হঠাৎ অদ্ভুতুড়ে পর্ব-০৮

0
1984

#হঠাৎ_অদ্ভুতুড়ে(পর্বঃ-৮)
লিখাঃ-সুহাসিনী

হঠাৎ একটা হাসপাতালের সামনের মোড়ে যেন রিদমকে দেখতে পেলাম। রিদম! হ্যাঁ, রিদমই তো। রিদম এখানে? বিশ্বাস হচ্ছে না আমার। চিৎকার করে রিক্সাতে বসেই ওর নাম ধরে ডাকলাম,”রিদম, এই রিদম…”

রিদমের কানে আমার আওয়াজ যেন পৌঁছালো না। সে আপন মনেই রাস্তার পাশ দিয়ে হেঁটে চলেছে। আবার জোরে চিৎকার দিয়ে ডাক দিলাম, “রিদম, এই রিদম, আমার কথা শোনো..”।

ছেলেটা একবার যেন থমকে দাঁড়ালো। কিন্তু কোনোদিকেই তাকালো না। মাথা নিচু করে ক্ষণিক সময় স্থির দাঁড়িয়ে রইলো শুধু। ওটা যদি সত্যি রিদম হয়, ওর সাথে আমার কথা বলাটা জরুরি। ভীষণ জরুরি। অগত্যা রিক্সাচালককে থামতে বলতে হলো।
-মামা, এখান থামুন তো। স্কাই হাসপাতালের সামনে আমাকে নামিয়ে দিন।

রিক্সাওয়ালা আমার কথায় কর্ণপাত করলো না। নিজের মন মতো রিক্সা চালিয়ে চলছে। অদ্ভুত তো! আমি তাকে এতটাও মৃদু স্বরে ডাকিনি যে, সে শুনতে পায়নি। অথচ এমন উদাসীন ভাব কেন দেখাচ্ছে? গলার আওয়াজ আরো একটু বাড়িয়ে বললাম,
-মামা, রিক্সাটা থামান।

রিক্সাচালক আমার দিকে ফিরে তাকালেন না। একবার স্কাই হাসপাতালের দিকে চেয়ে রিক্সায় প্যাডেল করতে করতে বললেন,
-রিক্সা থামানো যাবে না। আপনার রিদম না কি যেন বন্ধু, তাকে আপনি এখানে কোথায় পাবেন?

লোকটার কথায় আবার হাসপাতালের দিকে ফিরে তাকালাম। কোথায় রিদম! একটু আগেই তো দেখলাম ওকে। আচ্ছা, ও যে আমার বন্ধু-এটা এই রিক্সাচালক কীভাবে জানলো? সন্দেহ হচ্ছে, ভারি সন্দেহ। ধমক দিয়ে বলে উঠলাম,
-কে আপনি? রিক্সা থামাচ্ছেন না কেন? এই মুহুর্তে থামান বলছি। নয়তো আমি লাফ নিয়ে নেমে যাবো।

রিক্সা থেমে গেল। চালক নির্বাক। ব্যাগটা রিক্সা থেকে নামিয়ে আবার জিজ্ঞাসা করলাম,
-কে আপনি?

-আমি তো রিক্সাচালক। আপনাকে ফ্ল্যাটে পৌঁছে দিচ্ছিলাম।

-লাগবে না আমাকে পৌঁছে দেওয়ার। মানে মানে এখান থেকে কেড়ে পড়ুন। কত টাকা ভাড়া দেওয়া লাগবে?

লোকটা একবার আমার দিকে গভীর পর্যবেক্ষণ করে নিল। তারপর রিক্সায় প্যাডেল করে দ্রুত চলে গেল। ভাড়াটা পর্যন্ত নেয়নি। বেশ কয়েকবার পিছন থেকে ডাকা সত্ত্বেও আর ফিরে তাকালেন। ভারি অদ্ভুত আর ত্যাড়া মানুষ তো। লোকটার থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে স্কাই হাসপাতালের সামনে এসে দাঁড়ালাম। একটু আগে রিদমকে এখানেই তো দেখেছিলাম। আমার চোখ রিদমকে চিনতে ভুল করবে না কখনোই। হাসপাতালের এপাশ ওপাশ হেঁটে বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়েই ওকে খুঁজলাম অবশ্য। কিন্তু কোথাও সে নেই। এমনটা হবার কথা তো নয়। আর রিদম আমার ডাক শুনতে পায়নি? এটাও আমাকে মেনে নিতে হবে?

কি মনে হলো হাসপাতালের ভিতর ঢুকে গেলাম। লোকজন পায়চারি করছে। এখানে কী রিদমকে পাওয়া সম্ভব? অনেক খুঁজলাম। কিন্তু কই রিদম? হয়তো আমার মনের ভুল। ত্রাত্রি তো বলেছিলো, রিদম মারা গেছে। সেই তাকেই আবার কেন খুঁজছি আমি!
হতাশ হয়ে হাসপাতাল থেকে বের হবো, ঠিক সেই মুহুর্তে চোখে পড়লো চিরচেনা সেই মানুষটাকে। রিদম! বাম চোয়ালে ব্যান্ডেজ পট্টি দেওয়া। হাতে পায়েও ব্যান্ডেজ।
“রিদম” বলে ডাক দিয়ে ওর কাছে ছুটে গেলাম। এতক্ষণে আমার কথা সে শুনতে পেয়েছে। আমার ডাক শুনেই ফিরে তাকালো। শরীরের অনেক জায়গায় আঘাতের চিহ্ন। দূর থেকেও দেখেছিলাম। কিন্ত এতখানি আঘাত! সবচেয়ে ভয়ংকর সত্যি হলো- রিদম বেঁচে আছে। আমাকে দেখতে পেয়েই ও বললো,
– কেমন আছো তুমি? তোমার কোনো ক্ষতি হয়নি তো?

খুব কান্না পাচ্ছে ওর কথা শুনে। নিজের এই অবস্থায় আমার খোঁজ নিতেও ভোলেনি। কাঁদো কাঁদো স্বরে বললাম,
-তুমি বেঁচে আছো?

-হুম।

-কিন্তু…

রিদম হাসলো একবার। তারপর ব্যান্ডেজের একটা অংশ ঠিক করতে করতে বললো,
-চিন্তা কোরো না। এখন বেশ আছি আমি। কীভাবে বেঁচে আছি, সে ইতিহাস জানি না। সেদিন ত্রাত্রির বিছানায় বসার পর যেন মনে হলো, কেউ আমার উপর ভয়ংকরভাবে আক্রমণ করলো। কিছু বুঝে উঠার আগেই শরীরের এখানে ওখানে আঘাত। তারপর কখন জানি জ্ঞান হারালাম। যখন জ্ঞান ফিরলো, টের পেলাম- কেউ যেন আমার বেঁচে থাকার কথা জেনে গেছিলো। আমাকে মারার প্ল্যানিং করছিলো। সুযোগ বুঝে গাড়ি থেকে চুপিচুপি নেমে গেলাম। এরপর হাসপাতালে। রক্ত দিতে হয়েছে বোধহয়। তোমার সাথে দেখা করার অনেক চেষ্টা করেছি। পারিনি। একটু আগেও হাসপাতাল থেকে বের হতে গেছিলাম।

রিদমের কথায় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। ভাগ্যিস, আঘাতের দরুন কেবল রক্ত বের হয়েছিলো। এই ছেলেটার লাশ গুম করার জন্য আমি ত্রাত্রি আর ফাইজা আপুর সঙ্গ দিলাম? ওরাও কীভাবে রাজি হলো.! রিদমকে বললাম,
-আমি তোমাকে মৃত ভেবে লাশটা অব্দি…

রিদম আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠলো,
– ওসব কথা বাদ দাও। এমন অবস্থায় কী ভাবতে পারবে বা ভেবেছিলে, ওসব নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। তবে তোমার রুমে কোন আত্মা বসবাস করে। হতেও পারে সেটা কোনো ভৌতিক বিষয়। এর সমাধান কীভাবে করবে?

-সমস্যা আমার থেকে শুরু, তাই আমাকেই সমাধান করতে হবে। আমি জানি, এই রহস্যের শেষ কোথায় আর কীভাবে সম্ভব। নিজের যত্ন নিও। আমি বরং ফ্ল্যাটে ফিরে যাই।

-তোমাকে আমি ওই ভয়ংকর ফ্ল্যাটে ফিরে যেতে দিতে পারি না। আমার অবস্থা দেখছো না? মরতে মরতে বেঁচে গেছি।

-চিন্তা কোরো না। আমার কিছু হবে না। আর ত্রাত্রি এবং ফাইজা আপু তো আছেনই।

রিদম আমাকে ছাড়তে চাইছে না। কিন্তু ফ্ল্যাটে আমাকে ফিরতে হবেই। ওকে অনেকক্ষণ বুঝিয়ে শুনিয়ে আশ্বস্ত করে মার্কেটের দিকে এলাম। খুঁজে খুঁজে লাল টকটকে রঙের দারুণ কিছু কাচের চুড়ি নিলাম। তারপর ফিরে এলাম ফ্ল্যাটে।

কলিংবেল চাপতেই ত্রাত্রি দরজা খুলে দিলো। আমাকে দেখে রীতিমতো অবাক। আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠলো-
-মহারানি তো এত দ্রুত বাসা থেকে আসার মেয়ে নও। কী ব্যাপার? আসার আগে আমাকে জানাতে পারলি না? গিয়ে নিয়ে আসতাম।

-সমস্যা নেই। আমি একা চলতে পারি। একা একা কত ভয়ংকর জীবনের মুখোমুখি হলাম। ক্ষতি হয়েছে আমার? আর মরে গেলে, মরলাম। ওসব নিয়ে ভাবিস না।

আমার কথায় ত্রাত্রি দারুণভাবে আহত হলো যেন। মুখ ভার করে দরজার পাশ থেকে সরে দাঁড়িয়ে বলল,
-শুধু উলটাপালটা কথা।

ফাইজা আপুর রুমের দিকে একপলক চেয়ে নিলাম। দরজা বন্ধ করে গুনগুন করে পড়াশোনা করছেন। এ জীবনে বয়স শেষ হলেও বোধহয় চাকরি আর হবে না। বেচারি! আমাদের রুমে ঢুকতে ঢুকতে ত্রাত্রিকে বললাম,
-এই দুইদিন ফ্ল্যাটে কোনো সমস্যা হয়নি?

ও মাথা দুলালো। তারপর বললো,
-না তো। তেমন কিছুই হয়নি। তবে আমার কালো রঙের কানের দুলজোড়া খুঁজে পাচ্ছি না। মনে হয়, কেউ চুরি করে নিয়েছে।

-আশা করি খুব শিঘ্রই সেই চোর ধরতে পারবো। চিন্তা করিস না।

ত্রাত্রি অবাক হয়ে তাকালো। খুব সম্ভবত আমার কথা ওর বিশ্বাস হচ্ছে না। তাই টপিক পালটে জিজ্ঞাসা করলাম,
-ফ্ল্যাটের বাকি সবাই কবে আসতে পারে?

-জানি না। আগামী দুই এক মাসে আর আসবে না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান লকডাউন চলছে তো। আমার এখানে ওটি ক্লাস না থাকলে আমিও বাসায় থাকতাম।

-তোর বাসায় তো নিয়েও গেলি না আমায়।

– সত্যি কী তুই যাবি?

ত্রাত্রির কথায় জবাব দিলাম না। ব্যাগ থেকে জামাকাপড় বের করে র‍্যাকে গুছিয়ে রাখলাম। ফাইজা আপুও এই ফাঁকে একবার এসেছেন। মনে মনে অনেক হিসাব কষছি। আমার কী ওদের সাথে কথাগুলো শেয়ার করা উচিত হবে? নাহ, দেওয়ালেরও কান আছে। ওদের কাছে বলতে গিয়ে যদি সেই অদ্ভুত অশরীরীটা টের পেয়ে যায়? তবে তো সব শেষ। যা করার, একা একা মনে মনেই করতে হবে।

রাতে ঘুমের আগে ব্যাগ থেকে কাচের চুড়িগুলো বের করে একবার পরেছিলাম। রিনিঝিনি আওয়াজ। চুড়িগুলো আবার হাত থেকে খুলে টেবিলের উপর রেখে দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। ঠিক ঘুমানোর চেষ্টা নয়, ঘুমের ভান করছি। বাকিসব মনে মনে কৌশলে ম্যানেজ করে রেখেছি আগেই।

অনেক রাত। অপেক্ষা করতে করতে কখন জানি ঘুমের ঘোর এসে গেলো। এমন সময় সেদিন রাতের মতো আবার সেই রিনিঝিনি আওয়াজ। কেউ একজন চুড়িগুলো তুলে নিচ্ছে।

(চলবে…)