রাতের কুয়াশা পর্ব-০৫

0
1940

#রাতের_কুয়াশা
#পর্ব = ০৫

অচেনা পথে রাতের আধারে গন্তব্য খুঁজে পাওয়া খুব কষ্টকর কিন্তু আমাদের নিজেদের তো কোন গন্তব্য নেই তাহলে পথ খুঁজবো কোথায়? রাতের কুয়াশা আরো ঘন হয়ে চারিদিকে গ্রাস করেছে। রাত বারোটা বেজে গেছে লঞ্চে থাকার সময়, এখন হয়তো আরো আধা ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে। শীতের রাতে এই সকল স্থানে বাড়িঘর থাকলেও এত রাতে কেউ বাতি জ্বেলে বসে থাকবে না। চাঁদপুর আর শরিয়তপুরের বিভিন্ন যায়গা পরিচিত আছে কিন্তু রাতের এই অন্ধকারে কতটুকু পার হতে পারবো কে জানে?

পিছনে তেমন কারো আসার সম্ভবনা পাচ্ছি না তাই আমি ওদের নিয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। প্রচুর ঠান্ডায় সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপছে, দাঁড়াতে বলার সাথে সাথে মুন্নী আমাকে ভেজা কাপড়ে জড়িয়ে ধরে কান্না আরম্ভ করে দিল। আমি তার হাত স্পর্শ করে দেখি সব ঠান্ডায় রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যাবার মতো উপক্রম হয়ে গেছে। সাজিদকে বললাম তাড়াতাড়ি করে ব্যাগ থেকে শুকনো কাপড় বের করতে। মুন্নীর দেয়া শীতের কোটটা ব্যাগের ভেতর রেখেছিলাম সেটা বের করে হাতে নিলাম। মুন্নীর ব্যাগ থেকে কাপড় বের করে তাকে বললাম সামান্য দুরে গিয়ে যেন কাপড় পরিবর্তন করে। ভেজা কাপড় পরিবর্তন করে সেগুলো একটা স্থানে ঝোপের মধ্যে রেখে আমি আমার কোট মুন্নীকে জড়িয়ে দিলাম।

মুন্নী এখনও কাঁপছে, আমরা সামনে হাঁটা শুরু করে দিলাম, সাজিদ কিছুক্ষণ পর পর পিছনে পরে যায়। আমরা কিছুু দুর গিয়ে আবারও তার জন্য অপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে থাকি।

রাত একটার পরে আকাশে জোৎস্না ফুটতে শুরু করলো, চারিদিকে তাকিয়ে দেখি অসম্ভব সুন্দর লাগছে চারিপাশে। চরের বালি চাঁদের আলোয় চকচক করছে, মনে হয় যেন আনন্দ তার অজস্র নিঃস্বার্থ স্নেহময়। মুন্নী আমার ডান হাত বাহুর কাছে জড়িয়ে ধরে হাঁটছে, কিছুক্ষণ পর পর যখন সাজিদ এর জন্য অপেক্ষা করি তখন মুন্নী আমাকে বলেঃ-

” তোমার তো খুব ঠান্ডা লাগছে, এখন তুমি শীতের কোটটা গায়ে দাও। ”

” বললাম, আমি আমার কষ্ট সহ্য করতে পারবো কিন্তু আমার চোখের সামনে তোমার কষ্ট সহ্য করতে পারবো না পরি। ”

” আজকে কতদিন পরে আমাকে পরি বলে ডাক দিলে হিসাব করছো? ”

” না তো, তুমি করেছো? ”

” এক মাস এগারো দিন পর। ”

” চর থেকে যেতে ইচ্ছে করছে না, দেখো কত সুন্দর আকাশ ভেঙ্গে জোৎস্না নেমেছে। তুমি আর আমি যদি এই চরের মাঝে একটা ঘর বানাতে পারি তাহলে দুজনে সারারাত আগুন জ্বালিয়ে তার পাশে বসে বসে জোৎস্না দেখতাম। ”

” আর? ”

” দিনের বেলা জাল দিয়ে নদীতে মাছ ধরতে যাবো আর তুমি ঘরে বসে মাথায় খোলা নারিকেল তেল মেখে অপেক্ষা করবে। ”

” আমি যদি তোমার সাথে নদীর তীরে মাছের ব্যাগ নিয়ে সাথে সাথে থাকি? ”

” তাহলে তো সোনায় সোহাগা হয়ে যাবে। ”

” আজকে রাতটা আমার সারাজীবন মনে থাকবে। আজকেই আমি তোমাকে পেলাম, আজকে তোমার সত্য পরিচয় জানলাম, আজকেই তোমার সাথে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এত ঠান্ডায় নদীতে ঝাপ দিয়ে পরলাম। আর আজকের এই রাতেই তোমার সাথে হাতটা জড়িয়ে ধরে খালি পায়ে বালুর মধ্যে হাঁটছি। ”

” ভেবেছিলাম সারাজীবনের জন্য তোমার সামনে থেকে হারিয়ে যাবো কিন্তু এভাবে তোমাকে নিয়ে নির্জন চরে হাঁটবো ভাবিনি। ”

” তোমার ভাগ্নে এসে গেছে চলো আবার হাঁটা শুরু করতে হবে। ”

” কোথায় যাবো গো? ”

” সামনে তো বড় বাগান দেখা যাচ্ছে, দেখি যদি কোন ঘরবাড়ি পাওয়া যায় কিনা? ”

” অপরিচিত মানুষের কাছে থাকবে? ”

” আরে না, তাদের কাছ থেকে ঢাকা ফেরার পথটা জেনে নিতে হবে। ”

” চলো তাহলে। ”

★★

অনেক কষ্টে একটা বাড়ি খুঁজে পাওয়া, গেল ঘরের মধ্যে এখনো বাতি জ্বলছে। আমি আর মুন্নী উঠোনে দাঁড়িয়ে রইলাম আর সাজিদ এগিয়ে গেল দরজা টোকা দিয়ে কাউকে পাওয়া যায় কিনা সেটা দেখার জন্য। চারিদিকে বড় বড় গাছে ঘেরাও করা তারই মাঝে দোচালা একটা টিনের বাড়ি। চাঁদের আলোয় উঠোন আলোকিত হয়ে গেছে, মুন্নী আমার হাতটা আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। মনে হয় চারপাশে তাকিয়ে সামান্য ভয় পাচ্ছে অথবা শীতের রাতের তীব্র ঠান্ডায় জমে যাচ্ছে।

সাজিদের ডাকাডাকিতে একটা বৃদ্ধ লোক দরজা খুলে বেরিয়ে এলো। হাতের হারিকেন উঁচু করে ধরে সাজিদকে চিনতে চেষ্টা করছে। তারপর যখন দেখল অপরিচিত তখন সাজিদের কাছে পরিচয় জিজ্ঞেস করলোঃ-

” কে তুমি? ”

” কাকা আমরা অনেক দুরের মানুষ, একটা বিপদে পরে আপনার কাছে এসেছি। আপনি কি একটু কষ্ট করে বলবেন এখান থেকে ঢাকা ফেরার পথ কি? মানে রাস্তা বা বাস স্টেশন কতদূরে? ”

” সে তো অনেক দুর বাবা, তোমরা এই চরের মাঝে কীভাবে আসলে? এত নির্জন দ্বীপে তো কেউ আসে না কখনো। ”

” বললাম তো বিপদে পরেছি, লঞ্চে করে যাচ্ছিলাম তখন হঠাৎ করে ডাকাতদের আক্রমণে দিকশূন্য দুর্বোধ্যতায় এদিকে চলে এসেছি। ”

” তোমরা আজকে তাহলে এই ঘরে থাকো, কালকে দিনের বেলায় আমি তোমাদের বাস স্টেশন পৌঁছে দিয়ে আসবো। ”

” আজকে রাতে হলে খুব ভালো হতো কারণ ডাকাত দলের সদস্যরা আমাদের পিছু নিচ্ছে। ”

” পিছু নিচ্ছে কেন? ”

” সেটা তো জানিনা কাকা। ”

” কিন্তু এত রাতে যাওয়া যাবে না, আর তাছাড়া এখন তো জোয়ার মনে হয় শুরু হবে। সামনে গিয়ে অনেকটা নিচু ভূমি আছে সেখানে জোয়ারে তলিয়ে যায় তাই যাওয়া যাবে না। ”

” আমি বললাম, সাজিদ সমস্যা নেই তুমি তাহলে ভিতরে ঢুকে দেখো থাকার ব্যবস্থা করা যায় কিনা। মুন্নীর শারীরিক অবস্থা ভালো না, এত রাতে আবার ভিজতে পারবো না। ”

” ঠিক আছে মামা তাই করছি। ”

★★

ভিতরে একটা রুমের মধ্যে ভালো করে বিছানা করে মুন্নীকে থাকতে বললাম। মুন্নী একা থাকতে পারবে না বলে দিল কারণ তার ভয় করবে। আমি বুঝতে পারছি কারণ সে শহরের মেয়ে তাই রাতের আধারে এমন নির্জন চরে থাকতে সাহস না হওয়ারই কথা।

” সাজিদ বললো, মামা আপনি তার সাথে এখানেই থাকুন, এমন রাতে ঘুম আসবে কিনা জানিনা। তবে চেষ্টা করুন মামী যেন ঘুমাতে পারে কারণ কালকে হয়তো অনেক পরিশ্রম করতে হবে। আমি বাহিরের ঘরে জাগ্রত ভাবে কাটিয়ে দেবো কারণ সর্দার যদি যেকোনো সময় এখানে পৌঁছে যায় তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। ”

” আমি বললাম, সেটা আমারও মনে হচ্ছে তাইতো মুন্নীকে এখানে রেখে তুই আর আমি বাহিরে থাকতে চাচ্ছি কিন্তু ও রাজি হচ্ছে না। ”

” মামা আপনি চিন্তা করবেন না, কোন রকম বিপদ সামনে দেখলে আমি আপনাকে ডাকবো। ”

” ঠিক আছে তাই কর তাহলে। ”

” আচ্ছা মামা আপনারা তাহলে শুয়ে পরুন। ”

এমন একটা পরিস্থিতিতে পরতে হবে সেটা কখনো ভাবতে পারিনি। এখন এই মুহূর্তে যদি সর্দারের কাছে ধরা পরি তাহলে হয় তাদের সবাই কে মারতে হবে নাহয় তাদের হাতে আমাদের মরতে হবে। মুন্নীর জন্য খুব খারাপ লাগছে, বেচারি আমার সাথে জড়িয়ে আজ নিজেও বিপদের মধ্যে রয়েছে। বাঁচবে না মরবে কেউ জানিনা কিন্তু তবুও আমরা সবাই কতটা নির্বিকার।

” মুন্নী বলল, কি হলো বিছানায় আসো। ”

” তুমি ঘুমানোর চেষ্টা করো আমি এখানে বসে আছি তোমার কোন ভয় নেই। ”

” আমার খুব শীত লাগে তাই তোমার বুকে মাথা রেখে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ঘুমাতে চাই। ”

” বেঁচে থাকলে সারাজীবন প্রতিটি রাত্রে তোমার জন্য আমার এই বুকটা অপেক্ষা করবে। তখন নাহয় নিশ্চিন্তে পৃথিবীর সব কলোহল ভুলে গিয়ে দুচোখ বন্ধ করে থাকবে। ”

” যদি বেঁচে না থাকি? আজকে রাতেই যদি আমরা মারা যাই তাহলে তো আমার একটা ভালবাসার তৃষ্ণা রয়ে যাবে। তখন কি মৃত্যুর সময় তোমার বুকে জড়িয়ে রাখবে আমাকে? ”

” এমন মুহূর্তে এ ধরনের কথা বলে আমার মনটা খারাপ করে দেয়া কি ভালো হচ্ছে? ”

” আমি তো চাই না তোমার মন খারাপ হোক, আমি চাই তোমাকে নিয়ে সুখী হতে। কিন্তু তুমি তো আগে আমার মন খারাপ করে দিচ্ছ, সেটা কার দোষ? ”

” তুমি একটা মেয়ে আর আমি একটা ছেলে, রাতের আধারে দুজনে একই বিছানায় জড়িয়ে ধরে ঘুমাতে গেলে শরীর গরম হয়ে যদি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় তাহলে কি করবে? ”

” বাহিরে প্রচুর ঠান্ডা তাই এত সহজে গরম হবে না হিহিহিহি! ”

” এত সুন্দর করে হাসো কেন? ”

” যাকে ভালবেসে ফেলেছি তাকে দেখাবো বলে, সে আমাকে বারবার অবহেলা করে তাই চেষ্টা করছি বিভিন্ন ভাবে তার মানে স্থান তৈরী করতে। যেদিন তার মনের জমিটা সম্পুর্ন দখল করতে পারবো সেদিন আমি স্বার্থক হবো। ”

আমি আস্তে করে বিছানায় উঠে গেলাম, দুজনের কারো পায়ে জুতা ছিল না। মুন্নী প্রথমে একটা টুকরো কাপড় দিয়ে পা মুছে বিছানায় উঠেছে, আমি সেই কাপড় দিয়ে পা মুছে বিছানায় উঠলাম। দুটো বালিশ আছে, সেখান থেকে একটা নিচে সরিয়ে দিয়ে আর একটা বালিশের উপর আমি মাথা রেখে শুয়ে পরলাম। এরপর হাত বাড়িয়ে মুন্নীকে কাছে টেনে বুকের উপর চেপে ধরলাম। মুন্নী তার দুহাত প্রসারিত করে আমাকে জড়িয়ে ধরে আছে, তার নিশ্বাস ভারি হয়ে গেছে। আমি হাত দিয়ে তার মুখটা উঁচু করে দিয়ে কপালে আলতো করে চুমু খেলাম।

মিনিট বিশেক পরে সাজিদ এর কণ্ঠ শুনতে পেলাম, সে মামা মামা বলে ডাকছে। আমি মুন্নীকে সরিয়ে রেখে বিছানা থেকে উঠে দরজার সামনে সাজিদের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম।

” সাজিদ বললো, মামা সর্বনাশ হয়ে গেছে। ”

” কি হইছে? ”

” এই ঘরের সেই বড়ো কাকা তো আমাদের সর্দার এর পরিচিত। ”

” বলিস কি? ”

” হ্যাঁ মামা, আমি উঠোনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছিলাম তখন হঠাৎ করে দেখি বাগানের মধ্যে মনে হয় যেন কেউ মোবাইল টিপেছে। কারণ তখন মোবাইলের আলো টিপটিপ করে জ্বলছিল, আমি কৌতূহল নিয়ে সেখানে আস্তে আস্তে পা টিপে টিপে গেলাম। গিয়ে শুনি সে আমাদের কথা সবকিছু সর্দার এর কাছে বলছে, আমি তো অবাক হয়ে গেলাম। এখন আমার বিশ্বাস তারা যেকোনো সময় এখানে চলে আসবে। ”

” কি বলিস এগুলো? এর মানে সে সর্দারের সাথে কোন একটা বিষয়ে যুক্ত আছে? ”

” হ্যাঁ মামা, এখন কি করবেন? লোকটা তো এখন আমাদের সব পথ বন্ধ করে দিয়েছে। বাঁচার কোন উপায় আর থাকবে না মনে হয়। ”

#চলবে..

লেখাঃ-
মোঃ সাইফুল ইসলাম (সজীব)