শ্রাবণ ধারায় পর্ব -০৪

0
144

#শ্রাবণ_ধারায় |৪|
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি

সকালের নাস্তা বারিশকে পরিবেশন করে নিজের অফিসে যাবে চিনি।এই ভেবেই সকাল সকাল উঠে রান্না-বান্না করে বারিশের জন্য অপেক্ষা করছিল।বারিশ টেবিলে বসতেই প্লেটে খাবার দিল চিনি।খুব মনোযোগের সাথে তরকারির ঝোলে ভাত মাখিয়ে এক লোকমা গালে তুলবে ঠিক তখনই মনোযোগ ভঙ্গ হলো দরজায় কলিং বেলের শব্দে।মুখের সামনে লোকমাটা ধরেই ভীত চোখে চিনির দিকে তাকালো বারিশ।চিনি নিজেও ভীত চোখে চেয়ে আছে তার দিকে।বারিশ ইশারায় দরজা খুলতে বলল।চিনি এগিয়ে গেল দরজার কাছে।ডোর ভিউয়ার দিয়ে বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকা কলিং বেল বাজানো মালিককে দেখের চেষ্টা করে।কিছু দেখা গেল না।হয়তো হাত দিয়ে চেপে ধরে রেখেছে ডোর ভিউয়ারটা চিনির শঙ্কা আরো প্রবল হয়।পিছন ফিরে ডানে বামে মাথা নাড়িয়ে বোঝায় দেখা যাচ্ছে না।ঘামতে শুরু করে বারিশ।এঁটো হাতে তাড়াতাড়ি টেবিল ছাড়ে সে।ইশারায় চিনিকে দরজা খুলতে বলে চিনির রুমে চলে যায় সে।আতঙ্কিত চিনি শুষ্ক ঢোক গিলল।কাঁপা হাতে দরজার ছিটকিনি খুলে দরজা হালকা ফাঁক করে মাথা বের করে উঁকি দিল।বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিকে দেখতেই বুকের ভিতর ঢিপঢিপ করতে শুরু করল চিনির।মৃদু স্বরে বলল,
– ফারিশ?

ফারিশ তীক্ষ্ণ চোখের তাকিয়ে আছে তার দিকে। চিনি ঢোক গিলে নিজেকে স্বাভাবিক রাখারা চেষ্টা করে বলল,
– ত তুমি এখানে?

ফারিশ বাহিরে দাঁড়িয়ে ভিতরে চোখ বুলাতে বুলাতে বলল,
– কেমন আছো?

ফারিশের দৃষ্টি অনুকরণ করে চিনিও ভিতরে তাকায় বারিশের গতিবিধি জানতে।বারিশকে দৃষ্টিতে না আসতেই চোখ সরিয়ে ফারিশের দিকে তাকাল সে।মুখে সামন্য হাসির রেখা ফুটিয়ে বলল,
– আমি ভালো আছি।তুমি কেমন আছো?হঠাৎ এখানে কি মনে করে?

ফারিশ সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে চিনির চোখে চোখ রেখে নিচু স্বরে প্রশ্ন করল,
– ভাই আছে?

থমকে যায় চিনি।চোখ সরিয়ে উত্তর দিল,
– কি যে বল তোমার ভাই এখানে আসবে কি করে?আর তাছাড়া আমাদের ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে জানোই তো।

ফারিশ আরো গভীর দৃষ্টিতে চোখ রাখল চিনির চোখে তীক্ষ্ণ স্বরে জিজ্ঞেস করল,
– হুম। যদি আসে তাহলে বলবে বাড়িতে যেতে। বা আমাকে ফোন করবে।ভাইকে আবার অ্যাব্রট পাঠানো হবে।আসছি তাহলে আমি।

মাথা নাড়াল চিনি।গলা থেকে কথা বের হচ্ছে না।দর দর করে ঘেমে চলেছে সে।যে ঘামে ভেজা কপাল দেখে সন্দেহ হয় ফারিশের।সে শেষবারের মতো ঘরের ভিতরে উঁকি দিতেই খাবার টেবিলে খাবার দেখে ভ্রুদ্বয় কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,
– খাচ্ছিলে?

পিছন ফিরে আধ খাওয়া খাবারের প্লেটটি একপলক দেখে নিল চিনি।মাথা নেড়ে সায় দিল।ফারিশ ইশারায় তার সঙ্গে আসা লোকজনকে ভিতরে ঢুকতে বলল।তারা তাদের সর্বশক্তি দিয়ে দরজায় ধাক্কা দেয়।ছিটকে দুরে সরে যায় চিনি।শ্বাস প্রশ্বাস ঘন হয়ে ওঠে তার।ভীত চোখে ফারিশের দিকে তাকিয়ে উচ্চ স্বরে,
– এসব কি করছ ফারিশ?দিনে দুপুরে কেউ এভাবে একা একটা মেয়ের ঘরে ঢুকে পড়ে?এটা কোন ধরনের অসভ্যতা?

চেহারার রং বদল হয় ফারিশে।চেহারায় হিংস্রতা ফুটে ওঠে। একহাতে চিনির চোয়াল চেপে ধরে ফারিশ।দাঁতে দাঁত চেপে হুমকির সহিত বলে,
– চুপ একদম চুপ!আমরা যা জরতে এসেছি করতে দাও। আমরা আমাদের কাজ শেষে চলে যাবো।তুমি জানো না আমি অভদ্র? তাহলে আমার থেকে ভদ্রতা আশা কর কিভাবে?সুন্দর করে দু’টো কথা বলেছি বলে নিজেকে আমার বড় ভাবি ভাবতে শুরু করেছ নাকি?

চোখে জল চলে এল চিনির। চোয়ালটা জ্বলছে।বুকের হৃৎস্পন্দন অস্বাভাবিক হারে বেড়ে চলেছে।এদিকে ভয়ে শ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম। সবকিছু মিলিয়ে একটি নরক যন্ত্রণার অনুভূত হল চিনির।জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে বড় বড় চোখে তাকাল ফারিশের দিকে। ফারিশ হুংকার দিয়ে বলল,
– সবখানে খুঁজবি। এমনকি যেন একটা ইঁদুরের ঘরও বাদ না পড়ে।বুঝলি?

ফারিশের আদেশ অনুযায়ী সকলে খোঁজা খুঁজি শুরু করল।চিনি শুঁকনো ঢোক গিলে বোকা হেসে বলল,
– শোনো ফারিশ তোমার ভাই এখানে নেই।থাকলে আমি বলবনা কেন?তোমার মনে হয় এতকিছুর পরও তোমার ভাইকে আমি সাপোর্ট করবো?তাই এখানে খুঁজে লাভ নেই।

-এই একদম আমার সাথে চালাকি করবে না।ভাত খাচ্ছিলে না তুমি?তুমি না একটা থাক?তাহলে এই প্লেটে কার জন্য ভাত বেড়েছ?

তর্জনি দিয়ে আধ খাওয়া প্লেটের পাশেই একটি সুন্দর করে খাবার সাজানো প্লেট ইশারা করল ফারিশ।থমকে গেল চিনি।এটা কে সাজাল?সে তো সাজায়নি।তাহলে?পরক্ষণেই ভাবল বোধহয় বারিশ সাজিয়েছে তার জন্য।চোখ মুখ কুঁচকে ফেলল চিনি।ইশশ!কে বলেছিল তার জন্য খাবার সাজাতে এখন সে কি বলবে?ফারিশের দিকে ফিরে আবারও বোকা হাসে চিনি।হাসির মাত্রা বাড়িয়ে বলে,
– ওহ্।এটা তো আমার ফ্রেন্ড এর জন্য।ওকে ব্রেকফাস্টে ইনভাইট করেছিলাম।

ফারিশ তেড়ে এসে আবারও চোয়াল চেপে ধরল চিনির।প্রচণ্ড জোরে ধাক্কা দিয়ে দেয়ালের সাথে মিশিয়ে দিল চিনিকে।চিনির কাছে মনে হলো কেউ মুগুর দিয়ে তার পিঠের উপর বারি দিল।তবু কোনো রকম আর্তনাদ করল না চিনি।দাঁত খিঁচে দু’হাতে তলপেট চেপে ধরল।রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে বলল,
– আমার সাথে চালাকি করলে কিন্তু ফল খারাপ হবে। তাই ভালোই ভালোই বলছি ভাই কোথায় বলে দাও।

এর মধ্যেই ফারিশের লোকজন এসে দাঁড়াল বসার ঘরে।ফারিশকে উদ্দেশ্য করে বলল,
– কোথাও কাউকে পেলাম না।

– আচ্ছা তোরা বাইরে গিয়ে দাঁড়া। আর আশপাশটাও খুঁজে দেখ আমি আসছি।

চিনির দিকে তাকিয়েই উত্তর দিল ফারিশ।ওরা বেরিয়ে যেতেই পা থেকে মাথা অবধি অদ্ভুত এক দৃষ্টিতে চিনিকে দেখল বারিশ। যে দৃষ্টিতে অন্তর আত্মা কেঁপে উঠল চিনির।কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
– ছাড়ো আমাকে ফারিশ।

ফারিশ ছাড়ল না।চিনির গালে তার হাত আরও দৃঢ় হলো।ফারিশের ঠিক পিছনে বেশ অনেকটা দূরে দৃশ্যমান হল বারিশ।যাকে শুধু চিনির দৃষ্টিতে এল।বারিশ পকেটে হাত পুরে খুব শীতল দৃষ্টিতে তাদের দিকে চেয়ে আছে।বারিশকে দেখতেই ঢোক গিলে চিনি।দ্রুত চোখ ফিরিয়ে ফারিশের দিকে তাকায়।ফারিশ কিছুটা দুরত্ব কমালো।নিচু কন্ঠে আফসোসের সুরে বলল,
– ইশশ!আমার ভাবিটার কি অবস্থা হয়েছে।তবে এখনও শরীরে ঘ্রাণ একই রকম আছে।

তৎক্ষনাৎ ফারিশের মুখে থুতু ছুঁড়ে দিল চিনি।ফারিশ চিনির চোয়াল ছেড়ে নিজের মুখে হাত দিল।রাগে চিনির শরীর তির তির করে উঠলো।চোখ থেকে জল বয়ছে তার।ফারিশ মুখের থুতু মুছে রাগে কটমট করতে করতে ঠাস করে একটি চর বসিয়ে দিলো চিনির গালে।সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে বসে পড়লো চিনি।নিচু হয়ে পুনরায় চিনির চোয়াল চেপে ধরে হুমকি দিল,
– এর ফল ভুগতে হবে বুঝেছিস।

ঝটকা দিয়ে মুখ ছেড়ে গটগট করে বেরিয়ে গেল ফ্লাট থেকে ফারিশ।চিনি এখনও একই জায়গায় বসে আছে।কান্নার বেগ বেড়েছে তার।বারিশ শান্ত পায়ে এগিয়ে এল।ফ্লাটের দরজা আঁটকে চিনির সামনে এসে দাঁড়াল। কিছুক্ষণ শীতল দৃষ্টিতে চিনিকে দেখে রান্নাঘরে চলে এলো।
হঠাৎ মুখে ঠান্ডা অনুভব করতেই চোখ তুলে তাকায় চিনি।বারিশ তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে আছে।আইসব্যাগ দিয়ে তার মুখে বরফ লাগাচ্ছে।চিনিকে নিজের দিকে তাকাতে দেখে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
– ভালোবাস না তো?বলেই দিতে পারতে আমি এসেছিলাম।

বরফের ব্যাগটা একটানে দূরে ফেলে দিল চিনি।সেটার দিকে চেয়ে মুখ বাঁকালো বারিশ।চিনি কান্নারত কন্ঠে উচ্চ স্বরে বলল,
– জুতো মেরে গরু দান করতে এসেছেন?আপনার ভাই আপনার চোখের সামনে আমাকে কতটা কুরুচিপূর্ণ আচারণ করল।আর আপনি ওখানে চুপ করে দাঁড়িয়ে সব দেখলেন।নিজের স্বার্থের জন্য।অবশ্য নিজের স্বার্থের জন্য তো আপনি যা খুশি তা করতে পারেন।নিজের বাচ্চাকেও খুন করতে পারেন।তাও আবার এক দুবার না তিন তিনবার।আর এখন আমার মা হওয়াটাই অনিশ্চয়তার মধ্যে।আর এটা জেনেই আপনি আমার সাথে এখন এত ভালোবাসা দেখাচ্ছেন।

একটু থেমে চিনি আবারও কান্নাজড়িত কন্ঠে বলল,
– আচ্ছা এতো শোয় সম্পত্তি এগুলো কার জন্য?বলুন আপনার এতো শোয় সম্পত্তি কার জন্য করছেন এতকিছু?আপনি তো চিরকাল বাঁচবেন না। তাহলে কার জন্য করছেন এগুলো?আপনার অবর্তমানে এগুলো কার হবে?কেউ আছে?নেই!কারণ আপনি নিজেই তো তাদের আসতে দেননি এই পৃথিবীতে। আপনার থেকে হিংস্র,নিষ্ঠুর কোনো প্রাণী নেই।

শূন্য দৃষ্টিতে মাথা নত করে শান্ত হয়ে সব শুনছে বারিশ।যা চিনিকে আরো বেশি আবেগাপ্লুত করল।সে কান্নায় ভেঙে পড়লো নাক টেনে আবার বলতে শুরু করল,
– মানুষ যখন জিজ্ঞেস করবে তোমাদের বিয়ে হল এতবছর বাচ্চা হয় না কেন?তখন বলবেন আমার বাবার সম্পত্তির জন্য আমি আমার বাচ্চা ভূমিষ্ট হতে দিইনা।কেমন?আর এর পরও আপনি বলবেন আপনি পাগল না।আপনাকে ওরা পাগল সাজিয়ে শুধু শুধু হাসপাতালে রেখেছে।কি নিখুঁতভাবে মিথ্যা বলেন আপনি।মানুষ একটা বাচ্চার জন্য সারাটা জীবন কেঁদে পাড় করে।আর আপনি সেই বাচ্চাকে বউয়ের অজান্তেই সজ্ঞানে নিজে মেরে ফেলেন।পৃথিবীতে আপনার থেকে বড় সাইকো আর কেউ আছে?

শেষের কথাটি বেশ হুংকার দিয়ে বলে চিনি।মাথা তোলে বারিশ শূন্য চোখে চিনিকে দেখে সে।চিনি চোখ মুছতে মুছতে উঠে দাঁড়ায়। নিজেকে ঠিকঠাক করতে করতে বলে,
– আমি অফিসে যাচ্ছি। এসে যেন আপনাকে এখানে আর না দেখি।যদি আপনাকে দেখি তাহলে আমি নিজে এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো।বুঝতে পেরেছেন।

চলবে…?