সম্পর্কের মায়াজাল পর্ব-১৪

0
3299

#সম্পর্কের_মায়াজাল
#ফারজানা_আফরোজ
#পর্ব_১৪

অনেকগুলো ছেলে মেয়েটিকে একা পেয়ে বিরক্ত করছে। নিজের অজান্তেই সেই দিকে পা বাড়ালো শুভ্রতা…….

—” এই এই কি করছেন আপনারা? একটা মেয়েকে একা পেয়ে হেনস্তা করছেন লজ্জা করে না। আপনাদেরও তো বোন আছে,মা আছে, ভবিষ্যতে মেয়ের বাবাও হবেন।”

—” আরেহ মা-মুনি তুমি কখন আসলে। দেখ দোস্ত আজ কপাল কিন্তু খুলে গেছে। এতদিনের তালা বদ্ধ কপাল কিভাবে খুলে গেলো রে?”

—” বুঝতে পারছি আপনারা ঠিক কথার মানুষ না। আপনাদের মতো জানোয়ারদের জন্য আলাদা পদ্ধতি আছে।”

তাড়াতাড়ি করে ব্যাগ থেকে চাকু বের করলো সাথে স্টিলের স্কেল।

—” এখন যেই সামনে আসবে পেটে,চোখে,বুকে যেখানেই পারি ঢুকিয়ে দিবো। ভাববি না মেয়ে বলে সাহস থাকবে না। আমি কিন্তু কমার্সের স্টুডেন্ট ছিলাম কখন কোথায় হিসাব মতো ছুরি চালানো যায় আমার জানা আছে।”

শুভ্রতার ভয়ানক চেহারা দেখে ছেলে গুলো পিছপা হলো। শুভ্রতা গিয়ে মেয়েটির কাছে গিয়ে ছোট আলপিন বের করে বললো…..

—” ভয় নেই। ছোট জিনিস হলেও এইটার ক্ষমতা অনেক। কেউ আসলেই হাতের রগ বা চোখের ভিতর ঢুকিয়ে দিবে তাহলেই কেল্লাফতে।”

ছেলেগুলো শুভ্রতার কথা শুনে একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে জোরে জোরে চিল্লিয়ে বলতে লাগলো…..

—” ওই এখনও দাঁড়িয়ে আছিস কেনো পালা। এই মেয়ে কিন্তু মেয়ে না বোম্বাই মরিচ। কি ডেঞ্জারাস মেয়ে রে বাবা।”

ছেলেগুলো দৌঁড়ে চলে গেলো। শুভ্রতা ব্যাগে চাকু ও স্কেল ঢুকিয়ে মেয়েটিকে বললো…..

—” আপু আপনি একা কেনো বের হলেন? এসেছেন যেহেতু নিজেকে নিরাপত্তা রাখার প্রয়োজনীয় জিনিস কাছে রাখবেন না? এই নিন আলপিন আর এই ছুড়ি-টা ধরুন।”

মেয়েটি ছুরি ও আলপিন হাতে নিয়ে দেখতে লাগলো। এইগুলো দেখে খিলখিল করে হেঁসে বলল…..

—” গরু জবাই দিবো আমি কি মজা কি মজা!”

শুভ্রতা এত বড় মেয়ের এমন বিহেভ দেখে অবাক না হয়ে পারলো না। কি বড় বিপদে পড়েছিল মেয়েটি কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে কিছুই হয় নি।

—” আপু, আর ইউ ওকে?”

—” আন্টি আন্টি আমি হাওয়া মিঠাই খাবো। গোলাপি আর হলুদ দুইটা কিনে দিবে?”

শুভ্রতা মেয়েটির কথা শুনে এক পলক মেয়েটির দিকে আরেক পলক ফোনের স্ক্রিনে নিজেকে দেখতে লাগলো। কোন দিক থেকে তাকে আন্টি মনে হচ্ছে বুঝতে পারছে না সে। আন্টি হতো যদি মেয়েটি বাচ্চা থাকতো কিন্তু মেয়েটি তার সম-বয়সি বা কিছু দিনের ছোট হবে । আন্টি হওয়ার মতো ছোট না মেয়েটি।

—” আচ্ছা আমার বয়সের তুলনায় আমাকে কি বুড়ি বুড়ি দেখতে? হতে পারে যে বজ্জাত অসভ্য ছেলেকে বিয়ে করেছি না তাতে বুড়ি হইয়া কোনো ব্যাপারেই না।”

—” কি হলো আন্টি? চলো চলো শুনো,আজ আমরা অনেক ঘুরবো,আইসক্রিম খাবো,চিপস খাবো, ফুচকা খাবো, চটপটি খাবো, পিজ্জা খাবো, পার্কে যাবো কেমন? চিন্তা করো না আমার আব্বুর অনেক টাকা তোমার টাকা নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।”

—” নাহ আপু আমার কাছে টাকা আছে চলো।”

মেয়েটি শুভ্রতার হাত টেনে নিয়ে যেতে লাগলো। শুভ্রতা একটা হাওয়া মিঠাই নিলো আর মেয়েটি দুইটা নিলো। মেয়েটির কাছে কোনো টাকা ছিলো না। হতে পারে মেয়েটি আনে নাই বা কেউ নিয়ে গেছে।

ঘড়িতে কাটায় কাটায় তিনটা বেজে চল্লিশ। শুভ্রতা ও মেয়েটি বসে আছে পার্কের একটি বেঞ্চে। দুই হাতে দুই হাওয়া মিঠাই নিয়ে খিলখিল শব্দে হাসছে। ছোট একটা বাচ্চাকে যখন তার চাওয়া পাওয়া অনুযায়ী খেলনা বা খাবার কিনে দেওয়া হলে তখন সে খুশিতে আত্মহারা হয়ে হাসতে থাকে মেয়েটি ঠিক সেইভাবেই হাসছে। শুভ্রতার কাছে বিরক্ত না লেগে ভালোই লাগছে। মেয়েটিকে অনেকবার জিজ্ঞাসা করেছে নাম কি? কিন্তু মেয়েটি উত্তর না দিয়ে হেসেই যাচ্ছে।

—” আফা মনিরা ঝাল মুড়ি খাইবেন? আমার ঝাল মুড়ি খুব ইস্পিশাল।”

লোকটির কথা শুনে মেয়েটি আবারো হাসছে। শুভ্রতা ভাবছে….

—” আচ্ছা মেয়েটি পাগল? কথা নাই বার্তা নাই হাসা হাসি শুরু করে দিয়েছে। লোকটি কি ভাববে এখন?”

—” আফা মনি হাসেন ক্যান?”

—” মামা ওইটা ইস্পিশাল না স্পেশাল হবে হাহাহা । আইচ্ছা মামা দেও আমাকে আর আন্টিকে।”

শুভ্রতা হাসার চেষ্টা করছে কিন্তু তাকে আন্টিকে ডাকাতে কিছুটা লজ্জাও পাচ্ছে। শুভ্রতা ভাবছে তার বয়সের তুলনায় তাকে অনেক বড় লাগে।

ঝাল মুড়ি নিয়ে খেতে লাগলো মেয়েটি। শুভ্রতা তখন বললো…..

—” তোমাকে যে আমি এত আদর করছি তুমি তো এখনও তোমার নাম,ঠিকানা কিছুই বলো নি এইটা ঠিক না।”

—-” আচ্ছা আন্টি বলো তো বিকালের পর কি হয়?”

—” বিকালের পর তো সন্ধ্যা হয়। হটাৎ এমন প্রশ্ন?”

—” ওই যে আমার নাম এখন তুমি জেনে গিয়েছ। কি মজা কি মজা আন্টি আমার নাম জেনে ফেলেছে।”

শুভ্রতা কিছুক্ষণ নিজের কথা রিপিট করলো। হটাৎ তার মাথা ঘুরে গেল সন্ধ্যা নাম শুনে। সন্ধ্যা তখন হাত তালি দিচ্ছে। দ্রুত স্পন্দনকে ফোন দিল…..

—” হ্যালো হ্যালো স্যার,শুনছেন?”

—” কোথায় তুমি? আম্মুকে ফোন দিলাম তুমি না-কি এখনও যাও নাই বাসায়? কি করছো?”

—” স্যার সন্ধ্যা, সন্ধ্যার একটা পিক দিবেন?”

—” হটাৎ সন্ধ্যাকে নিয়ে পড়লে কেনো?”

—” ওয়েট আপনাকে একটা পিক দিচ্ছি দেখুন তো চিনেন কি-না?”

শুভ্রতা পিক দিলো। পিক দেখার সাথে সাথেই স্পন্দন ফোন দিলো……

—” তোমার সাথে সন্ধ্যা কি করছে? তোমরা কোথায়?”

—” স্যার ঠিকানা বলছি।”

শুভ্রতা ঠিকানা দিয়ে সংক্ষিপ্তভাবে স্পন্দনকে সব বলল। স্পন্দন দেরি না করে যত দ্রুত সম্ভব রওনা দিলো। সন্ধ্যা বাচ্চাদের মত এদিক ওদিক দৌড়াদৌড়ি করছে শুভ্রতা সন্ধ্যার পিছু নিচ্ছে…..

—-” ওরে ননদিনী তোমার পিছু দৌড়াতে দৌড়াতে আমি এক সপ্তাহে দশ কেজি কমে যাবো। তুমি তো দেখছি আমাকে চিকন করতে পারবে।”

।।

।।

।।

।।

দুধ,ডিম, আর কিছু মেডিসিন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মুগ্ধ। গতকাল রাতে ড্রিঙ্কস করে এসে সাধনার সাথে মারাত্মক ভুল করে ফেলেছে সে। সাধনার শরীর খুব খারাপ। ডক্টর তাকে বিশ্রাম করতে বলেছে। মানসিক,শারীরিক কোনো অবস্থাই ভালো না সাধনার। সাধনা চোখ মেলে সামনে মুগ্ধকে দেখে চোখ সরিয়ে নিলো। মুগ্ধ সাধনার কাছে বসে সাধনার হাত দুটি চেপে ধরলো…..

—” সরি জান, গতকাল রাগে অনেকটা নেশা করে ফেলি। নিজের উপর কন্ট্রোল ছিলো না তার উপর তুমি প্রচুর প্রশ্ন করেছিলে তখন নিজেকে আরো পশু বানিয়ে ফেলেছিলাম। প্লিজ রাগ করো না। তুমি তো জানোই আমি এই রকম। তুমিই তো বলেছিলে আমাকে ভালো লাগার কারণ আমার রাগ। তাহলে কেনো আজ সেই রাগ কে ঘৃনা করছো?”

—” ভুল করেছিলাম। জানতাম না তখন যে তোমাকে ভালোবেসে আমার এমন পরিস্থিতি হবে। কত বোকা ছিলাম। আপুকে ভাবতাম খুব বোকা। ও কোনোদিন প্রেম ভালোবাসা এসবে জড়াইনি তাই ওকে নিয়ে কত ঠাট্টা করেছি কিন্তু আজ বুঝলাম বোকা আপু না আমি। তোমার কথা শুনে আপুর কথাও ভাবিনি আমি। কতটা স্বার্থপর আমি ছিঃ। এখন মনে হচ্ছে এই বাচ্চা যখনি পেটে এসেছিলো নষ্ট কেনো করলাম না তাহলে আজ আমার এমন দিন দেখতে হতো না।”

মুগ্ধ সাধনাকে চড় মারতে গিয়েও থেমে যায়। নিজের হাতকে কন্ট্রোল করে সাধনার পিঠের দিক গিয়ে চুলের মুঠি ধরে…..

—” আমার বাচ্চাকে নিয়ে অাজে-বাজে কথা বললে খুন করে ফেলবো। ও আমার বাচ্চা। আমি তোকে আর আমার বাচ্চাকে খুব ভালোবাসি। তোর সাহস কি করে হয় আমার বাচ্চাকে এই পৃথিবীর মুখ না দেখিয়ে খুন করতে চাচ্ছিস? আমার রাগ সম্পর্কে তুই খুব ভালোই জানিস। শোন,তোকে আমি প্রথম ভালোবাসিনি তুই নিজেই ভেসেছিস। তুই আমাকে তোর প্রতি ভালোবাসা শিখিয়েছিস এখন সেই ভালোবাসা কেড়ে নেওয়ার কোনো অধিকার তোর নেই।”

—” লাগছে আমার।”

মুগ্ধ সাধনার চুলের মুঠি ছেড়ে দিয়ে সাধনাকে তার সামনে বসিয়ে পরম আনন্দে ও ভালোবাসা মিশ্রিত অনুভুতি নিয়ে খাওয়াতে লাগলো।

।।

।।

।।

।।

স্পন্দন এসে সন্ধ্যাকে জড়িয়ে ধরলো। সন্ধ্যা তার ভাইকে দেখে খুশিতে সেও জড়িয়ে ধরলো। এখন তার চড়ের কথা মনে নেই। খুশি হয়ে আদুরী গলায় বলল…..

—” ভাইয়া জানো এই আন্টি-টা খুব ভালো। দেখো কত কিছু কিনে দিয়েছে। আন্টির টাকাগুলো দিয়ে দেও এখন তুমি।”

সন্ধ্যার কথা শুনে স্পন্দন শুভ্রতার দিকে তাকালো। শুভ্রতার মুখ তখন দেখার মত ছিলো। স্পন্দনও মজার ছলে বললো…..

—” আন্টি কত টাকা খরচ করেছেন? ”

শুভ্রতা দাঁতে দাঁত চেপে বললো…..

—” আমি আন্টি?”

—” হ্যাঁ অবশ্যই। দিন দিন যে মোটু হচ্ছেন আন্টি নামেই বেশ মানাচ্ছে আপনাকে?”

—” নিজে কি হুম? সালমান খান ভাবছেন? বুইরা দাদুর মতো লাগে আপনাকে। আপনাকে দেখতে ভুতের মতো লাগে । আর আরো আছে কি কি কি যেনো….?”

শুভ্রতা আর কোনো কথা খুঁজে না পেয়ে সোজা হাঁটতে থাকে। স্পন্দন সন্ধ্যাকে নিয়ে শুভ্রতার পিছু নেয়। যেতে যেতে সন্ধ্যাকে বুঝিয়ে বলে শুভ্রতা আন্টি নয় ভাবী লাগে।

।।

।।

।।

বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে ইউ টিউব দেখতে লাগলো। ইউ টিউব এ সার্চ দিলো রূপচর্চার পরামর্শ। একে একে অনেক ভিডিও আসতে লাগলো। শুভ্রতা কোনটা রেখে কি দিবে বুঝতে পারছে না। এক প্রকার রেগে গিয়ে ফোন রেখে দিলো…..

—” কাক যতই ময়ূরের পালন লাগায় শেষে কিন্তু তাকে কাকেই লাগে।”

—” কি অসভ্য বর আমার। কোনোদিন তো আমার প্রশংসা করলই না। হটাৎ আজ হ্যান্ডসাম, কিউট, প্রথম দেখার ক্রাশ ওয়ালা ছেলে প্রশংসা করলো তাতে উনার শরীর জ্বলে যাচ্ছে। কোনোদিন তো বলেন নি যে, শুভ্রতা তোমার কন্ঠ-টা খুব কিউট। কোকিল পাখির মতো।”

—” ওই ফায়াজের বাচ্চার কান খারাপ আমি সি-উর তাই এই কাক গলাকে কোকিল গলা বলেছে।”

শুভ্রতা স্পন্দনের দিকে তাকিয়ে বললো…..

—” ওকে আমার গলা তো আপনার ভালো লাগে না। আমাকেই তো আপনার অপছন্দ। যে আমাকে পছন্দ করে তার সাথে গিয়ে আমি কথা বলি।”

শুভ্রতা ফোন নিয়ে বাহিরে যেতে নিলে স্পন্দন বলে উঠলো…..

—” কার সাথে কথা বলবে?”

—-” ওই যে স্যার মানে ফায়াজ স্যার।”

স্পন্দন রেগে গিয়ে বললো…..

—” ওর নাম্বার কোথায় পেলে?”

—” জানি না। আজ উনি অনেকবার ফোন দিয়েছেন।মনে হয় অফিস থেকে নিয়েছে। যাই একটু সুখ দুঃখের কথা বলে আসি।”

শুভ্রতা হনহন করে চলে গেলো। স্পন্দন রেগে গিয়ে বিছানায় ধপাস করে বসে পরলো…..

—” শালা তোর সাথে কোনো ডিল নাই আমার। আমার বউ কে ফোন দিচ্ছিস।”

শুভ্রতা দরজার আড়াল থেকে কথাগুলো শুনছিল। ওর প্ল্যান সাকসেস হওয়ায় খুব খুশি। ফায়াজ কোনো ফোন দেয় নাই শুভ্রতা বানিয়ে বলেছে সব। খুশি মনে বাহিরে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে রুমে ঢুকলো……

—-” ফায়াজ ছেলেটা না খুব ভালো।”

চলবে……