সুবর্ন বন্ধন পর্ব-০৬ এবং শেষ পর্ব

0
151

সুবর্ণবন্ধন – ৬

সুবর্ণার পরীক্ষা শুরু হয়েছে। পরীক্ষা তেমন ভালো হয়নি৷ রাজীব বিভিন্ন ভাবে উৎপাত করেছে।
ফরম ফিলাপের দিন ঝামেলা করেছে। সুবর্ণাকে ব্যাংকে লাইনে দাঁড়াতে দেয়নি। এমন সিন ক্রিয়েট করেছে, সুবর্ণা চলে এসেছে বাধ্য হয়ে। পরে লেট ফি সহ এক জুনিয়র মেয়েকে দিয়ে টাকা জমা দিয়েছে।
সবটা একাই সহ্য করছে, জাহিদকে কিছু বলেনি।
রাজীবকে বলেছে প্রক্টর স্যারের কাছে নালিশ করবে, কিন্তু করেনি। নালিশ করলে রাজীবকে বহিষ্কার করে দিবে।
শেষ সেমিস্টারে ওর ক্ষতি হোক এটা সুবর্ণা চায়নি। কিন্তু সুবর্ণার এই উদারতা রাজীব দুর্বলতা হিসেবে ভেবে নিয়েছে। সব বন্ধুদের নিয়ে একদিন মিটিং বসালো। সুবর্ণার বিপক্ষে কথা বলেছে কয়েকজন, কয়েকজন রাজীবের বিপক্ষে। সুবর্ণাকে আক্রমণ করে রাসেল তো বললই , তুই তো এমন করবি আগেই জানতাম!
সুবর্ণা চুপচাপ ছিল। রাজীব খুব ঠান্ডা ছিল সেদিন, ওর কথা ওর বন্ধুদের শিখিয়ে নিয়ে এসেছিল।
অদিতি অবশ্য হালকা বলেছিল, রাজীব তো সুবর্ণার বাড়িতে যায়নি, এখন এত নাটক করছে কেন!
শেষে সুবর্ণা একটাই কথা বলেছে, রাজীবের সাথে আমার অ্যাফেয়ার ছিল, বিয়ের আগে ওকে ডাকছিলাম, ও যায়নি, এখন আমার বিয়ে হয়ে গেছে, জাহিদ ছাড়া আমি কাউকে ভাবতে পারছি না৷ আমার মনে হচ্ছে এতদিনেও আমি রাজীবকে এত ভালোবাসতে পারিনি, যেমন জাহিদ আমাকে ভালোবাসে। সো, আমি খারাপ৷ স্বার্থপর, সব ওকে। তোরা আমার সাথে কথা বলতে আসিস না। পরীক্ষার পরে আমি ক্যাম্পাস, ডরমিটরি ছেড়ে চলে যাবো। ফাইন?
সুবর্ণার মতো চুপচাপ মেয়ে একবারে এতো কথা বলবে কেউ আশা করেনি, রাজীবও কথা বাড়ায়নি।
প্রতিদিন ফোন করে টেক্সট করে বিরক্ত করে যাচ্ছে, কোন কারণ ছাড়াই। পরীক্ষার পরে সুবর্ণাকে দাঁড়াতে বলে, কিন্তু রোজ সুবর্ণা দশ মিনিট আগে পেপার জমা দিয়ে চলে গিয়েছে। আজ রিসার্চ ম্যাথোডোলজি পরীক্ষা ছিল, ইচ্ছে থাকলেও তাড়াতাড়ি শেষ করতে পারলো না সুবর্ণা।
আজকে পরীক্ষার পরে সুবর্ণা ওয়াশরুমে গিয়েছিল। পরীক্ষা শেষ হলে অডিটোরিয়াম ফাঁকা হতে দু তিন মিনিটও লাগে না। সুবর্ণা ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে দেখে সবাই চলে গেছে।
হঠাৎ কেউ হ্যাচকা টান দিয়ে ওকে ওয়ালের সাথে চেপে ধরলো।
–রাজীব! তুই লেডিস ওয়াশরুমে কেন??
– তোর সাথে দরকার আছে!
-আমার কোন দরকার নাই, এখানে তোকে আমার সাথে কেউ দেখলে খারাপ ভাববে রাজীব, চলে যা এখান থেকে।
-না, তোর সাথে কয়েকটা সেলফি তুলে তোর জামাইকে পাঠাবো, দেখি এতো প্রেম কই থাকে!!
-রাজীব চলে যাবি না চিৎকার করব। পরীক্ষা অফিসে কিন্তু জালাল ভাই আছে এখনো!
-আমি জানি চিৎকার করবি না তুই, তুই চাস না আমার কোন ক্ষতি হয়, আরে গাঁধা কেন চাস না এটা বুঝিস না, কারণ তোর ফিলিংস আছে আমার জন্য!
রাজীব সুবর্ণাকে ওয়ালে চেপে ধরলো! ওর মুখ হাত দিয়ে বন্ধ করে দিলো, রাগে জিদে সুবর্ণার চোখে পানি চলে এলো!
ঠিক এই সময়ে খুব জোরে রিংটোন বেজে উঠলো সুবর্ণার ফোন, এস্যাইন করা, জাহিদ ফোন করছে!
জোরে টোন শুনে পরীক্ষা অফিসের জালাল সাহেব আর সুবর্ণাদের আজম স্যার এগিয়ে এলেন ওয়াশরুমের দিকে, -কে? কে আছে?
সুবর্ণা রাজীবকে ধাক্কা দিয়ে বের হয়ে গেল।
রাজীব একটু পর বের হলো।
বের হয়ে ফোন রিসিভ করে, ফ্যাকাল্টি বিল্ডিং এর সামনে বসে সুবর্ণা কান্নাকাটি শুরু করলো। এখানে এখন কেউ নেই তবে রাস্তার পাশেই বিল্ডিং, সবাই চলাচল করছে।
জাহিদ বুঝতে পারছে না কি হয়েছে। বারবার জিজ্ঞেস করছে, কি হয়েছে? বলো আমাকে প্লিজ? পরীক্ষা খারাপ হয়েছে??
সুবর্ণা কাঁদতে কাঁদতেই বললো, তুমি ঢাকা আসো প্লিজ, তাড়াতাড়ি আসো।
১৩
সুবর্ণা কাঁদছে দেখে জাহিদ অদিতিকে ফোন করলো। অদিতি পরীক্ষা শেষ করে ক্যান্টিনে ঢুকেছিল।
জাহিদ ভাগ্যিস অদিতির ফোন নম্বরটা টুকে রেখেছিল।
-হ্যালো অদিতি, আমি জাহিদ বলছি, সুবর্ণার হাজবেন্ড।
-জি আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া, কেমন আছেন?
-হ্যা আলহামদুলিল্লাহ, তুমি কোথায়? সুবর্ণার আশেপাশে না?
-না ভাইয়া, আমি তো ক্যান্টিনে ঢুকলাম, সুবর্ণা ওয়াশরুমে গিয়েছে।
-আচ্ছা ও কাঁদছে কেন? প্রশ্ন হার্ড ছিল? তুমি একটু যাবে ওর কাছে।
-জি যাচ্ছি এখনই ভাইয়া।
জাহিদের ফোন পেয়ে অদিতি বুঝলো সিরিয়াস কিছু হয়েছে। তাই দ্রুত চলে এলো সুবর্ণার কাছে।।সবটা শুনে অদিতি বলল, আর অপেক্ষা করিস না, নালিশ করে দে প্রক্টর স্যারের কাছে। সুবর্ণা উত্তরে বলল, নালিশ করলেই তো বহিষ্কার করে ফেলবে! তখন কী হবে বল তো!
অদিতি আর কথা বাড়ালো না, সুবর্ণার কথা যৌক্তিক।
বেচারির মনটা এতো ভালো, আল্লাহর হিসাব আসলে কেউ জানে না। তাই এই বেয়াদব রাজীব ছোড়াটা ওর কপালে পড়ে নাই। অদিতি একা একা ভাবছিল এসব।
সুবর্ণাকে নিয়ে ডরমিটরিতে ফিরে এলো অদিতি।
জাহিদ সে রাতে একটা ফোন পেলো। অপরিচিত নম্বর থেকে।
-হ্যালো, জাহিদ সাহেব বলছেন?
-হ্যা কে বলছেন প্লিজ?
-আমাকে আপনি চিনবেন না। আমি আপনার ওয়াইফের পরিচিত!
-ও আচ্ছা, কি নাম আপনার?
-নাম জেনে কি করবেন বলুন তো?
-কেন নামটা জানা প্রয়োজন নয়?
-আমার কাছে আপনার ওয়াইফের কিছু জিনিসপত্র আছে, সেগুলো আপনাকে দিতে চাই।
-সুবর্ণার জিনিসপত্র, ওকেই দিয়ে দিন।
-ও তো নিতে চাইছে না, আমার সাথে দেখাও করছে না।
-কি ধরনের জিনিসপত্র?
-সেটা দেখা হলেই দিবো!
-ফোন করেছেন, আর বলা যাবে না?
-বলতে চাইছি না। আপনি আসুন আপনার ওয়াইফের ক্যাম্পাসে। গেটে “মামুন ফটোকপি” আছে, ওখানে আসুন। দুয়েক দিনের মধ্যে আসুন। জিনিসপত্র আপনার দেখা দরকার।
-আপনার পরিচয়টা?
-সামনাসামনি দিবো, আমাকে চেনে আপনার বউ!
এমনিতেও দুদিন পরে জাহিদের ঢাকায় আসার কথা, ফোনটা পেয়ে ভীষণ চিন্তা হচ্ছিল। কী দিতে পারে সুবর্নার এক্স বয়ফ্রেন্ড! সুবর্ণা প্রেম থাকতে পারে, কিন্তু কী জিনিসপত্র থাকতে পারে, ছবি? কার্ড? চিঠি?ধুর, এগুলো খুবই সস্তা বিষয়!
জাহিদ হাতের কাজগুলো পরদিন শেষ করে, সন্ধ্যায় ঢাকার বাসে উঠে বসলো। ফোন কলটার কথা সুবর্ণাকে ইচ্ছে করেই জানায়নি জাহিদ। অহেতুক চিন্তা করবে মেয়েটা। কে জানে, হয়ত সুবর্ণা এজন্যই কাঁদছিল।
ওই ছেলেটা হয়তো ওকেই বিরক্ত করে যাচ্ছে।
১৪
-হ্যালো সুবর্ণা, তোর জামাই আসতেছে ক্যাম্পাসে!
রাজীবের ফোন পেয়ে সুবর্ণা খুবই অবাক হলো, জাহিদ আসবে একটু পরে, ঢাকা থেকে রওনা দিয়েছে, রাজীব জানলো কিভাবে সেটা!
-শোন, তোর জামাই আগে আমার সাথে দেখা করবে, তাকে ছবিগুলো দিবো, ট্যুরের টাইটানিক ছবি, মনে আছে?
সুবর্ণার মনে আছে, এই ছবি দেখে জাহিদ কী মনে করবে! হয়তো আগের মতো ফিলিংসটা আর থাকবে না। সুবর্ণার চোখে পানি চলে এলো। অথচ এই রাজীবের যাতে ইয়ার ড্রপ না হয় তাই ওর অত্যাচার সহ্য করেও কথা প্রক্টর স্যারকে জানায়নি সুবর্ণা। এর প্রতিদানে এটা পেলো!
ঘৃণা করতেও লজ্জা লাগছে রাজীবকে।
জাহিদ টিচার্স ট্রেনিং কলেজে ফর্মালিটিস শেষ করে বের হয়েছে, প্রায় বিকেল এখন। ও যখন পৌছালো, তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। রাজীব ফোন করেছে কয়েকবার। জাহিদ পৌছে একটু দাঁড়ালো, রাজীব আর ওর দুজন বন্ধু তখনই এলো।
সুবর্ণা অদিতিকে সাথে নিয়ে একটু পরে এলো। জাহিদ দেখলো মেয়েটার মুখটা শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে, চোখের নিচে কালি, কোথাও ভীষণ হতাশা লুকিয়ে আছে।
জাহিদের হঠাৎ মনে হলো, বিয়ের সময়ও মেয়েটা কত আমুদে ছিল, সেই চঞ্চলতা কোথায় হারিয়ে গিয়েছে, মাত্র এই কয়েকটা দিনে, রাজীব নামের ছেলেটা ওর কোন ক্ষতি করেনি তো!
জাহিদ সুবর্ণাকে বলল, তুমি এখানে কোন এলে, আমি তো তোমাকে ফোন করিনি?
রাজীব বললো, আমি করেছি ব্রো, একচুয়েলি আপনার ওয়াইফ আমার কথা খুব শোনে, এই যে দেখেন , বলে ছবিগুলো এগিয়ে দিলো।
জাহিদ ছবিগুলো হাত বাড়িয়ে নিয়ে নিলো, খোলার ইচ্ছে ছিল না কিন্তু কৌতুহল থেকে খুলে ফেলল। ঘনিষ্ঠ ছবি কিছু, কোন ট্যুরের বোঝা যাচ্ছে।
জাহিদ একটু চুপ করে বলল, আর?
রাজীব একটু থমকে গেল, আর মানে?
-মানে আমাকে এতদূরে ইনভাইট করে নিয়ে এসে এই কয়টা ছবি দেওয়ার মানে কি? এটা তো সফট কপি আমাকে মেইল করতে পারতে!
-আরো ছবি আছে, সেগুলো ভদ্রলোক দেখতে পারে না।
-আমাকে ভদ্রলোক মনে হলো, জাহিদ একটু ঘামছে, প্রচন্ড রেগে গেলে ওর ঘাম হয়, এটা রাজীবদের ক্যাম্পাস, মাথা গরম করা ঠিক হবে না, আর সব কিছুর উপরে জাহিদ একজন সরকারি কর্মকর্তা, খুব বাজে ভাবে নিউজ ছড়াবে অনলাইন পোর্টালে। তাই মাথা ঠান্ডা করে বলল, আসলে ঠিক ভেবেছ, আমি ভদ্রলোক এই পরিচয়ে আছি নয়তো দুগালে দুটো চড় মেরে তোমার চাপার দাঁত ফেলে দিতাম। যেহেতু আমাকে ভদ্রলোক ভাবছ, আমি এখন সুবর্ণাকে নিয়ে থানায় যাবো, এই ছবি আর ফোন কলের রেকর্ডগুলো দিয়ে জিডি করে আসব। বাকিটা কাল সকালে প্রক্টর অফিসে সুবর্ণা অভিযোগে লিখে দিবে, এতদিন কেন দেয়নি সেটা ও জানে!
রাজীব এবার একটু ভয় পেল, কিন্তু মুখে বলল, যা পারেন করেন, আমিও দেখব কতদূর পারেন!
সুবর্ণা কাঁদছে, অদিতি ওর হাত ধরে আছে।
জাহিদ বলল, তুমি কেন কাঁদছ, তুমি আমাকে আগে জানালে ছেলেট এই সুযোগটাই পেত না বোকা মেয়ে!
এখানে অনেক মানুষ আশেপাশে, তাও সুবর্ণা জাহিদকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। অদিতি বলল, ভাইয়া আসলে রাজীব সুবর্ণা আসার পর থেকেই ভীষণ বিরক্ত করছিলো, শুধু ওর সেমিস্টার ড্রপ হবে বলে সুবর্ণা নালিশ করেনি, অথচ ও কী করলো আজকে!
-ধূর বোকা মেয়ে, এতো কাঁদে না, থানায় যাবে? এগুলো ছাড়া আর কিছু আছে ওর কাছে?
সুবর্ণা মাথা নাড়লো, আর কিছু নেই!
-তোমাকে সফট দেখে ওই ছেলে এই সাহসটা পেয়েছে, বুঝলে!
অদিতির মনে হলো, এবার ওদের স্পেস দেওয়া উচিৎ, তাই অদিতি বিদায় নিয়ে চলে গেল।
জাহিদ সুবর্ণাকে শক্ত করে ধরে আছে। সুবর্ণা কেঁদেই যাচ্ছে, কাঁদুক, আজ সব কান্না শেষ করে ফেলুক, এরপর আর ওকে কাঁদতে দিবে না জাহিদ।
ওভারব্রীজের ওপর গাছের ফাঁকে মস্ত বড় একটা চাঁদ ঝুলছে, জোছনায় মাখাখাখি উপরের আকাশ, কিছু মেঘ ভেসে যাচ্ছে, উড়ন্ত মেঘ আর নিচের বিজলি বাতি জোছনার বৃষ্টি নিচে নামতে দিচ্ছে না। জাহিদ খুব চাচ্ছে জোছনা নামুক। হয়ত ওর চাওয়া তীব্র ছিল তাই হঠাৎই লোডশেডিং হয়ে গেল। জাহিদ সুবর্ণাকে ঘনিষ্ঠভাবে স্পর্শ করলো, ভেজা কপোলে ঠোঁট ছুঁয়ে মুছে দিলো। চারপাশ
অন্ধকার হয়ে যাওয়ায় জোছনা নামছে মেঘ আর বিজলী বাতির বিরোধ ভেঙে। আজকের গ্লানি মুছে যাবে কিছু স্বার্থপর অশ্রু আর মেঘভাঙা জোছনায়।

শেষ

শানজানা আলম