সুবর্ন বন্ধন পর্ব-০৪

0
130

সুবর্ণ বন্ধন – ৪

রাধানগরে জাহিদ সুবর্ণাকে নিয়ে পৌছে গেল সকাল সকালই। সুবর্ণার বাবা বারবার বলে দিয়েছেন যেন মামার বাসায়ই ওঠে। জাহিদকে বলেছেন, দু তিনদিন আর আলাদা ব্যবস্থা করার দরকার নেই, মামার বাসায়ই থেকো।
তাকে নিশ্চিন্ত করতে জাহিদ বলে এসেছে, জি আচ্ছা।
কিন্তু জাহিদের গোপন ইচ্ছে ওর ছোট্ট আস্তানায় সুবর্ণা গিয়ে থাক দুয়েকবেলা। একদম দুজনার ছোট্ট পৃথিবী।
কিন্তু এবার হবে না মনে হচ্ছে। সুবর্ণাকে মামার বাসায় রেখে জাহিদ কলেজ ক্যাম্পাসে চলে গেল। যে বয়স্ক মহিলা কোয়ার্টারে কাজ করে, তাকে নিজের বাসাটা পরিস্কার করতে বলে জাহিদ ক্লাশ নিতে চলে গেল।
ফিরতে ফিরতে দুপুর। সুবর্ণা মামাতো ভাইবোনদের সাথে এ বেলা গল্প করে কাটিয়ে দিলো। লাঞ্চের পরে জাহিদ বলল, আমার আস্তানা দেখে আসবে চলো।
-আচ্ছা আমরা ওখানে থাকতে পারি না? সুবর্ণা জিজ্ঞেস করলো।
-ওখানেই থাকতে চেয়েছিলাম, ভালো লাগতো তোমার। কিন্তু…
বের হওয়ার সময় সুবর্ণার মামি একটা দারুণ কাজ করলেন, তিনি মামাকে বললেন, ওদের বিয়ে হয়েছে নতুন, একটু নিরিবিলি ওদের সময় কাটানো দরকার আছে, নিজেদের চেনাজানার জন্য। ওরা যদি ওখানে থাকতে চায় থাকুক, কিন্তু রান্নার ঝামেলা করতে হবে না। আমি খাবার পাঠানোর ব্যবস্থা করবো, নয়তো ওরা চলে আসবে, এতটুকুই তো পথ!
মামির এই সিদ্ধান্ত জাহিদের একদম মন মতো হলো, ওরা তখন ব্যাগ নিয়েই চলে গেল জাহিদের কোয়ার্টারে।
ভ্যাপসা গরম পড়ছিলো দুপুর থেকে। ওরা থাকবে নাকি থাকবে না এই সিদ্ধান্ত নিতে অনেক দেরী হয়েছে।
প্রায় বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা।
একটা বিল্ডিং এ ছয়টা পরিবার থাকার ব্যবস্থা, তবে এখানে দুটো ফ্ল্যাটে ব্যাচেলর টিচাররা আছে।
জাহিদ আগে থেকেই আলাদা বাসা নিয়েছে, নিজের পড়াশোনার সুবিধার জন্য। ছিমছাম বাসা।
দুটো রুম, একটা বারান্দা আর ছোট্ট কিচেন। একচুলার একটা গ্যাস আর রান্নার আয়োজন দেখে সুবর্ণা জানতে চাইলো, রান্না কে করে এখানে?
-কেন, আমি থাকি তো রান্না কি ভূতে করবে নাকি!
-আপনি রান্না করতে পারেন!
-ভীষণ অদ্ভুত প্রশ্ন হয়ে গেলো, আমি হলেও রান্না করতাম প্রায়ই! ব্যাচেলর ছেলেরা সবকিছুই পারে বুঝলেন ম্যাডাম!
-আমি কিন্তু কিছুই পারি না, নুডুলস আর খিচুড়ি ছাড়া কিছু রাঁধতেও পারিনা।
-ডরমিটরিতে কোথাও খাও? ক্যান্টিনে?
-হুম, রান্না করে অনেকে, আমি করিনি, মাঝে মাঝে নুডুলস বানাই!
-এটাই অনেক বলো, ধরো তুমি একবার নুডুলস রান্না করলে, আমি একবার আলু আর ডিম সিদ্ধ করে নিলাম, চলবে না?
জাহিদ এত সিরিয়াস ভাবে বলল, সুবর্ণা ভাবলো, এখন আলুভর্তা আর নুডুলস খেয়েই দিন কাটাতে হবে।
তাই সুবর্ণা জিজ্ঞেস করলো, এখানে বুয়া পাওয়া যাবে না? রান্না বান্না করলো, ধোঁয়া মোছা করলো!
জাহিদ হাসি চাপতে পারলো না। এত ইমম্যাচিউরড মনে হয়নি সুবর্ণাকে, ও তো সিরিয়াস হয়ে গেল একদম!
জাহিদকে হাসতে দেখে সুবর্ণা বুঝতে পারলো যে ও মজা করেছে।
এই সময়ে খুব জোরে জানালার কপাট ধাক্কা খেয়ে গেল বাতাসে। কয়েক দফা ঝড়ো বাতাস হয়ে বৃষ্টি নামলো ঝুপ করে, মুষলধারে বৃষ্টি। থামার নাম নেই আর।ঝড় শুরু হলে লোকাল এরিয়ায় আগে ইলেকট্রিসিটি অফ করে দেয়। তাই লোডশেডিং হয়ে গেল।
চার্জারের অল্প আলোতে সুবর্ণার মনে হলো, কোন অচিনপুরে এসে পড়েছে। ঝড়ো বাতাস আর বৃষ্টি, কেমন রহস্যময় পরিবেশ!জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল সুবর্ণা, যদিও কিছু দেখা যাচ্ছে না, বিজলি চমকালে আশপাশটা স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে শুধু।
জাহিদ এসে পাশে দাঁড়ালো, কি অদ্ভুত, মাত্র দশদিন আগেও সুবর্ণাকে চিনতো না, অথচ এখন ও কতো কাছে!
কিন্তু রোমান্টিকতার চাইতে জাহিদের মনে হলো, এই আবহাওয়ার মধ্যে সুবর্ণাকে নিয়ে বের হওয়া যাবে না। এদিকে পিয়নরাও সবাই চলে গিয়েছে। তাই আপাতত রান্নার ব্যবস্থা করতে হবে।
-সুবর্ণা, মামিকে বলে দাও, আমাদের ইনভাইট আছে, এই আবহাওয়ায় যেন মামা না আসেন। ঝড়ো আবহাওয়া দেখে আমাদের ব্যাচেলর কলিগরা একত্রে আয়োজন করেছে।
-হায় হায়, মিথ্যে কথা বলবো!
-বলো, নয়তো এখন এই ওয়েদারে মামা খাবার নিয়ে চলে আসবেন।
অগত্যা সেটাই বলতে হলো।
রান্নাঘরে বাজার করা নেই, আর জাহিদও তো কয়েকদিন ধরে বাড়িতেই ছিলো, বিয়ের ঝামেলায়। সেলফোনের টর্চ ধরে দুটো ডিম পাওয়া গেল। কাঁচা মরিচ শুকিয়ে গেছে, শুকনো মরিচ পাওয়া গেল তিন চারটা। বাকি চাল, ডাল তেল মশলা আছে। জাহিদ বলল, সুবর্ণা চার্জার নিয়ে এসো, আমরা খিচুড়ি চাপিয়ে দেই! সরি, প্রথমদিনই এমন ঝামেলায় ফেলে দিলাম তোমাকে।
সুবর্ণার মজাই লাগছিল, আসলে খেতে হবে এই চিন্তাই ছিল না। আবহাওয়া ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে, কাঁথা মুড়ি দিয়ে ভালো ঘুম হবে।
-আচ্ছা আপনার কাছে কাঁথা আছে তো?
জাহিদ অবাক হয়ে তাকলো, কাঁথা দিয়ে কি করবে?
-না মানে, এই আবহাওয়ায় কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমাতে খুব আরাম!
জাহিদ ভাষা হারিয়ে ফেলল। এখন সুবর্ণার ঘুমাতে ইচ্ছে করছে! দুপুরের পর থেকে কিছু খাওয়া হয়নি। ওর নিজেরও খিদে পাচ্ছে। বৃষ্টি কমার অপেক্ষা করতে করতে এখন নটার বেশি বাজে।
অল্প আলোয় জাহিদ বসে খিচুড়ি রান্না করার জন্য সব গুছিয়ে ফেলল, লাইটের চার্যও শেষ হয়ে আসছে।
মোমবাতি ছাড়া আর উপায় রইল না।
রান্না শেষ হতে হতে সাড়ে দশটা বেজে গেল। বৃষ্টি কমেছে, একেবারে থামেনি।
মোমবাতির আলোয় খেতে বসে সুবর্ণা প্রথমেই বলল, ওয়াও, ক্যান্ডেল লাইট ডিনার!
জাহিদ হেসে বলল, হু, একদম আসল ক্যান্ডেললাইট ডিনার ।
খাবারটা এত সুস্বাদু হয়েছে যে সুবর্ণা বলল, আপনি অনেক ভালো রান্না করেন!
জাহিদ হাসলো একটু।
-এই খাবারই তোমার কাল আর ভালো লাগবে না। আজকের ওয়েদার সাথে প্রচন্ড খিদে, এজন্য শুধু চাল ডালে খিচুড়ি আর পেয়াজ ছাড়া ডিমভাজাও ভালো লাগছে।
-আমার কিন্তু মনে হচ্ছে আমরা পিকনিক করতে এসেছি, এ্যাডভেঞ্চার!
জাহিদ মনে মনে বলল, আমার সাথে পুরো জীবনটা তোমার এ্যাডভেঞ্চারেই কাটবে, এখন ভালো লাগছে, কিন্তু হিসেব করে এ্যাডভেঞ্চার করতে কতক্ষণ ভালো লাগবে, কে জানে! মাঝপথে যদি…
না, প্রশ্নই আসে না, সুবর্ণাকে সে কোথাওই যেতে দিবে না।
একটু অন্যমনস্ক দেখে সুবর্ণা জিজ্ঞেস করলো, কী ভাবছেন? খাওয়া শেষ করুন। এগুলো ধুয়ে রাখতে হবে না?
-না না, বুয়া আসবে সকালে।
-ওহ, বুয়া আছে তাহলে, আমি ভাবলাম কাল আবার নুডুলস রাঁধতে হবে।
দুজন একসাথে হেসে ফেলল।

রাতের ঝড় বৃষ্টির পরে সকালটা হয় অনেক বেশি স্নিগ্ধ। মনে হয় প্রকৃতি নতুন বউয়ের মতো সদ্য স্নান সেরে সবুজ শাড়ি পরেছে, নাকে নথ দিয়ে কপালে সিদূরের টিপ দেওয়ার চেষ্টা করছে।
নতুন জায়গা হলেও সুবর্নার ঘুম হয়েছে ভালো৷ জাহিদের বুকের উপর শুয়ে গল্প করতে করতে কখন ঘুমিয়েছে, জাহিদ কখন পাশের বালিশে নামিয়ে দিয়েছে, কিচ্ছু টের পায়নি। ঘুম ভেঙে দেখছে জাহিদ উল্টোদিকে ফিরে ঘুমাচ্ছে। সুবর্ণা উঁকি দিয়ে ডাকলো।
-এই যে, উঠবেন কখন? একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসি??
ঘুম ভেঙে জাহিদ দেখলো সুবর্ণা মুখের উপর উঁকি দিচ্ছে।জাহিদ ওকে কাছে টেনে চুমু খেলো। হাতের আলগা বাঁধন ছাড়িয়ে সুবর্ণা নেমে পড়লো বিছানা থেকে।
-চলুন পুরো এলাকা ঘুরে আসি!
জাহিদ উঠে বসলো, বাইরে যেতে ইচ্ছে করছে না। সুবর্ণাকে কাছে পেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু ও তো বাইরে যেতে চাইছে। তাই জাহিদ উঠে হালকা ফ্রেশ হয়ে সুবর্ণাকে নিয়ে বের হয়ে পড়লো।
সকালের স্নিগ্ধ পরিবেশে হাঁটতে ভালো লাগছিল। জাহিদ জিজ্ঞেস করল, কেমন লাগছে তোমার?
-সুন্দর, এককথায় ছোট্ট উত্তর সুবর্ণার।
-কাল দিয়ে আসব তোমাকে তোমাদের বাসায়!
-আরো দু একদিন থাকা যাবে তো,
– তোমার কষ্ট হবে তো!
-আমার কষ্ট হবেনা, আমি তো গেস্ট, রান্নাবান্না সব আপনি করবেন! সুবর্ণা হাসতে লাগল।
-আচ্ছা, ঠিক আছে, করবো।
-আচ্ছা আপনার ছাত্রীরা আপনার প্রেমে পড়ে না? মানে ফ্যান ট্যান নেই?
-এখানে প্রেমে পড়ার মতো ছাত্রী নেই, ইতিহাসের শিক্ষকের প্রেমে পড়ে না কেউ!
-পড়ে পড়ে, আপনি হয়ত জানেন না, গসিপ করে আপনাকে নিয়ে!
জাহিদ হেসে ফেলল, করলে করে। তো?
-না মানে বললাম আর কি!
-তোমার বয়ফ্রেন্ড নেই?
সুবর্ণা একটু ধাক্কা খেলো, রাজীবের কথা মনে হলো। ওর সাথে অসংখ্য ছবি আছে, জাহিদকে কী বলে দিবে?
একটু ভেবে বললো, ছিল!
-তো কী হলো, এখন নেই?
-এখন তো বিয়ে হয়ে গেল আমার।
-মানে কী? ব্রেকআপ হয়নি?
-না!
-তুমি বিয়ে করে ছেলেটাকে ঠকালে??
সুবর্ণা বলল, আপনার কী তাতে কোন সমস্যা আছে? আপনাকে তো ঠকাইনি!
জাহিদ হাসতে লাগলো, বলল ভাগ্যিস! নয়তো এমন সুন্দরী বউ কোথায় পেতাম বলো!
সুবর্ণা হাঁটতে হাঁটতে পুকুরের কাছে চলে এলো।
-সুবর্ণা, এই পুকুরকে রানীর পুকুর বলে, জানো?
-জানি!
– জায়গা জমিদার রাধারমন সেনের নাম অনুসারে, এই বাড়িটাও তার করা ছিলো৷ এই পুকুরে নাকি তার স্ত্রী রানী ঢুবে মারা গিয়েছেন। তাই পুকুরের নাম রাণীর পুকুর!
গল্পটা শুনেছ?
-এটুকুই শুনেছি!
-আরো বড় গল্প আছে, তোমাকে বলবো একসময়।
-আচ্ছা।
-এই পুকুরে নেমো না, ভাঙা ঘাটে পা ফসকে পড়ে যাবে।
সুবর্ণা নামতে যাচ্ছিল, উঠে এলো উপরে। জাহিদের বাসায় ফিরতে ফিরতে প্রায় সাড়ে সাতটা বেজে গেল। এখন কেমন ঝলমলে রোদ।
-বুয়া কখন আসে?
-নটার দিকে,
-ওকে, তাহলে এখন একটু ঘুমাই, ঘুম পাচ্ছে আমার।
জাহিদ এগিয়ে এলো সুবর্ণার কাছে, এখন ঘুমাবে?
-হু, আপনি কি করবেন?
-কিছু ক্লাসটেস্ট এর কপি আছে, সেগুলো দেখে ফেলব!
-আচ্ছা
দুটো রুমের একটা রুম জাহিদের বেডরুম, আর একটা স্টাডি রুম, চেয়ার টেবিল বই পত্র আর ছোট একটা চৌকির মত খাট। জাহিদ স্টাডিরুমে চেয়ার টেবিলে বসলো গিয়ে। ও এক মনে পেপারগুলো দেখছিল। হঠাৎ আলতো স্পর্শে চমকে উঠল। সুবর্ণা এসেছে, ও তো ঘুমাবে বলছিল!
চেয়ারের পেছনে দাঁড়িয়ে জাহিদের ঘাড়ে চুমু খাচ্ছে।
এই মেয়েটা এত দুরন্ত কেন, প্রথমে তো এমন মনে হয়নি! জাহিদকে কেমন আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলছে।
-কি হলো, তুমি ঘুমুবে না?
-হু,
-তো? আবার এলে কেন?
এবারে সুবর্ণা উত্তর দিলো না। উবু হয়ে জাহিদকে ঘনিষ্ঠভাবে ধরলো। জাহিদ এবার আর প্রশ্ন করলো না।
সুবর্ণাকে কাছে টেনে নিলো।

সুবর্ণা সারাদিন জাহিদের বাসায়ই ছিল, বের হয়নি কোথাও। মামি ফোন করেছিলেন, জাহিদের ক্লাশ আছে, তাই সে মামার বাসায় যাবে কিনা, কিন্তু সে যায়নি। বুয়া এসে কাজ করেছে৷ সুবর্ণা সারাদিন খুঁটিয়ে খুটিয়ে জাহিদের জিনিসপত্র দেখেছে। অন্যের কোন জিনিস এভাবে দেখা ঠিক না, কিন্তু সুবর্ণার ভীষণ ভালো লাগছিল দেখতে। বেশকিছু বই আছে জাহিদের, বেশিরভাগই টেক্সট ধরণের বই। গল্পের বই কম। পড়ার মতো অন্য বই না পেয়ে সুবর্ণা “ইউরোপের ইতিহাস” নামের একটা বই পড়তে শুরু করলো। তিন চার পৃষ্ঠা পড়ার পরই ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে এলো।
ঘুম ভাঙলো জাহিদের ফোনে, ক্লাশ শেষ করে ফোন করেছে। দশ পনেরো মিনিট লাগবে চলে আসতে। সুবর্ণা উঠে পড়লো, প্রায় একটা বেজে পনেরো মিনিট, এই অসময়টা ঘুমিয়েছে, রান্না অবশ্য করতে হবে না। মামি পাঠাবে।
জাহিদ ফিরলো পোণে দুইটার দিকে।
-অনেক দেরি করে ফেললাম? কি করবো বলো, তোমাকে সবাই দেখতে চাইছে, বাসায় কি কেউ এসেছিল?
-না, কেউ আসেনি তো!
-তুমি কি করলে সারাদিন?
-ঘুমিয়েছিলাম!
-এই অসময়ে? রাতে ভালো ঘুম হয়নি তাই না!
-সকালে ঘুম হয়নি!
জাহিদ প্রথমে বুঝতে না পারলেও পরে বুঝতে পারলো। মেয়েটা অসম্ভব দুষ্টু, সে নিজে লাজুক এবং গম্ভীর। অবশ্য টিচিং প্রফেশনে নিজের চারপাশে একটা ব্যক্তিত্বের দেয়াল তৈরি করে রাখা প্রয়োজন।
কলিংবেল বাজল। জাহিদ গিয়ে দরজা খুলল, পিয়ন খাবার নিয়ে এসেছে। জাহিদ মামাকে ফোন করে জানালো।
-সুবর্ণা, রাতে কিন্তু আমাদের দাওয়াত আছে, নিচতলার ভাবীর বাসায়, ভাবী এসেছিলেন?
-না আসেননি।
-আচ্ছা, আসবেন বিকেলে, আমাকে সকালে বলেছেন, তার বাচ্চা ছোট তো তাই হয়তো সময় বের করতে পারেননি।আচ্ছা তুমি বললে না তো ফিরবে কবে ঢাকায়? আমি দিয়ে আসব।
-আমি শুক্রবারে যাব, আপনাকে যেতে হবে না। প্রতিবারের মতো আমি একাই চলে যেতে পারব।
জাহিদ আর কথা বাড়ালো না। খাবার গুলো সাজাতে হবে।
ও রান্নাঘরের দিকে যেতেই পেছন পেছন সুবর্ণাও গেল।
-কি করছেন, গরম করতে হবে?
-না, গুছিয়ে দেই!
-কী দরকার, আমরা দুজনই তো, এখান থেকেই খেয়ে ফেলি!
-তাও তো প্লেট আনতে হবে, নাকি!
-একটা নিয়ে আসি, একসাথে খাই?
-না, এত রোমান্স করতে হবে না, তুমি বসো, আমি গুছিয়ে দিচ্ছি।
সুবর্ণার মুখ কালো হয়ে গেল। কেন যেন জাহিদকে খুব ভালো লাগছে, কিন্তু জাহিদ এমন কেন, কেয়ারিং কিন্তু রোমান্টিক কম! একসাথে কি খাওয়া যেত না?
সুবর্ণা আর কথা বাড়লো না। এখন খাওয়ার ইচ্ছেটা হালকা হয়ে গেছে, অবশ্য খিদে আছে প্রচন্ড।
বিরক্ত লাগছে, সুবর্ণা কী বেশি বেশি কথা বলেছে! নো, আর কোন কথা নাই, একদম চুপচাপ হয়ে গেল।
জাহিদ খেয়াল করলো বিষয়টা, এতক্ষণ বকবক করছিল, হঠাৎ করে চুপ করে গেল। লাঞ্চ করতে বসেও কথা বলছিলোনা।
-আচ্ছা, আমি কি এমন কিছু বললাম যে মন খারাপ করতে হবে?
-মন খারাপ করছি না!
-তাহলে খাচ্ছ না কেন?
-খাচ্ছি তো!
-অনেকটা সময় বসে চিকেনটা নাড়াচাড়া করছ!
-ওহ, না তো খাচ্ছি।
-আচ্ছা সরি, এসো আমি খাইয়ে দিচ্ছি।
-না, সুবর্ণা খাওয়া শেষ করে ফেলল।
জাহিদের একটু মন খারাপ হলো, আসলে ও সিচুয়েশন বুঝতে পারেনি। সুবর্ণার সাথে মাত্রই একটা মিষ্টি সম্পর্ক শুরু হয়েছে, সেখান থেকেই হয়তো মেয়েটা বলেছিল।
এখন হয়তো আর কিছু বলবেই না।
সুবর্ণা খাওয়া শেষ করে চুপচাপই জাহিদকে সাহায্য করলো সবটা গুছিয়ে রাখতে। জাহিদের একটা দমবন্ধ করা অনুভূতি হচ্ছে, ছোট্ট একটা কথায় এতোটা রাগ করবে, বুঝতে পারেনি৷ আসলে কাছের সম্পর্ক গুলো এমনি হয়, ছোট ছোট চাওয়া বা ইচ্ছেগুলোকে গুরুত্ব দিতে হয় হয়তো। আজকের মুহুর্তটা অনেক সুন্দর হতে পারতো, নিজের একটু অসাবধানতায় ভারী হয়ে গেল।
জাহিদ ঠিক করলো, এই ইনোসেন্ট মুহূর্তগুলো সে আর নষ্ট করবে না। শারিরীক প্রয়োজনটা একটা বেসিক নিডের আওতায় ফেলা যেতে পারে। বউ হলে স্বামীর সাথে শারিরীক সম্পর্ক হয়, কিন্তু ভালোবাসপূর্ণ সম্পর্ক খুব কমই হয়, হলেও টিকে থাকে না।
লাঞ্চের পরে পাশাপাশি শুয়েও মনে হচ্ছে যোজন যোজন দূরে দুজন। জাহিদই নিরবতা ভাঙলো।
-সুবর্ণা, সরি!
-সরি বলছেন কেন?
-তুমি মন খারাপ করেছ, তাই ।
-আমি মন খারাপ করিনি!
-আমি বুঝতে পারছি।
-আপনি কি সব বোঝেন?
-তোমাকে বুঝতে শুরু করেছি!
-ওহ আচ্ছা! একটু থেমে সুবর্ণা বলল, কিন্তু বোঝেননি!
আমি মন খারাপ করিনি!
-সত্যি?
-হ্যা!
-আচ্ছা তাহলে আমাকে আদর করে দাও, সকালের মতো করে!
সুবর্ণার কান গরম হয়ে গেল, লোকটা মোটেও সুবিধার না! তখন বললো, একসাথে খাই, তাতে রাজি হলো না।
এখন আদর করতে বলছে! একবার ইচ্ছে করছে কাছে যেতে, আবার ওই কথাটা মনে করে কাছে যেতে ইচ্ছে করছে না।
-কি হলো, আসবে না?
সুবর্ণা উত্তর দিলো না। জাহিদ এগিয়ে এলো, সুবর্ণার দু হাতের পাতা ধরে বলল, আমি সরি, সত্যিই সরি, তোমার ইমোশনটা বুঝতে পারিনি।
আর কিছু বলার থাকে না, সুবর্ণা হেসে ফেলল। উঠে বসে বললো, আচ্ছা ঠিক আছে, আপনি আমাকে আবৃত্তি করে শোনান, তাহলে সব ঠিক হয়ে যাবে।
-ওকে ম্যাম, চোখ বন্ধ করে শোনো তাহলে। চোখ খুলবে না!
-বই লাগবে না?
-না, এটার জন্য লাগবে না।
-ওকে, সুবর্ণা সত্যিই চোখ বন্ধ করে ফেললো।
জাহিদ ভরাট গলায় আবৃত্তি করলো, রবী ঠাকুরের “আগমন”…
“তখন রাত্রি আঁধার হল,
সাঙ্গ হল কাজ –
আমরা মনে ভেবেছিলেম,
আসবে না কেউ আজ |
মোদের গ্রামে দুয়ার যত
রুদ্ধ হল রাতের মত,
দু’এক জনে বলেছিল
“আসবে মহারাজ!”
আমরা হেসে বলেছিলেম
“আসবে না কেউ আজ!”
দ্বারে যেন আঘাত হল
শুনেছিলেম সবে,
আমরা তখন বলেছিলেম
বাতাস বুঝি হবে |
নিবিয়ে প্রদীপ ঘরে ঘরে
শুয়েছিলেম অলস ভরে,
দু’এক জনে বলেছিল
“দূত এল বা তবে!”
আমরা হেসে বলেছিলেম
“বাতাস বুঝি হবে!”
নিশীথরাতে শোনা গেল
কিসের যেন ধ্বনি |
ঘুমের ঘোরে ভেবেছিলেম
“মেঘের গরজনি!”
ক্ষণে ক্ষণে চেতন করি
কাঁপল ধরা থরহরি,
দু-একজনে বলেছিল
“চাকার ঝনঝনি।”
ঘুমের ঘোরে কহি মোরা
“মেঘের গরজনি।”
তখনো রাত আঁধার আছে,
বেজে উঠল ভেরী,
কে ফুকারে “জাগ সবাই,
আর কোরো না দেরী!”
বক্ষ’পরে দুহাত চেপে
আমরা ভয়ে উঠি কেঁপে,
দু-এক জনে কহে কানে
“রাজার ধ্বজা হেরি!”
আমরা জেগে উঠে বলি
“আর তবে নয় দেরী”
কোথায় আলো, কোথায় মাল্য
কোথায় আয়োজন।
রাজা আমার দেশে এল
কোথায় সিংহাসন।
হায়রে ভাগ্য, হায়রে লজ্জা,
কোথায় সভা, কোথায় সজ্জা।
দু-একজনে কহে কানে,
“বৃথা এ ক্রন্দন –
রিক্তকরে শূন্য ঘরে
করো অভ্যর্থন!”
ওরে দুয়ার খুলে দে রে,
বাজা শঙ্খ বাজা!
গভীর রাতে এসেছে আজ
আঁধার ঘরের রাজা |
বজ্র ডাকে শূন্যতলে
বিদ্যুতেরই ঝিলিক ঝলে,
ছিন্ন শয়ন টেনে এনে
আঙিনা তোর সাজা।
ঝড়ের সাথে হঠাত্‍‌ এল
দুঃখরাতের রাজা!”
… কি সুন্দর, একটা অদ্ভুত ঝংকার তোলা কন্ঠ, অথচ বলছে প্রাকটিস নেই।
সুবর্ণা চোখ বন্ধ করেই ছিল, আবৃত্তি শেষ করে জাহিদ ওর চোখে চুমু খেলো, সুবর্ণা চমকে উঠে চোখ খুলল।
কিছু বলতে চাইলো কিন্তু জাহিদ ওর মুখ বন্ধ করে দিলো আদর করে।

চলবে

শানজানা আলম