হলদে প্রজাপতি পর্ব-৩৪+৩৫

0
249

#হলদে_প্রজাপতি
(প্রাপ্তমনস্কদের জন্য )
— অমৃতা শংকর ব্যানার্জি ©®

চৌত্রিশ

মাস তিনেক হয়ে গেল বাবা-মা আমার কাছেই আছে ।
সেই কোন নরম ভোরে মৌটুসী পাখিগুলো যখন অশান্ত লেজ নাড়াতে নাড়াতে ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে ওড়াউড়ি করে , সেই তখন আমরা বাপ-বেটিতে মিলে প্রতিদিন প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে ষড়যন্ত্র করতে বেরোই। মানব সভ্যতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র । কল-কারখানা , টেকনোলজির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র । সব রকমের ষড়যন্ত্র । মানুষের বিরুদ্ধে যা যা করা যায়। আমরা তখন ভুলে যাই, আমরাও ‘মানুষ’ । মনে হয় যেন , প্রকৃতি পরিবেশের বিরুদ্ধে মানুষের মত ষড়যন্ত্র আর কেউ করেনি । আমরা তাই চুপি চুপি, আলগোছে প্রতিদিন সেই ষড়যন্ত্র ভেঙে ফেলার নতুন ষড়যন্ত্র করি।

এখন বর্ষাকাল । ভরা বাদর পেরিয়ে এসে কাটছাঁট হয়েছে তার আয়ুকাল । প্রকৃতির এই এক মজা , সে প্রতি বছর নিজের রূপ , রস , গন্ধ, যৌবন , নতুন করে সাজিয়ে গুছিয়ে নেয়। পৃথিবীর অবলা জীবদের মত বছর বছর বুড়িয়ে ওঠেনা । তাই প্রকৃতি চিরযৌবনা । যেমন বয়সন্ধিকাল আসে একটি মেয়ের জীবনে তাকে পূর্ণ নারী রূপে গড়ে তুলতে, তেমনই বর্ষাকাল আসে প্রকৃতিকে যুবতীর সাজে সাজিয়ে তুলতে । আকাশ মুখ ভার করে না থাকলে, প্রতিদিন আমরা প্রকৃতির সেই যুবতীর সাজ দেখতে বেরিয়ে পড়ি । প্রথম আলো ফোটা ভোরে । টিয়া পাখির একটা সবুজ ঝাঁক প্রতিদিন দক্ষিণ থেকে উত্তরের দিকে উড়ে যায়। তখন ঠিক সাতটা বাজে। হারানদা যখন নিচু হয়ে ঝুঁকে প্রতিটা গাছের হলদে হয়ে যাওয়া পাতাগুলো পরম যত্নে আঙুলের ভাঁজে ছিঁড়ে ছিঁড়ে জড়ো করে, আমরা বাপ-বেটি তখন ফিরে আসি। টগর লনে দিয়ে যায় দুটো চেয়ার , সাথে চা-টেবিল। তিন কাপ চা আসে । আমারটা সাদা, বাবার আর হারাণদার লাল। মা কখনো কখনো ইচ্ছে হলে আমাদের সাথে এসে বসে । সোঁদা মাটির গন্ধে ভিজে একসাথে সবুজের মধ্যে ডুবে বসে থেকে আমরা গরম পানিয়র কাপে চুমুক দিই ।

ইতিমধ্যে বাবার সঙ্গে আমার চা বাগানের শ্রমিকদের ভাবসাব হয়েছে । মেয়েরা কেউ কেউ ছোট ছোট দলে কাজ সেরে বাড়ি ফিরে যাওয়ার আগে আমার বাংলোর চত্বরের মধ্যে ঢুকে, লনে উবু হয়ে বসে বাবার সঙ্গে গপ্পোসপ্পো করে যায়। আমি ঠিক যেমনটা চেয়েছিলাম, অথচ পেরে উঠিনি । একটা অদৃশ্য পর্দা নেমে আসত। বাবা কিভাবে এইটুকু সময়ের মধ্যে তা করে ফেলেছে । ওদের মতে, বুঢ়াবাবু মান্যি মানুষ। কথা কয়, বেশ লাগে, বোঝেন নি ? কার ছেলের জ্বর হয়েছে, কার ঘরের ঘরের চাল বর্ষার জল পেয়ে পচে উঠেছে, কার গরু বাচ্চা দিয়েছে, এইসব খবরাখবর দিয়ে ওরা বাবার কাছে শুনতে চায় , কলকেতায় পায়রার খুপড়ির মতো পিঠের ওপর চাপানো ঘরগুলোতে দাওয়া’ই যদি নেই, কচি ছোঁড়াছুঁড়িরা খেলে কোথায় ? ভিজে জামাকাপড়ই বা কোথায় শুকুত’ দেওয়া হয় শাওন-ভাদর দিনে , এইসব । ওদের মতে, গোবর দিয়ে তকতকে করে নেকানো একটা উঠান না থাকলে সে ঘর আবার ঘর নাকি ? আবার কখনো উৎসুক দুচোখ মেলে জানতে চায়, চান্দ-সদাগরের কথাটা আবার কইবেন ? আপনার মুখে বড্ড মানায় । অবশ্য বাবার কাছে গল্প শোনার সবচেয়ে বেশি আবদার করে পাতা। আস্ত ঠাকুরদার ঝুলি পেয়েছে ও একটা ।

তিনদিন ধরে একটানা বৃষ্টি হলো । নিম্নচাপের বৃষ্টি । এক টানা বৃষ্টিতে মনে মেঘ জমে। আমার জমে । আর কার কি হয় জানিনা । খারাপ ওয়েদারের জন্যই ঠান্ডা লেগে হল কিনা জানিনা, বাবার হঠাৎ করে একদিন জ্বর এলো । সর্দি, কাশি , জ্বর । প্রথমে ভেবেছিলাম সেরে যাবে । তারপর দেখলাম, দুটো দিন কেটে গেল, অথচ সারার লক্ষণ নেই। চিন্তা হলো। ইন্দ্রাশিষ বাবু বাড়িতে এসে বাবাকে দেখে ওষুধ দিয়ে গেলেন। দিন সাতেক জ্বর থাকলো । তারপর সেরে উঠলেও, শারীরিক দুর্বলতাটুকু বাবার রয়েই গেল । কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করলেই হাঁপিয়ে ওঠে । একটানা বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারে না । খাওয়া-দাওয়াও কমে গেছে । মাঝেমাঝেই বড় করে শ্বাস নেয় । ভালো লাগছিলো না বাবাকে এভাবে দেখতে। মা, আমি, দুজনেই চাইছিলাম কলকাতায় গিয়ে ডাক্তার দেখাতে । কিন্তু , বাবা যেতে রাজি নয়। বলছে, জ্বর তো সেরে গেছে । যেটুকু যা উইটনেস রয়েছে, আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে । তার জন্য ছোটাছুটি করা দরকার নেই । আসল কথা যেটুকু আমি বুঝেছিলাম, ডাক্তার দেখানোর ব্যাপারে কলকাতার দিকে একবার চলে গেলে বাবা বুঝেছিল, আবার এদিকে কবে আসা হবে তার ঠিক নেই। বাবা আসলে এখান থেকে যেতে চাইছিল না । বুঝেছিলাম সেটা। জোর করিনি আর । ইন্দ্রাশিষ বাবু দু-তিন দিন অন্তর অন্তর ঠিক একবার সময় করে বাবাকে এসে দেখে যেতেন। বাবা আজকাল আর মর্নিং ওয়াকে বের হতে পারে না । জবা , মালতি, লক্ষী , সন্ধ্যা, ছায়া’রা এসে নিজেরাই খানিক গল্প করে চলে যায়। বাবা ওদের সাথে খুব বেশি কথা বলতে পারে না । পাতার জন্য বরাদ্দ গল্পেও আজকাল টান পড়েছে। সারাদিনে আধখানা । পরের দিন বাকিটা। তবে ইন্দ্রাশিষ বাবু বাবার সাথে দেখা করতে এলে বাবা খুব আন্তরিকতার সঙ্গে কথা বলে। শুধু আন্তরিকতা নয়, কোথায় যেন কি একটা আগ্রহ মিশে থাকে। আমি বুঝতে পারি। উনি পারেন কিনা জানিনা । মাঝে মাঝে আমাকে যেন ইন্দ্রাশিষ বাবুর ব্যাপারে কিছু একটা বলতে চায় বাবা । তবে এখনো কিছু বলেনি ।

একরকম স্রোতে চলে এসেছিল জীবনটা। ভাবতে শুরু করেছিলাম, এখানেই রেখে দেবো বাবা-মাকে । কিন্তু এখন আর তা ভাবার ভরসা পাচ্ছি না । মানুষ নিশ্চিন্তে কয়েকটা পা’ চলতে পারলেই ভাবে এমনি নিশ্চিন্তেই বুঝি জীবনটা কাটবে । হঠাৎ ছোট-বড় ঝাঁকুনিতে জীবন সে ভুল ভেঙে দেয় । সপ্তাহ তিনেক কেটে গেছে । এখনো বাবার পুরনো ছন্দে ফেরা হয়নি। সেপ্টেম্বর মাস চলছে। সামনের মাসে পুজো । বাবা বলেছে , এবার পুজোয় এখানেই কাটাবে । বেশ কিছুটা দূরে একটা বসতি আছে । সেখানে ছোট্ট করে দুর্গাপুজো হয়। জানিনা এখানে পুজোয় কেমন লাগবে । বাবার মাঝেমধ্যে অদ্ভুত খেয়াল চাপে বটে ।

একদিন সন্ধ্যাবেলায় আমায় বলল, কালকে মর্নিং ওয়াকে বেরোবো , বুঝলি ? সারাদিন মনটা ফ্রেশ থাকে।
— তুমি বেরোতে পারবে বাবা ? বেশিক্ষণ তো একনাগাড়ে হাঁটতে পারো না।
— যেটুকু পারবো , সেটুকুই হাঁটবো । তবে বেরোবো ।
ভালো লাগলো শুনে। মনে ভাবলাম , নিশ্চয়ই বাবা কিছুটা বেটার ফিল করছে । পরের দিন সকালে, মাঝে বেশ কিছুদিন বিরতির পর আবার বেরোলাম আমরা। তবে বাবা বেশিক্ষণ হাঁটতে পারল না। মিনিট পনেরো পরেই গুটি গুটি পায়ে ফিরে এলো। তবে ঘরে ঢুকলো না । ফেরার রাস্তায়, বাড়ির অল্প দূরে একটা শেড ট্রির নিচে বাঁশের তৈরি বেঞ্চের মতো করা আছে। সেখানে বসে পড়ল। আমিও বসলাম বাবার পাশে । কেমন যেন মনে হচ্ছে , কি একটা বলতে চায় বাবা ।

কিছুক্ষন পর বলল , তুই তোর জীবনটাকে নিয়ে কি ভাবছিস?
— কি ভাবছি ?
— হ্যাঁ আজ যেভাবে চলছে , সারাটা জীবন কিন্তু সেভাবে কাটবে না ।
— তাহলে কিভাবে কাটবে?
— একদিন আমিও থাকব না , তোর মা’ও না । সেদিন তুই একা হয়ে যাবি।
— এসব কথা এখন কেন বাবা ?
— বলতে হবে । এখনই হাই টাইম।
আমি চুপ করে রইলাম ।
বাবাও বেশ কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বলল,
— জেনারেলি মেয়েদের যে বয়সে বিয়ে হয় , সেই বয়সটা তোর অনেকদিন পেরিয়ে এসেছে। আমি তোকে বিয়ের জন্য রাজি করাতে পারতাম, বিয়ে দিতে পারতাম ইচ্ছে করলে।
এই কটা কথা বলে বাবা আবার চুপ করে গেল।
কিছুক্ষণ পর বলল,
— সব বাবা-মা’ই তার মেয়ের বিয়ের জন্য মনে মনে একটা টেনশনে ভোগে । চাপা চিন্তা। আমারও হয়েছে । আমি জানি, আমি যদি তখন তোকে জোর দিয়ে বলতাম , তুই বিয়ে করছিস । কিন্তু তোর বিয়ের সম্বন্ধ করতে গিয়ে সত্যি কথা বলতে কি, আমি এমন একজন ছেলেকেও দেখিনি , যাকে দেখে মনে হয়েছে, তুই অনিচ্ছায় জোর করে বিয়ে করলেও, বিয়ে করার পরে ভালো থাকবি।
আবার চুপ করে গেল বাবা ।
বেশ কিছুক্ষন পর বলল ,
— বিয়ে মানে একচুয়ালি কি জানিস ? এডজাস্টমেন্ট । এটা থাকতেই হবে । ভালোবাসা, বিশ্বাস, আর যা-ই থাকুক, তার সাথে জানবি এডজাস্টমেন্ট মাস্ট । তোর মার সাথে আমার মতের মিল হয়েছে খুব কম জায়গায় । এডজাস্টমেন্ট। সেটাই করেছি।
আবার চুপ করে গেল বাবা ।
আমি কিছুক্ষণ পর বললাম , তুমি কি আমাকে কিছু বলতে চাইছ বাবা ?
একটা ছোট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাবা বলল ,
— আজকাল মনে হয়, তোর বিয়ে দেওয়ার সময় জোর করেই বিয়েটা দেওয়া উচিত ছিল । বাবা হয়ে সেটা আমার কর্তব্য ছিল । আমি সেটা করিনি । তোর ওপরে কোনো দিনই কি জোর করে চাপিয়ে দিয়েছি কিছু ? তবে এইটা মনে হয় চাপানো উচিত ছিল ।
অস্থির গলায় বললাম , এসব আজকে হঠাৎ করে কি বলছ বাবা ? যেখানে আমার নিজের মনকে জোর করে ঠেলে বিয়ের পিঁড়িতে নিয়ে গিয়ে ফেলতে হতো, সেটা বুঝি খুব ভালো হতো ? তার রেজাল্ট ?
— কাজে লাফ দিলে, তবে তো তার রেজাল্ট পাওয়া যেত। আমিও সেই ভাইটাল কাজটা করিনি , তোরও সেই রেজাল্টটা দেখার ইচ্ছে ছিল না ।
— কিন্তু, আজকে কেন হঠাৎ-
— না, হঠাৎ নয় । আজকে তো আর তোর অমত নেই মা-
চমকে বাবার মুখের দিকে তাকালাম,
— মানে !
— ইন্দ্রাশিষের সঙ্গে আজকে তোর যদি একটা বিয়ের কথা ওঠে , তোর কি তাতে অমত হবে ? নিশ্চয়ই হবে না । আমি জানি হবে না ।
এক ঝাঁক বাঁশপাতি সামনের ইলেকট্রিক তারটায় দোল দিয়ে এসে বসলো । সেগুলোর দিকে এক ঝলক তাকিয়ে নিয়ে চোখ নামালাম ।
বাবা বলল, বলি তাহলে ?
সারা শরীরে কেমন যেন বিদ্যুত খেলে গেলো ।
— মানে ! বাবা, কাকে কি বলার কথা বলছো তুমি ?
— ইন্দ্রাশিষকে । এক্ষেত্রে সরাসরিই বলতে হবে । তা ছাড়া উপায় নেই । অনেক ভেবেছি আমি । ওর মতটা না জেনে তো ওর মাকে গিয়ে বলা যায়না । সেভাবে প্রস্তাব করা যায় না।
আমি চমকে উঠে দাঁড়ালাম , এসব কি বলছ বাবা ! তিনি .. তাঁকে.. না না.. সেকি.. , তা কি করে হয়? তিনি তো তেমন কিছু-
— না বললেও আমি বুঝেছি । ওটুকু আমি বুঝতে পারি । তুই এক্সাইটেড হয়ে পরিস না । শান্ত হয়ে বোস । বেশ কিছুদিন ধরেই ভাবছি তোকে বলি কথাটা । আমি আসলে সারাজীবনে ভেবেছি অনেক বেশি, কাজ করেছি কম । সেই কারণেই শেষ জীবনে আজকে এসে এতোখানি দুঃশ্চিন্তা মাথায় করে বয়ে নিয়ে বেড়াতে হচ্ছে । কিন্তু আমি ঠিক বুঝেছি, তোদের দু’জনকেই বুঝেছি। এই প্রপোজাল উঠলে, তোদের দুজনের কারোরই কোন অমত থাকবে না।
অস্থির হয়ে উঠলাম ।
বললাম , কিন্তু বাবা তিনি তো তেমন কিছু কখনো-
আবার একটা ছোট দীর্ঘশ্বাস পড়ল বাবার।
— না , আমি বলছি না একেবারে যে আমার বোঝার ভুল হতে পারে না । হয়তো ইন্দ্রাশিষের অমত হতেও পারে । তাহলেও সেটা জানাটা প্রয়োজন । ব্যাপারটা ক্লিয়ার হয়ে যাওয়ার প্রয়োজন আছে।
— কেন প্রয়োজন , কিসের প্রয়োজন, সেটাইতো আমি বুঝতে পারছি না বাবা।
— প্রয়োজনটা হলো , তুই চাস ।
— আমি চাই !
থমকে রইলাম কিছুক্ষন ।
তারপর বললাম, এমনটা তোমার হঠাৎ কেন মনে হল বাবা?
বাবা এবার অল্প একটু হাসলো।
বলল , হঠাৎ মনে হয়েছে কে বলেছে তোকে ? তাহলে আমি এতগুলো দিন সময় নিতাম না এই কথাটা তোকে বলার জন্য ।
বাবার পাশে গিয়ে বসলাম । বাবা আমার শুকনো মুখটার দিকে একবার তাকে নিয়ে বলল , এটা আমাকে বলতেই হবে মা । তুই এটা নিয়ে চিন্তা করিস না । আমার ওপরে ছেড়ে দে ।
গলা শুকিয়ে এল আমার । বললাম, কিন্তু বাবা এরকম সাডেন প্রপোজাল – , তিনি যদি কিছু মাইন্ড করেন ? অসন্তুষ্ট হন ? তাহলে ?
— তাহলেও বলতে হবে। সেটাও জানা প্রয়োজন ।
— তেমনটা হলে তুমি কি ভীষণ ছোট হয়ে যাবে তাঁর কাছে।
— ছোট হয়ে যাওয়ার আমাদের এই সামাজিক ধ্যান-ধারণাগুলো ভুল । এগুলো ভেঙে আমরা বের হতে পারি না । তবে বেরোনো উচিত । আর পাঁচটা সিম্পল প্রপোজালের মতই এটাও একটা প্রপোজাল । এটাকেও আমাদের সিম্প্লি নিতে শিখতে হবে। যেকোনো প্রপোজালের যেমন ‘হ্যাঁ’ ‘না’ দুই আছে, বিয়ের প্রপোজালের ক্ষেত্রেও সেটা থাকতে পারে । তারমধ্যে অসম্মানের কিছু নেই। একটা বিয়ের প্রপোজাল ‘না’ করে দেওয়ার পেছনে হাজার একটা কারণ থাকতে পারে ।
আরো কিছু যেন বলতে যাচ্ছিল বাবা, কিন্তু হঠাৎ করেই চুপ করে গেল।
কিছুক্ষণ পর বলল, নাহ্ , চল বাড়িতে ফিরে যাই ।
আমার ভেতরের অস্থিরতাটা বাড়ছিল ।
বললাম , তুমি কি সত্যিই সেরকম কিছু বলবে বাবা তাঁকে?
— হ্যাঁ বলবো । শেষ জীবনে এসে জীবনের এই মস্ত বড় ভুলটা শোধরানোর এই একটা চান্সই আমি পেয়েছি। আর যে কখনো পাবোনা, তাও বুঝেছি । তোদের যদি সত্যিই বিয়েটা হয়, তুই খুব ভালো থাকবি মা।
বাবা ডান হাতটা বাড়িয়ে আমার মাথার পেছন থেকে রাখল ।
বলল, ইন্দ্রাশিষ সোনার টুকরো ছেলে । ওর মনটা বড় । হয়তো একটু খামখেয়ালি। রোগী দেখে বেড়ায় । কাজ-পাগল । কিন্তু আলটিমেটলি একটা গোল্ডেন হার্ট আছে । আর তোকে ও যথেষ্ট সম্মান করে । সেটা আমি দেখেছি ।

হাতটা আমার মাথার উপর থেকে সরিয়ে নিয়ে সামনের দিকে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে বাবা বলল,
— আমি কখনো বিশ্বাস করিনি একজন মানুষকে তার অমতে জোর করে বিয়ে দিয়ে তাকে ভবিষ্যতে সুখী দেখতে পাওয়া যায় । সে কারণেই তোকে কখনো ওই ব্যাপারে জোর করিনি । আজকেও হয়তো শুধু আমার একারই যদি ইন্দ্রাশিষকে ভালো লাগতো, বুঝতাম তুই পছন্দ করিস না , তাহলে জোর করতাম না । কিন্তু তা যখন নয়, তোর যখন ইন্দ্রাশিষকে পছন্দ, তখন এই ব্যাপারে সামনে এগোনোই যায় । না এগোলে সেটা অন্যায় হবে । জীবন সুযোগ বারবার দেয় না । একজন সত্যিকারের ভালো মানুষকে লাইফ পার্টনার হিসেবে পাওয়ার সুযোগ হয়তো জীবনে আর কখনো ফিরিয়ে দেবেনা। তোর সাথে কথা বলে নিলাম । একবার তোর মায়ের সঙ্গে কথা বলতে হবে । তারপর ইন্দ্রাশিষকে বলব । তারপরে তার মা’কে ।
— বাবা, তুমি কি ধরেই নিচ্ছ তিনি এ প্রস্তাবে রাজি হবেন ?
বাবা বেশ অন্তর্মুখী দৃষ্টিতে আমার চোখের দিকে তাকাল কয়েক সেকেন্ড ।
তারপর বলল , সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার ভয় পাস না । যে সম্পর্কগুলো জীবনে স্টে করার থাকে, সেগুলোতে সামনে এগিয়ে যেতেই হয় । সেগুলো কখনো ভাঙ্গে না ।

বাবার চোখের দিকে একবার চোখ তুলে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলাম । কেমন যেন মনে হলো চুরির দায়ে ধরা পড়েছি। সেই অনেক বছর আগের সম্পর্ক ভাঙা-পড়া, মন নিয়ে পুতুল-খেলা, খেলাঘরের রান্নাবাটি সংসার, মনে মনে মন-কলা – আরো কত কি ! সেদিন বাবার উঁচু মাথাটা আমার জন্য নুয়ে পড়েছিল । বড় চিন্তা হয় , সারাজীবনে আর যেন কখনো তেমন কিছু না করে ফেলি, যাতে করে আমার জন্য আবার বাবাকে কখনো সেরকম কোন পরিস্থিতিতে পড়তে হয় । ছোট-বড় যাই হোক , আমি যেখানে জড়িয়ে , আমার হিতাহিত যেখানে জড়িয়ে, শুধুমাত্র আমার জন্যে বাবার মাথা যেন হেঁট না হয় কখনো । আমার যেমন তেমন । তবে আজ থেকে অত বছর আগে বাবার সেই হেঁট হয়ে যাওয়া মাথাটা তুলে ধরতে পারি , এমন কোন দৃষ্টান্তমূলক কাজ তো করে উঠতে পারিনি । পরিচিতি , সন্মানও গড়ে তুলতে পারিনি । নিজের কাজেও তেমন কোন দলিল রাখিনি । তাই আর চাইনা । বাবার ছোট্ট কোনো অপমানের কারণও যেন নিজেকে না হতে হয় ।
ক্রমশ..

#হলদে_প্রজাপতি
(প্রাপ্তমনস্কদের জন্য )
— অমৃতা শংকর ব্যানার্জি ©®

পঁয়ত্রিশ

বাবা আমার সাথে য’বে ইন্দ্রাশিষ বাবুর সঙ্গে বিয়ের সম্বন্ধ করার ব্যাপারে কথা বলল, তারপরে একটা সপ্তাহ কেটে গেছে। এর মধ্যে বাবা মায়ের সঙ্গে কথা বলে নিয়েছে, আমি জানি । ইন্দ্রাশিষ বাবুকে নিজেই ফোন করে আমাদের বাড়িতে আসতে বলেছে গতকাল । আজকে বিকেলে উনি আসবেন বলেছেন । আমি যেহেতু সম্পূর্ণটাই জানি, আজকে আমাদের বিয়ের একটা প্রস্তাব উঠতে চলেছে, বাবা নিজে মুখে ইন্দ্রাশিষ বাবুকে তা বলবে, তাই সকাল থেকেই মনে মনে একটু টেন্স রয়েছি। সত্যি বলতে কি, গতকাল বাবা ওনাকে ফোন করার পর থেকেই সেই টেনশনটা মনের মধ্যে খচখচ করছে। কিসের টেনশন জানিনা । কোনো কারণে উনি যদি প্রপোজাল রিফিউজ করে দেন, তাতেই বা কি আমার? ওনাকে কি আমি ভালোবাসি? জীবনে কি আমার সোনুদার পরে আর কাউকে ভালোবাসা আদৌ সম্ভব ? জানিনা । তবে কিছু একটা অনুভূতি রয়েছে ওনার প্রতি । কোথাও যেন উনি স্পেশাল, সেটা আমি বুঝি । না হলে এই মানসিক চাপ হতো না। তবে কি পাতা’র কারণে হচ্ছে? পাতাকে কি আমি ভালোবেসে ফেলেছি ? সেটা সম্ভব। ওই মিষ্টি, খামখেয়ালি, দুরন্ত, মেয়েটা আজকে প্রায় দেড় বছর ধরে আমার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে। ও এই মাঝের ক’দিনও এসেছে আমার বাড়িতে । প্রায় রেগুলার। যেমন আসে । আমার চা বাগান থেকে বেশকিছু শুকিয়ে ঝরে পড়া চা গাছের বীজ সংগ্রহ করে রেখেছিল । সেগুলো দিয়ে ও আর টগর দুজনে মিলে কিভাবে যেন সুতোর মালা তৈরি করেছে । ঘুঙুরের ঝুমঝুমগুলো যেমন দড়িতে বাঁধা ঝোলে, তেমনই একটু মোটা সুতো দিয়ে ঝোলানো রয়েছে বীজগুলোকে। মালার মতো । আমাকে একটা বানিয়ে দিয়েছে । মাকেও একটা দিয়েছে । এও ওদের খেলনা বাটির সংসার । ক্রিয়েটিভিটি আছে । কেন জানিনা পাতার সঙ্গে আমার সম্পর্কে কোথায় যেন একটা অদৃশ্য পর্দা পড়েছে । সেই পর্দা সরিয়ে আমি ঠিক ওকে আগের চোখে দেখতে পারিনা। কিসের যেন একটা বাধা । হয়তো বাবা যে প্রপোজালটা ইন্দ্রাশিষ বাবুকে দিতে চলেছে , তার ওপর আমার আর পাতার সম্পর্কটা নির্ভর করছে, তাই হয়ে থাকবে । এই কটা দিন যতবার পাতার মুখের দিকে তাকিয়েছি , একটাই প্রশ্ন উঠে এসেছে – ও আমার কে হয় ?

আজকে শনিবার । বাবার ফোনটা পেয়ে উনি কালকে জানিয়েছিলেন, আজকে আসতে পারবেন কিনা ঠিক নেই । তবে চেষ্টা করবেন। সারাটা দিন বেশ অস্বস্তির মধ্যে কাটানোর পর, এখন সন্ধ্যে সাতটা বেজে গেছে । আজকে তাহলে নিশ্চয়ই তিনি আর সময় করতে পারলেন না । আসবেন বলে মনে হয় না । এমনটাই ভাবছিলাম । ছাদে অস্থিরভাবে পায়চারি করছিলাম। তবুও মাঝে মাঝে চোখ দুটো রাস্তার বাঁকে চলে যাচ্ছিল, যতদূর পর্যন্ত আলোয় দেখা যায়। হঠাৎ করেই দেখলাম, পরিচিত সেই ভটভট শব্দ তুলে তাঁর স্কুটার রাস্তার বাঁক গলে বেরিয়ে এলো । মনের মধ্যে কেমন যেন হুড়মুড়িয়ে ঝড় আরম্ভ হলো । স্কুটারটাকে দাঁড় করালেন তিনি গেটের সামনে । তারপর সোজা হেঁটে গেলেন দরজার দিকে । কলিংবেলের শব্দ শুনতে পেলাম । ছাদের ওপাশটায় সরে এসে কার্নিশের উপর হেলান দিয়ে ভূতের মত দাঁড়িয়ে রইলাম । হাতের তালু দুটো চিনচিনে একটা সূক্ষ্ম ভয়ের অনুভূতিতে ঘেমে উঠছে । কতক্ষণ সময় এভাবে কেটেছে জানিনা । বেশ কিছুক্ষণ পর সিঁড়িতে পায়ের আওয়াজ পেলাম । বাবা ছাদে উঠে আসছে । এ আমার আজন্ম পরিচিত পায়ের শব্দ । ভুল হওয়ার নয় । ছাদে উঠে এসে চারিদিকে তাকিয়ে আমাকে দেখতে পেয়ে আমার দিকে এগিয়ে এলো বাবা । মুখ সেভাবে দেখতে পেলাম না , তবে বাবার গলার স্বর শান্ত।
আমাকে বলল, একবার নিচে আয় মা। ইন্দ্রাশিষ তোর সঙ্গে একটু কথা বলতে চায় ।
দুরুদুরু বুকে বাবার মুখের দিকে তাকালাম । আলো ছিল না । বিশেষ কিছু এক্সপ্রেশন বুঝতে পারলাম না ।
আমি কোনো কথা না বলে চুপচাপ নিচে নেমে যাচ্ছিলাম ।
বাবা বলল, পোশাকটা চেঞ্জ করে যাস মা। অন্য একটা সালোয়ার, কি শাড়ি ।
একটা সালোয়ারই পরেছিলাম বটে , তবে সেটা নিতান্তই আটপৌরে। হামেশাই গায়ে গলিয়ে বসে থাকি।রঙ চটে গেছে। বুঝলাম এখানে একটা কনে দেখার মতোই হচ্ছে। হঠাৎ করে নিজের অজান্তেই ঠোঁটের কোণে একটা তীর্যক হাসি ফুটে উঠল । এই বুড়ো বয়সে এসে আবার নতুন করে কনে দেখার জন্য সেজেগুজে বসতে হবে নাকি ? কিন্তু আমার মধ্যে নতুন করে আর কি দেখবেন উনি? প্রায় দেড় বছর হয়ে গেল তো এই মুখটা দেখে আসছেন। সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসে নিজের ঘরে ঢুকলাম । ওয়ারড্রব খুলে একটা লেমন ইয়েলো সফট হ্যান্ডলুম বার করলাম । মাঝেমাঝেই শাড়ি পরি । শাড়ি পরে অফিসেও যাই। শাড়ির স্টক খুব মন্দ নেই আমার। তবে , একটা মানুষ, যে আমাকে প্রায় দেড় বছর ধরে দেখছে, আজ হঠাৎ করে তার সাথে একটা বিয়ের প্রপোজাল উঠেছে, তিনি কি বলেছেন বা কি ভাবছেন আমি জানিনা, এই অকেশানে কি শাড়ি পরা যায় সেটা একটা চিন্তার ব্যাপার। ঠিক কী রকমটা মানানসই হতে পারে এক্ষেত্রে। তবে, এই শাড়িটা আমার ভারী পছন্দের। শরীর জুড়ে পড়ে থাকে মাত্র, উপস্থিতি জানান দেওয়ার কোনো ব্যস্ততা নেই । শর্ট স্লীভ একটা নেবি ব্লু কালারের ব্লাউজের সাথে পরে ফেললাম শাড়িটা । অগোছালো চুলগুলোকে অগোছালোভাবেই ব্রাশ করে নিলাম । টিপ পরবো একটা? নাহ্ , থাক। দরকার নেই । একটা ছোট্ট লকেট ঝোলা সরু সোনার চেন পরলাম গলায় । দু কানে দুটো ছোট ছোট সোনার ট্যাপ থাকে । সেগুলোকে খুলে ছোট্ট ঝুমকো বসানো দুটো সোনার ফুল পরে নিলাম । আমার জীবনে এই অভিজ্ঞতা বেশ কিছু বার হয়েছে । পাত্রপক্ষ এসে বসে আছে , আমি সেজেগুজে গিয়ে বসেছি । কখনো তারা রিজেক্ট করে দিয়েছে, কখনো আবার তা না করলে শেষমেষ আমি করেছি । আজকে ঠিক কনে দেখা নয়, আবার কোথায় যেন সিমিলারিটি রয়েছে। জানিনা । সব এলোমেলো । জীবনটাই কি খুব কিছু গোছানো ছিল আমার কোনদিনই ? তা নয় । একবার আয়নার দিকে তাকিয়ে নিয়ে হালকা একটা লিপস্টিক অল্প ছোঁয়ালাম ঠোঁটে ।
ঠোঁটদুটো ঘষে নিয়ে নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে বললাম , মন্দ লাগছে না তরু তোকে । তুই যেমন, তোকে তেমনই লাগছে। তার চেয়ে খারাপ লাগেনি।

বারান্দার লাগোয়া সামনের দিকের ঘরটায় বসেছিলেন তিনি । ঘরে ঢোকার সময় অল্প দুলুনি অনুভব করলাম বৈকি। একঝলক লক্ষ্য করলাম , হালকা লেমন ইয়েলো কালারেরই চেককাটা একটি শার্ট পরেছেন তিনি। অদ্ভুত কান্ড ! আজকে আমাদের দুজনের ড্রেসের কালার কিভাবে ম্যাচিং হয়ে গেল ! এক ঝলক তাকিয়ে নিয়ে চোখ সরিয়ে আমি সামনের চেয়ারে গিয়ে বসলাম । ঘরে আর কেউ নেই । বুঝলাম , তিনি আলতো চোখে আমাকে দেখছেন। ময়ূরের পালকের মতো রংবেরঙের দৃষ্টি। সেই দৃষ্টির সামনে ছাতিম ফুলের গন্ধ মাখা লজ্জা ঘিরে ধরে । এ সেই দৃষ্টি , যা দেখে বোঝা যায় , যেকোন নারী বুঝতে পারে, সামনের পুরুষটি তাকে পছন্দ করছে । এপ্রিশিয়েট করছে । বুঝলাম , অন্যদিনের থেকে আজকে আমার এই সাজ-পোশাকের পারিপাট্য তাঁর নজর এড়ায়নি। কয়েক সেকেন্ড আমরা দুজনেই চুপ করে রইলাম ।
তারপরে তিনি অল্প একটু গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন ,
— বেশ লাগছে আপনাকে । বেশ অন্যরকম ।
আমি কি বলবো বুঝতে না পেরে তাঁর দিকে তাকিয়ে শুধু অল্প হাসলাম।
তিনি বললেন, কিছু কথা ছিল আপনার সাথে । এখানেই বলবেন, নাকি অন্য কোথাও ? আপনি চাইলে ছাদে যাওয়া যেতে পারে ।
আমি তাঁর দিকে সরাসরি না তাকিয়েই বললাম , বেশ তো ! ছাদে চলুন ।
— আসুন তবে ।
উঠে দাঁড়ালেন তিনি ।
আমিও নিঃশব্দে উঠে দাঁড়ালাম।

ছাদে এলাম দুজনে । বাংলোর সামনের দিকে যেখানে আলো রয়েছে , সেই দিকটায় কার্নিশে ঠেস দিয়ে দুজনে দাঁড়ালাম । এই ধরনের কথাবার্তার ক্ষেত্রে কথার থেকে মুখ দেখা বেশি প্রয়োজন । ফেসিয়াল এক্সপ্রেশনস মিস করলে চলে না। তিনি প্যান্টের পকেটে হাত চালান করে আমার দিকে ফিরে দাঁড়ালেন ।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মুখ তুলে সরাসরি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে একবার গলা ঝাড়া দিয়ে বললেন আজকে,
— আপনার বাবা আমাকে একটি বিশেষ প্রস্তাব করেছেন । আপনি জানেন সে ব্যাপারে কিছু ?
অস্বীকার করতে পারলেই ভালো হতো । কিন্তু মিথ্যে কথা বলা আমার ধাতে সয় না ।
খুব আস্তে বললাম , হ্যাঁ জানি ।
— আমিও তেমনটাই অনুমান করেছিলাম । ওনার মতো মানুষ মেয়ের মত ভাল করে জেনে তবেই আমায় প্রপোজাল দেবেন । সেটা আমার আগেই মনে হয়েছে।
আরো কিছু বলতে গিয়ে উনি চুপ করে গেলেন।
তারপর বললেন, দেখুন আমরা দুজন যাতে এখন স্বচ্ছন্দভাবে এই ব্যাপারে খোলামেলা কথা বলতে পারি সেজন্য আমার মনে হয় কথাটা প্রথম থেকেই হলে ভালো হয় । আপনি যদিও জানেন, তবুও বলি , আপনার বাবা আজকে আমাকে, আপনার সঙ্গে একটা ম্যারেজ প্রপোজাল এনেছেন । আপনি বললেন আপনি জানতেন সেটা । অর্থাৎ আমি কি এটা ধরে নিতে পারি যে, আপনার কাছে গ্রিন সিগন্যাল পাওয়ার পরেই উনি আমাকে জানিয়েছেন ?
কি বলবো ঠিক বুঝতে পারলাম না ।
অল্পক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম , আমার যদি অমত থাকতো, তাহলে বাবা এই প্রপোজাল আনতো না ।
তিনি চুপ করে শুনলেন । আমি বুঝতে পারলাম ওনার মুখটা আমার কথা শুনে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তিনি অল্প একটু কাছে সরে এলেন আমার । বাঁ হাতটা ছাদের কার্নিশের ওপর রেখে মুখটা অল্প ঝুঁকিয়ে আমার মুখের দিকে আগ্রহভরে তাকিয়ে বললেন ,
— তরুশী, আপনার .. মানে আমি বলতে চাইছি, অমত না থাকা, আর ইচ্ছা বা আগ্রহ থাকা এক জিনিস নয় । আপনার কি এব্যাপারে আগ্রহ রয়েছে? মানে আপনি কি আগ্রহী ?
প্রশ্নটা শুনে কেমন যেন গুরু গুরু করে উঠলো ভেতরটা । উত্তর দেওয়া সহজ নয় ।
কোনরকমে অন্য দিকে তাকিয়ে বললাম, আগ্রহ থাকাটা কি খুব প্রয়োজন ?
— অবশ্যই । ভীষণভাবে প্রয়োজন ।
অল্পক্ষণ চুপ করে থেকে তিনি বললেন , খুব প্রয়োজন তরুশী। ভীষণ প্রয়োজন । দু’ তরফের সমপরিমাণ আগ্রহ না থাকলে কখনো একটা কনজুগাল রিলেশনশিপে ঢোকা উচিত নয়।
নিজের অজান্তেই চোখ চলে গেল তাঁর মুখের দিকে । কি ভীষণ সত্যি যে কথাটা , আমার চেয়ে বেশি ভালো আর কেউ জানেনা। একটা ব্যাপার লক্ষ্য করছিলাম আজকে তাঁর কথার মধ্যে । তিনি আজ পর্যন্ত কখনো আমার নাম ধরে ডাকেন নি। আজকেই হয়তো প্রথম ডাকলেন । তাঁর মুখে নিজের নাম শুনতে বেশ লাগছে। মনের ছোট ছোট অনুভূতিগুলো কি এভাবেই তার অস্তিত্ব জানান দেয় ?
চোখ সরিয়ে নিয়ে বললাম , আপনি বলুন তো আপনার কি যথেষ্ট আগ্রহ রয়েছে?
অল্প হাসলেন তিনি।
বললেন , বুঝলাম প্রশ্নটার উত্তর দেওয়া বেশ কঠিন । তাই ঘুরিয়ে আমায় করলেন ।
— কিন্তু আপনি তো উত্তর দিলেন না।
উত্তরে তিনি কিছু বললেন না । বাঁ হাতটা অল্প বাড়িয়ে কার্নিশের ওপর পড়ে থাকা আমার ডানহাতটার ওপর রাখলেন। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইলেন।
তারপর বললেন , সব প্রশ্নের উত্তর কথায় দেওয়া যায় না । আরো অনেক সহজ উপায় আছে ।

ভালো লাগছে। আমার কি ভীষণ ভালো লাগছে । কতদিন পর, কত বছর পর –

একজনের অস্তিত্ব টের পাচ্ছি । ভীষণ কাছ থেকে। সেই অস্তিত্বের মধ্যে কোন তীব্রতা নেই । আশ্বাস রয়েছে। বন্ধুত্ব রয়েছে। নিজের হাতের আঙ্গুলগুলো দিয়ে তাঁর হাতের উষ্ণতাটুকু শুষে নিলাম। কয়েক সেকেন্ড হবে, তিনি হাত সরিয়ে নিয়ে একটু সরে দাঁড়ালেন ।
বললেন, একটা দুটো ব্যাপারে একটু গুছিয়ে নিতে হবে । তারপরে আমি আপনার বাবাকে জানাবো।
ঘাড় নেড়ে বললাম, আচ্ছা ।
তিনি বললেন , আমার দু’ তিনটে দিন সময় লাগবে।

কিছুটা অবাক হলাম তাঁর কথা শুনে। দু তিনটে দিন সময় লাগবে কেন ? তবে কি সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বাধা রয়েছে ? কি জানি ! কেমন যেন খচখচ করতে লাগলো কথাটা মনের ভেতরে । কিছু বললাম না , শুধু অল্প হেলালাম ঘাড়টা ,
— বেশ !
কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ করে রইলাম । বুঝলাম তিনি একদৃষ্টে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন । যেন কিছু খুঁজছেন।
কিছুক্ষণ পর বললাম , তাহলে তো কথা হল । এবার নিচে আসুন তাহলে । বাবাকে যা বলার বলে দিন।
— হ্যাঁ আমি তাঁকে জানাব , আমার দুটো দিন সময় লাগবে ।
— বেশ ।
দু’পা এগিয়ে গেলেন তিনি সিঁড়ির দিকে। তারপরে কি মনে হতে থমকে দাঁড়িয়ে আমার দিকে ফিরে বললেন ,
— আমার সাথে বিয়ে হলে তুমি সুখে থাকতে পারবে তো , তরুশী? আমি একটু খামখেয়ালী। ঠিক সংসারী নই । দেখেছো তো । কয়েক বছর পর হাঁপিয়ে উঠবে না তো ? তখন মনে হবে না তো, আমায় বিয়ে করার ডিসিশনটা ভুল ছিলো?
আগ্রহভরে তাকিয়ে রইলেন তিনি আমার মুখের দিকে উত্তরের আশায় ।
আমি বললাম, জীবন আমিও কম দেখিনি। হয়তো আপনার থেকে মাত্র দু তিন বছরের কম সময় ধরে দেখছি এই পৃথিবীটাকে । আজকে আর এতদিন পরে আলটিমেটলি যদি বিয়ে করি, তবে তখন আর সুখের আশায় নয় , একটু শান্তির আশায় করবো। অল্প একটু ভরসা চাই মাত্র । একজন মানুষ থাকবে আমার পাশে বন্ধুর মতো আজীবন । ব্যাস এটুকুই । আমার সুখ চাইনা , শান্তি চাই ।

আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখ দুটো তাঁর উজ্জ্বল হয়ে উঠল । ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলেন তিনি। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম ছাদের কার্নিশ ধরে । ভালো লাগছে । খুব ভালো লাগছে । এতো ভালো শেষ কবে লেগেছিল মনে নেই –
শুধু সেই খচখচানিটা , দু’ তিনটে দিন সময় লাগবে-
কিন্তু, কেন –

ক্রমশ..