সম্পর্কের মায়াজাল পর্ব-১৫

0
3426

#সম্পর্কের_মায়াজাল
#ফারজানা_আফরোজ
#পর্ব_১৫

—-” ফায়াজ ছেলেটা না খুব ভালো।”

—” আমাকে শুনানোর কি আছে? আজব তো!”

—” ইসসসসসস আপনার সাথে দেখা করার আগে যদি ওর সাথে দেখা হতো!”

শুভ্রতা লজ্জা মাখা ভঙ্গিতে বলল। স্পন্দন শুভ্রতার চেহারার হাব ভাব লক্ষ্য করলো…..

—” এত লজ্জা পাওয়ার কি আছে? আর একদিনের কথাতেই ‘ও’ বলে ডাক-ছো। কই আমাকে তো আপনি ছাড়া ডাকো না ।কি কথা বলেছ তুমি ওর সাথে?”

—” আপনাকে কেনো বলবো? ”

—-” আমার বিয়ে করা বউ হয়ে তুমি অন্য ছেলের সুনাম করছো আমার সামনে। জানো তোমাকে এখন আমি কি করতে পারি?”

—” ভুলে যাবেন না এক বছরের বিয়ে করা বউ আমি হুহহহ।”

—-” যদি ডিভোর্স না দেই তখন?”

—” এক বছর তো আগে হোক পরে না হয় বুঝা যাবে। বাই দা ওয়ে পোড়া পোড়া গন্ধ পাচ্ছি মনে হচ্ছে।”

—” এইভাবে নাক টানলে নাক কেটে দিবো।”

—” আজব তো।”

শুভ্রতা বিছানা ঠিক করে কম্বল গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়লো। স্পন্দন শুভ্রতাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়লো…..

—” এই কি করছেন ছাড়েন বলছি।”

—” বেশি কথা বললে ঠান্ডা পানিতে চুবিয়ে আসবো।”

—” বিরক্তিকর,অসভ্য ছেলে কোথাকার।”

স্পন্দন শুনেও না শোনার ভাব করে শুয়ে রইলো। শুভ্রতা মনে মনে খুব খুশি হলো। স্পন্দন যে তাকে পছন্দ করে খুব ভালোভাবে বুঝতে পেরেছে সে। এই ছেলে হলো পাথরের মতো মন ভাঙার পরেও ছোট ছোট পাথরের দানা থাকবেই।

।।

।।

।।

মুগ্ধ সাধনার মাথা তার কোলে নিয়ে বসে আছে। সাধনার মাথায় বিলি কেটে দিচ্ছে মুগ্ধ।

স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক হলো মধুর মতো। এই সম্পর্কটা পবিত্র। ভালোবাসা লুকিয়ে রাখার বস্তু না। যাকে ভালোবাসা যায় সে ঠিক ভালোবাসার কথা না বললেও বুঝতে পারে তাকে যে সে ভালোবাসে। ভালোবাসা কি শুধু ভালোবাসা থেকেই আসে? না একদম না। ভালোবাসা আসে রাগ,অভিমান, কষ্ট, সুখ, ভালো লাগা সব কিছু থেকেই ভালোবাসা সৃষ্টি হয়। নিম পাতা তিতো কিন্তু তার গুন অনেক। যে বাড়িতে একটা নিম গাছ সেই বাড়ির বাতাসেও উপকার আছে। নিমের ডাল,পাতা, শেকড় সব কিছু থেকেই যেমন উপকার পাওয়া যায় ঠিক তেমনি একটা মানুষের রাগ,অভিমান, সুখ দুঃখ, ভালো লাগা, ঝগড়া, কথা বার্তা, কান্না, হাঁসি, চাল চলন সব কিছু থেকেই ভালোবাসা সৃষ্টি হতে পারে। একেকজনের ভালোবাসা একেক রকম। কেউ বা সুন্দর চেহারা দেখে ভালোবাসে আবার কেউ বা সুন্দর মন দেখে ভালোবাসে। ভালোবাসার মাঝে গায়ের রঙ কোনো ফ্যাক্ট না।

—” আর কয়েকটা মাস পর আমার ছোট্ট বাবুটা আসবে। আমাকে বাবা বাবা বলে ডাকবে। আমি ঘোড়া সেজে তাকে পিটে উঠিয়ে খেলবো। অনেক অনেক খেলনা এনে দিবো। তার ছোট্ট ছোট্ট হাতগুলো আমার মুখে হাত বুলিয়ে দিবে। আমার আঙ্গুল ধরে হাঁটবে। তোমাকে আম্মু আম্মু বলে ডাকবে। দেখো কি সুন্দর দৃশ্য।”

সাধনা মুগ্ধর কথা শুনে হেঁসে দিলো। বাচ্চাদের মতো কথা বলছে মুগ্ধ।

—” আচ্ছা আমাদের মেয়ে হলে কি নাম রাখবে?”

—” ছেলে হলে নাম রাখবো সা’দ আর মেয়ে হলে রাখবো….!”

—” মুগ্ধতা। মুগ্ধতা নামটা আমার ভীষন পছন্দের। বাবা মেয়ের সেম নাম হাহাহা।”

মুগ্ধ সাধনার হাঁসি দেখতে লাগলো। এই তো কলেজের সেই চঞ্চল মেয়েটি খিলখিল করে হেসে কলেজ মাঠ দিয়ে যাচ্ছে। হাতে ফোন আশে পাশে কি হচ্ছে বুঝতে পারছে না সে। মুগ্ধ এক ইম্পর্টেন্ট কাজে সেখানেই যাচ্ছিলো। ভীষণ রেগে আছে সে। রাগের মাথায় ফোনে কাওকে বকা-ঝকা দিচ্ছে। সাধনা ফোনের দিক থেকে মনোযোগ সরিয়ে ছেলেটির রাগান্বিত মুখ দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ছেলেটি তখন রাগের বশে বাজে কথা বলছে। সাধনা তখন ছেলেটির সামনে গিয়ে বলছে…..

—” ওয়াও কি রোমান্টিক।”

মুগ্ধ সাধনার চুলে পরম যত্নে বিলি কেটে তাদের প্রথম দেখার কথা বললো। সাধনা হেঁসে উঠে বসলো…..

—” এই উঠ-ছো কেনো?”

—” ওইদিন তোমার রাগান্বিত চেহারা আমাকে এতটা টেনে ছিলো তাই হটাৎ করেই বলে দিয়েছিলাম ওয়াও কি রোমান্টিক।”

মুগ্ধ তখন নিজের চুল হালকা টেনে বললো…..

—” আমিও কিন্তু তোমার মুখের ওয়াও ভাবটা দেখে ক্রাশ খেয়ে ফেলেছিলাম। মুখে প্রকাশ না করলেও অন্তরে কিন্তু ঠিকই প্রকাশ করেছি।”

—” ক্রাশ খাওয়া সত্বেও তোমাকে পটাতে গিয়ে আমাকে যে কি কষ্ট করতে হয়েছে তা শুধু আমি জানি। কি ভাব ছিলো তোমার।”

মুগ্ধ হেঁসে দিয়ে টেবিল থেকে মেডিসিন সাধনার হাতে দিলো…..

—” খেয়ে ঘুমিয়ে পড়। এত রাত পর্যন্ত জেগে থাকা ঠিক হবে না।”

সাধনা লক্ষ্মী মেয়ের মতো ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়লো। মুগ্ধ রুম থেকে বের হয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো…..

—-” আমার বাচ্চাটাকে আসতে দে স্পন্দন। শুধু মাত্র আমার বাচ্চার জন্য তুই এখনও ভালো আছিস। তোর ক্ষতি না করা পর্যন্ত আমার শান্তি নাই। নিজেকে সবার সামনে এত ভালো দেখিয়ে চলছিস তোর মন তো কয়লার চেয়েও খারাপ। ”

।।

।।

।।

।।

সমুদ্র আর নাদিয়া বসে আছে। বসে আছে বললে ভুল হবে সমুদ্র নাদিয়ার মাথা শান্ত করছে। আজ নাদিয়ার ব্রেকআপ হয়েছে। দুইশত ছয় নম্বর ব্রেকআপ হলো আজ। আগের প্রেম গুলোর থেকে কয়েকটা দিন বেশি ছিল এই প্রেম। বলতে গেলে রেকর্ড ভেঙ্গে ফেলেছে এই প্রেম।

—” দুইশত সাত নম্বর কবে আসবে?”

—” ভাইয়া তুই মজা করছিস আবারো? বলছিনা এইসব প্রেম ভালোবাসা করা ঠিক না। প্যারা এইগুলো আর জীবনেও প্রেম করবো না আমি। ফালতু লোকেরা প্রেম করে।”

—” আগেও বলেছিস এইসব কথা। পরে কি হয়? প্রেম তো করিস আবার।”

—” আর করবো না। সবগুলো ফালতু পোলাপান।”

—” তুই তো ঐগুলোর সাথেই যাস।”

—” ভাইয়াআআআ।”

—” শোন, মাম্মী আমের আচার বানিয়েছে। একটু নিয়ে আয়।”

—” এই অসময়ে আম কোথায় পেলো মাম্মী?”

—” গ্রামের বাড়ি থেকে পাঠিয়েছে। সারা বছর আম ধরে এমন গাছে নাকি আছে গ্রামে। যা নিয়ে আয়। আমি আনলে কত ঠাট্টা করবে মাম্মী।”

—” হাহাহা ছেলে হয়ে এত টক কিভাবে খেতে পারিস তুই ? ছেলেরা শুনি টক খেতে পারে না।”

—” এত কথা না বলে যা গিয়ে নিয়ে আয়। আর এক বয়াম শুভ্রতার জন্য রাখতে হবে। বেচারি আচার দিয়ে গরম ভাত খেতে খুব পছন্দ করে।”

—” মাম্মী ওর জন্য আলাদা রাখবে আমি জানি। আমাদের এত আদর করে না যা করে ওই বজ্জাত মাইয়াকে । যাই লুকিয়ে আনতে হবে। আর শোন আমার ৭০ ভাগ তোর ৩০ ভাগ। কষ্ট আমি করবো তাই ভাগটাও আমার বেশি ওকে।”..

—” আগে নিয়ে আয় পরে দেখা যাবে।”

—” হুম। ”

।।

।।

।।

সন্ধ্যা ফোনে গেমস খেলছে। একটু পর পর চকোলেট মুখে পুরে গেম নিয়ে খুব ব্যস্ত সে। ফোন আসাতে রিসিভ করলো…..

—” তুই বাড়ি চলে গেছিস বললি না-তো? শুনলাম তোর ভাবির সাথে তোর না-কি খুব মিল হলো? ব্যাপার কি-রে? যে মেয়ের জন্য এত অপমান হলি শেষমেশ কি-না সেই মেয়ের সাথে এত মিল। মানুষ ঠিকই বলে তোর কোনো বুদ্ধি নাই। পাগল মেয়ে তুই।”

—” আমি পাগল না। আমাকে পাগল বলবে না তুমি।”

—” কেনো বলবো না। তুই পাগল পাগল পাগল।”

—” আপুউউউউ।”

—” চিৎকার দিবি না। যদি নিজের অপমানের প্রতিশোধ নিতে চাস তাহলে যা তোর ভাইয়ের রুমে। ওদের আলাদা করে দে।”

—” তাজরীন আপু ভাবী খুব ভালো গো।”

—” ওকে তুই তোর ভালো নিয়েই থাক আমাকে কোনোদিন ফোন দিবি না।”

—” আপু রাগ করো না প্লিজ। আচ্ছা বলো কি করতে হবে আমার।”

—” আমার নাম কোনোদিন মুখে আনবি না তোর ভাইয়ের সামনে মনে আছে তো? যদি না শুনিস তাহলে স্পেশাল চকোলেট দিবো না বলে দিলাম।”

—” হ্যাঁ মনে আছে। বলো কি বলবো।”

—” গুড। শোন…….?”

তাজরীনের প্ল্যান অনুযায়ী সন্ধ্যা তার বড় টেডি আর তিনটা চকোলেটের প্যাকেট নিয়ে স্পন্দনের রুমের দিকে হনহন করে চলে যায়। দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে। স্পন্দন ঘুম ঘুম চোখে বললো…..

—” এত রাতে কে এসেছে?”

—” ভাইয়া আমি।”

—” তুই এত রাতে কেনো?”

—” আমি ভাবির সাথে ঘুমাবো। দরজাটা খুলে দে খুব ঠাণ্ডা লাগছে।”

স্পন্দন শুভ্রতাকে ছেড়ে দিয়ে উঠে দরজা খুলল। সন্ধ্যাকে দেখে হেঁসে বলল…..

—” একদিনেই ভাবী পাগল হয়ে গেলি? আসতে না আসতেই ভাবির সাথে ঘুমাবি। যা ঘুমিয়ে পড় ওর সাথে।”

—” তুই কোথায় ঘুমাবি?”

—” এত বড় সোফা আছে কেনো?আমি সোফা-তে শুয়ে পরবো।”

—” তুই আমার রুমে চলে যা আমি এইখানে ভাবির সাথে আছি।”

—” সমস্যা নাই তুই ঘুমিয়ে পড়।”

—” আমি বলছি তুমি আমার রুমে যাবে মানে যাবে।”

সন্ধ্যার রাগ উঠলে স্পন্দনকে সে ‘তুমি’ বলে ডাকে। স্পন্দন শুভ্রতাকে সন্ধ্যার সাথে একা থাকতে ইচ্ছা করছে না। সন্ধ্যা যে প্রকৃতির মেয়ে কখন কি মাথায় আসবে করে ফেলবে। কিন্তু স্পষ্ট বলতে পারছে না সন্ধ্যাকে। অনেকদিন পর এসেছে সে।

স্পন্দন চলে যাওয়ার পর সন্ধ্যা দরজা বন্ধ করে তিনটা চকোলেট শেষ করলো। চকোলেট শেষ করে শুয়ে পড়লো।

অন্যদিকে তাজরীন ফোনের আশায় বসে আছে। কাজ হয়েছে কি-না তা জানাতে বলেছে সে সন্ধ্যাকে। কিন্তু সন্ধ্যার ফোন না আসাতে রাগে নিজের হাত নিজে খামচে ধরছে…..

—” এই পাগল মেয়েকে নিয়ে পারি না। কিছুই মনে থাকে না। এই-টাকে বুঝালে মাথা নষ্ট হয়ে যায় আমার। একবার প্ল্যান সাকসেস হোক পরে এই পাগলটা-কে পাবনা দিয়ে আসবো। যত্তসব।”

তাজরীনের সাথে স্পন্দনের সম্পর্ক ভালো না। তাজরীন একদিন সবার সামনে স্পনদনকে প্রপোজ করেছিল কিন্তু স্পন্দন রিজেক্ট করে। এই অপমান ও রাগে সন্ধ্যাকে তার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে।

~~~~

সন্ধ্যাকে স্পন্দন ভেবে শুভ্রতা ঘুমের ঘোরে করে জড়িয়ে ধরে। সকালে ঘুম ভাঙ্গার পর সন্ধ্যাকে দেখে অবাক হলো। কিছু বলতে যাবে কিন্তু সন্ধ্যার ঘুমন্ত মুখ দেখে কিছু ইচ্ছা করছে না বলতে। আবারো সন্ধ্যাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে রইলো…..

দরজার সামনে দাঁড়িয়ে স্পন্দন শুভ্রতাকে ডাকছে…..

—” এই শুনতে পাচ্ছো আমার কথা? দরজাটা খুলো ফ্রেশ হতে হবে।”

শীতের সকালে কম্বলের নিচ থেকে উঠতে কার ভালো লাগে? গরম শরীর ঠান্ডা করা এক ধরনের বিরক্ত। তবুও স্পন্দনের চিৎকারে উঠতে হলো তাকে। দরজা খুলে স্পন্দনকে দেখে চমকে গেলো শুভ্রতা…..

—” সারারাত ঘুমান নি? চোখ ফুলে আছে। এইখানে বালিশ কেনো?”

চলবে……