#হঠাৎ_অদ্ভুতুড়ে(পর্বঃ-০৭)
#সুহাসিনী
হঠাৎ ঘুমের ঘোরেই মনে হল, কোথাও যেন নূপুরের শব্দ বাজছে। গাঢ় থেকে গাঢ়তর সেই শব্দ। নূপুরের শব্দে আশেপাশে গা ছমছমে পরিবেশ সৃষ্টি করে যাচ্ছে। আর ঘুমিয়ে থাকতে পারলাম না। অন্ধকারেই চোখ মেলে তাকালাম। সবকিছু আধাঁরে ঢাকলেও শব্দটা ঠিকই কানে আসছে। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, কোথাও থেকে যেন আজকেও একটা বাচ্চার চাপা কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে। পাশেই মা ঘুমিয়ে আছেন। এই মুহুর্তে মাকে ডাকলে, শব্দটা মিলিয়ে যেতেই পারে। আমার যে কোনো মানসিক সমস্যা নেই, এটা প্রমাণ করতে গেলে আমাকে একা একা সব রহস্যের সমাধান করতে হবে। অন্ততঃ এটুকু খুব ভাল করেই অনুধাবন করতে পেরেছি।
অন্ধকারের বিছানা থেকে নেমে হাতড়িয়ে হাতড়িয়ে দরজার পাশে এসে দাঁড়ালাম। এখান থেকে দুটো শব্দই বেশ জোরালোভাবে শোনা যাচ্ছে। আস্তে করে দরজাটা ঠেকে উঁকি দিলাম। নূপুরের শব্দটা আমার দরজার সামনের বাম দিক থেকে ডানদিকে এগিয়ে গেল। কী ব্যাপার, নূপুরের শব্দ পাচ্ছি, অথচ মানুষ কই? শব্দটা পার হতেই দরজাটা আরেকটু ঠেলে একদম বাইরে চলে এলাম। এতটাই নিঃশব্দে যে আমি নিজেই হয়ত টের পাচ্ছি না, আমি হাঁটছি।
ধীর পায়ে নূপুরের শব্দটার পিছু নিলাম। সানার ঘর পার হয়েই সামনে বাগান করার জন্য সামান্য ফাঁকা জায়গা পড়ে আছে। তার পিছেই ছোট রাস্তাটা পার হলেই নদী। ছোট শব্দটা সেদিক থেকেই আসছে।
আরো কিছুক্ষণ এগিয়ে যাবার পর হঠাৎ খেয়াল হল,একটা নারী শরীর সানার ঘর অব্দি এগিয়ে যাচ্ছে। এতক্ষণ আমার চোখেই বাধেনি। খুব হালকাভাবে অন্ধকারে ঠিক যতটা কারো অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়, কেবল ততটুকুই দেখা যাচ্ছে। শরীরটার পিছু পিছু আমিও এগোচ্ছি।
সানার ঘর পেরিয়ে সে বাগানের ছোট ফাঁকা জায়গাটাতে গিয়ে দাঁড়ালো।খুব সম্ভবত কেউ একজনকে জড়িয়ে ধরছে। ছোট সাইজের আরেকটা শরীর। তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়ার ভঙ্গি। সানার ঘরের পাশে এসে একেবারে চুপটি করে দাঁড়িয়ে রইলাম।
নারী অবয়বটি মুখ খুললো।
-আহা,কান্না করছো কেন?
আড়াল থেকে কেউ একজন কাঁদো কাঁদো স্বরে জবাব দিলো,
-তুমি শহরে নাই। আমি গিয়ে তোমাকে পাইনি। আমাকে তো জানিয়ে আসবে এখানে।
– আচ্ছা, কেঁদো না। আমি আছি তো। কাঁদে না মা।
এতক্ষণে কান্নার শব্দটা থেমে গেছে। আড়ালে সে কার সাথে কথা বলছে! খুঁজে পাচ্ছি না আর কাউকে। একবার যেন অস্তিত্বটা স্পষ্ট, আবার যেন অস্পষ্ট। বাচ্চা কন্ঠে কেউ যেন বললো,
-আর কতদিন লাগবে তোমার এইসব শেষ করতে?
-এইতো, শেষ হয়ে যাবে।
-তুমি ফ্ল্যাটে ফিরে যাও। এখানে আসার অনুমতি কিন্তু আমাদের নেই।
আরো বেশ কিছুক্ষণ আলাপের পর মনে হল কিছু যেন একটা প্রবল বাতাসের আলোড়ন করে দূরে কোথাও হারিয়ে গেল। আবছায়া নারীমূর্তিটা তখনো দাঁড়িয়ে আছে।
আমি চুপি চুপি ওর দিকে এগিয়ে গেলাম। সমস্যা আমার মধ্যে না। সেই ফ্ল্যাট থেকেই শুরু হয়েছে। আর সেটা এখান অব্দি টেনে এনেছি। তার পেছনের মূল কারণ নিশ্চয় এই নারীমূর্তি। একে হাতছাড়া করা যাবে না। ছায়াটা সুযোগ বুঝে কেটে পড়বে,সেই মুহুর্তে তার পোশাকের একটা অংশ খপ করে চেপে ধরলাম। ভয়ে সমস্ত শরীর আমার কাঁপছে। হাত যেন অবশ হয়ে আছে। তবু ছাড়লাম না।চোখ বন্ধ করে শক্ত হাতে তার পোশাকের অংশটুকু চেপে ধরে আছি।
প্রায় অনেকক্ষণ কেটে যাবার পরেও দেখি অপর পাশ থেকে কেবল ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করলো। কিন্তু আমাকে কোনোভাবেই আক্রমণই করছে না। ভয় ভয় দৃষ্টিতে সামান্য চোখ মেলে তাকিয়ে দেখতে পেলাম,সে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কেবল দুটো জ্বলজ্বলে চোখে আমার দিকে চেয়ে আছে। অদ্ভুত রকম দুটি চোখ। চেহারার বাকি অংশ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। গাঢ় অন্ধকার। সে যেন ক্ষীণ সুরে বলে উঠলো,
-কেন ঝামেলা করছো এভাবে আমাকে আটকে রেখে?
আমাকে সে কিনা প্রশ্ন করছে? একটা হালকা দৃশ্যমান অস্তিত্বের সাথে আমি কথা বলবো, ভাবতেই গা হিম হয়ে যাওয়া অবস্থা হওয়ার কথা। কিন্তু এই মুহুর্তে আমি আমার অনুভূতি বুঝে উঠতে পারছিলাম না। কম্পিত গলায় জবাব দিলাম,
-আপনার সাথে আমার কীসের ঝামেলা? কেন এভাবে শুধু শুধু আমার পিছে পড়ে আছেন? এতদিন আমি নিজেই নিজেকে মানসিক ভারসাম্যহীন পাগল মনে করা শুরু করছিলাম। আজ আমি নিশ্চিত, এই সব কিছুর পেছনের কারণটা আপনি। তাই না? আপনি চাইলেও অস্বীকার করতে পারবেন না।
-আমি তোমার পিছে পড়ে থাকবো কেন? আমাদের তো একসাথেই থাকার কথা। তুমি ছাড়া এখানে আমার কেইবা আছে। সবসময় তোমার সাহায্য ছাড়া আবার চলা যায় নাকি?
– এখানে বলতে? কে আপনি! আর কেনোই বা এখানে এসেছেন। জবাব না দিয়ে আপনি আমার থেকে ছাড় পাবেন না। অনেক হয়েছে। এবার হয় আপনি থাকবেন নয়তো আমি।
সাহস করে কথাগুলো আমি বলছি বটে,কিন্তু ভিতরে ভিতরে অনুভব হচ্ছে -এক্ষুণি যেন অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাবো। হাত যে তখনও কাঁপছে, খুব সম্ভবত সেও টের পেয়েছে। অদ্ভুত এক অট্টহাসিতে আশেপাশের বাতাস ভারি করে তুললো। অথচ বাড়ির কেউই তো জেগে উঠলো না। প্রায় বেশ কিছুক্ষণ পর হাসি থামিয়ে সে বললো,
– তুমি তো বেশ ভয় পাচ্ছো। যাও, নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়। এভাবে ভয় পেতে থাকলে তো মরেই যাবে। নিজের কাজে মন দাও। এত বেশি ভাবলে লোকে পাগল বলবে। আমার কাজ শেষে আমিই ফিরে যাবো। তোমাকে কষ্ট করে আমাকে জানার কী এত প্রয়োজন?
-খবরদার আমাকে আর একটাও যুক্তি দেখাবে না। সোজাসাপ্টা জবাব দাও। নয়তো তোমাকে আমি খুন করে ফেলবো।
-করো দেখি।
এই বলে সে আমার আরো একটু কাছে এগিয়ে এল। খুব, খুব কাছে। তবু তার চেহারা স্পষ্ট দেখা যায় না। কেবলই অদৃশ্য আবছা আবছা একটা ছায়ামূর্তির মতোই কিছু। ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললাম। নিশ্বাস যেন থেমে যাচ্ছে। আমার মাথার উপর যেন কারো কোমল হাতের স্পর্শ হলো। আমি কোথায় জানি হারিয়ে যাচ্ছি। দূরে, অনেক দূরে। সাদা মেঘের ভেলা,লোক লোকারণ্য ছেড়ে দূরের কোথাও। এরপর, এরপর আর কিছুই অনুভব করতে পারছি না।
চোখ মেলে তাকিয়ে দেখি টেবিলের উপর নাস্তা রেখে মা আমার দিকে চেয়ে আছেন। তার মানে সকাল হয়ে গেছে। সত্যি সকাল হয়ে গেছে? মায়ের দিকে শুধু সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালাম। মা বললেন,
-ভালো ঘুম হয়েছে?
-হুম।
-তাহলে নাস্তা করে রেডি হয়ে নিতে হবে তো। ডাক্তারের কাছে যেতে হবে, মনে আছে?
আমি কোনো জবাব দিলাম না। ডাক্তারের কথা শুনে কাল রাতের কথা মনে পড়ে গেল। আমি তো বাইরে ছিলাম। একটা আবছায়া ছায়ামূর্তির সাথে। বিছানায় কী করে এলাম? তবে কী সেই আমাকে রেখে গেছে? আমার প্রতি তার এত যত্ন? আমাকে যত্ন করার কারণ কী? হ্যাঁ, এতদিনে সে কখনোই আমার কোনো ক্ষতি করার চেষ্টা করেনি। কিছু তো একটা রহস আছে অবশ্যই। আমাকে এখন সেই রহস্য খুঁজে বের করতেই হবে। যেহেতু সে আমার ক্ষতি কখনো করেনি, করবে বলেও মনে হয়না। এটাই আমার জন্য বোনাস পয়েন্ট।
বিছানা ছেড়ে মায়ের পিছু পিছু উঠে এলাম। মা তখন সানার সাথে কী যেন আলাপে ব্যস্ত। আমাকে দেখেই সানা ভয় পেয়ে গেল। একপাশে সরে দাঁড়িয়ে আমাকে জায়গা করে দিলো। ওর দিকে একপলক চেয়ে মাকে বললাম,
-মা, এখানকার ডাক্তারের চেয়ে আমি শহরে গিয়ে চেকাপ করাই। তুমি চিন্তা কোরো না তো। আমি আজই রওনা দেবো।
মা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,
-আজ?
– হ্যাঁ, তোমার দুশ্চিন্তা তো দূর করি।
অনেকটা দোটানার মধ্য থেকেই মা আমাকে ছাড়তে রাজি হলেন। আসলে ডাক্তারি চেকাপ করানোর কোনো উদ্দেশ্যই আমার নেই। এইসব রহস্যের সমাধান লুকিয়ে আছে আমার ফ্ল্যাটে। ওখানেই আমাকে ফিরতে হবে। মায়ের সাথে কথা শেষ করে সানার সামনে এসে বসলাম। সানা মাথা নিচু করে আছে। ওকে কোলের মধ্যে চেপে ধরে কপালে চুমু দিয়ে বললাম,
-আমার উপর এখনো রাগ করে আছিস?
সানা বলল,
-রাগ নয় তো, ভয়। তুমি বলেছো,আমার নাকি লম্বা লম্বা হাত।আমি ব্লাক ম্যাজিক শিখেছি।
-না রে। ওটা এমনি তোকে দুষ্টুমি করে বলেছিলাম। দেখলাম, তোর ভয় আছে কিনা। এবার আপুকে ক্ষমা করা যায় না?
সানা সামান্য মৃদু হেসে ফেললো। ওকে কোলে নিয়েই রুমে ফিরে নিজের ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিলাম। তারপর সকাল সাড়ে দশটার ট্রেন ধরে সোজা আমার গন্তব্যে।
স্টেশনে যখন পৌঁছালাম, সন্ধ্যা পার হয়ে রাত ছুঁই ছুৃই সময়। অনেকক্ষণ রিক্সার জন্য অপেক্ষা করেও একটাও রিক্সা পাচ্ছি না। আরো প্রায় দশ পনেরো মিনিট পর একজন রিক্সাচালক নিজেই এগিয়ে এসে আমাকে বলল,
-যাবেন না?
-হুম, যাবো বলেই তো রিক্সার জন্য অপেক্ষা করছি।
রিক্সাচালক নিজেই আমার কাছ থেকে ব্যাগপত্র নিয়ে রিক্সায় তুলে নিলো। আমিও চুপচাপ উঠে বসেছি। আমার ফ্ল্যাটে পৌঁছাতে রিক্সায় প্রায় আধা ঘন্টা সময় লাগবে। আনমনে চারপাশে চেয়ে বসে আছি। শহর জুড়ে আলো আঁধারের খেলা শুরু হয়েছে। সন্ধ্যার পর এই এক অন্যরকম পরিবেশ তৈরি হয় প্রতিটা শহরেই।
হঠাৎ একটা হাসপাতালের সামনের মোড়ে যেন রিদমকে দেখতে পেলাম। রিদম! হ্যাঁ, রিদমই তো। রিদম এখানে? বিশ্বাস হচ্ছে না আমার। চিৎকার করে রিক্সাতে বসেই ওর নাম ধরে ডাকলাম,”রিদম, এই রিদম…”
(চলবে…)