সম্পর্কের মায়াজাল পর্ব-৩৬ এবং শেষ পর্ব

0
5144

#সম্পর্কের_মায়াজাল
#ফারজানা_আফরোজ
#শেষ_পর্ব

খাবার টেবিলে মিসেস সাবিনা বেগম ও মিস্টার আজম বসে আছে। অন্যদিকে সন্ধ্যা বসে বসে নুডলস খাচ্ছে। মুগ্ধ তার মাকে দেখে থমকে গেল। পরিবেশটা বেশ শান্ত হয়ে গেলো। মিসেস সাবিনা বেগম সন্তানকে দেখে আনন্দের কান্না সাগরে পরিণত করে দিলেন……….

স্পদন মায়ের চোখে পানি দেখে জিজ্ঞাসা করলো……

—” আম্মু হটাৎ কি হলো তোমার? এইভাবে কান্না করছো কেন?”

মিষ্টার আজম মুগ্ধের দিকে তাকিয়ে বললেন……

—” এতদিন পর বড় ছেলে দেখলে কান্না তো আসবেই বাবা। সন্ধ্যা আর স্পন্দন তোমাদের একটা কথা বলতে চাই?”

সন্ধ্যা আর স্পন্দন বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। মিষ্টার আজম চেয়ার থেকে উঠে মুগ্ধের কাঁধে হাত রেখে বললেন……..

—” তোমরা জানো তোমরা দুই ভাইবোন। কিন্তু তোমরা জানো না তোমরা তিন ভাইবোন।”

স্পন্দন চমকে উঠলো। সন্ধ্যার মুখ থেকে নুডলস পরে গেলো। শুভ্রতা ও সাধনা দুই বোন দুইজনের দিকে তাকিয়ে ইশারা করছে……

—” আপু কি ব্যাপার?”

—” জানি না রে। দেখ কি হয়।”

—” হুম।”

মিষ্টার আজম মিষ্টি হাসি দিয়ে বললেন……

—” মুগ্ধ তোমাদের বড় ভাই।”

মুগ্ধ বড় ভাই নামক উপাধি পেয়ে কান্না করতে শুরু করলো। মিসেস সাবিনা বেগম অতীতের কালো ধোঁয়ার কথা গুলো বলতে লাগলেন।

মিসেস সাবিনা বেগম স্পন্দনের দিকে তাকিয়ে বললেন……

—” তোকে কোনোদিন আমি মায়ের অভাব বুঝতে দেই নাই। আমার লুকানো কথা গুলো আজ তোর সামনে চলে আসছে তুই কি এখন আমাকে খারাপ মা ভাবছিস?”

স্পন্দন মায়ের মুখে আলতো হাত রেখে বলল……

—-” তোমাকে আমি আমার নিজের মা ভেবে এসেছি আর সারাজীবন তাই ভাববো। আমি মুগ্ধকে আমার ভাই হিসেবে কেন মানবো না? যে আমার ভাই তাকে তো আমার ভাই মানতেই হবে।”

মিসেস সাবিনা বেগম আনন্দের হাসি হাসলেন। কিন্তু তার ভয় হচ্ছে মুগ্ধকে নিয়ে। মুগ্ধ কি মানবে এই সম্পর্ক? মুগ্ধর চোখের দিকে তাকালো কিন্তু মুগ্ধ এখনও চোখ নিচে নামিয়ে রেখেছে। আজ অনেক বছর পর মায়ের সাথে দেখা তার। একবার ভাবছে সব মেনে নিবে কিন্তু আরেকবার দীর্ঘ দিনের মায়ের আদর থেকে বঞ্চিত হওয়ার জন্য অভিমান পুষিয়ে রেখেছে।

মুগ্ধর চুপ থাকা দেখে মিসেস সাবিনা বেগম আশা ছেড়ে দিলেন। সন্ধ্যা তখন দৌঁড়ে এসে মুগ্ধকে জড়িয়ে ধরে বলল……

—-” ইয়াহু আজ থেকে আমার দুইটা ভাইয়া। আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে। তারমানে এখন থেকে সাধনা আপু আমার বড় ভাবী। হিহিহিহি ছোট বোনের বিয়ে হলো বড় ভাইয়ের কাছে আর বড় বোনের বিয়ে হলো ছোট ভাইয়ের কাছে।”

সন্ধ্যার কথায় সবাই হাসলেও মুগ্ধের চোখে পানি। ছেলেরা যে এত কাঁদতে পারে মুগ্ধকে না দেখলে বুঝা যেতো না। সন্ধ্যা তখন মুগ্ধের গলা জড়িয়ে বলল ……

—” তোমাকে দাদা ভাই আর স্পন্দন ভাইয়াকে ভাইয়া বলে ডাকবো। অবশ্য স্পন্দন ভাইয়াকে আমি তুই করেই বলি কিন্তু তুমি আমার থেকে অনেক অনেক বড় তাই তুমি করেই বলবো। আচ্ছা দাদা ভাই তুমি কি থাকবে না আমাদের সাথে?”

মুগ্ধ সন্ধ্যাকে বুকে জড়িয়ে বলল…..

—-” কেন থাকবো না? জানিস যখন তুই এসেছিলি তখন লুকিয়ে আমি তোকে দেখতে গিয়েছিলাম। তোকে তো আমি প্রায় দেখতে আসতাম। তোর মুখ থেকে ভাই ডাক শুনতে মনটা ছটপট করতো। যখন দেখতাম তুই স্পন্দনকে ভাইয়া ডাকছিস আমারও শুনতে বড্ড ইচ্ছা করতো। কিন্তু ওই যে অভিমান, রাগ, জেদ, কষ্টের জন্য সব ইচ্ছা মাটি চাপা দিয়েছি।”

—-” ইয়াহু আজ থেকে আমরা সবাই একসাথে থাকবো ইয়াহু।”

হটাৎ শুভ্রতার চিৎকারে সবাই চমকে উঠলো। সন্ধ্যা এই রকম করলে হয়তো সবাই মেনে নিত কিন্তু শুভ্রতার এমন চিৎকারে অবাক হলো। মুগ্ধ একদিকে ভাসুর অন্য দিক থেকে ছোট বোনের স্বামী। শুভ্রতা লজ্জায় স্পন্দনের পিছু লুকিয়ে রইলো। শুভ্রতার এমন কান্ড দেখে সবাই হাসিতে মেতে উঠলো।

চারমাস পরে………

সাধনার সাত মাস থেকে আট মাসে শুরু হলো। কোনো কাজ তাকে করতে দেওয়া হয় না। এইদিকে সন্ধ্যা প্রায় ভালো হয়ে উঠেছে। সন্ধ্যা তার চাদরের ব্যাপারে সব জেনে গেছে। প্রথম প্রথম রাগ করলেও পরে ঠিক হয়ে যায়। কেননা আজ সুস্থ থাকার প্রধান হাতিয়ার কিন্তু সমুদ্র। স্পন্দনের বাবা মা তো আগেই রাজি ছিল। মুগ্ধ ও স্পন্দন সব জেনে বিয়েতে রাজি হলো।

আজ সন্ধ্যার বিয়ে। সাধনা মানুষ জনের সামনে লজ্জায় আসতে চায়নি। মুগ্ধ জোর করে সাজিয়ে ড্রয়িং রুমের সোফায় বসিয়ে রেখেছে। মুগ্ধ নিজে সাজগোজ করে বউয়ের সাথে বসে আছে।

অন্যদিকে……

শুভ্রতা আজ গোল্ডেন কালার শাড়ি পরেছে। ম্যাচিং গয়না। শুভ্রতা-কে দেখতে এখনও সেই ভার্সিটি পড়ুয়া মেয়ের মতো লাগছে। স্পন্দন কালো ও গোল্ডেন কালারের শেরওয়ানি গায়ে দিয়ে শুভ্রতা-কে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে চুলে নাক ডুবিয়ে বলল…..

—“আমাকে খুন করার ইচ্ছা জাগল না-কি?”

—” কেন কি করলাম আমি?

—-” যেভাবে সাজছ দেখে মনে হচ্ছে তোমারেই আজ বিয়ে। পাত্র পক্ষরা আবার তোমাকে বউ ভেবে না নিয়ে গেলেই হয় এই আর কি?”

শুভ্রতা মুখ ভেংচি কেটে বলল……

—” সব সময় ফাইজলামি করতে ভালো লাগে তাই না? এই সরেন তো আমার অনেক কাজ পরে আছে।”

শুভ্রতা যেতে নিলে স্পন্দন পিছন থেকে হাত টেনে নিয়ে কানের পাশ থেকে চুলগুলো সরিয়ে বলল……

—” তুমি না-কি এখন খুব তেতুঁল খাচ্ছ কথাটা কি সত্য?”

শুভ্রতা লজ্জা মাখা মুখ নিয়ে বলল…..

—” কে বলেছে এই কথা?”

—” বড় ভাবী বা ছোট শালী-কা বলেছে।”

—” ভাবী বা শালী একটা বললেই তো হয়।”

—” ভাবছি সাধনাকে বীকা বলে ডাকবো। ভাবীর বী আর শালী-কার কা বীকা। আচ্ছা বাদ দেও এখন বলো কথাটা কি সত্য?”

—” হুম সত্য। তাছাড়া আমার টক খেতে ভীষণ ভালো লাগে।”

—” কিন্তু বীকা তো আমায় অন্য কথা বলেছে।”

শুভ্রতা মুখ লুকিয়ে লজ্জা পেয়ে বলল……

—” আমি এখন যাচ্ছি।”

—-” ওরে আমার লজ্জাবতী বউ রে। বিয়ের এতদিন পরেও না-কি সে লজ্জায় লীলাবতী হয়ে যাচ্ছে। তো আমার চাঁদ যে আমার ঘরে আলো দিতে আসছে আমায় কেন বলো নি?”

শুভ্রতা মাথা নিচু করে রাখল। স্পন্দন শুভ্রতার মাথা আলতো হাতে উপরে তুলে বলল…….

—” বলো কেন বললে না?”

—” সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য। ”

স্পন্দন মুচকি হেসে বললো……

—-” এই চাঁদেই তো সব চেয়ে বড় সারপ্রাইজ । এই সারপ্রাইজের থেকে আর কি সারপ্রাইজ লাগবে চাঁদের আম্মু। আমি তো খুব খুশি হয়েছি বাট এই খবর যদি তোমার মুখে আগে শুনতাম তাহলে খুব খুব খুব খুশি হতাম।”

শুভ্রতা খুশিতে চোখ দিয়ে দু এক ফোঁটা অশ্রু বিন্দু গড়াতে লাগলো। স্পন্দন শুভ্রতার চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বলল……

—-” আজ তোমাকে একটা সারপ্রাইজ দিবো চোখ বন্ধ করে রাখো।”

—” কি দিবেন?”

—-” বললে সারপ্রাইজ আর থাকে না। চোখ বন্ধ করো।”

শুভ্রতা আর কথা না বাড়িয়ে চোখ বন্ধ করলো। স্পন্দন রুমের বাহির থেকে মধুকে নিয়ে এসে বলল……

—” তোমার জীবনের প্রথম সন্তান। যে তোমাকে সর্ব প্রথম আম্মা বলে ডেকেছে। আমাদের বড় চাঁদ আজ তোমাকে দেখতে এসেছে চোখ খুলো।”

শুভ্রতা চোখ খুলে মধুকে সামনে দেখতে পেয়ে জড়িয়ে ধরলো। মধু শুভ্রতা-কে জড়িয়ে ধরে বললো…..

—” আম্মা কেমন আছো তুমি?”

—” হুম মা-মনি ভালো তুমি।”

—” হ আম্মা ভালা। জানো আমি এহন স্কুলে যাই। আমাগো এইনে হাসপাতাল হইছে। আমরা অসুখ হইলেই ঐহানে যাই। আম্মা আমি বড় হইয়া ডাক্তার হইমু। তাইলে আব্বার মতন টেহা না থাকলেও অসুস্থ মানুষ গো সেবা দিয়া ভালা করুম। আম্মা আব্বার কাইছ থেকে হুনছি আমার না-কি দুইটা বোইন বা ভাই আইতাছি? কই ওরা আমি খেলুম ওগো লগে?”

—” ওরা খুব শীগ্রই আসবে আম্মু। একটু অপেক্ষা করো কেমন?”

—” আইচ্ছা আম্মা।”

সন্ধ্যার বিয়ে হয়ে যায় সমুদ্রের সাথে। এইদিকে নাদিয়া এখনও বয়ফ্রেন্ড খুঁজতে ব্যাস্ত। তার প্রেম এতদিনে তিনশো ওভার করে ফেলছে কিন্তু এখনও কাউকে লাইফ পাটনার হিসেবে মিলাতে পারে নাই।

সন্ধার বাসর রাতে……..

—” সন্ধু পিচ্চি মেয়েটা যে আমার বউ হবে আমি কোনোদিন ভাবী নি। আচ্ছা সন্ধু পিচ্চি বউয়ের কি কষ্ট হচ্ছে?”

দোলনায় সমুদ্র ও সন্ধ্যা বসে আছে।আকাশে ইয়া বড় চাঁদ। সমুদ্রের কাঁধে সন্ধ্যা মাথা রেখে দুইজন চাঁদের দিকে তাকিয়ে জোৎস্না বিলাস করছে আর কথা বলছে। আজকের চাঁদ যেন তাদের জন্যই এখনও জেগে আছে। সন্ধ্যা ও সমুদ্রের সঙ্গ দেওয়ার কারণেই আজকের চাঁদ এত উজ্জ্বল হয়ে আছে।

—” চাদর নামের ছেলেটাকে যে আমি বিয়ে করলাম সেই চাদর তো এমন কথা আমাকে বলত না। তুমি কে হ্যাঁ?”

সমুদ্র মুচকি হেসে সন্ধ্যার কপালে চুমু খেয়ে বলল……

—” সরি আর বলবো না।”

—” গুড।”

ভালোবাসার সম্পর্ক গুলো বড্ড অদ্ভুদ। কখন কিভাবে সম্পর্ক গুলোতে একজন আরেকজনের সাথে জড়িয়ে যায় বুঝা যায় না। মানুষ যত দূরে থাকুক সম্পর্কের কারণে তারা সব সময় নিকটেই থাকে।

ছয় মাস পরে……..

সাধনার কোল জুড়ে রাজকুমার এসেছে। রাজকুমারের নাম রাখা হয়েছে নীল। রাজকুমারের বয়স সবে চারমাস। বাড়ির সবাইকে দেখে তার চাঁদ মাখা মুখে হাসি লেগেই থাকে। স্পন্দনের বাড়িতে খুশির সীমা নেই।

দোলনায় নীলকে শুয়ে দিয়ে সাধনা মাথা ঠিক করছে। আর রাগে গজগজ করছে…..

পাজি ছেলেটা সারাদিন ঘুমাবে আর রাত হলেই জেগে থাকবে। ছেলের সাথে সাথে মাকেও জেগে থাকতে হয়। রাতে না ঘুমানোর কারণে চোখের নিচে কিছুটা কালি পড়েছে সাধনার। মুগ্ধ অফিস থেকে এসে ক্লান্ত শরীরে ঘুমিয়ে যায়। মাঝে মাঝেই সেও ছেলের সাথে জেগে থাকে।

—-” বাবাও যেমন ছোট থেকে পাজি ছিল ছেলেটাও হয়েছে বাবার মত। বলি রাতে কি চুরি করতে যাস যে ঘুমুতে পারিস না। তুই ঘুমাবি না ভালো কথা আমাকে তো একটু ঘুমুতে দিবি। বেয়াদব ছেলে একটা।”

ওয়াশ রুম থেকে ফ্রেশ হয়ে মুগ্ধ মুখের পানি তোয়ালে দিয়ে মুছে বেলকনিতে গিয়ে আদুরিনীকে খাবার দিচ্ছিল। আদুরিনী হলো পাখির নাম। সাধনা এই পাখিটা নীলের জন্য এনেছিল। বাচ্চা ছেলে সে তো কিছু পারবে না তাই পাখিটার দায়িত্ব মুগ্ধ ও সাধনায় নিচ্ছে।

ছেলেকে বকা দেওয়ার কারণে মুগ্ধ এসে সাধনার সামনে বসে বলে…….

—-” আমার বাবাকে বকা কেন দিচ্ছি জানো না বাবা খুব রাগী?”

—” এই যাও তুমি এখন আমার সামনে থেকে। একদম বিরক্ত করবে না।”

সাধনা রাগে ঠিক মত চুল বাঁধতে পারছে না। মুগ্ধ হেয়ার ব্যান্ড নিয়ে সাধনার মাথা বেঁধে দিয়ে চুলে কিস করে বলল…..

—” তোমার এই পাগল করা চুলের ঘ্রাণে সব সময় আমি শেষ হয়ে যাই। কি দেও গো চুলে?”

—-” ওই সরো তো ঘুমাবো এখন। রোমাঞ্চ করার কোনো ইচ্ছে নেই আমার।”

—” সরি বউ কাজের এত চাপের জন্য তোমাকে ও আমার বাবাকে সময় দিতে পারছি না। চিন্তা করো না এখন থেকে সব আগের মত হয়ে যাবে। কাজের চাপ এখন শেষ।”

সাধনা হেসে মুগ্ধের হাত দুটি ধরে বলল……

—-” আরেহ আমি রাগ করিনি। আমার তো মা হতে পেরে খুব লাগছে।”

মুগ্ধ নীলকে কোলে নিয়ে এক হাতে সাধনার হাত ধরে বলল……

—-” আমার আনন্দের সংসার। সবাই মিলে আমাদের পরিবার।”

—” হুম।”

________________________

৩৫ বছর পরে……..

হাতে লাঠি নিয়ে কবরস্থানে বসে আছে একজন বৃদ্ধ লোক। সামনে তার চাঁদ ও চাঁদের মা শুয়ে আছে। বৃদ্ধ লোকটি কবরের মাটি হাতে নিয়ে বলল…..

—” আমার বাচ্চা বউটা কি গতকাল রাতে ভয় পেয়েছে? জানো শরীরটা আর আগের মত নেই। গতকাল খুব জোরে ঝড় উঠেছে কিন্তু তোমার এই অপদার্থ স্বামী ঝড়ের সাথে মোকাবেলা করে সক্ষম হতে পারে নাই। তাইতো আজ সকাল সকাল চলে আসছি । এত বছরে তো ঝড় আসার আগেই তোমার কাছে বসে থাকি কিন্তু আজ পারলাম না। জানো আজ সাধনা ও মুগ্ধের নাতনী মানে আমাদের সেই ছোট্ট নীলের মেয়ের পাঁচ বছর। ওরা অনেক বড় আয়োজন করেছে। তুমি বেঁচে থাকলে হয়তো আমার চাঁদের আজ বাচ্চা থাকতো আমাদেরও নাতি নাতনী হতো । জানো আমি নীলের মেয়ের নাম নিলীমা রেখেছি। সন্ধ্যা আমার সেই পাগল বোন ওতো কিছুদিনের ভিতর নাতির মুখ দেখবে। সন্ধার দুই ছেলে আকাশ আর আরিফ। দুজনেই বিয়ে করে ফেলেছে। জানো সবাই খুব সুখে আছি শুধু মাত্র আমি ছাড়া। তোমাদের দুজনকে ছাড়া আমি নিঃসঙ্গ পথিক শুভ্রতা। কবে তোমার ডান পাশের জায়গাটায় এসে থাকতে পারবো সেই চিন্তায় দিন গুনছি। আজকাল তো চোখে প্রায় কিছুই দেখি না। কানে কম শুনি। তোমার হ্যান্ডসাম স্যার এখন বুড়ো হয়ে গেছে হাহাহা। কবে আবারো আমরা একসাথে হবো কে জানে। কিন্তু প্রকৃতির নিয়ম বলছে খুব শীগ্রই আমরা এক হতে চলেছি। আর আমাদের সেই ছোট্ট মধু এখন সে বিরাট বড় ডক্টর। মানুষের সেবা করার জন্য পাগলী মেয়েটা বিয়ে করে নাই। আমাদের এই বড় সংসারে শুধু মাত্র তোমার আর চাঁদের অভাবের জন্য এখনও সব আঁধার আছে শুভ্রতা।”

স্পন্দন শুভ্রতার কবরে চুমু খেয়ে লাঠি ভর দিয়ে বাড়ির উদ্দেশে যেতে লাগলো। সাধনা ও মুগ্ধ তারা এখন দেশের বাহিরে থাকে তাদের একমাত্র ছেলে নীলের সাথে। সমুদ্র ও সন্ধ্যা তাদের দুই ছেলের সাথে বাংলাদেশেই থাকে। এত বড় বাড়িতে এখন স্পন্দন ও মধু থাকে। সমুদ্র ও সন্ধ্যা মাঝে মাঝে আসে। তাদের ছেলেরাও এসে দেখে যায়। সাধনা,মুগ্ধ,সমুদ্র ও সন্ধ্যা অনেক বলেছে স্পন্দনকে তাদের সাথে থাকতে কিন্তু স্পন্দন যেতে চায় না। এই বাড়িতে স্পন্দনের মা বাবার স্মৃতি শুভ্রতার স্মৃতি তাদের খুনসুটির সমস্ত স্মৃতি এই বাড়িতে রয়েছে। স্পন্দন যেতে রাজি না হওয়ায় এখন মধু থাকে তার বাবার সাথে।

____________________

৩৫ বছর আগে………

শুভ্রতার জন্মদিন উপলক্ষে স্পন্দন শুভ্রতা-কে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য অনেক বড় আয়োজন করে। একদিকে শুভ্রতা সাত মাসের প্রেগনেন্ট। জন্মদিনের দিনটা স্বর-নীয় থাকার জন্য অনেক প্ল্যান করে বাড়ির সবাই। সব কিছু শুভ্রতার আড়ালে করা হয়।

শুভ্রতা রুমে নীলকে নিয়ে বসে আছে। সাধনার কি দরকার কাজ সেই জন্য নীলকে শুভ্রতার কাছে রেখে যায়। নীলের বয়স পাঁচ মাস। নীলের দিকে তাকিয়ে শুভ্রতা নীলের কপালে কিস করে বলে……

—” শোন আমার মেয়ে হলে তোকে আমার মেয়ের জামাই বানাবো। তাহলে আমার মেয়েও বাহিরে যাবে না সবাই একসাথেই থাকবো।”

ছোট্ট নীল কি বুঝ-লো কে জানে সে হেসে কুটিকুটি। হটাৎ ছোট্ট নীল কাঁদতে শুরু করলো। শুভ্রতা তাড়াহুড়া করে সাধনার রুম থেকে ফিডার আনতে গিয়ে আচমকাই পা ভেজে পরে যায়। পেটে প্রচণ্ড চাপ পড়ে। ফ্লোর জোরে রক্ত গড়াতে লাগলো। বাড়িতে কেউ না থাকায় শুভ্রতার চিৎকার কেউ শুন-লো না।

দুই ঘণ্টা পর সবাই বাসায় আসে আর শুভ্রতার এই অবস্থা দেখে চিৎকার শুরু করে দেয়। তাড়াতাড়ি ডক্টরের কাছে নিয়ে গেলে শুভ্রতা-কে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়। পেটে প্রচণ্ড চাপ ও অতিরিক্ত রক্ত করণের জন্য শুভ্রতা ও তাদের অনাগত বাচ্চা মারা যায়। এই কথাটা শুনে স্পন্দন পনেরো দিন অজ্ঞান ছিল। শুভ্রতার জানাজায় সে অংশ গ্রহণ করতে পারে নাই। জ্ঞান ফেরার পর খুব চুপচাপ হয়ে গেছে। সারাদিন একা রুমে বসে থাকতো। শুভ্রতার জন্মদিন স্বর-নীয় রাখার জন্য তারা যে প্ল্যান করেছিল এখন শুভ্রতার জন্মদিন ও মৃত্যু বার্ষিকী সবার কাছে স্বর-নীয় হয়ে আছে। শুভ্রতার মৃত্যুর তিন বছর পর মিস্টার আজম সবাইকে ধোঁকা দিয়ে পরলোকে গমন করেন আর উনার সাত-মাস পরে মিসেস সাবিনা বেগম একই ধোঁকা দেন সবাইকে।

বর্তমানে……..

সারা বাড়িতে লাইটিং জ্বলছে। আনন্দের বন্যা বয়ে যাচ্ছে কিন্তু স্পন্দন এখনও দরজা বন্ধ করে শুভ্রতার হাসি মাখা পিক গুলো দেখতে ব্যাস্ত। আত্মহত্যা মহাপাপ এই জন্য হয়তো এখনো এই পথ সে বেছে নিতে পারে নাই। কিন্তু শারীরিক ও মানসিক দুভাবেই সে মৃত। স্পন্দনের দেহ এখনও পৃথিবীর শ্বাস নিলেও বাস্তব অর্থে সে এখন মৃত। সম্পর্কের মানুষগুলো কখন কিভাবে ধোঁকা দিয়ে চলে যায় বুঝা মুশকিল। মানুষের জীবনে সম্পর্কের মায়াজালের সম্পর্ক গুলো বড়ই অদ্ভুত ধরনের হয়ে থাকে।

সমাপ্ত………