শ্রাবণ ধারায় পর্ব-০৫

0
233

#শ্রাবণ_ধারায় |৫|
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি

ফারিশের ফর্সা মুখ রক্ত বর্ণ ধারণ করেছে।বারবার চোখের সামনে চিনির থুতু ছোঁড়ার দৃশ্যটি ভেসে উঠছে।গাড়িতে বসে রাগে ফোঁস ফোঁস করছে সে।গাড়ির ফ্রন্ট সিটে গুমোট হয়ে বসে রয়েছে ফারিশ।তার এ চেহারা দেখে তার পিছনে বসা লোকজনরা কিছু বলার সাহস পাচ্ছে না।তবু তাদের মধ্য হতে একজন বেশ সাহসের সতিহ বলল,
– স্যার আর কোথায় কোথায় খুঁজবো?

তৎক্ষণাৎ ফারিশ রাগে কিড়মিড় করে বলল,
– জাহান্নামে খোঁজ।

আর কোনো প্রশ্ন করার সাহস পেল না তারা।গাড়ি এসে থামলো এক বিশাল রাজকীয় বাড়ির সামনে।বাড়িটির কারুকাজ বেশ আভিজাত্যপূর্ণ।প্রাচীরের একপাশে সোনালী অক্ষরে বড় বড় করে লেখা “বারিশ মেনশন”।বড় লোহার গেট খুলে যেতেই গাড়ি প্রশস্ত পাকা রাস্তা দিয়ে বাড়ির ভিতরে ঢোকে।রাস্তার দু’ধারে বাড়ি সৌন্দর্য বর্ধনে পাতাবাহারি গাছ লাগানো।ফারিশ দ্রুত গতিতে গাড়ির দরজা খুলে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করল।রাণী মৃধা বসার ঘরেই সোফাতে বসে আছে।অনবর ফোন কল করে চলেছে কাউকে কিন্তু একবারও ফোন রিসিভ হচ্ছে না।
– মা?

ফারিশের ডাকে মনোযোগ ভঙ্গ হয় রাণীর।উদ্বেগ স্বরে বলে,
– আরে তুমি ফোনটা ধরছ না কেন?কতবার কল করেছি জানো?

ফারিশ পকেট থেকে ফোন বের করে দেখল ফোন সাইলেন্ট করা।মায়ের দিকে অপরাধী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
– ফোনটা সাইলেন্ট করা।

– ফোন কি সাইলেন্ট করে রাখার জন্য?ফোন প্রয়োজনের সময় সহজে যোগাযোগ করার জন্য।যাকগে এসব বাদ দাও। বারিশের কোনো খবর পেলে?

– চিনির বাড়িতে গিয়েছিলাম।সেখানে নেই।তবে ও হয়তো ওখানেই ছিল।আমাদের দেখে পালিয়েছে।

– এতো শিওর হয়ে বলছ কিভাবে?

– অস্বাভাবিক কিছু দেখেছি তাই।

– কি দেখেছ?

-বলবো।আগে ওকে খুঁজে বের করি তারপর।এখন যাচ্ছি কাজ আছে।

অফিস থেকে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেল চিনির।দরজার লক খুলে ভিতরে প্রবেশ করতেই শরীর ভারি হয়ে গেল চিনির।ফ্লাটটা চারিদিকে অন্ধকার একদম থমথমে।ভ্রু কুঁচকে আসে চিনির।মোবাইলের ফ্লাশ জ্বালিয়ে আশেপাশে দেখে। ছোট্ট আওয়াজে ঢাক দিল,
– বারিশ?

কোনো সাড়া পাওয়া গেল না।বরং চিনির ফিসফিসানিতে ঘরটা আরো থমথমে হয়ে গেল।চিনি হাতের বাজারগুলো মেঝেতে রেখে ধীর পায়ে নিজের ঘরে এল।পুনরায় হিসহিসিয়ে বলল,
– বারিশ?

চোখ বুলিয়ে চারিদিকে খুব সুক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করলো চিনি।কোথাও বারিশের ঘ্রাণটুকুও নেই।চিন্তারা বাসা বাঁধল চিনির মস্তিষ্কে।তাহলে কি সত্যি সত্যি চলে গেল সে?নিজের ভাবনাকে ভুল প্রমাণ করতে দৌড়ে পাশের ঘরে গেল চিনি।আবার হাক ছাড়ল,
– বারিশ..বারিশ..?বারিশ?বারিশ?

আস্তে আস্তে গলার আওয়াজ বাড়িয়ে ডাকতে শুরু করল চিনি।বুকের মধ্যে বেদম হাতুড়ি পেটাচ্ছে কেউ।অক্সিজেন ঘাটতিও দেখা দিয়েছে।ছেলেটা কি সত্যি চলে গেল?এভাবে না বললেও পারত চিনি।না জানি কোথায় গিয়েছে।যদি ওদের হাতে পড়ে যায় তখন কি হবে?ভাবতেই দৃষ্টি ঘোলা হয়ে এল চিনির।গলায় কেউ ফাঁস দিয়ে রেখে যেন।চারিদিকে থমথমে নীরবতা। যা পরিস্থিতি আরো গুমোট করে তুলছে।এই মুহুর্তে কিছু মাথায় আসছে না চিনির।শুধু ভাবছে যদি ওদের কাছে ধরা পড়ে যায় তাহলে কি হবে?চিন্তায় মস্তিষ্ক জটা পাকিয়ে গেল চিনির।কাঁধের ব্যাগটা মেঝেতে ফেলে দৌড়ে ফ্লাট থেকে বেরিয়ে গেল।ফ্লাট লক করে বেরিয়ে পড়লো গন্তব্যহীন পথে।রাত হয়েছে বেশ।আটটা কি সাড়ে আটটা বড় বড় ল্যামপোস্টের আলোই পিচ ডালায় রাস্তায় হাঁটছে চিনি।দু’চোখ খুঁজছে সেই প্রিয় মুখ।হাঁটতে হাঁটতেই থমকে দাঁড়ায় চিনি।ভাবে হঠাৎ এতোটা উদ্বেগ হয়ে উঠলো কেন চিনি?বারিশের জন্য?বারিশকে তো সে ঘৃণা করে তাহলে এতো উদ্বিগ্ন কেন সে?পরমুহূর্তেই ভাবল এতো কিছু ভাবার সময় নেই এখন।তাড়াতাড়ি আগে বারিশকে খুঁজে বের করতে হবে।চঞ্চল চোখ দু’টো এদিকে সেদিক ঘুরিয়ে কাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে খুঁজে চলেছে চিনি।হাঁটতে হাঁটতে বেশ অনেকটা দূর চলে এলো চিনি।বাতাসে কেমন শীতলতার আভা।বৃষ্টি গন্ধ মোঁ মোঁ করছে।শীতল বাতাস আরো প্রখর হল।বাতাস যেন চিনির কানে কানে বারিশের মতো কন্ঠ খাদে নামিয়ে বলছে মেঘে মেঘে সংঘর্ষে আকাশ এবার কাঁদবে।ভীত চিনি শুঁকনো ঢোক গিলল।বর্ষার আগ মুহুর্তে প্রকৃতি এলোমেলো আচরণে সকল মানুষ যে যেখানে পারে ঠাঁই নিয়েছে।রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা আকাশীরঙা রাজশাহী সিল্ক শাড়ি পরিহিতা রমণীর কোনো হেলদোল নেই।সে তার মতো কাউকে খুঁজতে ব্যস্ত।তা দেখে মধ্য বয়সী একলোক চিনিকে বলল,
– এই মেয়ে তাড়াতাড়ি ছাউনির নিচে আসো।দেখছ না ঝড় আসছে।

চিনি একপলক তাকায় সে কন্ঠের মালিকের দিকে।অতঃপর আবারও নিজের কাজে মনোযোগ দেয়।লোকটি চোখ মুখ খিঁচে বলল,
– কি রে বাবা কানে শোনে না নাকি?

আচমকা সব দোকানের বৈদ্যুতিক আলো নিভে গেল।বোঝা গেল বৃষ্টি দরুন ইলেক্ট্রিসিটি বন্ধ করা হয়েছে।দোকানে ঠাঁই নেওয়া লোকদের থেকে আওয়াজ এলো,
– ধূর!গেল কারেন্ট!

ঝুপ করে বৃষ্টি নামল এবার।চিনি কিছু বুঝে উঠতে না পেরে দৌড়ে পাশের একটি দোকানে যাওয়ার জন্য উদ্যত হল।সঙ্গে সঙ্গে ছিঁড়ে গেল চিনির পায়ে থাকা দুই ফিতার স্টোন দেওয়া জুতোটা।কিছু স্টোন অদৃশ্য আর কিছু স্টোন চকমক করছে।চিনি তড়িত গতিতে জুতো খুলে হাতে নিল ঢুকে পড়লো দোকানটিতে। অর্ধেক শরীর পানি স্পর্শ করেছে তবে সেভাবে ভেজাতে সক্ষম হয়নি।ঠাঁসাঠাঁসি করে দাঁড়িয়ে আছে সবাই। সেখানে চিনির জায়গা হলো দোকানের একদম কোণায়।ফলে বাতাসের সাথে বৃষ্টির পানি এসে খুব দৃঢ়ভাবে ছুঁয়ে যাচ্ছে চিনির শরীর।চিনি শাড়ির আঁচলে নিজেকে ভালো করে মুড়ে নিল।চারিদিকে অন্ধকার নিস্তব্ধ পরিবেশ শুধু বৃষ্টির টুপটাপ শব্দ।জোরে এক শ্বাস নিল চিনি।আবছা আলোই দেখা গেল দোকানে পুরুষের সংখ্যা বেশি।মহিলা বলতে চিনি এবং দুজন বয়স্ক মহিলা।তারা দোকানের অপর প্রান্তে।চিনি সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে বাহিরে তাকালো।প্রচন্ড বেগে বৃষ্টি নেমেছে।হঠাৎ অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শে বুক কেঁপে উঠল চিনির।হাত কোমর জুড়ে দু’টো অপরিচিত ছোঁয়া বিচরণ করছে।চিনি বিব্রত হয়ে সামান্য সরে দাঁড়াল। পাশে তাকিয়ে এক মধ্য বয়সী চাকুরিজীবী লোককে চোখে পড়লো তার।হাতে একটি কালো ব্যাগ সচারাচর এসব ব্যাগ চাকুরিজীবীদের হাতে দেখা যায়।সেভাবেই অনুমান করল লোকটি অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে আঁটকে গিয়েছে।চিনি কিছু বলল না ভাবল হয়তো কোনো কারণে ভুলে স্পর্শ হয়ে গিয়েছে।কিন্তু সে স্পর্শ পুনরায় পেতেই চট করে ঘাড় ঘুরিয়ে রক্তচক্ষু নিয়ে লোকটির দিকে তাকাল চিনি।লোকটি মুখে এক আত্ম তৃপ্তি মূলক হাসি নিয়ে তাকিয়ে আছে চিনির দিকে।কটমট চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিল চিনি।আরেকটু বের হয়ে দাঁড়াল সে।এবারও কিছু না বলায় আস্পর্ধা বেড়ে গেল লোকটির।বাঁকা হেসে নিজের হাতটি চিনির দিকে বাড়িয়ে আনতেই কেউ সেই হাত ধরে ধাক্কা দিয়ে লোকটিকে পাশে সরিয়ে চিনির পাশে দাঁড়িয়ে পড়ল। মুখে বলল,
– এই ভাই এই দেখি সরুন তো।দাঁড়াতে দেন।দেখছেন না বাইরে কেমন বৃষ্টি হচ্ছে।

পরিচিত কন্ঠে থমকে গেল চিনি।অবাক চোখে পাশে তাকাতেই দেখতে পেল বারিশ তার ভেঁজা চুলগুলো অনবরত পিছনে ঠেলছে আর শার্ট ঝেড়ে বৃষ্টি পানি মুছতে চেষ্টা করছে।বারিশ এবার চিনির দিকে তাকালো দেখল চিনি চোখ বড় বড় করে তার দিকে চেয়ে আছে।বারিশ নিজের থুঁতনিতে হাত দিয়ে ভাবুক স্বরে,
– আরে আপনাকে খুব চেনা চেনা লাগছে।কেন বলুন তো?ওয়েট আ মিনিট…ও মাই গশ! আপনি দেখতে একদম আমার বউয়ের মতো।

পাশের লোকটা বেশ বিরক্ত হলো তার ফজিলতপূর্ণ কাজে ব্যাঘাত ঘটাতে। তার উপর বারিশের এমন বেহুদা কথাবার্তা।লোকটা বেশ কড়া গলায় বলল,
– এই কে আপনি?এমন মাঝখানে উড়ে এসে জুড়ে বসলেন কেন?

বারিশ বেশ হাসি হাসি মুখ করে লোকটার দিকে তাকাল লোকটাকে পা থেকে মাথা অবধি দেখে বাঁকা হেসে লোকটির কানে ফিসফিসিয়ে বলল,
– এতো কারেন্ট যখন তাহলে লাইটগুলো জ্বালিয়ে দেন না।অন্ধকারে কিছু দেখতে পাচ্ছি না।আমার আবার রাতকানা রোগ আছে।রাতের বেলা বউকে ছাড়া কাউকে দেখতে পাই না।দেখেন না যাকে দেখছি তাকে আমার বউয়ের মতো লাগছে।বলছি যে অনুগ্রহপূর্বক আপনার ব্যক্তিগত প্রাকৃতিক কারেন্টে যদি লাইটগুলো জ্বালিয়ে দিতেন তাহলে খুব উপকৃত হতাম।

খেপে গেল লোকটি বারিশের থেকে দূরে সরে গিয়ে রাগি কন্ঠে বলল,
– কি বলছেন এসব?মাথা খারাপ নাকি?

বারিশ ঠোঁট উল্টিয়ে আফসোসের সুরে বলল,
– ইশশ!এতো অবুঝ হলে কি আর পুরুষ মানুষ হওয়া যায়?

লোকটি বারিশের থেকে আরেকটু সরে গেল।বারিশ তার পাশে অবাক চোখে বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা চিনিকে তাকাল।দুই ভ্রু নাচিয়ে বলল,
-কি ম্যাম এতো রাতে এখানে কি করছেন?

কোনো উত্তর দিল না চিনি অপলক দৃষ্টি তাকিয়ে রইলো বারিশের দিকে।বারিশ বেশ শান্ত চোখে তাকিয়ে আছে চিনির দিকে।চিনির থেকে কোনো প্রতিত্তোর না পেয়ে বারিশ আবারও বলল,
– এই রাতের বেলা বৃষ্টি বিলাসের শখ জেগেছে বুঝি?বাড়িতে কেউ জানে যে এই রাতের বেলায় আপনি রাস্তায় নেমেছেন বৃষ্টিবিলাসে জন্য?

এবারও নিশ্চুপ চিনি।বারিশ বাহিরে তাকালো। বৃষ্টি কমে এসেছে।বারিশ বাহিরে হাত দিয়ে বৃষ্টির তীব্রতা পরিমাপ করছে।আর তার দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে চিনি।বারিশ আড় চোখ চিনিকে দেখল।এখনো গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে গলা ঝেড়ে আশেপাশে তাকালো সে।শার্টের খুলে রাখা দু’টো বোতাম থেকে একটি আঁটকে ফেলল।আবারও আড় চোখে তাকালো চিনির দিকে।বাহিরে তাকিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলো চিনির সামনে। জ্বল জ্বল চোখে বলল,
– চলো শ্রাবণ ধারায় একসাথে বৃষ্টিবিলাস করি!

চলবে…