়ে দেওয়ার পরেও কেনো বিয়ে টিকলো না ব্যাপারটা আসলেই ভাববার বিষয়। ”
“বিয়েটা কেনো ভেঙ্গেছে বিষয় টা আমিও জানি কিন্তু বলবো কার কাছে, বাবার কাছে, না সে-তো কখনোই পারবো না। একে-তো ভীষণ দুঃখী মানুষ টা,সেই কবেই স্ত্রী কে হারিয়ে একাকী আছেন তাও আমার কথা ভেবে, চাইলেও বলতে পারবো না আমি। ”
“একমাত্র দাদী জানতো ব্যাপারটা।
উনি ছিলেন পুরনো মানুষ।
ভেবেছিলেন বিয়ের পর ঠিক হয়ে যাবে, কিন্তু হলো কোথায়?
উল্টো বিপরীত হলো।
টেনশনে শেষ হয়ে যাচ্ছে আমার বাবা, শ্বশুরবাড়ি কতোই না হলাম লাঞ্চিত, বঞ্চিত।
জামাই তো উঠতে বসতে কথা শোনাতো, মাঝেমধ্যে হাতও তুলতো গায়ে। মাত্র ২ মাস টিকেছিল বিয়ে টা।
নীরবে চোখের জল ফেলা ছাড়া আর কিছুই করবার উপায় ছিলোনা।
উপায় থাকবে কী করে পড়াশোনা টাও ঠিকভাবে শেষ করতে পারলাম না।
এই পড়াশোনায় কে-ই বা আমাকে চাকরি দেবে।”
.
.
“আগামীকাল যার সাথে বিয়ে হচ্ছে, উনি হচ্ছেন আমার বাবার বসের ছেলে।
নামকরা শিল্পপতি, নাম উনার রাজ চৌধুরী। আমাকে উনার বাবা-ই পছন্দ করেছেন।”
“কোনো একদিন বাবার অফিসে বাবার জন্য খাবার নিয়ে গিয়েছিলাম।
বাবা এমনিতেই অনেক দূর্বল মানুষ, অসুখ-বিসুখ নিত্যদিনের সঙ্গী উনার।বাবার জ্বরও ছিলো ভীষণ, তবুও অফিসে গেলেন। চাকরি থাকতো ঠিকই কারণ বাবার বস্ ছিলেন ভীষণ ভালো মানুষ তবুও পরিস্থিতি শান্ত রাখতে বাবা কাজে গেলেন । ”
“নিজ হাতে খাইয়ে আসবো বলে অফিসে গেলাম। যে-ই অফিসে ঢুকলাম অমনি বাবা-র বসের সাথে দেখা হলো।
উনি আমাকে দেখে কিছু একটা ভেবে জিজ্ঞেস করলো আমার নাম ,ঠিকানা ,কেনো এসেছি, পুরো ডিটেইলস। ”
“আমি কিছুটা বিচলিত হয়ে সব কিছুর জবাব দিলাম।
উনি অফিস বয় কে ডেকে বাবা-র কাছে আমাকে পাঠানোর ব্যাবস্হা করলেন।”
“উনার এতো বড়ো অফিসে আমার বাবা একজন সামান্য কর্মচারী মাত্র।”
“বাবাকে খাইয়ে বাসায় চলে আসলাম।”
“সন্ধ্যার বাবা বাসায় ফিরলো ঝাঁকঝমক বাজার নিয়ে। ”
“আমি হতাশ হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম, বাবা কি ব্যাপার, আমরা দু’জন মানুষ তা-ও এ-তো এ-তো বাজার। এ বাজারতো একবছরেও শেষ করতে পারবোনা। ”
“বাবা মুচকি হেসে বললো,পাগলি মেয়ে আমার তোকে কে বললো, এগুলো আমাদের দুজনের? ”
“এগুলো তো মেহমানদের জন্য। ”
“আমি বাবার দিকে তাকিয়ে দেখলাম, আজ অনেক দিন পর আমার বাবার মুখে যেনো প্রশান্তির হাসি খেলে যাচ্ছে।
অবুজ অবলীলায় বাবা যেনো অনেক দিন পর মন থেকে হেঁসে যাচ্ছে।
বাবাকে এতো টা খুশি দেখে আমার মনটাও খুশিতে ভরে গেলো।”
“হঠাৎ কদাচিত মনে চিন্তার উদয় হলো,মেহমান মানে। ডিভোর্স হয়েছে জেনে এই ছ’মাস আমাদের বাসায় কোনো আত্মীয় স্বজনরা আসে না।”
“তাঁর কারণ হলো, ডিভোর্স। আমি অপয়া।
অপয়া মেয়ে কে দেখলেও তাদেরও অমঙ্গল হবে, তাই তাঁরা আমাদের কোনো রকম খোঁজ খবর রাখে না।
তাতে কী হলো,বাবা মেয়ে আছি তো বেশ।”
“বাবাকে মেহমানের কথা জিজ্ঞেস করলে,বাবা উনার বসের সব কথা আমাকে জানালো।
আমি যেনো স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছি।
নাম করা শিল্পপতি আমার মতো মধ্যবিত্তের মেয়েকে বিয়ে করাবে উনার একমাত্র ছেলে কে। তা কী আদৌ বিশ্বাসযোগ্য!”
“আমি বাবাকে অভিমানী স্বরে বললাম, বাবা তুৃমি কী উনাদের আমার সত্যিটুকু বলোনি।”
“বাবা মুখ টা কে কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে বললো, সব বলেছিরে মা, আগে একটা বিয়ে হয়েছে সেটা জেনেও উনি রাজি হয়েছেন তোকে উনার ছেলের বউ করবেন বলে।
তোকে দেখার পর উনার না-কি খুবই ইচ্ছে, তোর হাতের রান্না হবে উনার প্রতিদিনের ভোজন।
তুই দেখতে না-কি উনার মায়ের মতো সুন্দরী।
উনি এতো এতো আবদার করেছেন যে আমি না করতে পারি নি। ”
“বাবা আমার কাছে এসে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল, মা তুই কী খুব রাগ করেছিস্ আমার উপর বল?
তুই যদি ক্ষমা না করিস তাহলে তোর এই বুড়ো বাবা এখুনি কান ধরে ওঠবস করবে?
করবো না-কি বল?”
“আমি বাবার পাগলামো দেখে না হেসে পারলাম না।”
“থাক না, আজ বাবা খুশি, যার আরশে আমিও আজ খুশি।”
“বাবা আমাকে অভয় দিয়ে বললেন, চিন্তা করিস না মা,আল্লাহ যা করে ভালোর জন্যই করে।
শুনেছি উনার ছেলে রাজ চৌধুরীও খুব ভালো।
বসের সব কথাই শুনে।
তাই উনি উনার ছেলেকে নিয়ে তোর হাতে আংটি পড়িয়ে যাবে আগামীকাল।
তা-ই এতো এতো বাজার করা।”
“পরদিন বাবা-র বস একা এসেই আংটি পড়িয়ে গেলেন।
উনার ছেলে আসেননি, এটা জেনে আমার আরো বেশি ভয় হতে লাগলো।
সিসি ফুটেজে উনি না-কি আমাকে দেখিয়েছেন,পছন্দও করেছেন। আর তা আমি আমার হবু শ্বশুর থেকেই জানতে পারি।
উনি আমার আগের বিয়ের কথা জেনেও রাজি হয়েছেন।
উনার একটাই কথা তা হলো, উনার বাবা যাকে পছন্দ করবেন উনার জন্য , উনিও তাকেই বিয়ে করবেন। ”
___”বাবার সাথে বাবার বস মানে আমার শ্বশুর সব কথা পাকা করেন শুভ বিবাহের দিন ধার্য করলেন। ”
“আমার মনের ভেতর একটাই ভয় তা হলো আমার আগের বিয়ে ভাঙ্গার কারণ।
যা সবার অজানা। ”
“রাজ চৌধুরী কে আমি এখনো দেখিনি, উনিও আমাকে সামনাসামনি দেখে নি।”
“আজ আমার বিয়ে খুব ছোট করেই বাবা বাবার সাধ্যমতো আয়োজন করলেন।”
“কবুল বলার সময় খুবি কষ্ট হচ্ছিলো।
এ বুঝি প্রাণ টা চলে যাবে।
পুরো শরীর কাঁপছে, এ-তো এ-তো কাঁপছে যেনো শীতের বুড়ী ধরে রেখেছে।
চিন্তায় পুরো মাথাটা ঝিম ঝিম করছে।
পৃথিবীটাকে পুরোপুরি অচেনা অজানা লাগছে।”
“বাবার অসহায় মুখ টা বারবার ভেসে আসছে, ভেবে বুকে পাথর চেপে কবুল বলে ফেললাম।
সম্পন্ন হয়ে গেলো, পরী আর রাজ চৌধুরীর বিয়ে।
আদৌ বিয়ে টিকবে কিনা সেটা বড্ড বেশি ভাবাচ্ছে।
বিদায় বেলা বাবাকে জড়িয়ে ধরে অনেক কান্না জুড়ে বসলাম।
তার একটাই কারণ, বাবার যে, এই পরী ছাড়া কেউ নেই।
কে দেখবে আমার বাবাকে সেটাই ভীষণ ভাবাচ্ছে আমাকে। দু-চোখ থেকে অশ্রু জল গড়িয়ে পড়ছে। ”
“আমি বিয়ে করলে যদি আমার বাবা একটু খুশি থাকে তাহলে আমি সব করতে রাজি, এমনকি বাবার জন্য এ জীবন বিসর্জন দিতেও রাজি।”
“ফুল দিয়ে সাজানো একটি গাড়িতে আমাকে উঠানো হলো।
মাথাটা ভীষণ ঘুরছে, বুক টা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। পাশে কেউ একজন বসা। সে দিকে আমার কোনো ভ্রুভ্রুক্ষেপ নেই।
চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে। পড়ুক না আজ এই মূলহীন জল,বাঁধা দেবো না। জল পড়েপড়ে চোখ আজ লোহিত সাগরে পরিণত হোক তবুও বাঁধা দেবো না। বাঁধা দিয়েই বা কি হবে, কান্না যে আমার ছোটবেলার পাতানো সই।যাকে ছাড়তে চাইলেও ছাড়া যায়না।”
“কেউ একজন রুমাল এগিয়ে দিলো,আমিও রুমাল টা নিয়ে চোখের পানি মুছতে লাগলাম।কে দিলো ঐ বিষয়ে আমার কোনো মাথাব্যাথা নেই ”
“কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা পৌঁছে গেলাম, অচেনা গন্তব্যে।
এই গন্তব্যে আমার জন্য কি লেখা আছে সেটা আমার অজানা।”
“কয়েকজন মেয়ে এসে আমার হাত ধরে গাড়ি থেকে নামালো।আমাকে যত্নের সহিত দরজার সামনে নিয়ে গেলো ”
“বরণডালা সাজিয়ে আমার শ্বাশুড়ি বরণ করে ঘরে প্রবেশ করালো।”
“সকল পর্ব শেষ করে পুষ্পসজ্জিত একটি রুমে নিয়ে খাটে বসালো।
বিশাল বড়ো বাড়ি, কতরকম এক্সপেন্সিভ ফার্নিচার দিয়ে সাজানো। বাহিরের দেশ থেকে আনা হরেক রকম শোফিজ।
এতো বড়ো বাড়ির বউ হবো স্বপ্নেও ভাবিনি। ”
“চারপাশে চোখ ভুলিয়ে তাকালাম। বিদেশি নাম না জানা বাহারি ফুল,প্রিয় শিউলি ফুল দিয়ে সাজানো, খাটের মাঝখানে ফুল দিয়ে পরী+রাজ লেখা।
লেখাটা দেখে বুকের ভেতর কোমল স্পর্শ যেনো খেলে গেলো, হৃদয়ে হালকা শিহরণ বয়ে গেলো।”
“বিশাল ঘোমটা টেনে খাটের মাঝখানে বসা আমি। মিনিট পাঁচেক পর, কেউ একজন দরজা খুলে রুমে আসলো।
বুক টা ধুকপুক করতে লাগলো।এসি রুমে
বসেও ভীষণ রকম ঘামছি। এতো এতো ঘামছি যেনো পড়ন্ত রোদে বসে আছি আমি।
যার সাথে বিয়ে হয়েছে, এখন পর্যন্ত সামনাসামনি দেখতে পাইনি।
সে আমাকে দেখেছে কি-না তা-ও জানিনা।
হয়তো দেখেনি, হয়তো দেখেছে।
পা গুলো কেমন কাঁপতে শুরু করলো, হাতের তালু গুলোও যেনো বরফের মতো জমে যাচ্ছে।
কেউ ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে ফেললো। আর আমি ভয় পেয়ে মরি মরি অবস্থা। ভয়ে কলিজা টা পর্যন্ত শুকিয়ে যাচ্ছে।
চলবে———