শহর জুড়ে আলোর মেলা পর্ব-০৩

0
410

#শহর_জুড়ে_আলোর_মেলা
কলমে: লাবণ্য ইয়াসমিন
পর্ব:৩

নীরা মা*রা যাওয়ার চতুর্থ দিন, সামাজিক রীতিনীতি মেনে সামান্য পরিসরে অনুষ্ঠান করা হচ্ছে।যারা লা*শ দাফনে সাহায্য করেছিল তাদেরকে আর মসজিদের ইমাম, হুজুর গোছের কিছু লোকদেরকে বাড়িতে নিমন্ত্রণ করেছেন লতিফ সাহেব। সমাজে বসবাস করতে হলে কিছু নিয়মকানুন মানতে হয়। ধর্মীয় আইন যেখানে আমাদেরকে রক্ষা করে সামাজিক রীতিনীতি সেখানে আমাদের গলা টি*পে ধরতে উস্তাদ। সামর্থ্য অনুযায়ী সাহায্য করতে অসুবিধা নেই কিন্তু লতিফ সাহেবের অবস্থা করুণ। মেয়ে মা*রা গেছে সেই এক কষ্ট,দুই দাঁতে দাঁত চেপে এতোগুলো মানুষের মুখে আহার তুলে দিতে হচ্ছে। সকলে গণ্যমান্য ব্যক্তি। তাদের আপ্যয়নের ত্রুটি রাখলে এলাকা জুড়ে বদনাম হবে। অথচ এইটুকু অর্থ জোগাড় করতে বীণা বেগমের মায়ের দেওয়া হাতের বালা বিক্রি করতে হয়েছে সেখবর কেউ জানেনা। চল্লিশা মৃ*ত মানুষের কোনো কাজে আসবে কিনা জানা নেই তবে জীবিত মানুষের জিবন্ত দা*ফন যে হচ্ছে তা নিশ্চিত। আলো নিষেধ করেছিল এসব না করে টাকা এতিমখানায় দান করতে কিন্তু মোড়ল সাহেব মানলেন না। শেষপর্যন্ত সবাইকে নিমন্ত্রণ করতে হয়েছে। লোকজন নিয়ে ভাবতে হয়নি মোড়ল সাহেব বেশ কিছু লোক পাঠিয়ে দিয়েছে। আলো সকাল থেকে নিজের কক্ষে দরজা বন্ধ করে বসে আছে। আজকের দিনটা ওদের জীবনে কখনও আসতে পারে ভাবতে পারেনি। ছোট থেকে বোনের সঙ্গে বেড়ে উঠা। হাসি কান্না কতকিছু বোনটাকে ঘিরে। ইশার জ্বর এসেছে। মেয়েটাকে ডাক্তার দেখানো জরুরী। ওষুধ চলছে কিন্তু কাজের কিছু হচ্ছে না। মাঝে মাঝে কাশি হচ্ছে। আলোর ভয় লাগছে। বোনের মতো কিছুতেই ও ইশাকে হারাতে পারবে না। ইশা ঘুমিয়ে আছে। আলো ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলো হঠাৎ দরজায় ঠকঠক আওয়াজ শুনে দরজা খুঁলে দিলো। ওকে অবাক করে হুড়মুড় করে ভেতরে প্রবেশ করলো হাবিব। আলো চমকে উঠে তাড়াতাড়ি গিয়ে ইশাকে কোলে তুলে নিলো। হাবিব সেদিকে চেয়ে হাসলো। মাথা নিচু করে বলল,

> ভয় পাচ্ছো কেনো? আমি ওকে নিতে আসিনি। আমি শুধুমাত্র তোমার সঙ্গে কথা বলতে এসেছি। কথা শেষ হলে চলে যাব প্রমিজ। আলো আমার কথাটা শুনো প্লিজ।

আলো ঢোক গিললো। প্রচণ্ড ভয় করছে।বাড়ির লোকজন সব কাজে ব্যস্ত। এদিকে কেউ আসছে না। হাবিব ওর দিকে এগিয়ে গিয়ে পূণরায় বলল,

> আলো আমি যে কথাটা তোমার বলতে চাইছি সেটা শুনে হয়তো তুমি আমাকে খারাপ বলবে কিন্তু শুনো এতে আমার একটুও দোষ ছিল না। আমি তোমার বোনকে প্রথমে খুব একটা পছন্দ করতাম না। আমিতো তোমাকে চেয়েছিলাম। তোমার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে নীরাকে বেছে নিয়েছি। ভেবেছিলাম নীরার সঙ্গে সম্পর্কে জড়াতে পারলে তোমার কাছাকাছি আসতে পারবো কিন্তু তুমি আমাকে গুরুত্ব দিলে না। আমি ক্রমাগত নীরার দিকে ধাবিত হলাম।পরে মানিয়ে নিয়ে ভাবলাম নিয়তিতে যা আছে তা মেনে নেওয়া উচিত। আমি ওকে বিয়ে করলাম। বিয়ের পর ছয় মাস আমাদের মধ্যে দারুণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো। কিন্তু পরে কি হলো জানিনা। তোমার বোন অসুস্থ হয়ে এখানে চলে আসলো। কথায় বলে চোখের আড়াল তো মনের আড়াল। আমারও বুঝি তেমনই হয়েছিল। নীরাকে দেখতে যতবার এসেছি বারবার চোখ তোমাকে খুঁজেছে। আমি আবারও তোমার মায়াতে পড়ে যায়। নীরাকে বিরক্ত লাগতে শুরু করে। নীরা ভাবতো আমি বুঝি অন্য মেয়ের জন্য ওর সঙ্গে এমন করি কিন্তু আসলে তেমন কিছুই না। বারবার আমি তোমাকে চেয়েছি। আজ ফাইনালি তোমাকে পাওয়ার একটা আশা দেখতে পাচ্ছি প্লিজ আমাকে ফিরিয়ে দিওনা। ইশা তোমার কাছে আজীবন থাকতে পারবে। আমরা সুখে থাকবো। তুমি আমাকে মেনে নিলে আমি কথা দিচ্ছি ইশার দায়িত্ব নিয়ে আমি কোনো অবহেলা করবোনা। প্লিজ আমার কথাতে রাজি হয়ে যাও।

আলো হতভম্ভ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট পুরুষ মানুষ। যে কিনা স্ত্রীর বোনের দিকে খারাপ নজর দিয়ে নিজের স্ত্রী সন্তানকে দিনের পর দিন অবহেলা করেছে। আলো ইশাকে বাম হাতে আগলে রেখে ডান হাতে নিজের জুতাটা তুলে নিয়ে অপেক্ষা করলোনা। হাবিব কিছু বুঝে উঠার আগেই ওর গালে জোরে একটা থা*প্প*ড় লাগিয়ে দিয়ে চিৎকার করলো,

> এখুনি এ ঘর থেকে বের হবি,নয়তো তোকে খু*ন করে আমি জেলে যাব। তোর সাহস কিভাবে হয় আমার বোনকে মে*রে ফেলে এখন আমাকে বিয়ে করতে আসিস? বের হয়ে যা। তোর মতো জা*নোয়া*রের মরে যাওয়া উচিত। আমার বোনকে পছন্দ না হলে আগে বলতে পারতি। ভালোবাসার যোগ্য তুই না। বুবুকে বলেছিলাম এই অ*মানু*ষটাকে বিয়ে করিস না কিন্তু ও শুনলো না।
আলো কথা শেষ করে হাপাচ্ছে। হাবিব মুখে হাত রেখে ওর দিকে চেয়ে আছে। এমন অপমানজনক পরিস্থিতিতে আগে কখনও পড়তে হয়নি কিন্তু কিছু করার নেই। কিছু পেতে হলে কিছু দিতে হয়। তাই ছলছল চোখে বলল,

> তুমি যা ইচ্ছে আমাকে বলো তবুও প্লিজ আমার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিওনা। একটা কেনো হাজারটা জুতা মা*রো আমি সব কিছুর জন্য প্রস্তুত। নিজের ভালো পাগলেও বুঝে। তোমার বাবার যে পরিস্থিতি শুনলাম মামা তোমার খরচ দিতে অস্বীকার করেছে। আমাকে মেনে নিলে তোমার বাবার উপর থেকে চাপ কমবে। চলোনা প্লিজ।

হাবিব এগিয়ে আসাতে আলো দু’পা পিছিয়ে ধমক দিয়ে বলল,

> তুই যাবি না তাইতো? আচ্ছা যাসনে আমি দেখছি।
আলো চিৎকার করে মাকে ডাকতে শুরু করলো। পাশেই ফায়জু ছিল হন্তদন্ত হয়ে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল,
> আলো বাড়িতে লোকজন আছে এভাবে চিৎকার করিস কেনো?

ফায়জু আরও কিছু বলতে চাইলো কিন্তু পারলোনা। ওর চোখ হাবির দিকে আটকে গেলো। কি হচ্ছে বোঝার জন্য আলোর দিকে চাইলো। আলো ইশারায় বুঝিয়ে দিলো। ফায়জু সোজা হাবিবের কলার ধরে টেনে বাইরে বের করলো। আশেপাশে লোকজন আছে। কি শুনতে কি শুনবে শেষমেশ আলোর বদনাম হবে তাই দু চারটা থা*প্প*ড় দিয়ে বলল,

> বলেছিলাম না এই বাড়িতে আর পা রাখবি না? বাবা নীরাকে যেসব ফার্নিচার দিয়েছিল ওসব তোকে আমরা ভিক্ষা দিলাম ফিরিয়ে দিতে হবে না। আর আলোর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। ওর আশা ছেড়ে দিয়ে বাড়িতে গিয়ে তোর মায়ের পছন্দসই বিয়ে করে মানুষ হয়ে উঠ। আমার বোনের ভাগ্য খারাপ ছিল আমরা মেনে নিয়েছি।

ফায়জু কথা বলতে বলতে ওকে পেছনের গেট দিয়ে বাইরে ছুড়ে দিয়ে গেট বন্ধ করলো। নানারকম লোকজন আসছে তার মধ্যে ওকে চোখে পড়েনি। অমানুষ কাকে বলে একে না দেখলে অদেখা থেকে যাবে।
হাবিব চলে যাওয়ার পর লতিফ সাহেবের কানে কথাটা পৌঁছনোর পর উনি বেশ চিন্তিত ছিলেন। বারবার ছেলেটা এভাবে আসতে থাকলে মেয়ের নামে বদনাম হবে। তাছাড়া বেহায়া লোকদের মেরে ধরে বকাবকি করে লজ্জা দেওয়া কঠিন। লতিফ সাহেবের চিন্তার অবসান ঘটিয়ে ইকবাল মাহমুদ ফোন করে জানালেন যেহেতু আয়োজন করা হয়েছে। আর উনাদের নিমন্ত্রণ করেছে তাই এই উপলক্ষে বিয়েটা আজকের মধ্যেই হবে। লতিফ সাহেব খুশী হলেন। এমন প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা বোকামি হবে তাই রাজি হলেন। নতুন করে কিছু করতে হলোনা। সন্ধ্যার আগে ইকবাল মাহমুদ কয়েকজনকে নিয়ে উপস্থিত হলেন। পাত্র এলো বিয়ের কয়েক মিনিট আগে। ফায়জু বিরক্ত হলো। বখাটেদের আবার ব্যস্ততা কিসের কে জানে। আলো খুব সাধারণভাবে সেজেছে। পরণে সুতি সিল্কের কোমলা রঙের শাড়ি। আর টুকটাক কিছু অলঙ্কার। ইকবাল মাহমুদ ছেলের বউকে এইটুকুই দিয়েছেন। তাতে এবাড়ির কারো কোনো অসুবিধা নেই। হঠাৎ বিয়ের আয়োজনে এটাই অনেক কিছু। আলোকে বাইরের কক্ষে নেওয়া হলোনা। ফলাফল, পাত্র না দেখে কবুল বলে অচেনা লোকটাকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করলো। আলোর মনের মধ্যে বিয়ে শশুর বাড়িকে কেন্দ্র করে তিক্ত একটা ধারণা তৈরী হয়েছে। জানা নেই এটা ঠিক কোন দিকে গড়াবে।
****
বাসর ঘরে বসে আছে আলো। বাসর ঘর বলতে ছিমছাম সাজানো গোছানো কক্ষ।কিছু রজনী গন্ধা আর গোলাপ ফুলদানিতে শোভা পাচ্ছে। টি টেবিলের উপরে বড় থালার মধ্যে গোলাপের পাপড়ির নিচে ছোট একটা বাতি জ্বালিয়ে রাখা। বেলি ফুলের গন্ধে চার‍দিক মৌমৌ করছে। বড় বিছানার মাঝে চারখানা মাথায় দেওয়া বালিশ আর একটা পাশ বালিশ রাখা। সিঙ্গেল সোফা আছে দুখানা। আলো চারদিকটা ভালো করে দেখে নিলো। ভাবলো, লোকটা এতো বিলাসীতা পেয়ে হয়তো বিগড়ে গেছে। নিজের জন্য বড্ড আফসোস হচ্ছে। এরকম একটা বখাটে লোকের বউ হয়ে বড়সড় কোনো ভুল হলো না তো? ঘড়িতে টাইম বারোটা বেজে চল্লিশ মিনিট। একটা বাজতে চলেছে লোকটার খোঁজ নেই। বাইরে থেকে কয়েকজন মহিলা অদ্ভুত সব নিয়মকানুন শিখিয়ে দিয়েছে যেটা করা আলোর পক্ষে সম্ভব না। বড়জোর সালাম করতে পারবে। হুট করে দরজা খোলার শব্দে ও চমকে উঠলো। ঘোমটা আরও একটু টেনে নিলো। শ্রাবণ গটগট করে হেঁটে এসে ওর কোলের উপরে ইশাকে রেখে পুরুষালী গমগমে কণ্ঠে বলে উঠলো,

> এই মেয়ে,কেমন মা তুমি? বাচ্চাটাকে ফেলে বাসর ঘরে ঘোমটা টেনে বসে থাকতে লজ্জা করছে না? শুনো আমার সামনে এসব চলবে না। তোমার অপরাধের ফল ওকে কেনো ভোগ করতে হবে বুঝলাম না।

আলোর চোখেমুখে বিস্ময় খেলা করছে। কণ্ঠটা ওর চেনা। আসার সময় শশুর মশাই জোর করে ইশাকে সঙ্গে এনেছে।কিন্তু শাশুড়ি মা ওকে নিজের কাছে রেখে দিয়েছিল। বলেছে বাচ্চা ঘুমিয়ে আছে সমস্যা হবে না। কিন্তু এই লোক ঠিকই সঙ্গে এনেছে। ইশা ঘুমিয়ে কাদা হয়ে আছে। ঠান্ডা লেগেছে বিধায় নিশ্বাসের সঙ্গে শব্দ হচ্ছে। শ্রাবণ পকেট থেকে ফোন বের করে কাকে একটা ফোন করে বলল,

> আঙ্কেল বাচ্চার ঠান্ডা লেগেছে আগামীকাল কি আপনি ফ্রি থাকবেন? আমি সকালে আসছি। আপনি খেয়াল রাখবেন।

লোকটা এইটুকু বলে রেখে দিলো। আলো চুপচাপ বসে আছে। হাত পা কাঁপছে। কিসের বখাটে?এই লোকটার সঙ্গে আলোর বেশ ভালো করে আলাপ আছে। যদিও শ্রাবণ আলোকে চিনবে না। মুখ দেখেনি কখনও। আলো ইকবাল মাহমুদের কথা এবার বুঝতে পারলো। কেনো ওকে চেনা বলেছিলো। আট মাস আগে রেবা নামের একটা কলেজ ছাত্রী মা*র্ডার নিয়ে একটা ঝামেলা হয়েছিল। আলো দলের লিডার হিসেবে লিড দিয়েছিল। তুখোড় মিছিল মিটিং হয়েছিল সেবার। আলোর সাক্ষাৎকার নিতে শ্রাবণ এসেছিল। ওদের একটা চ্যানেল আছে। অবহেলিত বা সুবিধা বঞ্চিত মানুষের নায্য বিচার পেতে ওরা সাহায্য করে। আলোর সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয়েছিল শ্রাবণের দলের। সে অনেক কাহিনী। আলো সেসব ভেবেই নার্ভাস হয়ে পড়লো। লোকটা যদি ওকে চিনতে পারে তবে? সবচেয়ে বড় কথা এই শ্রাবণ মাহমুদ ভাবছে ইশা আলোর নিজের মেয়ে। কি অদ্ভুত ব্যাপার। ইকবাল মাহমুদ সত্যিটা বলেনি। আলো হতাশ হলো নিজের ভবিষ্যতের চিন্তা করে। ততক্ষণে শ্রাবণ ফ্রেস হয়ে এসেছে। আলোকে এভাবে বসে থাকতে দেখে ধমক দিলো,

> এভাবে বসে থাকলে হবে? বাচ্চা জেগে উঠলে ঘুমাতে পারবে? তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ো।

শ্রাবণ আরও কিছু বলতে চাইলো তার আগেই ওর ফোনটা বেজে উঠলো। বিরক্ত হয়ে ফোন রিসিভ করে বলল,

> এখনো বউয়ের মুখ দেখতে পারিনি ভাই,তার মধ্যেই ফোন দিয়ে বিরক্ত করছিস। মানে কি রাহিন? ঝামেলা থাকলে আগামীকাল দেখবো। আপাতত এখন বাসর ঘর ছেড়ে যাওয়ার মুড নেই আমার।
আলো ঘোমটার আড়াল থেকে গোলগোল চোখ করে তাঁকিয়ে আছে। বিড়বিড় করলো, সত্যি সত্যি বখাটে একটা। কথাবার্তার কি শ্রী? আলোকে অবাক করে শ্রাবণ বলে উঠলো,

> আচ্ছা অপেক্ষা কর আমি আসছি।
শ্রাবণ ফোন রেখে আলোর দিকে চেয়ে বলল,

> শুনো আমাকে যেতে হবে। আধা ঘন্টা টাইম পাবে। এর মধ্যে ফ্রেস হয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। আমি আসছি।
শ্রাবণ উত্তরের অপেক্ষা করলো না তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেলো। আলো ঘোমটা ফেলে দম ফেললো। উপরের দিকে চেয়ে বলল,

> আল্লাহ একে আমার কপালেই গছাতে হলো? এই বান্দার সঙ্গে আমার তো মিনিটে মিনিটে ঝগড়া মারামারি লাগবে।

আলো চুপসে আছে। পাত্র দেখে বিয়েতে রাজি হওয়া উচিত ছিল। আবেগে চরম ভুল হয়ে গেছে। শ্রাবণ খারাপ না ভালো কিন্তু ওর আচরণ অন্যদের মতো না। সব সময় নিজের মতো ভাবে। অন্যায় দেখলে আগে বোঝাতে হয় কিন্তু শ্রাবণ সেসব করে না। ওর আগে হাত চলে পরে মুখ। আলো এটাই পছন্দ করে না। দুজনের উদ্দেশ্য এক কি রাস্তা ভিন্ন। একজন আগুন তো আরেকজন পানি।
***
নির্জন কক্ষে একজন অচেনা ছেলের সামনে বসে আছে শ্রাবণ। পাশে রাহিন ফোন ঘাটাঘাটি করছে। সামনের ছেলেটার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমাট হয়ে আছে। শার্ট ভিজে একাকার অবস্থা। শ্রাবণ জিঞ্জাসা করলো,

> আপনার পরিচয়? বলুন কিভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি?

ছেলেটা ঢোক গিলে বলল,

> আমি হাবিবুর রহমান হাবিব। ইশার বাবা। মানে আপনার স্ত্রীর কাছে যে বাচ্চা মেয়েটা আছে ও আমার মেয়ে।

শ্রাবণ চরম বিরক্ত হলো। রাহিন ফোন রেখে বিস্ময়কর দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে আছে। হাবিব পূণরায় বলল,
> আমি আমার মেয়েকে ফেরত চাইছি। আলো আমার সঙ্গে বিশ্বাস ঘাতকতা করেছে। আমি ওকে ভীষণ ভালোবাসি। অথচ আপনার টাকা পয়সা দেখে আমাকে ছেড়ে আপনাকে বিয়ে করলো। এরকম খারাপ চরিত্রের মেয়ের কাছে আমার মেয়েকে আমি রাখতে চাইছি না। প্লিজ আপনি ওকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিতে সাহায্য করুন। আপনি জানেন না আলোর চরিত্র কতটা নোংরা। ও আমার সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছিলো। পর*কিয়া যাকে বলে।

রাহিন এতগুলো কথা হজম করতে পারলোনা। উত্তেজিত হয়ে বলল,

> দেখলি আমি আগেই বলেছিলাম এই মেয়ের মধ্যে ঝামেলা আছে। এই ভাইটা ওদের দায়িত্ব নিতে রাজি আছে অথচ তোকে বিয়ে করলো। চরিত্রের ত্রুটি ঠিক হবে কখনও?

শ্রাবণ চোখ গরম করে ধমক দিলো,

> তুই থামবি? অবিবাহিত অবস্থায় ছেলেমেয়েরা একটু আধটু প্রেম করে থাকে। অনেক মাথামোটা মেয়ে আছে ছেলেদের প্রলোভনে পড়ে নিজের ক্ষতি করে ফেলে । যাইহোক হাবিব সাহেব আপনি ভুল সময়ে এখানে উপস্থিত হয়েছেন। বাচ্চা আমি দত্তক নিয়েছি। আইনী কাগজপত্র সবটা আছে। আর আমার বউয়ের হয়ে আমি আপনার কাছে ভীষণভাবে দুঃখিত। বিয়ের আগে যা করেছে সেসবের জন্য সত্যিই আমি ক্ষমা চাইছি কিন্তু কথা দিচ্ছি আমার বউ আর জীবনেও আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করবে না। আগামীকাল যা হয়েছে সেসব অতীত বর্তমানে সে আমার স্ত্রী। তাই তাকে সব ধরনের নিরাপত্তা দিতে আমি প্রস্তুত। আপনি এখন আসতে পারেন। বাসর ঘরে বউয়ের চাঁদ মুখ দেখার পরিবর্তে আপনার পোড়া মুখটা আমাকে দেখতে হচ্ছে। আমি আর অপেক্ষা করতে পারছি না। বাবাকে কথা দিয়েছি আজকের দিনটা আমি ভদ্র ছেলে হয়ে থাকবো। আপনি এখন আসতে পারেন। অনেক রাত হয়েছে। ফিরতে হবে।

শ্রাবণ কথা শেষ করে উঠে পড়লো। রাহিনকে ইশারা করলো হাবিবকে বের করে দিতে। রাহিন কথা মতো কাজ করলো। হাবিব কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। এতোটা দূরে আসার একমাত্র কারণ ছিল আলোর সর্বনাশ করা। অপমান করেছে তার প্রতিশোধ নেওয়া। কোনো ছেলে নিজের স্ত্রীর চরিত্র নিয়ে নোংরা কথা শুনে চুপ থাকতে পারবে না। ভেবেছিল এসব শুনে আলোকে শ্রাবণ তাড়িয়ে দিবে কিন্তু তেমন কিছুই হলোনা। হাবিব হতাশ হয়ে বাইকে বসলো। হাবিব বেরিয়ে যেতেই রাহিন মুখ খুঁললো।

> তুই কিন্তু ভুল করছিস। আমার ভালো লাগছে না। কতবার বললাম এরকম মেয়েকে বিয়ে করিস না। মেয়েটার বয়ফ্রেন্ড এসে বাচ্চার দাবি করছে। ছিঃ ভাবলেই কেমন লাগছে।

শ্রাবণ ভ্রু কুচকে বলল,

> কিসের মেয়ে মেয়ে বলিস? ভাবি বলতে পারিস না? বাচ্চাসহ বউ আমি মেনে নিয়েছি বারবার বলতে হবে? একজন মেয়ে নিশ্চয়ই শখ করে একজনের বাচ্চা জন্ম দিয়ে অন্যজনকে বিয়ে করতে চাইবে না? এই ছেলের মধ্যে ঘাপলা আছে। খবর লাগা। এসব আজেবাজে বিষয়ে আমাকে ডাকবি না। আমি যাচ্ছি।

শ্রাবণ ফোন হাতে বেরিয়ে গেলো। ক্লাবঘর ফাঁকা পড়ে আছে। রাহিন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

> এই আজব প্রাণীর বউটাও শেষমেশ আজব হলো।
***
শ্রাবণ চুপচাপ সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছিলো হঠাৎ ইকবাল সাহেবকে দেখে থমকে গেলো। ভদ্রলোক ওকে তীক্ষ্ণ নজরে দেখছে। শ্রাবণ জোর করে ওষ্ঠ হাসি এনে বলল,

> বাবা,কিছু বলবে ? একটু কাজ ছিল।
ইকবাল মাহমুদ ধমক দিলেন,

> বলেছিলাম না আজকের রাতটা তাড়াতাড়ি ফিরতে? আমার একটা কথা যদি রাখতে। আলো মা একা আছে। নতুন জায়গা একা থাকতে ভয় পাবে।
> কাজ কি জানে আজ আমার বিয়ে?

শ্রাবণের ত্যাড়া উত্তর। এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে অহেতুক কথা শুনতে হবে বিধায় কক্ষের দিকে এগিয়ে গেলো। ইকবাল মাহমুদ চিন্তিত হলেন। ছেলের ভাব ভঙ্গি পরিবর্তন হতে সময় লাগে না। কখন যে কি করবে আল্লাহ ভালো জানে। শত্রুর অভাব নেই। সোসাইটির একজন যদি ওকে ভালো চোখে দেখে। কিভাবে পথের ঝামেলা ঘরে আনতে হয় সেই বিষয়ে পিএইচডি করে ফেলেছে। এখন একমাত্র ভরসা আলো। আলো কি পারবে এই বখাটেকে জব্দ করতে?

চলবে