শ্রাবণ ধারায় পর্ব-৬+৭

0
138

#শ্রাবণ_ধারায় |৬|
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি

বারিশের এগিয়ে দেওয়া হাতে কয়েক ফোঁটা বৃষ্টির জল এসে পড়লো।শীতল বৃষ্টির জলে হাত কেঁপে উঠল বারিশের।চিনির দৃষ্টি ধীরে ধীরে শান্ত ও গভীর হল।বারিশের সে হাতে হাত রাখল না সে। বৃষ্টি মাথা বেরিয়ে পড়ল দোকান থেকে।কাঁধ থেকে আঁচল পড়ে গেল তার।পিছন ঘুরে একবার বারিশের গতিবিধি দেখার প্রয়োজন মনে করল না সে।
বোকা বনে গেল বারিশ।ঠোঁট উল্টিয়ে দৌড়ে চিনির পিছু গেল।বৃষ্টি ভেজা পিচের রাস্তায় খালি পায়ে হাঁটছে চিনি।চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করছে তার।কাঁদতে না পারায় গলাটা শক্ত হয়ে গিয়েছে।হঠাৎই খপ করে তার ডান হাতটি পিছনে মুচড়ে ধরল বারিশ।সহসা আঁকড়ে ধরায় টাল সামলাতে না পেরে কিছুটা ঢলে পড়ল বারিশর বুকের উপর।জিজ্ঞেসু দৃষ্টিতে চোখ তুলে তাকাল চিনি।বারিশ রাগী তবে শীতল চোখে তাকিয়ে আছে।হাতে চাপ দিয়ে চিনিকে নিজের আরেকটু সান্নিধ্যে নিয়ে এলো। চিনি কাঁপা কাঁপা অস্ফুটস্বরে উচ্চারণ করল,
– বারিশ!

বারিশ দাঁতে দাঁত চেপে হিসহিসিয়ে বলল,
– অনেক বেশি সাহস বেড়েছে তোমার?বারিশকে ইগনোর করছ?বারিশের সাথে উঁচু গলায় কথা বলছ?রাত-বিরেতে রাস্তায় হাঁটছ!ডোন্ট ইউ নো আমি কি করতে পারি?

চোখ মুখ খিঁচে হাত ছাড়ানোর জন্য ছটফট করতে লাগলো।তাতে বারিশ হাতটি আরেকটু চেপে ধরলো।মৃদু আর্দনাত করে উঠল চিনি,
– আহ্!

শীতে সারা শরীর অনবরত কাঁপছে চিনির।ঝটকা মেরে ছেড়ে দিলো চিনিকে বারিশ।দু’কদম পিছিয়ে গেল চিনি।হাঁটু ভেঙে বসলো বারিশ। জুতোর ফিতা খুলে পা থেকে জুতো খুলে ফেলল। চিনির পায়ের দিকে হাত বাড়াতেই চমকে কয়েক কদম পিছিয়ে গেল চিনি।বারিশ মাথা তুলে কটমট দৃষ্টি ফেলল চিনির দিকে।পুনরায় নড়তে সাহস পেল না চিনি।স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।শীতল কোমল হাতে চিনি পায়ে হাত দিল বারিশ।চিনির কাঁপাকাঁপি আরেক ধাপ বেড়ে গেল।পায়ের বৃদ্ধ আঙুল সংকুচিত করল।প্রথমে ডান পা এবং পরে বাম পায়ে নিজের ইয়া বড় বড় একজোড়া জুতো চিনির পায়ে গলিয়ে দিল বারিশ।নিখুঁত হাতে ফিতা বেঁধে উঠে দাঁড়াল বারিশ।চিনির ডান হাত নিজের হাতের ভিতর নিয়ে পিছনে ইশারা করে ভ্রু নাচিয়ে বলল,
– ম্যাম বাসা এদিকে।আপনি ঐদিকে কোথায় যাচ্ছেন?

হাত ছাড়িয়ে নিল চিনি।নিজের মতো উল্টো রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে বলল,
– যেখানে যাই আপনার কি?যান এখান থেকে।আমার পিছু নিবেন না।

বারিশ থুতনিতে তর্জনি রেখে এক ভ্রু উঁচিয়ে বলে,
– আ’র ইউ শিওর?

আড় চোখে বারিশকে দেখল চিনি।ভাবল সত্যি সত্যি চলে যাবে নাকি?এতো রাতে একটা মেয়েকে একা রাস্তায় ফেলে যাবে না নিশ্চয়ই। এতটুকু মনুষ্যত্ব অন্তত বারিশের আছে।বারিশ কোনো উত্তর না পেয়ে নির্বিকার কন্ঠে বলল,
– দেখুন ম্যাম আপনার ভাষ্যমতে আমি পৃথিবীর সব থেকে নিষ্ঠুরতম ব্যক্তি।সো আপনাকে এখানে ফেলে যেতে আমার এক সেকেন্ডও ভাবতে হবেনা।গট ইট?

চোখ বড়বড় হয়ে গেল চিনির।পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে পিছন ফিরে বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করে।পায়ের থেকে বড় জুতোটা পরে হাঁটতে বেশ বেগ পেতে হয় চিনির।তার উপর বৃষ্টির পানিতে ওজন কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে জুতোটার।পিচে পা ফেলতেই ঠক ঠক শব্দ হলো।শব্দ শুনে দাঁড়িয়ে গেল চিনি।পায়ের দিকে তাকিয়ে নৌকার সমান জুতোটা দেখে নাক কুঁচকে ফেলল।আবারও কদম ফেলতে একই শব্দ হলো।চিনির পায়ের দিকে তাকিয়ে মুখে হাত দিয়ে হাসল বারিশ।খালি পায়ে চিনির পিছু পিছু আসছে।চিনি আড় চোখে পাশে দেখল বারিশকে দেখতে না পেয়ে পিছন ঘুরে তাকায়।দেখতে পেল বারিশ নেশাক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে তার পিছু পিছু আসছে।ঢোক গিলল চিনি সামনে তাকিয়ে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিল।আড় চোখে বার বার বারিশের গতিবিধি অনুভব করার চেষ্টা করল।ভাবল বারিশ তার পিছু আসছে কেন?তার সাথে আসলেই তো পারে। হঠাৎ থমকে দাঁড়ালো চিনি। অনুভব করলো তার আঁচল খোলা মাটিতে দোল খাচ্ছে তা।শুঁকনো ঢোক গিলল সে।এতক্ষণে বুঝতে পেল বারিশ কেন তার পাশাপাশি না হেঁটে পিছু পিছু আসছে।পিঠ সংকুচিত করল সে।চুলে গরম নিশ্বাস আর উষ্ণতা পেতেই চোখ বন্ধ করে ফেলল চিনি।বারিশ চিনির পিঠে বুক ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে।বুকের ওঠানামা প্রবল হলো চিনির।চিনির খোলা আঁচল মাটি থেকে উঠিয়ে অপর কাঁদে মুড়িয়ে দিল বারিশ।চিনির মাথায় থুতনি রেখে ফিসফিসিয়ে বলল,
– তুমি কত বোকা চিনি!পৃথিবীর সবাইকে বিশ্বাস করো শুধু আমাকে ছাড়া!অথচ আমি পৃথিবীতে একমাত্র তোমাকে বিশ্বাস করি।

বারিশের কথায় বুক কেঁপে উঠল চিনির।চোখ খুলে মাটিতে দৃষ্টি স্থির করে।এতক্ষণে প্রশ্ন করল,
– কোথায় ছিলেন আপনি?

দু’হাতে চিনির হাত স্পর্শ করলো বারিশ।পূর্বের ন্যায় ফিসফিসিয়ে বলল,
– কেন?আমাকেই খুঁজতে বের হয়েছিলে বুঝি?

– এভাবে না বলে উধাও হয়ে গেলেন কেন?

মাথা নিচু করে চিনির কানে আবারও ফিসফিসিয়ে বলল,
– তুমিই তো বললে অফিস থেকে এসে আমাকে দেখতে চাওনা।তাই তো একটা পার্কে গিয়ে বসেছিলাম। ভেবেছিলাম তুমি ঘুমিয়ে গেলে জালনা দিয়ে আবার ঢুকবো।

বারিশের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল চিনি।হঠাৎ বারিশ চিনিকে ছাড়িয়ে দেওয়াতে সামান্য অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো বারিশ।চিনি হাত তুলে বলল,
– দুরত্ব বজায় রেখে কথা বলুন।

বারিশ মুখে হাত দিয়ে গলা ঝেড়ে নিল।পকেটে হাত দিয়ে ভ্রু উঁচিয়ে বলে,
– ওকে।

চিনি এবার রেগে কিড়মিড় করতে করতে বলল,
– কি শুরু করেছেন আপনি?হঠাৎ করে উদয় হন আবার হঠাৎ উধাও হয়ে যান।

– উধাও হলে তোমার কি?তোমার তো আরো ভালো।ইজেন্ট ইট?

– সেটাই।

বলে ঘুরে চলে যেতে চাইলো চিনি।কিন্তু বারিশ চিনির মুখটা নিজের শীতল হাত দিয়ে আবদ্ধ করে নিল।সামান্য বাঁকা হেসে বলল,
– আচ্ছা চিনি তোমার মাথায় এটা কে ঢুকিয়েছে বলো তো?মানে আমি বাবার সম্পত্তির জন্য বাচ্চা হতে দিইনা?আর আমার বাচ্চার নামে বাবার সম্পত্তি এটাও বা কে বলল তোমাকে?

দৃষ্টি নত করল চিনি।চিনিকে নিশ্চুপ দেখে বারিশ আবারও বলল,
– তোমার মনে হয় বাবার সম্পত্তি আমার প্রয়োজন?এব্রোট থেকে আসার পর মাত্র তিন বছরে আমি যা করেছি আমার বাবা তার সম্পূর্ণ জীবনেও করতে পারেনি।তবু তোমার মনে হয় বাবার সম্পত্তির জন্য আমি বাচ্চা নষ্ট করেছি?হাউ ফানি!

এবারও নিশ্চুপ চিনি।মাথা নত করে চুপচাপ বারিশের কথাগুলো ভাবছে সে।সত্যিই তো বারিশের তো তার বাবার থেকে তিনগুণ আছে তাহলে সে কেন বাবার সামান্য কিছু সম্পত্তির জন্য বাচ্চা নষ্ট করবে?ভাবনার মধ্যে বারিশ আবারও বলল,
– আর তোমাকে এটা কে বলল বাবা তার সম্পত্তি আমার বাচ্চার নামে করেছে?বাবার করা উইল আমার কাছে আর তাতে স্পষ্ট লেখা সব সম্পত্তির উত্তরাধিকার আমি।যে সম্পত্তি অলরেডি আমার তাহলে আমি কেন সেই সম্পত্তির জন্য নিজের বাচ্চাকে পৃথিবীর আলো দেখতে দিবো না।

মাথা তুলল চিনি অবাক দৃষ্টিতে বারিশের চোখে চোখ রেখে বলল,
– ফারিশ?

– ওর বিষয়টা তোমাকে পরে কেনো একদিন বলবো।এখন বলো এসব আজগুবি কথা তোমার এই মস্তিষ্কহীন মাথায় ঢুকিয়েছে কে?

নিজের তর্জনি চিনির মাথার ডান পাশে ছুঁইয়ে প্রশ্ন করে বারিশ।দু’বার বারিও দিল।চিনি মুখ ফুলিয়ে মাথা সরিয়ে নিল।ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,
– মা।

মিহি হাসলো বারিশ।বলল,
– বললাম না দুনিয়ার সবাইকে বিশ্বাস করো শুধু আমাকে ছাড়া।

চিনিকে মাড়িয়ে চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলে বারিশের হাত ধরে ফেলল চিনি।বারিশ জিজ্ঞেসু দৃষ্টিতে ঘুরে তাকালো চিনির দিকে।চিনি মাথা নত করে বলল,
– আপনার জুতোটা পরে হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে আমার।

– খুলে ফেলো।

টলমল চোখে বারিশের চোখে তাকালো চিনি।বারিশ গম্ভীরমুখে তার দিকে তাকিয়ে আছে।চিনির কোনো হেলদোল না দেখে বারিশ এবার একটু জোরেই বলল,
– কি হলো খোলো।

চিনি জুতো থেকে পা বের করে নিল।জুতোটা এতো বড় ছিল যে চিনির ফিতা খোলার কোনো প্রয়োজন হলো না।চিনি ভাবল হয়তোবা চিনির পা ই বেশি ছোট।জুতো দুটো নিয়ে পুনরায় নিজের পায়ে পরে নিল বারিশ।চিনির কেন যেন খুব কান্না পাচ্ছে। ঠান্ডায় নাক টানলো চিনি।বারিশ হাঁটু গেঁড়ে নিজের পিঠে ইশারা করে বলল,
– চলে এসো।

চিনি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। তা দেখে মুখ ফিরিয়ে আবারও চিনির দিকে ফিরে গম্ভীর স্বরে বলল,
– সারারাত কি রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকবে?আসতে বললাম না?

এগিয়ে এলো চিনি।বারিশের পিঠে ভর ছেড়ে গলা জরিয়ে ধরলো বারিশের।বরফের মতো ঠান্ডা শরীর পিঠময় স্পর্শ করতেই কেঁপে উঠল বারিশ।চোখ বন্ধ করে জোরে শ্বাস টেনে হাঁটতে শুরু করল।

– মা..মা… মা..?
নিস্তব্ধ বাড়িতে হঠাৎ মেয়েলি কন্ঠে মা ডাক প্রতিধ্বনিত হতেই বাড়ির সকল গৃহকর্মী দ্রুত পায়ে বসার ঘরে এলো।পরিচিত মুখ দৃশ্যমান হতেই চকচক করে উঠল সবার চোখ।ছলছল নয়নে এগিয়ে এসে অস্ফুটস্বরে বলল,
– মিষ্টি বউ!

জরজেটের খয়েরি শাড়ি পরিহিতা রমনী বিগলিত হেসে
উক্তিটির মালিকের উদ্দেশ্যে বলল,
– আরে মিতু কেমন আছো?মা কই গো?

মিতু আবেগি স্বরে বলল,
– মা তো ঘরে।কিন্তু মিষ্টি বউ তুমি এখানে?সেই যে স্যারকে ছেড়ে চলে গেলে।তারপর তো আর কোনো খবরই নেই তোমার।তোমার আর স্যারের তো ডিভোর্স হয়েছিল তাহলে তুমি এখানে?

চিনি মুখে মন ভোলানো হাসি রেখেই বলল,
– আরে আরে সব বলল। একসাথে কত প্রশ্ন কর তুমি।আগে আমাকে একগ্লাস পানি খাওয়াতে হবে।তারপর মাকে ডাক দিও।

মিতু চলে গেল পানি আনতে।চিনি একজন গৃহকর্মীর উদ্দেশ্যে বলল,
– আমার লাগেজগুলো বারিশের রুমে রেখে এসো।

মেয়েটি গেল না ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো।চিনি ভ্রু কুঁচকে বলল,
– কি হলো দাঁড়িয়ে আছো যে কি বলেছি শুনতে পাওনি?

এর মধ্যে পানি নিয়ে হাজির হলো মিতু।চিনির হাতে পানির গ্লাসটি দিয়ে আমতা আমতা করে বলল,
– আসলে মিষ্টি বউ স্যারের ঘরে তো ছোট সাহেব থাকে।

চিনি আনমমেই উচ্চারণ করল,
– ফারিশ!

পরক্ষণেই স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
– আচ্ছা ঠিক আছে তাহলে বড় গেস্ট রুমটাই রেখে আসো।আমি ওখানেই থাকবো।আর মাকে একটু ডেকে দাও।

চিনি সোফায় বসে পানির গ্লাস মুখে দেয় ঠিক সেই মুহুর্তে বাড়ি প্রবেশ করলো ফারিশ।প্রথমে ফারিশকে দেখে ঘাবড়ে গেল চিনি।পরমুহূর্তেই কানে বাজলো বারিশের ফিসফিসিয়ে বলা কথাটি,”কখনো অন্যের সামনে নিজের দূর্বলতা প্রকাশ করবে না।যদি তুমি দূর্বল হয়েও পড়ো তবু তার চিহ্ন তোমার মুখে ফুঁটে উঠতে দিবে না।তোমার সাথে আমি সব সময় থাকবো।তোমাকে রক্ষা করার জন্য দরকার হলে জান দিবো আবার দরকার হলে জান নিবোও।তাই বেশি টেনশন করো না আমি আছি।” ঢোক গিলে নিজেকে স্বাভাবিক করলো চিনি।মুচকি হেসে বলল,
– আরে ভাই..

ফোনে দৃষ্টি রেখে ভিতরে যাচ্ছিল ফারিশ। হঠাৎ এমন উক্তিতে মাথা তুলে তাকালো সে।

চলবে…

#শ্রাবণ_ধারায় |৭|
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি

চিনিকে দেখে ফারিশ চমকে গেল।পরবর্তীতে সেদিনে ঘটনা মনে পড়তেই চোখ মুখের ধরন বদলাতে শুরু করে ফারিশের।রাগি চোখে দাঁতে দাঁত চেপে তেড়ে আসে চিনির দিকে।শক্ত হাতে চিনির গলা চেপে দেয়ালে মিশিয়ে দেয়।সর্বশক্তিতে চিনির গলা চেপে ধরে সে।বাড়ির গৃহকর্মীরা হঠাৎ ফারিশের এমন আচরণে ঘাবড়ে যায়।মিতু দৌড়ে রাণীকে ডাকতে যায়।শ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে চিনির।চোখমুখ রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে।চোখ উল্টে যাচ্ছে। ফারিশ দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
– এখানে এসেছ কেন?মরার খুব শখ হয়েছে না?তাই নিজেই বাঘের খাঁচায় ঢুকে পড়লে!আজ তোমাকে এখান থেকে বেঁচে ফিরতে দিবো না।

জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে নিজের হৃদপিণ্ডকে সচল রাখার প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে চিনি।ঘাম ছুটছে সারা শরীর থেকে এবার বুঝি জানটা বেরিয়েই গেল।রাণী এলো দৌড়ে ছেলেকে শান্ত করতে করতে বলল,
– কি করছিস ফারিশ ছাড় ওকে।

ফারিশ ছাড়ল না বরং গলায় আরেকটু চাপ দিলো।ককিয়ে উঠলো চিনি।কোনো মতে ঠোঁট নাড়িয়ে বলার চেষ্টা করল,
-ম….মা..

এগিয়ে এলো রাণী ছেলের হাত ধরে চিনি ছাড়ানোর চেষ্টা করল।ফারিশের শক্তির কাছে পেরে উঠল না সে।সে মুহুর্তে বাড়ি প্রবেশ করল কোট প্যান্ট পরা যুবক।হালকা কেশে বলল,
– এসকিউজ মি। হ্যালো মি.ফারিশ মৃধা।আমি এডভোকেট হিয়ান।

ফারিশ ছেড়ে দিলো চিনিকে।মেঝেতে বসে পড়লো চিনি।শরীরের সব শক্তি যে কোপপুরের মতো উবে গেছে।গলায় হাত দিয়ে জোরে জোরে শ্বাস টেনে শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক করার চেষ্টা করল।মৃদু আওয়াজে উচ্চারণ করল,
– বারিশ!

তবে তা কারো কান অবধি পৌঁছালো না।অনাবরত কাশতে লাগল চিনি।রাণী এগিয়ে গিয়ে চিনিকে ধরলো।নরম সুরে বলল,
– মিষ্টি বউ তুমি এখানে কেন?

ফারিশ জিজ্ঞেসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে লোকটির দিকে।ফারিশের শরীর থেকে দরদরিয়ে ঘাম ঝরছে।হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
– কে?

যুবকটি আলতো হেসে নিজের চশমা তর্জনির সাহায্যে ঠেলে উঠিয়ে দিলো।বলল,
– এডভোকেট হিয়ান।চিনি ম্যামের ল ইয়ার উনিই আমাকে এখানে ডেকেছে।

ফারিশ পিচন ঘুরে চিনির দিকে তাকালো।এক ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
– ল ইয়ার এখানে কি করছে?আর তুমিই বা এখানে কেন?

চিনি মিতুর উদ্দেশ্যে বলল,
– আমাকে একটু পানি খাওয়াও।

মিতু দৌড়ে পানি নিয়ে এলো।এক নিঃশ্বাসের পুরো পানিটা শেষ করে ফেলল চিনি।উঠে দাঁড়িয়ে সোফায় গা ছড়িয়ে বসে পড়লো।সোফায় মাথা এলিয়ে চোখ বন্ধ করে রইলো কিছুক্ষন।চিনির এমন হেয়ালিতে শরীর জ্বলে উঠলো ফারিশে।চিনির হাত ধরে উঠিয়ে দিলো সোফা থেকে ধাক্কা দিয়ে বলল,
– এসব ড্রামা বন্ধ করো আর বের হও এখান থেকে।

বাঁকা হাসলো চিনি।সে হাসি কিছুটা অন্যরকম লাগল রাণী আর ফারিশের কাছে।তারা দুজন দু’জনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো কিছু বুঝতে পারছে কিনা।চিনি নিজের গলা ডলতে ডলতে আফসোসের সুরে বলল,
– ইশশ!কি যে করো না দেবরজি।রাগটা একটু কমাও বুঝলে।

ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়তে লাগলো ফারিশ।চিনির মুখের সামনে তর্জনি তুলে বলল,
– সেট আপ এন্ড গেট লস্ট ফ্রম হেয়ার।

মুখ থেকে বিরক্তির “চ্” শব্দ উচ্চারণ করল চিনি।রাণী শাড়ির আঁচল মুখে দিয়ে এগিয়ে এসে ন্যাকা কাঁদতে কাঁদতে বলল,
– আমার ছেলেটাকে পাগল বানিয়ে এখানে আবার কেন এসেছ মিষ্টি বউ?না জানি ছেলেটা এখন আমার কোথায় আছে।হয়তো রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে।

বলেই উচ্চস্বরে কাঁদতে শুরু করল রাণী।চিনি তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে।গম্ভীর কন্ঠে বলল,
– নিজের ফিফটি ফোর পার্সেন্ট শেয়ারের জন্য।

চমকে উঠলো রাণী।কোঠর থেকে চোখ বেরিয়ে এলো তার।কান্না বন্ধ হয়ে গেল নিমিষেই। ফারিশ তেড়ে এসে বলল,
– কিসে শেয়ার?তোমার সাথে ভাইয়ে ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে।

চিনি না জানার ভান করে দু বাহু সংকুচিত করে বলল,
– কই না তো ডিভোর্স হয়নি তো।হয়েছে উকিল সাহেব?আর হলেও শেয়ারগুলো যেহেতু আমার নামে তাই এই শেয়ারের মালিক আমি।

হিয়ান মুখ খুললো এবার।ভদ্রতার সহিত বলল,
– জ্বী মি.ফারিশ।আমি মি.বারিশের ল ইয়ার ছিলাম।উনি আমাকে দিয়েই ওনার প্রোপার্টির ফিফটি ফোর পার্সেন্ট শেয়ার ওনার স্ত্রী অর্থাৎ চিনি বুশরার নামে করেছেন।উনি যেহেতু মানসিকভাবে সুস্থ নন আর ম্যামের সাথে ওনার মনোমালিন্য চলার ফলে ওনার প্রোপার্টি আপনারা সামলেছেন।কিন্তু এখন যেহেতু মিসেস মৃধা তার প্রোপার্টির দাবি নিয়ে এসেছেন তখন আপনারা তার প্রোপার্টি হ্যান্ড ওভার করতে বাধ্য।

বুকে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে এতক্ষণ শুনছিল চিনি।হিয়ানের কথা শেষ হতেই মাথা নাড়িয়ে সায় দেয় সে।চিনি ফারিশের দিকে তাকিয়ে বলল,
-কাগজগুলো একটু দেখান দেবরজিকে নাহলে তো আবার বিশ্বাস করতে চায়বে না।

হিয়ান কাগজগুলো নিয়ে ফারিশের সামনে দিলো।ফারিশ থমকে দাঁড়িয়ে আছে।নিউরন কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে তার।কাগজগুলোতে চোখ বুলিয়ে মায়ের দিকে তাকালো সে।রাণীরও একই অবস্থা। চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে আছে সে।চিনি হেসে হিয়ানের উদ্দেশ্যে বলল,
– ধন্যবাদ মি.হিয়ান।আপনি এবার আসতে পারেন।কোনো সুবিধা অসুবিধা হলে আপনাকে জানাবো।

মাথা নেড়ে সায় দিল হিয়ান কাগজগুলো নিয়ে বেরিয়ে গেল।চিনি গলা ঝেড়ে বলল,
– যেহেতু আমার শেয়ার বেশি তাহলে মালিক আমি।তাই এখন থেকে আমি এবাড়িতেই থাকবো।আমি গেলাম রুমে রেস্ট নিতে।

সোজা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল চিনি।রাণী ফারিশের হাত ধরে নিজের ঘরে নিয়ে গেল।

চিনির ফ্লাটে মুখ গোমড়া করে বসে আছে বারিশ।একা একা কিছু ভালো লাগছে না তার।ক্ষুধাও লেগেছে বেশ।চিনি রান্না করে রেখে গিয়েছে বটে তবে তা মুখে তুলতে ইচ্ছা করছে না বারিশের।এদিকে খুব চিন্তাও হচ্ছে তার।চিনিকে নিয়ে এতোবড় রিস্কটা নেওয়া কি ঠিক হলো?একা একা চিনি ও বাড়িতে কি করছে তা কে জানে?এদিকে যাওয়ার পর চিনি একটা ফোনও করলো না বারিশকে।এদিকে বারিশও নিজ থেকে ফোন করতে পারছে না।না জানি কি পরিস্থিতি চলছে সেখানে তারউপর যদি বুঝতে পারে বারিশের সাথে চিনি যোগাযোগ আছে তখন তীরে এসে দড়ি ডুবে যাবে।মলিন মুখে সোফায় পা ভাঁজ করে শুয়ে পড়লো বারিশ। ফোনের আলো জ্বালিয়ে অপেক্ষা করতে থাকলো কখনো ফোনের স্ক্রিনে মিষ্টি বউ নামটা ভেসে উঠবে।অপলক তাকিয়ে আছে ফোনের স্ক্রিনে।তাকিয়ে থাকতে থাকতেই চোখের পাতা এক হয়ে গেল বারিশের।হঠাৎ ফোনের আওয়াজে কাঁচা ঘুম ভেঙে গেল তার।ধরফরিয়ে উঠে বসল সে।ফোনটা দ্রুত কানে দিয়ে অনার্গল বলতে লাগল,
– হ্যালো চিনি ঠিক আছো তুমি?ওরা কিছু করেনি তো তোমার সাথে?এতোদেরি হলো কেন ফোন দিতে?

মুচকি হাসলো চিনি।দর্পনে নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে গলায় কালসিটে দাগে আলতো হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
– নাহ্ তেমন কিছু করেনি।

– তেমন কিছু করেনি মানে?কি করেছে ওরা তোমার সাথে?

চিনি রসিকতার সুরে বলল,
– ঐ তো আপনার ভাই আলতো গলা চেপে ধরেছিল।

দীর্ঘশ্বাস ফেলল বারিশ।অপর পাশ থেকে শোনা গেল সেই শ্বাস ফেলার শব্দ। চিনি মলিন হেসে বলল,
– বাদ দেন। খেয়েছেন আপনি?

বারিশ আমতা আমতা করে বলল,
– আব মানে…

চিনি রাগি কন্ঠে বলল,
– খাননি এখনও? তাড়াতাড়ি খেয়ে নিন।এখন রাখছি কেউ দেখলে সন্দেহ করবে।

– আচ্ছা।শোনো…

থমকে গেল চিনি মৃদু আওয়াজে বলল,
– হুম?

বারিশ মোলায়েম স্বরে বলল,
– সাবধানে থেকো।

– হুম আপনিও।

ফোন কেটে দিলো চিনি।রাণী অনবরত পায়চারি করে চলেছে।পায়চারি করতে করতে ফারিশের দিকে ফিরে চিন্তিত কন্ঠে বলল,
– আমি যতটুকু জানতাম বারিশ চিনিকে কখনোই জানিয়েছিল না যে চিনির নামে ফিফটি ফোর পার্সেন্ট শেয়ার আছে। তাহলে চিনি জানলো কিভাবে?

ফারিশ দম মেরে বসে আছে।রাণী ফারিশের পাশে বসলো।কাঁধে হাত দিয়ে শান্তনা দিয়ে বলল,
– মাথা ঠান্ডা কর বাবা।বারিশকে খুঁজে বের করার চেষ্টা কর।

– ওকে তো আমি ধরবোই।ও যেই গর্তেই থাকুক না কেন সেখান থেকে ওকে আমি টেনে বের করবো।

দাঁতে দাঁত চেপে হিসহিসিয়ে বলল ফারিশ।একইভাবে আবারও হিসহিসিয়ে বলল,
– বাঘের খাঁচায় ঢুকে খুব ভুল করে ফেলেছিস চিনি বুশরা।তোকে খুবলে খাবে বাঘ আর তুই শুধু আর্তনাদ করবি।

চলবে…