রুপা পর্ব-০৩ এবং শেষ পর্ব

0
1059

#রুপা
#মেঘাদ্রিতা_মেঘা
#শেষ_পর্ব
দিন পেড়িয়ে রাত আসে,কোন খবর নেই আরাফের।
রাত ১২ টা রুপা আবার আরাফকে ফোন দেয়।
এবার ফোন টা রিসিভ হয়।
আর ফোন টা রিসিভ করে আরাফ ধমকের সাথে রুপাকে বলে,এত বার ফোন দেয়া লাগে?
রিসিভ যখন করছিনা,বুঝতে কি পারছোনা আমি ব্যস্ত আছি?

_না মানে আসলে, চিন্তা হচ্ছিলো।
সারাদিন তোমার কোন খবর নেই তো তাই।
আর আমাদের তো আজ চেকাপেও যাবার কথা ছিলো।
তাই আরকি।

_বাসায় কি আর কেউ নেই?
যে আমাকে ছাড়া অন্য কারো সাথে যাওয়া যাবেনা।

_না আসলে তা না।তুমি কখন আসবে?
_আমি আজ আসতে পারবোনা।
অফিসের কাজে একটু বাইরে যাচ্ছি।
কয়েক দিন থাকতে হবে সেখানে।
_হঠাৎ করে কোথায় যাচ্ছো তুমি?
আর কাপড় চোপর ও তো নাওনি।
_উফ রুপা,এত কথা কেন বলতে হচ্ছে?
আমার ব্যবস্থা আমিই করে নিবো।
তোমার এত চিন্তা করতে হবেনা।
_আচ্ছা ঠিক আছে সাবধানে যেও।
আর শোনো,মিস ইউ।
_আচ্ছা রাখছি।

আরাফ ফোন টা রেখে দেয়।

রুপার চোখ কেন যেন আজ ভিজে যাচ্ছে।
এই প্রথম আরাফ ওর সাথে এমন ব্যবহার করলো।
আগে কোন দিনই এমন করেনি।
তাই হয়তো অশ্রু বাধা মানছেনা।

আরাফ কয়েক দিন বাসার বাইরে থেকে তারপর চলে আসে।

এসে ঠিক আগের মতই আবার ব্যবহার করে রুপার সাথে।
আর সেদিনের জন্য ক্ষমাও চায়।

রুপা সব কিছু ভুলে যায়।
আবার চলতে থাকে ওদের ভালবাসা খুনসুটি।

ইদানীং আরাফ অনেকটা রাত করে বাসায় ফিরে।
জিজ্ঞেস করলে বলে,অফিসে অনেক কাজ ছিলো।

রুপাও কোন সন্দেহের চিত্র আঁকে না মনে।
কারণ আরাফ ঠিক ঠিক কেয়ারও করে রুপার।
ওর খোঁজ নেয় ফোন দিয়ে অফিসের ফাঁকেফাঁকে।
এটা সেটা কিনে নিয়ে আসে ওর জন্য।
প্রয়োজন হলে ডাক্তারের কাছেও নিয়ে যায়।

দেখতে দেখতে অনেক গুলো মাস কেটে যায়।

রুপার বেবী ডেলিভারির সময় হয়ে যায়।

রুপাকে হসপিটালে নিয়ে যায় আরাফের পরিবার।

কিন্তু কোন ভাবেই আরাফের সাথে যোগাযোগ করা যাচ্ছেনা।

আরাফ ফোন রিসিভ করছেনা।
একটা সময় আরাফের ফোন টাও বন্ধ হয়ে যায়।

এদিকে রুপা বার বার আরাফকে দেখতে চাইছে।
ভয় পাচ্ছে রুপা।
যদি ও ডেলিভারির সময় মারা যায়।
তাই আরাফকে দেখার জন্য ছটফট করছে।

কিন্তু আরাফের কোন খবর নেই।

অবশেষে রুপা একটা ছেলে সন্তানের মা হয়।

দুই পরিবারের সবাই অনেক খুশি।
সবাই রুপাকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছে,বাচ্চাকে কোলে নিয়ে আদর করছে।
কিন্তু বাচ্চার বাবার খবর নেই।

রাত হয়ে গেছে।

হঠাৎ আরাফের এক কাজিন হসপিটালে সবার সামনে এসে বলে,

আরাফ কই?
ও আসেনি?

সবাই উত্তর দেয়,ও হয়তো অফিসের কাজে ব্যস্ত তাই ফোন টা রিসিভ করেনি।আর ফোনের চার্জ হয়তো শেষ তাই হয়তো ফোন টা বন্ধ হয়ে গেছে।

তখন সে বলে,
কথা টা কিভাবে বলবো,বুঝতে পারছিনা।
এই মুহূর্তে বলা উচিৎ কিনা তাও জানিনা।
তবে বলে দেয়াই ভালো মনে হচ্ছে।

আরাফ ওর অফিসেরই একটা মেয়েকে বিয়ে করে ফেলেছে।
আর এখন ও ওই মেয়ের সাথেই আছে।
আজ হয়তো বাসায়ও ফিরবেনা।

রুপা হাসতে হাসতে বলে,
ফান করছেন তাইনা ভাইয়া?
এমন আনন্দের সময় এমন ফান কেউ করে?
নিন আপনার ভাতিজাকে কোলে নিন।

_আমি ফান করছিনা ভাবী।
যা বলছি সত্যি বলছি আমি।
আর ওদের বিয়েতে আমারই বেস্ট ফ্রেন্ড সাক্ষী হিসেবে ছিলো,যে কিনা আরাফেরও ফ্রেন্ড।
যেটা আমি কিছু ক্ষণ আগেই জেনেছি।

রুপা এবার কি করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছেনা।
এক দিকে সন্তান,অন্য দিকে স্বামী অন্য নারীর কাছে।

রুপা চিৎকার করে কান্না শুরু করলো।

আরাফের পরিবার আর রুপার পরিবার রুপাকে সান্ত্বনা দিতে শুরু করলো।

সবাই বুঝালো,বাসায় গিয়ে দেখবে আসলে হয়েছে টা কি।বা কেন আরাফ এমন করলো।

রুপা সেই মুহূর্তে বল্লো,আমি এখন বাসায় চলে যাবো।
বাসায় চলুন।
যদিও ডাক্তার রা পরের দিন বাসায় যেতে বলেছে।
কিন্তু রুপা তখনই জেদ ধরে ও বাসায় চলে যাবে।
আর যেহেতু নরমাল ডেলিভারি তাই ডাক্তাররাও ছেড়ে দেন।

রুপারা সবাই বাচ্চা নিয়ে বাসায় চলে আসে।

আরাফকে বার বার ফোনে ট্রাই করা হয়।
কিন্তু আরাফের ফোন বন্ধ।

সবাই সারারাত রুপার কাছে বসে থাকে।

আজকের দিন টা রুপার জীবনের সব থেকে আনন্দের দিন হতে পারতো।
কিন্তু নিয়তি তা আর হতে দিলোনা।

রাত পেড়িয়ে সকাল হলো,
আরাফের ফোন বন্ধ।

রুপা কান্নাকাটি করে রুপার ভাইকে বল্লো,
তোমরা একটু অফিসে যাও ওর।
দেখো কোন খবর পাও কিনা।

রুপার ভাই অফিসে গিয়ে খবর নিলো আরাফের।

সবাই বল্লো,
আরাফ অফিসে আসেনি।
আর ও এখন ঠিক মত অফিসও নাকি করেনা।

রুপার ভাই চালাকির সাথে কৌশলে জানতে চাইলো,
আরাফের না একটা মেয়ে বন্ধু আছে?
যার সাথে ওর খুব ভালো বন্ধুত্ব?
সে কই?
তার সাথে একটু কথা বলতাম।

একজন বল্লো,সেও আসেনি।
আর তারা দুজন এক সাথেই অফিস বন্ধ দেয়।

রুপার ভাই,
খুব অনুরোধ করে একজনের কাছ থেকে ওই মেয়ের বাড়ীর ঠিকানা নিলো।

ঠিকানা নিয়ে আরাফের ভাইকে ফোন দিলো।

তারপর দুইজন মিলে ঠিকানা মত চলে গেলো।

মেয়ের বাসায় গিয়ে কলিং বেল বাজাতেই দরজা খুলে দিলো আরাফ।

আরাফ রুপার ভাই আর নিজের ভাইকে দেখে থতমত খেয়ে গেলো।

ওরা দুজনও নিজেদের চোখ কে বিশ্বাস করতে পারছিলোনা।

মেয়েটা আসলো,এসে বল্লো কে এসেছে?

আরাফ উত্তর দিলো,
তুমি একটু থাকো।
আমি পরে আসছি।
জরুরি একটা দরকারে ওরা আমাকে নিতে এসেছে।

এই বলে আরাফ ওদের নিয়ে বেড়িয়ে এলো।

সারা রাস্তা কেউ কারো সাথে কোন কথা বলেনি।

বাসায় পৌছানোর পর আরাফের ভাই চিৎকার করে বলে,
_কি ছিলো এই সব ভাইয়া?
ওই বাসায় কি করছিলে তুমি?
সারাটা দিন সারাটা রাত আমরা তোমায় ফোনে ট্রাই করেছি।কিন্তু পাইনি।
আর তুমি কিনা,
ছিঃ ভাইয়া।

কে হয় ওই মেয়ে তোমার?
কি সম্পর্ক ওই মেয়ের সাথে তোমার?

আরাফ আস্তে করে সবার সামনে উত্তর দেয়,

ও আমার স্ত্রী।

_এ কথা শুনে রুপার মা বলে উঠে,
স্ত্রী?
ও যদি তোমার স্ত্রী হয়,তবে আমার মেয়ে কি হয় তোমার?

আরাফ কোন জবাব দেয়না।

আরাফের বাবা মা আরাফকে গালাগাল শুরু করে।
কেন এমন করলো।

রুপা শুধু কেঁদেই যাচ্ছে।
যাকে নিয়ে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখেছে সেই কিনা আজ ওকে এই ভাবে ঠকালো।

আর ওর নিষ্পাপ বাচ্চাটা।ওর কি দোষ ছিলো।

এই ছিলো বুঝি বিশ্বাসের প্রতিদান।

রুপা এবার আরাফকে বল্লো,
তুমি এই ভাবে আমাকে ঠকাতে পারলে?

একটা বার চিন্তা করলেনা,আমার আর আমার সন্তানের কি হবে?

রুপার পরিবারের সবাই ওকে দোষারোপ করতে লাগলো।

আরাফের মা কাঁদতে কাঁদতে বল্লো,
কেন এমন করলি তুই?
কেন বউমাকে এভাবে ঠকালি?

তখন আরাফ উত্তর দেয়,

আমি ওকে ঠকাইনি।
বরং ও আমাকে ঠকিয়েছে।

আরাফের মা জিজ্ঞেস করে মানে কি?ও কিভাবে ঠকিয়েছে তোকে?

তখন আরাফ সকলের সামনে উত্তর দেয়,

আমার সাথে বিয়ে হবার আগে ওর আরেকটা বিয়ে হয়েছিলো।
আর ও আমাকে জানায়নি।
আর আমি এখন তা জেনেছি,তাই আমিও আরেকটা বিয়ে করে নিলাম।
শোধবোধ।

এখানে দোষের কিছু তো নেই।

এবার আরাফের পরিবার সবাই উলটো কথা বলা শুরু করলো।
রুপা খারাপ,রুপার পরিবার খারাপ।
নইলে এত বড় কথা কেউ গোপন রাখে?
তার ছেলে কে ঠকানো হয়েছে।
একটা বিবাহিতা মেয়ে তার ছেলের গলায় ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে।

সবাই মিলে অনেক অপমান করে রুপার পরিবারকে।

রুপা আরাফের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,

তুমি কিছু জানতেনা আরাফ?
আমার অতীত সম্পর্কে?

আরাফ উত্তর দেয়,নাহ আমি কিছু জানতাম না।

_এত বড় মিথ্যে তুমি বলতে পারলে?
নিজের দোষ ঢাকতে তুমি আমার সম্মান নিলামে তুল্লে?

আমি তোমাকে আগেই বলেছিলাম না,আমি ডিভোর্সী?তুমি বলেছিলে তোমার তাতে সমস্যা নেই।
বার বার বলেছিলাম,তোমার পরিবার যদি না মানে?তুমি বলেছিলে এই কথা টা যেন আজীবন গোপন রাখি।যাতে কেউ আমাকে কটু কথা বলতে না পারে।

অথচ আজ,তুমি নিজেই আমার মান সম্মান মিথ্যে অপবাদ দিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিলে।
এই বলে যে,তুমি বিয়ের আগে জানতেনা আমার আগের বিয়ের কথা।

এইদিকে রুপার মা বাবা বলছে,

চল রুপা তোর আর এই বাসায় থাকতে হবেনা।
এই মুহূর্তে আমরা এ বাসা থেকে তোকে নিয়ে যাবো।
দরকার হলে তোকে আবার বিয়ে দিবো।

কিন্তু রুপা উত্তর দেয়,

আমি যাবোনা মা।

আর বিয়ে মানুষ কয়বার করে মা?

আমি এখানেই থাকবো।
আমার একটা ছেলে হয়েছেতো।
ওকে আমি কার পরিচয়ে মানুষ করবো?
ওকে তো আমার মানুষ করতে হবে মা।
ওর জন্য আমি না হয় থেকে গেলাম।

থেকে যায় রুপা আরাফের বাসায়।

আরাফের বাবা মা কথায় কথায় রুপার ভুল ধরে বেড়ায়।
ওর আগের বিয়ের জন্যই নাকি তার ছেলে বিয়ে করেছে।নইলে কখনোই করতোনা।
রুপাকে দোষী করে তার ছেলেকে নির্দোষ বলে বেড়ায়।
কিন্তু নাতির মুখের দিকে চেয়ে আবার সব ভুলে যায়।

রুপা এসব চুপচাপ সহ্য করে যায়।
এখন আশেপাশের মানুষ জনও রুপার আগের বিয়ের কথা জানে।তারাও কত কিছু বলে বেড়ায়।কেউ কেউ মুখের উপরও রুপাকে গাল মন্দ করে যায়।
যেই মানুষ টা এক সময় রুপাকে সম্মান দিয়ে জীবনে জড়িয়েছিলো।
সেই মানুষ টাই এখন তার মান সম্মান মাটির সাথে মিশিয়ে দিলো।

আরাফ ২য় বিয়েটাও ভালবেসেই করেছে।
এই মেয়েকেও সে খুব ভালবাসে।

এই বউ এর কথায় আরাফ বাবা মা বউ বাচ্চা ছেড়ে আলাদা বাড়ীতে উঠেছে।সেখানে আরাফ আর আরাফের ২য় বউ থাকে।

আর রুপা সারাটা জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে শশুড় শাশুড়ির সেবায়।

রুপাকে জিজ্ঞেস করলাম,
কেন আপনি পড়ে আছেন তাহলে আরাফের বাসায়?
যেখানে আরাফই নেই।

সে উত্তর দিলো-
আমি এখন এই সংসার টা ছেড়ে গেলে লোকে বলবে আমিই খারাপ।
তার জন্যই আমার ২য় সংসারও টিকেনি।
কেউ আরাফের ভুল টা দেখবেনা।

তাছাড়া আমার সন্তানকে একটা নাম দিতে হবেতো।
পরিচয় দিতে হবেতো।

_আপনি যে বাসায় থাকেন আরাফ সেখানে আসেনা?
_হুম আসে,
মাসে একবার মন চাইলে ওর বাবা মা আর ছেলেকে দেখতে আসে।
তখন আমার সাথেও দেখা হয়।
একদিন থেকেই চলে যায়।একটা দিন আমি ওকে আমার কাছে পাই।
তবে প্রতি মাসে টাকা পাঠিয়ে দেয় ওর পরিবারের জন্য ছেলের জন্য।

_আরাফের জন্য খারাপ লাগেনা?
তার উপর ক্ষোভ হয়না?
_খারাপ লাগে কিনা জানিনা,তবে প্রতি রাতে মরণ যন্ত্রণা হয়।
যখন ভাবি আমার স্বামী অন্য কারো বুকে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে।
আর ক্ষোভ?
ভেবে নেই আমার কপালে এই ছিলো।

শুধু মাঝে মাঝে ভাবি,
মানুষ তাহলে জীবনে কয়বার প্রেমে পড়ে?
আর কয়বার ভালবাসে?কয়জন কে ভালবাসে?
আমাকে কি সে আদৌ ভালবেসেছিলো?
আবার ভাবি,যদি নাই ভালবাসতো।তাহলেতো এত পাগলামি করে বিয়ে করতোনা।

আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম,
বাকি জীবন টা তাহলে কিভাবে কাটাবেন?

সে উত্তর দিলো-
এইতো,শশুড় শাশুড়ির সেবা করে আর সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়েই না হয় বাকি জীবন টা কাটিয়ে দিলাম।
আরাফকে আমি সত্যি সত্যি ভালবাসি,খুব ভালবাসি।
ওর পরিচয় মাথায় নিয়েই না হয় মরে গেলাম।

(সমাপ্ত)

#মানুষের জীবন আসলে নাটকের চেয়েও নাটকীয়।