সুবর্ণবন্ধন -৫
১০
আরো একটা দিন কেটে গেল। কলিগদের সাথে পরিচয়, আড্ডা, মামা বাড়িতে দাওয়াত আর সর্বোপরি ভালোবাসাময় কিছু একান্ত মুহূর্ত জমা হলো সুবর্ণার স্মৃতির হাতব্যাগে।
আগামীকাল সকালে জাহিদ ওকে দিয়ে আসবে বাড়িতে।কেন যেন সুবর্ণার যেতে ইচ্ছে করছে না। ঢাকায় যাবার পরে একটা বড় নাটক অপেক্ষা করে আছে। রাজীব খুবই চালাক। সে নিশ্চয়ই বন্ধুদের কাছে সিম্প্যাথি আদায় করে ফেলবে, বিভিন্নভাবে প্রমাণ করবে, সুবর্ণাই ওকে ছেড়ে চলে গেছে। দুটো মাস টিকে থাকা কষ্ট হয়ে যাবে, এমবিএ নাহয় অন্য কোথাও থেকে করা যাবে।এমন সময় ফাইনাল পরীক্ষাটাও!
সুবর্ণা যে অভিনয় করে কাটিয়ে দিবে, সেটাও পারবে না। কারণ এখন জাহিদ ছাড়া কাউকে ভাবতেই পারছে না। রাজীবের সাথে এতদিন একটা সম্পর্কই ছিল শুধু এমন তো লাগেনি! এটা কেন হচ্ছে, জাহিদের সাথে খুব ঘনিষ্ঠ হয়েছে সেজন্য? নাকি অন্য কোনো টান! যেটা সুবর্ণার ঠিক পরিচিত নয়।
সন্ধ্যা থেকেই সুবর্ণা চুপচাপ। খারাপ লাগছে জাহিদেরও। সুবর্ণাকে ঢাকায় পৌছে দিয়ে আসতে পারলে ভালো লাগতো। কিন্তু এই মুহুর্তে ছুটি নেওয়া যাবে না। কলেজে ইন্টারনাল পরীক্ষার ডিউটি আছে। বিয়ের জন্য আগেই বেশ কয়েকদিন ছুটি নেওয়া হয়েছে। তাও চেষ্টা করবে যদি আর দুদিন ছুটি পাওয়া যায়।
-সুবর্ণা মন খারাপ লাগছে?
-একটু একটু
-কেন বলো তো?
-বুঝতে পারছি না।
-একটু কাছে আসবে?
সুবর্ণা কথা না বলে কাছে এগিয়ে গেল।
-মন খারাপ করো না, দু সপ্তাহ পরে আমার একটা দু মাসের ট্রেনিং আছে ঢাকায় , সেখানে যেতে হবে।
তখন উইকএন্ডে দেখা করা যাবে।
সুবর্ণা কথা বলল না, তার কান্না পাচ্ছে। কি অদ্ভুত, নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না, চোখ ভিজে আসছে।
জাহিদের বুকে মাথা রেখে সুবর্ণার চোখ বারবার ভিজে আসছে। অনুভূতি টের পাওয়া যায়, জাহিদেরও খারাপ লাগছে।
বিয়ের আগে মনে হয়েছিল, সুবর্ণার সাথে কীভাবে এডজাস্ট করবে, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, সুবর্ণাকে ছাড়া এখানে কতটা ফাঁকা লাগবে।
-মন খারাপ করে না বোকা মেয়ে!
-আপনার খারাপ লাগছে না, তাই না? সুবর্ণা জাহিদের দিকে তাকিয়ে বলল।
জাহিদ একটু হেসে বলল, তোমার কি তাই মনে হচ্ছে? আচ্ছা বলোতো আপনি করে কতদিন বলবে? তুমি করে বলবে না?
সুবর্ণা “হ্যা-বোধক” ঘাড় নাড়লো।
জাহিদ বলল, তোমাকে একটা গল্প বলি শোনো, আমি সায়েন্সের স্টুডেন্ট ছিলাম, কিন্তু স্কুলে দেখা গেল, সায়েন্সে কয়েকটা সাবজেক্ট প্রাইভেট পড়তে হবে। পরে গ্রুপ পাল্টে আর্টসে চলে এসেছিলাম। বাবা পারতেন না এত টাকা দিতে। আমি কিন্তু কোচিংও করিনি, একটা গাইড কিনে নিজে নিজে পড়েই পরীক্ষা দিয়েছিলাম। ইউনিভার্সিটিতে আসলে টিকে থাকার জন্য আমাকে সব সময় টিউশনির চিন্তা করতে হয়েছে, তার উপর একটা চাকরি প্রয়োজন। এসব কিছুর মধ্যে আমার কখনো কোন মেয়েকে নিয়ে ভাবার অবকাশ হয়নি। আমার প্রথম অনুভূতিটাই তুমি, বুঝতে পারছ? যদি তুমি অন্যরকম হতে তাহলে হয়তো এতো জড়িয়ে পড়তাম না, কিন্তু অদ্ভুতভাবে তুমিও আমাকে এতকাছে টেনে নিয়েছ! এই সব জায়গায় তুমি ছিলে, তুমি তো ব্যস্ত হয়ে যাবে, তখন আমার একা থাকতে কত কষ্ট হবে বুঝতে পারছ?
সুবর্ণার আরো কান্না পাচ্ছে। এভাবে কেউ কথা বলে, শুধু মন খারাপ করে দেয় এই লোক!
সুবর্ণাকে শক্ত করে জড়িয়ে জাহিদ বলল, মন খারাপ করো না, তুমি তো শুধুই আমার, অল্প কিছুদিন হয়তো দূরে থাকতে হবে।
সুবর্ণা তবুও কেঁদেই চলছে। একবার শুধু বলল, আমাকে ছেড়ে কখনো যাবে না তো?
জাহিদ কোনভাবেই থামাতে পারছে না। তাই শক্ত করে ধরে রাখছে, কোনদিনও ভাবেনি যে কেউ ওকে এত ভালোবাসবে যে সাময়িকভাবে দূরে যেতেও কাঁদবে।
জাহিদ মনে মনে বলল, কখনো তোমার হাত ছাড়বো না দেখো। ঠিক মিলিয়ে নিও!
১১
সুবর্ণা ক্যাম্পাসে চলে এসেছে গতকাল। তবে রুম থেকে বের হয়নি। প্রয়োজন ছাড়া বের হবে না ঠিক করেছে।
জাহিদ খুব আসতে চাচ্ছিল, সুবর্ণা বিভিন্ন ধরনের কথা বলে না করেছে।
রাজীব টের পেয়েছে, সুবর্ণা ক্যাম্পাসে। ওদের কোন বন্ধুই জানিয়েছে। চুপচাপ আছে, এখনো কিছু বলেনি।
সন্ধ্যার দিকে ফোন করলো একবার।
-কী খবর, বিয়ে টিয়ে করে আসছিস, নিচে আয় চা খাই!
মিষ্টি খাওয়াবি না আমাদের?
-হুম খাওয়াব, পরীক্ষা শেষ হোক, সবাইকে একত্রে খাওয়াব।
-সবাই আর আমি এক? নিচে আয় তো? একুশ চত্বরে হেঁটে চা খেয়ে আসি!
ক্যাম্পাসের শহীদ মিনারের চারপাশটার প্রচলিত নাম “একুশ চত্বর”। ডরমিটরি থেকে পনেরো মিনিটের হাঁটা পথ।কিন্তু সুবর্ণা কিছুতেই বের হবে না।
-আমি এখন নোট করতে বসবো রাজীব।
রাজীব অনেকবার বলেও সুবর্ণাকে রাজী করাতে পারল না। সুবর্ণার রুমমেট অদিতি বলল, তুই দেখা করে এলে সমস্যা কমতো কিন্তু, ভেবে দেখ!
-না, আমার ইচ্ছে করছে না! আর জাহিদ জানতে পারলে কষ্ট পাবে।
-জাহিদ ভাই জানবে কিভাবে?
-জানে যদি, তখন!
-তুই না বললেই হয়!
-জাহিদকে না বলে আমি থাকতে পারব না।
-তাহলে রাজীবকে ফেস করবি কিভাবে?
-ফেস করার কিছু নাই, ও ঝামেলা ছাড়া কিছু করবে না।
-ওর ঝামেলা করাই তো স্বাভাবিক, এত দিনের সম্পর্ক৷ তুই বিয়ে করে ফেললে ও ঝামেলা করবে না!
-ওরে তো আমি ডাকছিলাম, ও যায় নাই!
-ওর কী বিয়ের বয়স হইছে, ও গেলেই তোরে বিয়ে দিতো?
সুবর্ণার অসহায় লাগছে, অদিতির মতই সবাই বলবে সুবর্ণা কানে হেড ফোন দিয়ে লিখতে শুরু করলো।
মিনিট বিশেক পরে জাহিদ টেক্সট করলো,
“কি করছ, ব্যস্ত? ”
“না, নোট করছি, তুমি? ”
” ফিরলাম বাসায়, এখন একটু রান্না করে ফেলব, তোমাকে মনে হলো, তাই! ”
” কি রান্না করবে?”
“খিচুড়ি, আমার জাতীয় খাবার”
” ইস, মিস করছি খুব”
“চলে আসো, মিস ইউ টু”
“পরীক্ষাটা দিতে ইচ্ছে করছে না”
“এই একদম না, আমি এমনিই বলেছি”
‘হুম, বুঝেছি”
“ঠিক আছে, নোটস শেষ করে ফোন দিও”
“ওকে, বাই”
” আদর নিও, ভালোবাসি”
সব শেষ টেক্সটটা দেখে সুবর্ণার চোখে পানি চলে এলো। জাহিদ এমন কেন, খুব চুপচাপ, শান্ত, অল্প কথায় কি সুন্দর করে ভালোবাসি বুঝিয়ে দেয়, কোন অশালীন ইঙ্গিত নেই, তবুও ভালোবাসা ভরা। জাহিদ রাজীবের বিষয়ে ডিটেইল জানতে পারলে কি রিএ্যাক্ট করবে? করারই কথা।
সুবর্ণার মন অস্থির হয়ে আছে, মন বসছে না পড়ায়। যে হবে, ঠিক বুঝতে পারছে না। রাজীবের সাথে এতদিন কিভাবে সম্পর্কে আটকে ছিল, সেটা ভাবতেই বিরক্ত লাগছে।
নয়টার দিকে ডরমিটরির গেট বন্ধ হয়, রাজীব সাড়ে আটটায় আবার ফোন করলো, সুবর্ণা রিসিভ করলো না।
দুদিন পরে তো মিস করা ক্লাশ টেস্ট এটেন্ড করতে বের হতেই হবে। তখন কি করবে কে জানে! সুবর্ণা মনে মনে ঠিক করলো ভয় পাবে না। একবার তো ফেস করতেই হবে! ভয়ের কিছু নেই, বেশি বাড়াবাড়ি করলে প্রক্টর স্যারের কাছে অভিযোগ করবে। কিন্তু সুবর্ণা সেটা চায় না। ইভটিজিং এ ক্যাম্পাসের রুলস খুব কড়া, একটা অভিযোগ করলেই বহিষ্কার করে দিবে। ছেলেটার বড় কোন ক্ষতি হোক এটা সে চায় না।
দেখা যাক কী হয়।
শানজানা আলম