শেষের পঙক্তি পর্ব-২+৩

0
724

#শেষের_পঙক্তি
লেখনীতেঃ #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_২
দীর্ঘ চার বছর পর বন্ধুদের সাথে আড্ডা যেন জমজমাট হয়ে উঠেছে। নাদিয়া, লিরা, ফাইজা ও জারিন তো তূরকে দেখে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেছে। তূর আমেরিকা চলে যাবার সময়ও এদের কান্নার জন্য তূর তখন ওদেরকে এয়ারপোর্টে সিঅফ করতে আসতে নিষেধ করেছিল। আশ্চর্য বিষয় হচ্ছে, ওদের সাথে তূরের পরিচয় সাড়ে চার বছর আগে হয়েছিল। মাত্র ছয় মাসের ব্যাবধানে তূর ইউনিভার্সিটি ও দেশ ছেড়ে চলে যায়। এতো কম সময়ে বন্ধুত্ব এতোটা স্ট্রং হবে তা কল্পনাতীত ছিল। নাদিয়া তূরকে বলে,

–ভালো হয়েছে তুই এসেছিস। তোকে কতটা মিস করেছি জানিস? আমরা সবাই মিলে আমেরিকা যাওয়ার প্ল্যানিং করেছিলাম।

তূর নাদিয়াকে বলে,
–তাহলে ভালোই হয়। আরো কিছু পরিচিত মানুষকে পাবো।

সবার সাথে হাসি আড্ডাতে সময় গড়িয়ে দুপুর হয়ে যায়। কথার ঝুড়ি যেনো শেষ হতে চায় না। দুপুরের পর তূর ওর বাড়িতে গেলো। তূরের বাবা ড্রয়িংরুমে কপালে হাত দিয়ে বসে আছে। তূরের মা, বোন, চাচা, চাচি সবাই বসে আছে। তূরের পিছনে অর্ক ও রাফি লাগেজ নিয়ে ঢুকলো। তূরকে দেখা মাত্র তূরের মা এসে তূরকে জড়িয়ে ধরে বলতে থাকেন,

–কোথায় ছিলি এতসময়? তোর না ভোর রাতে ফ্লাইট ল্যান্ড করার কথা? এতক্ষণ কোথায় ছিলি? আমাদের টেনশনে কি অবস্থা একবারও চিন্তা করেছিস?

তূর ওর মা কে সোফায় বসিয়ে ওর বাবার দিকে একবার তাকায়। তূরের বাবা র-ক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে আছে। তূর ওর মায়ের হাত ধরে বলে,

–যা থেকে বাঁচার জন্য চার বছর আগে আমি সব ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম! আজ সেই সত্যর সামনে আমি নিজের মানসিক অবস্থার পরীক্ষা দিয়েছি। দুর্বল তূর আজ নিজেকে পরীক্ষা করেছে।

তূরের মা অবাক হয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। তূরের বাবা গম্ভীর স্বরে বলেন,
–তুমি কি এতক্ষণ মিহালের সাথে ছিলে?

তূর ওর বাবার দিকে দৃষ্টি সরায়। তারপর মলিন হেসে জবাব দেয়,
–অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে সে আজকে আমাকে রিসিভ করতে গিয়েছিল। চার বছর যার থেকে নিজেকে স্ট্রং করেছি বাহ্যিকভাবে! সেই দীর্ঘসময় পর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর প্রথম দৃশ্যমান হলো আমার। এটা নিয়তিতে লিখা ছিল আব্বু। আমি কিন্তু নিজেকে কিঞ্চিত পরিমানও দুর্বল করি নি। চাইলে রাফি ও অর্ককে জিজ্ঞাসা করো। সে তার মতো ভালো আছে যেনে খুশি হয়েছি কিন্তু মনের মাঝে একটা গাড়ো আক্ষেপ তো রয়েই যায়। বাদ দাও সেসব কথা। আমি যে ভেঙে পড়িনি তা তো বুঝতে পেরেছো?

তূরের মেঝোবোন নীরা এসে বলে,
–থাক বাবা। আর আপু কতসময় এভাবে পালিয়ে বেড়াবে বলো? পরিস্থিতির মোকাবেলা করতেই হয়। এমনও হতে পারে এবার নিয়তির পরিকল্পনা অন্যকিছু!

নীরার কথায় তূর মলিন হাসে। এই সামন্য ক্ষীণ আশা নিয়েই তো সে নিজেকে স্ট্রং করেছে। ক্ষীণ আশা কখন সুন্দর ভবিষ্যতে বদলে যায় তা আল্লাহ্ ছাড়া কেউ বলতে পারেন না। তাছাড়া তূর কোনো অযৌক্তিক বা অন্যায় আবদার তো করছে না। মিহালের ভাগ্যে কে আছে তা কেউ একরোখা দাবি করে বলতে পারে না।

নীরা ও নাফিহা(তূরের ছোটোবোন) অর্ক ও রাফির হাত থেকে লাগেজ নিয়ে তূরের রুমে চলে যায়। সকাল থেকে তূরের রুমটা ওরা দুই বোন মিলে গুছিয়েছে। তূরের কাকি রাফি ও অর্কর জন্য কফি ও কিছু নাশতা আনতে গেছেন। তূর্য (তূরের ছোটো চাচাতো ভাই) এসে তূরের সামনে মুখ গোমড়া করে দাঁড়ায়। তূর এতক্ষণে তূর্যকে খেয়াল করে দাঁত দিয়ে জিভ কাটে। তারপর এক কানে হাত দিয়ে তূর্যের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলে,

–আমার পিচ্চুটা। রাগ করেছিস আপির সাথে? সরি তো আপি। আপি তোর জন্য অনেক চকলেট এনেছি। মেঝো আপু আর ছোটো আপুকে গিয়ে বল, ব্যাগের সামনের চেইনে চকলেট আছে অনেক।

তূর্য তাও মুখ ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ৯ বছরের ছেলের কতো রা*গ! ভাবা যায়! তূর একটু অভিনয় করে ন্যাকা কন্ঠে বলে,

–তাহলে আমি আবার আমেরিকা চলে যাচ্ছি। আমার পিচ্চুটা তো আমার সাথে রাগে কথাই বলবে না! চল রাফি ও অর্ক! আজ রাত ১২ টার ফ্লাইটে আবার চলে যাবো। আর আসবো না আমি।

তূর্য এবার এক অকল্পনীয় কাজ করে বসে। তূরের ডান হাতের কব্জির উপরে তূর তার সুচালো ধারালো দাঁত দিয়ে কা*মড় বসিয়ে দেয়। আচমকা এমন হওয়াতে তূর চিৎকার করে উঠে কিন্তু তূর্য তো ছাড়ার পাত্র নয়। কয়েকমিনিট পর তূর্য হাত ছেড়ে দিয়ে দৌঁড়ে চলে যায়। তূরের হাতে এখন হালকা করে র*ক্ত দেখা যাচ্ছে। তূরের কাকি তূরের চিৎকারের শব্দে দ্রুত আসতে গিয়েও পারেন না। এখন হাত থেকে ট্রে টা রেখে অতিসত্তর তুলা ও স্যাভলন এনে লাগিয়ে দিচ্ছেন। তূরের কাকা এদিকে তূর্যের পেছোনে ছুটেছেন একটু উত্তম-মাধ্যম দেওয়ার জন্য। দিন দিন জেদী হয়ে যাচ্ছে ছেলেটা।

_________
মিহাল বাড়ি ফেরার পর মিহালের মা জিজ্ঞাসা করেন,
–কোথায় ছিলে তুমি সারাদিন? ফজরের আগে বের হলে। এখন বিকেল গড়িয়ে যাচ্ছে। মানলাম তুমি বড়ো হয়েছো কিন্তু একবার জানাবে তো। তোমার ফোনটাও বন্ধ বলছে।

মিহাল ক্লান্তিতে নিজের রুমে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে। মিহালের মা নিজের প্রশ্নের জবাব না পেয়ে মিহালের রুমে এসে আবারো একই প্রশ্ন করে। মিহাল এবার বলে,

–যেখানেই থাকি না কেন! দিনশেষে তো বাড়িতে সুস্থ ভাবে ফিরেছি। তাই নয় কি?

মিহালের মা ক্ষে’পে যান তাও রাগ দমন করে বলেন,
–তানজিনা তোমাকে কতোবার ফোন করেছে কোনো হিসেব আছে তোমার? দুই দিন বাদে যে তোমার বউ হবে তার প্রতি তোমার কোনো মনোযোগ নেই দেখছি!

মিহাল তার মায়ের কথার পাত্তা দেয় না। এই তানজিনা মেয়েটাকে তার মোটেও পছন্দ হয় না। নেহাত মা-বাবা পছন্দ করেছেন আর ছোটোবেলা থেকে এক প্রকার ঠিক করে রেখেছেন বলে। মেয়েটা অনেকটা প্লে-গার্ল টাইপ। কিন্তু তার বাবা-মা যে কি দেখেছে তাই তার বুঝে আসে না। বান্ধুবীর মেয়ে বলে মা যেনো তানজিনার নামে জপ করতে থাকে।
তানজিনার সাথে মিহালের সেই ছোটোবেলায় বিয়ে ঠিক করা। মিহাল এটা ইন্টারের পর জানতে পারে। অবশ্য মিহালের এতে ততোটা খারাপ কিছু মনে হয় নি। মিহালের কোনো প্রেমিকা ছিল না আর না মিহাল কাউকে পছন্দ করতো! পড়ালেখা ও খেলাধুলা এসবেই মিহাল মেতে থাকতো। ইন্টারের পর রুয়েটে চান্স পায়। বুয়েটে ওয়েটিংয়ে ছিল বলে আর বুয়েটের আশা রাখে নি। রুয়েটে পছন্দের সিএসসি সাবজেক্ট পেয়ে যাওয়াতে আর বুয়েট নিয়ে মাথা ঘামায় নি। তূর যে মিহালকে পছন্দ করে তা মিহাল জানতে পারে রুয়েট থেকে প্রথম ছুটিতে বাড়ি এসে যখন সব স্কুল ফ্রেন্ডদের সাথে গেটটুগেদার করে তখন। তূর প্রোপোজ করে নি তবে তূর ও মিহালের বন্ধুরা ধোঁ*কা দিয়ে তূরের মুখ থেকে সত্য বলিয়ে ফেলেছিল। মিহাল তখন জানে যে তার সাথে তানজিনার বিয়ে ঠিক। তাই মিহাল তূরকে মানা করে দেয়।

ফ্ল্যাশব্যাক ——–

তূরদের গেটটুগেদার। তূরের স্কুল ফ্রেন্ড, অর্ক, ইনায়া, মিহাল, তাইজুল, তাওহীদ, ইরা, ইতি, আরো কয়েকজন এসেছে। তানজিনাও তূরদের স্কুল ফ্রেন্ড কিন্তু তানজিনার আসতে দেরি হবে কারণ তানজিনা পার্লারে গিয়েছে। তো অর্ক, তাইজুল, তাওহীদ, ইনায়া, ইরা ও ইতি মিলে প্ল্যানিং করেছে যে তূরকে ডে*য়ার দিবে। ডেয়ার হচ্ছে,
“রুফটপে উঠে খোলা আকাশকে সাক্ষী রেখে নিজের লুকায়িত ভালোবাসা ব্যাক্ত করতে হবে!”

তূর অনেকবার মানা করলেও ওরা শুনে নি। ইরা দেখবে তূর ডে*য়ার পূরণ করে কী না সঠিকভাবে! তূর বাধ্য হয়ে রুফটপে গিয়া খানিকটা জোড়ালো শব্দে বলতে শুরু করে,

–তোমাকে ভালোবাসি কোনো কারণ ছাড়া। জানি না কেনো ভালোবাসি। ঠিক কোন মুহূর্তে তো তোমার প্রতি স্নিগ্ধ অনুভূতিরা ফুলের মতো পরিস্ফুটিত ও প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়াতে শুরু করেছে তা আমি নিজেও জানি না। এটুকু জানি, ভালোবাসি! ভিষণ ভালোবাসি। ভালোবাসি মিহাল! তুমি ভালোবাসো কী না জানি না কিন্তু আমি ভালোবাসি। আমার মনকে আমি থামাতে পারি না তোমাকে ভালোবাসতে।
“~তুমি হাতটা শুধু ধরো, আমি হবো না আর কারো!”

তূর এই জটিল ভালোবাসার সরল স্বীকারোক্তি দেওয়ার সময় কিঞ্চিত পরিমানও আভাস পায় নি যে তার বন্ধুরা সেই স্থানে মিহালকেও হাজির করেছে।
তূর নিজের ভালোবাসা খোলা আকাশের নিচে ব্যাক্ত করে এখন চোখ বন্ধ করে মিষ্টি হাসছে। তার তো ধারনাও ছিল না কিয়ৎক্ষণ পর তার এই হাসি তার প্রসারিত ঠোঁটে দীর্ঘস্থায়ী কী না!

চলবে ইনশাআল্লাহ,

#শেষের_পঙক্তি
লেখনীতেঃ #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৩
হঠাৎ মিহালের মুখ নিঃসৃত বাক্যটা যেনো উপস্থিত সকলকে স্তব্ধ ও বিমূঢ় করে তুললো। আর যাকে উদ্দেশ্য করে এই রুঢ় বাক্যব্যয়! সে নিজের অক্ষিযুগলের সম্মুখে সব কিছু যেনো কালোমেঘের মতো আঁধার দেখছে। মিহালের বলা কথাটা ছিল,

–আই এম এনগেইজড উইথ তানজিনা। স্যরি আই কান্ট একসেপ্ট ইউর লাভ। ফরগিভ মি।

মিহাল কিন্তু কথাটা বলে এক মুহূর্তও অপেক্ষা করে নি সেই স্থানে। তূর ছাদের মেঝেতে ধপ করে বসে পরে। শক্তিহীন মনে হচ্ছে নিজেকে তার। কিছুক্ষণ স্তব্ধ ও নির্বাক থেকে হুট করে নিজের দুই হাত দিয়ে মাথা ও চুল খা*মচে ধরে চিৎকার করে কান্না শুরু করে। অর্করা তূরের চিৎকারে ভয় পেয়ে দৌঁড়ে তূরের কাছে যায়। এতক্ষণ ওরা পুরো ঘটনাতে এতোটাই স্তব্ধ হয়েছিল যে তূরের কি অবস্থা হতে পারে তা তারা খেয়াল করে নি। ইরা ও ইতি গিয়ে তূরকে জাপটে ধরে। তূরের কান্না থামানোর চেষ্টা করছে ওরা। কিছুক্ষণ পর তূর নিস্তেজ হয়ে দেহের সব ভার ইরা ও ইতির উপর দিয়ে দেয়। মূলত তূর সেন্সলেস হয়েছে।

ফ্ল্যাশব্যাক এন্ড———

মিহাল ওর মাকে ডোন্টকেয়ার ভাবে জবাব দেয়,
–সে আমার বউ না যে তাকে আমার সময় দিতেই হবে। হবু বউ ও বউয়ের প্রতি পার্থক্য আছে। আর তানজিনার গা ঘেঁষাঘেঁষি স্বভাব আমার পছন্দ না। বিয়ের ঠিক এক সেকেন্ড আগেও আমি চাইবো, এমন কিছু হোক যার দরুন আমি তানজিনার থেকে রেহাই পাবো!

মিহালের মা হতভম্ব হয়ে গেলো। সে এরকমটা আশাও করেন নি। তার বান্ধুবীর সাথে অনেক আগে থেকে কথা বিয়েটা নিয়ে। মিহালের মা আরো কিছু বলতে মুখ খুলতে চাইলেন কিন্তু মিহাল তার আগেই তার মাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,

–তোমার যদি তানজিনার টপিক ছাড়া ভিন্ন কিছু বলার থাকে তবে বলো। আর না থাকলে, প্লীজ লিভ মি এলোন। আমি অনেকটা টায়ার্ড। আছে ভিন্ন কিছু বলার?

মিহালের মা কিছু না বলে হনহনিয়ে চলে গেলেন। মিহাল হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো যেনো। তারপর নিজের সুইচ অফ করা মোবাইলের দিকে তাকিয়ে সেটাকে সুইচ অন করার প্রচণ্ড বিতৃষ্ণা থেকে আর করলো না। সুইচ অন করলেই যদি তানজিনার কল বা মেসেজ আসে!
মিহাল কয়েকমিনিট রেস্ট করে মাগরিবের নামাজটা পড়ে রুমের লাইট অফ করে শুয়ে পরে। নেত্রপল্লব যেনো নিদ্রাতে মুদিত হতে চাইছে।

_______
মাগরিবের পর তূরের শরীরও আর সায় দিচ্ছে না জেগে থাকতে। জার্নির ধকল এখন হারে হারে টের পাচ্ছে। লং জার্নির কারনে এখন ঘুমালে ঘুমটা অনেক গভীর হবে তাই একেবারে রাত ৮.৩০ টার মধ্যে ডিনার করে এশার নামাজ পড়ে ঘুমাবে। নাফিহা ও তূর্য দুইজনে তূরের আনা চকলেট ভাগাভাগিতে লেগে গেছে। চকলেট তো তূরেরও খুব পছন্দ কিন্তু দীর্ঘসময় নিজের অনেক পছন্দ ও আবদার গুলোকে মনের গুপ্ত সিন্দুকে তালাবন্ধ করে রেখেছে। তূরের খুব ইচ্ছে ছিল, “মিহালের সাথে বিয়ে হলে মিহাল ওকে ফুলসজ্জার রাতে অনেক অনেক চকলেট দিবে। সাথে কাচের চুড়ি ও ফুল। বাকি আর কিছু দেক বা না দেক। ”
এগুলো ওর উইশ লিস্টে আছে। তূরের পাশে নীরা এসে বসে সাথে তূরের পছন্দের লেবুচা। হালকা চা-পাতি ও বেশি করে মশলাপাতি সাথে কড়া লেবু ও চিনি। নীরা তূরের হাতে চায়ের কাপ দেয়। তূর ওর রুমের ব্যালকনিতে বসে রাতের আকাশ দেখছিল। চন্দ্রমা আজ তার পূর্ণিমা রূপে আছে। অবশ্য আজ পূর্ণিমা না। ভরা পূর্ণিমা দুয়েকদিন আগেই চলে গেছে। সন্ধ্যা ৭.৩০ টার মতো বাজে। নীরার হাত থেকে চায়ের কাপ নিয়ে তাতে এক চুমুক দিয়ে প্রশান্তিতে বলে,

–জানিস, আমি এই চার বছরে একবারও লেবুচা বানাই নি আর পানও করি নি। আমার জিহ্বা হয়তো লেবুচাকে খুব বেশি পরিমানে মিস করছিল তাই তোর বানানো চা টাও অমৃত মনে হচ্ছে।

নীরা তার বড়ো বোনের কথায় ভ্রুঁ কুঁচকে নিজের চায়ের কাপে চুমুক দেয়। দুই কাপ চা এক সাথেই বানিয়ে তারপর কাপে ঢেলেছে সে। নীরা চুমুক দিয়ে তূরের দিকে তাকায় যেভাবে বাচ্চারা ধরা পরলে ঠোঁট ফুলিয়ে চোরা চোখে দৃষ্টি দেয় তেমন ভাবে। তূর সেটা দেখে ফিক করে হেসে ফেলে। তারপর নীরার এক গাল টেনে বলে,

–আমি তো জানি তুই চায়ে লেবু ও চিনির পরিমান একসাথে সঠিক বুঝতে পারিস না। এমনকি টেস্ট করেও বুঝতে পারিস না। তবে চা টা কিন্তু জোস হয়েছে। দীর্ঘ চার বছরের বেশি সময় পর চা পান করছি তো। এই নে উম্মা!

নীরাও তূরের দুষ্টুমিতে হেসে ফেলে। তূর আকাশের দিকে তাকিয়ে চা পান করছে। দৃষ্টি যেনো একনিষ্ঠ নিবদ্ধ ওই গোল থালার মতো চাঁদের দিকে। নীরা কিছুক্ষন তূরের দিকে তাকিয়ে থেকে তূরের হাতের উপর নিজের হাত রেখে বলে,

–আপু! তুই কি ঠিক আছিস? তোর খুব কস্ট হচ্ছে! তাই না?

তূর হেসে নীরার দিকে তাকায় তারপর বলে,
–উহুম। বাদ দে সেসব কথা। বাবা-মা তো চাইতো আমি যেনো আর কোনোদিন দেশে না আসি আর না মিহালের সামনে পরি। কিন্তু যদি নিয়তিতে সাক্ষাৎ লেখা থাকে তাহলে আমরা শত বাঁধা অতিক্রম করে হলেও সেই স্থানে সেই সময় উপস্থিত হবো। উপরে একজন সঠিক পরিকল্পনাকারী তো আছেন। তিনি কর্মের মাধ্যমে ভাগ্য বদল করেন ঠিক তবে বদল করা ভাগ্যটাও তিনি আগে লিখে রাখেন। যদি কর্ম করি তবে সেটা আমাদের ধাপে ধাপে প্রদান করবেন। নয়তো না। সঠিক সময়ে যদি আমরা সঠিক সিদ্ধান্ত নেই তবেই আল্লাহ্ আমাদের সহোযোগিতা করবেন। যদি সবকিছু মানুষ নিয়ন্ত্রণ করতো তবে রবের প্রতি বিশ্বাস থাকতো না কারো। আচ্ছা, সেসব বাদ দে। আগে এটা বল? আমি আসার পর থেকে তুই আমাকে আপু! আপু! বলছিস কেনো? আমাকে তো তুই কোনো কারণ ছাড়া আপু ডাকিস না!

নীরা চায়ের খালি কাপটা রেখে তূরকে জড়িয়ে ধরে বলে,
–তোকে কিছু বলার ছিল।

তূর এক ভ্রঁ উঁচিয়ে ইশারা করে। ব্যালকনিতে লাইট জ্বালানো নেই বা রুমেও জ্বালানো নেই। চাঁদের আবছা আলোতে নীরা কিছুটা বুঝতে পেরেছে আগের অভিজ্ঞতা থেকে যে তূরের ফেসিয়াল রিয়াকশন কেমন হতে পারে। নীরা একটু লাজুক স্বরে বলে,

–আসলে..

তূর তাকিয়েই আছে জানার জন্য। নীরা আবারও বলে,
–আসলে কিভাবে বলি!

তূর নীরার মাথায় চা’টা মে’রে বলে,
–তোমারে কি এহন ফুল দিয়া মনোরঞ্জন করতে হইবো? যা বলবা জলদি বলে ফেলো। নাহলে কিন্তু মুই আম্মুর কাছে গিয়া কমু যে তার মেঝো মাইয়া প্রেম করে! কি এহনও ভাব দেহাইবা?

নীরা হেসে ফেললো তূরের এরকম ভাষা শুনে। যেনো তেনো হাসি না! ব্যালকনির ফ্লোরে বসে পরেছে সে হাসতে হাসতে। তূর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ পর হাসি থামিয়ে নীরা বলে,

–তুই কিন্তু সঠিক আইডিয়া করেছিস। আই এম ইন লাভ উইথ সামওয়ান।

তূর এবার গোল গোল চোখ করে নীরার পাশে ধপ করে বসে পরে বলে,
–রিয়ালি! যাক তুইও তাহলে এই বিষাক্ত সুধা পান করেছিস!

চলবে ইনশাআল্লাহ,
ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। কার্টেসি ছাড়া কপি নিষিদ্ধ।