হলদে প্রজাপতি পর্ব-৪৪+৪৫

0
228

#হলদে_প্রজাপতি
(প্রাপ্তমনস্কদের জন্য )
— অমৃতা শংকর ব্যানার্জি ©®

চুয়াল্লিশ

সম্পূর্ণ একটা দিন , একটা রাত কেটে যাওয়ার পরের দিন যখন সারা রাত জাগা ঝড়ে বিধ্বস্ত চোখ দুটো চেয়ে মাটিতে পা রেখে দাঁড়ালাম, তখন প্রথমে মনে হয়েছিল পা’দুটো হয়তো বা মাটিতে পড়বে না । ওপর-নিচ , ডান’পাশ-বাঁ’পাশে কোথাও কোন অবলম্বন আছে বলে মনে হয়নি । মনে হয়েছিল, আমি একা । ভীষণ রকম একা । মহাশূন্যে ভাসছি কোথাও । ভারশূন্য এক দেহ । তারপরে যখন মাটিতে পা দিয়ে দাঁড়ালাম , তখন শিরদাঁড়া বেয়ে অসম্ভব শীতল স্রোত বয়ে গেল। এই ঘর , এই বাড়ি , এই শহর , এই পৃথিবী , আমার ভবিষ্যৎ, কোথাও নেই বাবা । বাবা হারিয়ে গেছে । তন্ন তন্ন করে প্রতিটি কোণা খুঁজেও কোথাও আর আমি সেই মানুষটাকে দেখতে পাবো না । কান পেতে শুনলাম । বাবার ঘর থেকে ভেসে এলো না কোন শব্দ ।
— তরু মা আসবি একবার ? দেখ্ তো , ফোনটা । এখানে হোয়াটস্যাপ এ কেউ বোধহয় কিছু পাঠিয়েছিল। ওই তোর অঙ্কন জেঠুর পাঠানোর কথা। আমি তো খুলতে পারি না। খুলে দিয়ে যা’তো মা ।
নয়তো বলবে , এই দ্যাখ্ , গীতাঞ্জলি বার করে রেখেছি । ওই খান’টা পড়ে শোনা আমায় । খোল্ , বলে দিচ্ছি ।
কিংবা ,
— তোর মায়ের কাছ থেকে জেনে আমায় বল্ তো বাজার থেকে আজকে কি আনব –

না , এর কিছুই সে ঘর থেকে আজ আর ভেসে এলো না । এক’বুক সাইক্লোন চেপে রেখে দুরুদুরু বুকে বাবার ঘরে গিয়ে ঢুকলাম । বিছানায় সাদা চাদর টানটান করে পাতা। বালিশের মাঝখানটা বাবার মাথার আকৃতিতে এখনো অবতল । সারা ঘর জুড়ে বাবা বাবা গন্ধ। গন্ধটা আজও রয়েছে। দুদিন পরে আর এটুকুও থাকবে না । আমি কোনদিন বাবার কাছে হাঁটু মুড়ে বসে সেই গন্ধটা বুক ভরে আর নিতে পারবো না । বাবা নেই । বাবার অনুভূতি নেই । বাবার গন্ধ নেই । চূড়ান্ত ‘নেই’ এর জালে আটকে থেকে এই অসহ্য জীবনের বাকি অধ্যায়টা আমি বাঁচবো কি করে ?

দীর্ঘক্ষণ সে ঘরের মেঝেতে থম মেরে কাঠের মূর্তির মত বসে থাকলাম। তারপরে যেন অন্য এক পৃথিবী থেকে ফোনের রিংটোন শুনতে পেলাম। উঠলাম না । আবার বাজছে। তাও উঠিনি । বেজেই চলেছে । অসাড় শরীরটাকে টেনে নিয়ে এলাম নিজের ঘরে । ছোটকাকার ফোন । এই মুহূর্তে আসতে পারছে না, চেষ্টা করছে আগামী কাল আসার, ইত্যাদি । কথা হতে ফোন রাখলাম। স্ক্রিনের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বসে রয়েছি। হঠাৎ করে মাথায় ক্লিক করলো, ‘বাবা’ নামটা আর স্ক্রিনে ভেসে উঠবে না । সারা জীবনে যতই ফোন কল আসুক না কেন, কখনো আর সেই মানুষটা আমায় ফোন করে বলবে না-
— কিরে মা ? আজ কখন ফিরলি আফিস থেকে ?
অথবা , আমাকে রিচার্জটা করে দিতে পারবি ?
কথাগুলো মনে হতেই কোহিনুর খোঁজার মতো বাবার নামটা বার করলাম কল লিস্ট থেকে ঠিক । দু’দিন আগে বাবার লাস্ট কল এসেছিল । আমি একটু বাজারে বেরিয়েছিলাম , বাবা ফোন করে আমাকে খানিকগুলো রজনীগন্ধার স্টিক কিনে আনতে বলেছিল । কলার লিস্টে বাবার নামটা ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছে । একেবারে হারিয়ে যাবে । তারপর আর কোন দিন বাবার কোন ফোন আসবে না । ছুঁড়ে ফেললাম ফোনটা ।
শীত করছে আমার । অসম্ভব শীত করছে । কুঁকড়ে গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়লাম । হাত-পা যেন বরফ ! ঢাকা নিলাম । হি হি করে কাঁপছি। এক অসম্ভব হিমশীতল অনুভূতি । কতক্ষণ ওই ভাবে কেটেছে জানিনা । ছোটমাসি জোর করে আমায় ডেকে তুললো । বলল , মায়ের শরীরটা খারাপ করছে । গিয়ে দেখি গায়ে অল্প জ্বর রয়েছে । মানসিক ধকল নিতে পারেনি , তাই । কিন্তু আমি এখন যা দেখছি, সেই মানসিক ধকল আমার সইবে তো ? মায়ের হাত দুটো –
সে দুটোয় শাঁখা-পলা পরা থাকবে, এ যেন একেবারে অমোঘ সত্যি । যবে থেকে জ্ঞান হয়েছে, তবে থেকে কোনদিন দেখিনি মায়ের হাত দুটোয় সেই লাল-সাদা কম্বিনেশনের সঙ্গে সোনার বালার ঠোকাঠুকিতে টুংটাং শব্দ হচ্ছে না । কখনো দেখিনি, সিঁথি বরাবর জ্বলজ্বলে সিঁদুরের রেখা না টেনে, কপালে সিঁদুরের টিপটা না এঁকে মা একদিনও কাটিয়েছে । স্নান সেরে বেরোনোর পর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে এটাই তো মায়ের প্রাত্যহিক কাজ । লালচে ছোপ পাক ধরা চুলের গোড়ায় গোড়ায় এখনো লেগে রয়েছে। কপালে হাত রেখে দেখলাম অল্প জ্বর । মায়ের দিকে তাকাতে পারছি না । মা কি সত্যি এবার থেকে এইরকম দেখতে হয়ে যাবে ?

তবু সময় কাটে । সূর্য ওঠে , অস্ত যায় । নতুন দিনের শুরু হয় । বাবার ঘর থেকে ‘বাবা’ ‘বাবা’ গন্ধটা মিলিয়ে যায় ধীরে ধীরে । সে ঘর থেকে আর কোন ডাক ভেসে আসে না। ফোনে ফুটে ওঠে না বাবার নাম। তবু দিন কাটে । পুব আকাশে রং মাখিয়ে সেই সূর্যই ওঠে যে অতীতের এতগুলো বছরে উঠে এসেছে। সমস্ত আয়োজন একই । শুধু তার মধ্যে মস্ত বড় এক ‘নেই’ আমাকে গিলে খেতে আসে ।

এই ভাবেই প্রায় দু সপ্তাহ সময় কেটে যায়। বাবার পারলৌকিক কাজ সম্পন্ন হয় । ধীরে ধীরে আমিও বাবা-হীন এই পৃথিবীতে বাঁচতে শিখে যাচ্ছি । এভাবেই মানুষ বাঁচে। বাঁচার জন্যই বাঁচে। খুব কাছের মানুষগুলো যখন হারিয়ে যায় , তখনও মানুষ বেঁচে থাকার দৌরাত্ম্যেতেই বাঁচতে শিখে যায় ।
টানা অনেক দিন ছুটি নিয়ে ফেলেছি। এবারে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গিয়ে না পড়লে চাকরিটাই রাখা দায় হবে । মা’কে আমার সঙ্গেই নিয়ে যাব। এ ছাড়া আর অন্য কোন উপায় নেই। যদিও সব সময় দুশ্চিন্তা থাকবে । হঠাৎ করে মায়ের শরীর-টরির খারাপ হলে কি যে করব ! তবুও এখানে একা রেখে যাওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠেনা । ছোটমাসি মেসোমশাই দুজনেই বারবার করে বলেছিল মাকে নিয়ে গিয়ে ওদের কাছে রাখার কথা। কিন্তু , মা আমার সাথেই থাকতে চায় । তাছাড়া পরের বাড়িতে গিয়ে থাকতেও চায় না । এমার্জেন্সি কিছু কাজ কালকে সকালে সেরে নিয়ে রাতের ট্রেনেই ফিরবো নর্থ বেঙ্গল । সে কারণেই বাবার পার্সোনাল লকারের আর ট্রাঙ্কের লক খুলে কিছু অফিশিয়াল কাগজপত্র , ব্যাংক ইত্যাদির গুছিয়ে নিচ্ছিলাম । বাবা মোট তিনটে ফিক্সড ডিপোজিট করেছিল। একটার পেপার্স পাচ্ছি না । লকারে নেই । ট্রাঙ্কটা খুলে খুঁজছি । হঠাৎ করে ট্রাঙ্কের একেবারে নিচের দিকে একটা ফাইল তুলতে , কাগজে মোড়ানো কি একটা নজরে পড়ল । কি এটা ? তুলে হাতে নিলাম । বেশ ভারী। কাগজের ভাঁজ খুলতে কিছুটা সময় লাগলো । খুব যত্ন করে চার-পাঁচটা খবরের কাগজ মুড়িয়ে রাখা । খুলে যা দেখলাম তাতে করে আমার বুকের ভেতরটা যেন এক নিমেষে ফাঁকা হয়ে গেল । দেখি , একটা লাল রংয়ের বেনারসি শাড়ি । আনকোরা নতুন। মিনা কাজ করা । অসাধারণ দেখতে।
আমার চোখ দুটো যেন কাঠের তৈরি ।
মাকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম, আজ থেকে প্রায় বছর তিনেক আগে বাবা বেনারসিটা নিজে পছন্দ করে কিনে এনে রেখেছিলো।
মা তা দেখে বলেছিল , আগে পাত্র খোঁজো । তবে না বেনারসি কিনবে ?
বাবা বলেছিল , সেসব ঠিক হয়ে থাকে । সময় হলেই এসে পড়বে । সেদিন তরুর তাকে চিনতে ভুল হবে না ।

আর এই সবই বাবা আমাকে জানাতে বারণ করে দিয়েছিল। শাড়িটাকে বুকে করে নিয়ে এসে নিজের ঘরে ছিটকিনি এঁটেছি । আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বুকের ওপর শাড়িটা এক ভাঁজ খুলে বিছিয়ে নিয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছি। এই পাতলা হয়ে যাওয়া মাথার চুলে, এই মেদ জমা কোমরের ভাঁজে, এই মানসিক ভারে ক্লান্ত রুক্ষ মুখে, এই কালি ভরা চোখে, এই বেনারসি কি মানায় ? এই লাল টুকটুকে বেনারসি চল্লিশ পেরিয়ে – ! এসব আমি কি ভাবছি? কেন ভাবছি? মানুষ শুধু শুধু কি বেনারসি পরে ? এইরকম লাল টুকটুকে বেনারসি বিয়ে হলে তবে না – ।

ওমা ! এ আবার কে? একেবারে পাটে পাটে ভাঁজ, আটপৌরে করে পরা লাল মিনা কাজ করা বেনারসি গায়ে? চন্দনের ফোঁটা, প্রসাধনী – মুখের রুক্ষতা ঢাকা পড়েছে । চুলগুলো এমন করে বাঁধা রয়েছে, তার ঘনত্ব বোঝা যায় না । রজনীগন্ধার অ্যাত্তো বড় একটা মালা পরেছে আবার ছুঁড়ি গলায় । সাধ কম নয় । সোনার গয়না । মুখে সোনার দীপ্তি। ওই যে বাবা ! বাবা দাঁড়িয়ে ওই ছুঁড়ির সামনে । ওমা , তাই তো ! এতক্ষণ এই ছুঁড়িটাকে চিনতে পারিনি বটে। চিনলাম, যখন ছলছল চোখে গিয়ে ঝুঁকে পড়ে দু’হাত বাড়িয়ে বাবার ফর্সা দুটো পায়ের পাতা ছুঁলো । টসটসিয়ে চোখের জল গড়িয়ে পরল নিচে। বাবা দুটো হাত বাড়িয়ে দিয়ে অনেকক্ষণ ধরে মাথায় ঠেকিয়ে কি সব যেন বলল মনে মনে । তারপর সেই প্রসাধনী ঢাকা পেত্নীর মত মুখটা বুকের ওপর চেপে ধরে বাবা বলল, কি অসম্ভব সুন্দর লাগছে আমার তরু মা’কে। ঠিক যেন রাজকন্যা ! খুব সুখী হও । খুব ভালো থাকো । প্রাণ ভরে আশীর্বাদ করলাম আজকে তোকে।

চটকা ভেঙ্গে গেল । দেখলাম , বুকের ওপর ফেলে রাখা শাড়িটার বেশ অনেকখানি অংশ জুড়ে ভিজে উঠেছে চোখের জলে। বাবা ঠিক যেভাবে কাগজগুলোর মধ্যে মুড়িয়ে রেখেছিল, সেভাবে রাখতে গিয়ে আলগোছে চোখে পড়লো ছোট্ট একটা খবর । কাগজে একেবারে পাতার কোণে রয়েছে । ‘বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে ঝগড়ার কারণে অবসাদগ্রস্ত তরুনীর আত্মহত্যা’ – হেডিং । জানিনা কবেকার কাগজ। হয়তো বছর তিনেক আগেরই হবে। দেখার ইচ্ছা হলো না কবেকার । তবে এক না-দেখা বাবা-মায়ের জন্য মনে কালশিটে পড়ল । দেখতে পেলাম নিতান্ত স্বার্থপরের মত একটি সন্তান তার বাবা-মায়ের কোল ফাঁকা করে নিতান্তই অমূলক কারণে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে। তার বাবা-মা সেই তার প্রথম পৃথিবীতে আসার দিনটা থেকে বুকে করে আলগোছে বড় করে তুলছিলো তাকে। কত স্বপ্ন বুকের স্তরে স্তরে জমা হচ্ছিল দিনের পর দিন ধরে । মেয়ে বড় হবে । মানুষের মত মানুষ হবে । একদিন বিয়ে হবে। বড় সুন্দর করে সেজে সে তার ভালোবাসার মানুষের হাত ধরে এগিয়ে যাবে নতুন জীবনের পথে। প্রতিটা মানুষের তার নিজের মতো করে বাঁচার অধিকার আছে । মরার অধিকারও অবশ্যই আছে । কিন্তু তাই বলে বাবা-মায়ের বুকটা এক নিমেষে শূন্য করে দিয়ে যারা চলে যায় স্বার্থপরের মত, তারা কি একবারও বোঝেনা, এক পৃথিবী স্বপ্ন নিয়ে তিলে তিলে গড়ে তোলা সন্তানের ভবিষ্যৎ ছবি নিয়েই বাবা-মায়েরা বেঁচে থাকে ?

শাড়িটাকে বাবা ঠিক যেভাবে রেখেছিল, সেইভাবেই রেখে দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। মুখ তুলে দাঁড়ালো সেই ছুঁড়িও । বাবার বুকের ভেতর থেকে মুখটা তুলে বাবার মুখের দিকে চোখ তুলে দাঁড়ালো । ওমা ! এখন যে তাকে দেখতে ভারী সুন্দর লাগছে ! বড্ড সুন্দর । বাবার রাজকন্যা ।

মাকে নিয়ে চলে এলাম নর্থ বেঙ্গল । আসার পথে সবই যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে । বাংলোয় ঢোকার কিছুটা আগে পরে সেই শিউলি গাছটা । বাবার সাথে ফুল কুড়াতে আসার কথা ছিল । কত কথাই এমনই রয়ে যায় । আরও কিছুটা এগিয়ে সেই কাঠের বেঞ্চটা । যেটাতে আমরা বাপ-বেটি মর্নিংওয়াকে বেরিয়ে বসে বসে গল্প করতাম। এই রাস্তা ধরে বাবাকে নিয়ে কত হাঁটলাম , এইতো কটা দিন আগের কথা। সবই তেমনই রয়ে গেল , শুধু বাবা’ই আর কোনদিন আসবেনা । আমাকে বলবে না – তরু মা , কালকে ভোরবেলাতে উঠিস্ । মর্নিং ওয়াকে বেরোতে হবে –

টগর শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে ছিল দরজার কাছে। মাকে ধরে ভেতরের ঘরে নিয়ে গেল । আবার শুরু হল কর্মব্যস্ততা । ক্লান্ত লাগে খুব । তবুও হয়তো এই কর্মব্যস্ততাই কিছুক্ষণের জন্য ভুলিয়ে রাখে বাবার স্মৃতি।

একটা সপ্তাহ কেটেছে । আজ রবিবার । এখন হেমন্তকাল । ভোর বেলায় ঘাসের আগাগুলো স্বচ্ছ মুক্তোবিন্দুতে সেজে ওঠে । খালি পায়ে হাঁটলে পায়ের পাতা ভরে ওঠে মন নিংড়ানো জলে । পা’দুটোকে মনে হয় যেন গাছের শেকড় । মাটির আর্দ্রতা শুষে নিচ্ছে, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে ছড়িয়ে দিচ্ছে। দুপুরবেলা মাছ-ভাত খেয়ে শুয়ে আছি । মা কিছুতেই আমিষ কিছু খাচ্ছিল না । অনেক কষ্টে খাইয়েছি । বলেছি , তুমি যদি না খাও , আমিও তবে ছেড়ে দেব । বাধ্য হয়ে খেয়েছে । সূর্য পশ্চিমে হেলেছে । হেমন্তের সোনালি দুপুর আগামী শীতের প্রস্তুতি নিচ্ছে । একটু দূরের আতা গাছেটায় একটা ঘুঘু দম্পতি উড়ে এসে বসল । অলস ভঙ্গিতে বাইরে তাকিয়ে আছি। হঠাৎ মনে হল , বাবা যদি থাকতো হয়তো বলতো, দুপুরবেলা খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়েছিস? ভাত খেয়ে উঠে ঘুম ভালো নয় । তার ওপর বেলা ছোট হয়ে আসছে –

একটা কলিংবেলের শব্দ পেলাম । দুপুরবেলায় আবার কে এলো ? যেই বা এসে থাকুক, আলটিমেটলি সেই আমারই ডাক পড়বে । উঠে পড়লাম । যাই দেখি –

ক্রমশ..

#হলদে_প্রজাপতি
(প্রাপ্তমনস্কদের জন্য )
— অমৃতা শঙ্কর ব্যানার্জী ©®

পঁয়তাল্লিশ

বান্টি এসেছে । ও নাকি মাঝে একদিন ঘুরে গেছিল । টগরের কাছে শুনেছে সব । তাই আমি ফিরে আসার পর এসেছে দেখা করতে । ওদের ফিরে যাওয়ার কথা ছিল বেশ কিছুদিন আগেই । তবে আপাতত মাস তিনেকের জন্য পিছিয়ে গেছে । ওদের এখানকার যে সমস্ত কাজ ছিল সেগুলো শেষ হতে এখনো বেশ কিছুদিন সময় লাগবে। সত্যি কথা বলতে কি ও আসাতে গুমোট ভাবটা একটু কম লাগছে। মনের মধ্যে রাজ্যের মেঘ নিয়ে আমি আর মা – এই দুটো মানুষ পাশাপাশি থাকতে থাকতে মেন্টাল ডিপ্রেশনের শিকার হয়ে পড়ছি। বান্টি অনেকক্ষণ বসে বসে মায়ের সঙ্গে কথা বলল । তারপর আমরা দুজনে সন্ধ্যাকালীন শিরশিরে হাওয়া আর পশ্চিমের নরম রোদ গায়ে মেখে ছাদে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ গল্প করলাম । প্রায় রাত্রি দশটা পর্যন্ত থাকল আমার কাছে ।

ফিরে যাওয়ার আগে একটা কথা বলল আমায় । বলল , তরুদি একটা রিকোয়েস্ট আছে । সেটা কিন্তু তোকে রাখতেই হবে ।
— কি রিকোয়েস্ট শুনি-
— শোন্ । তবে বললাম যে, রাখতেই হবে তোকে রিকোয়েস্টটা ।
— আগে তো বল্ –
— দ্যাখ্ –
বিছানার ওপর পা তুলে বেশ গুছিয়ে বসে আমার হাত দুটোর উপর হাত রেখে ও বলল, অনেকগুলো বছর হয়ে গেছে , আই বিলং টু এ নিটলী বন্ডেড ফ্যামিলি । আ্যম হ্যাপি উইথ মাই হাবি আ্যন চিল্ড্রেন। স্টিল, কোথাও একটা গিয়ে মনে হয় জানিস তো, যে এই বন্ডিং, এটা থেকে বেরিয়ে কয়েকটা দিন একদম ইন্ডিপেন্ডেন্টলি নিজের মতো করে কাটানোর প্রয়োজন আছে । তাই ঠিক করেছি তোর সঙ্গে ওনলি টু’নাইটস একটা ছোট্ট ট্যুর করব । প্লিজ তরুদি, না বলিস না ওনলি ফর টুডেজ ।
— কোথায়.. এখন ..
— হ্যাঁ এখনই । এখনই তোর নিজের মেন্টাল হেলথ এর জন্য দুটো দিন কোথাও একটা ঘুরে আসা ভালো হবে ।
— প্লিজ এখন না ।
— আমি বলছি তরুদি , শোন্ আমার কথা । আন্টিকেও প্লিজ রাজি করা । তোদের দুজনের জন্য এখন একটা আউটিং মেডিসিন এর কাজ করতে পারে। শুধু আমার জন্য নয় । আমি তোদের দুজনের জন্যও ভেবেছি এটার কথা।
— কোথায় ?
— মানস ন্যাশনাল পার্ক, আসাম । দ্যাখ্ এখান থেকে বেশি টাইম লাগবে না । এনজিপি স্টেশন থেকে ধর্ এই ম্যাক্সিমাম সিক্স টু সেভেন আওয়ার্স ট্রেন জার্নি । আমিও জানিস তো, ফ্লাইট এ জার্নি করে করে ক্লান্ত । আমাদের দেশের মাঠ ঘাট ঝোপঝাড় পেরিয়ে কু ঝিকঝিক করে ট্রেন ছুটে যাবে। উইন্ডো সিটে বসে চুল উড়িয়ে সেসব দেখতে দেখতে যাব । চল না তরুদি । আন্টিকে রাজি করা প্লিজ।
বলে একবার ফিক করে হেসে বললো, সত্যি কতদিন ট্রেনে চাপি না । সাপোজ প্লেনে যদি উইন্ডো গ্লাস ওপেন করা যেত ? কি কান্ডটাই না হত, জাস্ট ইম্যাজিন –
বলে দুটো হাতে ঘসে ছোট একটা বাচ্চার মত মুখভঙ্গি করে হাসলো । সিলি ওয়ান । তবুও আমারও ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি খেলে গেল। ঠোঁটের দুটো প্রান্ত যে বিপরীতমুখী সিফট্ করতে পারে, তা যেন ভুলতে বসেছিলাম । বান্টির ব্যাপারে ভাবলে মাঝে মাঝে আমার অবাক লাগে বটে । মেয়েটা এখনও ছেলেমানুষীটা ধরে রাখতে পেরেছে । অনেক বার করে বোঝানোর চেষ্টা করলাম, আমার এখন সেসব মুড একেবারেই নেই । কিন্তু ও কেমন যেন নাছোড়বান্দা। শেষমেষ আমার কাছ থেকে কথা নিয়েই ও উঠলো ।
বলে গেল , অনেক কান্ড করে রনিকে রাজি করিয়েছি । রনি , আই মিন , হনুমান দুটোর সাধের পাপ্পু , ও দুটো দিনের জন্য বাবি বেবো’কে সামলে সুমলে রাখবে বলেছে । এই সুযোগ আর এই জীবনে পাব কিনা সন্দেহ আছে । নিজের দেশ , নিজের মতো করে ঘোরা – ! ফ্যামিলি রেস্পন্সিবিলিটি জিরো । তবে তরুদি, একটা কথা তোকে বলি। আমি কিন্তু স্পেশালি এই ট্যুরটার ব্যাপারে ভেবেছি অনলি ফর ইউ আ্যন আন্টি । বিশ্বাস কর , আমাকে বিশ্বাস করে চল্ দুটো দিন । দেখবি ফিরে এসে একটুখানি হলেও ফ্রেশ লাগবে । উইল ফিল রিফ্রেশড্ । আমি কথা দিচ্ছি তোকে।

চলে গেল ও। প্রায় রাত্রি দশটার সময় বাড়ি ফিরে গেল। ফিরে গেল নিতান্তই বাধ্য হয়ে । ছেলে-মেয়ে দুটো মাকে ছাড়া থাকতে পারে না , তাই। না হলে ওর রাতে থাকার ইচ্ছা ছিল।
বান্টি চলে যাওয়ার পর টগরকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, এরমধ্যে এই বান্টি দিদিমণি যে এখানে এসেছিল, কই তুমি আমায় বলোনি তো ?
টগর হাতের দু’ গাছা ব্রোঞ্জের চুরি ঠনঠনিয়ে মুখের সামনে হাত নেড়ে বলল , ও ভুলে গেইচি দিদি । সে তুমি যাওয়ার হপ্তা তিনেক পর হবে কিনা। তখন শুনছি মেসোর ওই খবর খান । তাই –

দিন কয়েক কেটেছে । আমি ইদানিং রান্ডম অনলাইন ইন্টারভিউ দিচ্ছি । যেহেতু টি এস্টেটের ম্যানেজার পোস্টে কাজ করার এক্সপেরিয়েন্স হয়ে গেলো প্রায় দু বছরের কাছাকাছি। তাই একটু বড় কোম্পানিগুলো দেখে ম্যানেজার পোস্টেই এপ্লাই করছি । যাতে অন্য কোন কোম্পানিতে সিমিলার কোন ডেজিগনেশনের পোস্টে চলে যেতে পারি । অবশ্য টি এস্টেটে করছি না । টি এস্টেটের ম্যানেজার পোস্টে এপ্লাই করে লাভ নেই । তাহলে সেই নর্থ বেঙ্গলেই থাকতে হবে । আমার ইমিডিয়েট লক্ষ্য হচ্ছে এই ধরনের ধ্যাধধেড়ে গোবিন্দপুর ছেড়ে এবার মাকে নিয়ে একটা সিকিওর জায়গায় চলে যেতে। অবশ্যই প্রেফেরাবলি কলকাতা । বাবাকে হারিয়ে মায়ের গুরুত্ব ঠিক কতখানি, তা যেন আরও দশগুণ হয়ে ধরা দিয়েছে আমার কাছে । মায়ের হেলথ নিয়ে কোনরকম রিস্ক আমি নিতে পারবো না। মা আমার সঙ্গে ছাড়া থাকবেও না । কাজেই শুধু চাকরীর খাতিরে এখানে পড়ে থাকার কোন মানে হয় না । দু-একটা কোম্পানি থেকে পজিটিভ রেসপন্স পেয়েছি। ফাইনালি কিছু জানায়নি বটে, তবে ইমিডিয়েটলি জানাবে বলেছে ।

দিনের মধ্যে অনেকবার বাবার শেষ ইচ্ছেটার কথা মনে পড়ে । বাবা খুব করে চেয়েছিল আমার সঙ্গে ইন্দ্রাশিষ বাবুর বিয়েটা যেন হয় । কিভাবে যেন ভদ্রলোককে বাবা শুধু ভালোলাগা ছাড়িয়েও ভালোবেসে ফেলেছিল । অমি তা বুঝেছিলাম । বাবা মানুষটার মধ্যে এমন কিছুর অস্তিত্ব ছিলনা যা কৃত্রিম অথবা মেকি । কাউকে সেভাবে ভালো লাগলে বাবা তাকে ভালবেসে ফেলত। বাবার এই শেষ ইচ্ছেটার কথা মনে পড়লেই মনের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে । কিন্তু ইন্দ্রাশিষ বাবু বা পাতার কোন খবরই আমি আর জানিনা । উনি নিশ্চয়ই শুনেছেন আমার দুর্ভাগ্যের কথা। কই একবার ফোন করেও তো খবর নেননি। যে মানুষটা আদপে কোন যোগাযোগ রাখতে চাইছেন না, তাঁর জীবনে কি জোর করে কোন একটা সম্পর্ক পাকিয়ে নিয়ে ঢুকে পড়া যায় ? তবুও শুধু বাবার জন্যেই নয়, নিজের জন্যও যেন মাঝে মাঝে গলার ভিতরে কি একটা পাকিয়ে ওঠে । তার অনেকখানি পাতার জন্য বরাদ্দ । তবে তার বাবার জন্যও কিছুটা বটে। এসব কথা কি কাউকে বলার ? কাকে বলি ? কাকে বোঝাই ? কার সাথে আলোচনা করি ? না , এসব আর পারবো না আমি ।

তবুও একদিন কি ভেবে কে জানে, জগন্নাথ দা’কে ফোন করে আসতে বারণ করে দিলাম । ঠিক করলাম নিজেই যাব ড্রাইভ করে । গেলাম। সারাদিন ঘুরে ঘারে যা কাজ করার করে ফিরে আসার সময়, কিছুটা জেনে , কিছুটা না জেনে , পাতা’দের বাড়ির দিকের রাস্তা ধরলাম । বুকের ভেতরটা ঢিপঢিপ করতে লাগল । কাউকে কি দেখতে পাবো? পাতা কি সেই প্রথম দিনের মতো রাস্তায় খেলতে পারে ? হঠাৎ করে দেখা হয়ে যেতে পারে আমাদের দুজনের ? আহা রে ! মেয়েটাকে কতদিন দেখিনি । কেমন আছে কে জানে? শরীর ঠিক আছে তো ? আজকাল কে ওকে পড়ায় ? ধুর্ , আমারও না যত্তসব আজে বাজে চিন্তা – । যে পড়ায় পড়ায় । কথায় বলে ‘পরের সোনা দিও না কানে, প্রাণটা যাবে হ্যাচকা টানে’ ।

শ্যাওলা ধরা একতলা বাড়িটার পাঁচিল নজরে আসছে । ক্রমশ বাড়িটার সামনে এগিয়ে চলেছি আমি। টিনের সেই নেমপ্লেটটা – ডক্টর ইন্দ্রাশিষ গাঙ্গুলী । নাহ্ , বাড়ির সামনে কেউ নেই। আনমনে ব্রেকে পা চলে গেল । বাড়িটাকে অল্প পেছনে ফেলে রেখে গিয়ে দাঁড়ালাম । মুখ বাড়িয়ে পিছন ফিরে বাড়িটার দিকে তাকালাম । আমি বুঝতে পারছি আমার চোখদুটো খুঁজছে কিছু । কতকিছুই আমরা অহরহ খুঁজে চলেছি । তার কতটুকুই বা পাই ? গাড়ি থেকে নামলাম । গাড়িতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রয়েছি বাড়িটার দিকে। ঠিক যেমন চটা ধরা হলদেটে রঙের ওপর শ্যাওলা ধরে রয়েছে, তেমনি আমার আস্ত আস্ত সব চাওয়া জুড়ে খাবলা খাবলা শ্যাওলার আস্তরণ । ওই বাড়িটার মধ্যেও নিতান্ত অবুঝ কিছু স্বপ্নের আধখাওয়া অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পড়ে রয়েছে । পাতা কি এখন বাড়িতে আছে ? থাকারই কথা । কি করছে ? ইন্দ্রাশিষ বাবু নিশ্চয়ই নেই । ওদের বদলি হয়ে চলে যাওয়ার কি হলো ? সেটা নিশ্চয়ই এখনো হয়নি। তাহলে খবর পেতাম। টগরই ঠিক খবর দিতো আমায়। এগিয়ে যাব? একবার ঢুকিই না – । কি হয়েছে ? ‘কি হয়েছে’ না , কি হবে ? আমি ওখানে ঢুকলে, অনেক কিছু প্রমাণ হবে । আমি আমার আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে মরিয়া হয়ে ছুটে এসেছি । এক জীবনে আত্মসম্মান বিসর্জন কতবার দেওয়া যায় ? ন্যাড়া বেলতলায় বার বার যায় কখনো ? একবার গিয়েই যা আঁবের মত হয়ে ফুলে গেছে ! সারাজীবন বহন করছি । মাথা নিচু করে ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ড্রাইভিং সিটে এসে বসলাম। স্টার্ট দিলাম গাড়ি । এরকম কত স্বপ্নের মৃতদেহ কত জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে। সেগুলো নিয়ে কি অত ভাবলে চলে ?
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া সেই বিখ্যাত গানটা – , তার দুটো লাইন – ‘ ছোট ছোট মানুষের ছোট ছোট আশা / কে রাখে খবর তার’ –

দীপাবলী ভাইফোঁটা পেরিয়ে যাওয়ার দিন দশেক পরে আমরা বেরোলাম । বরপেটা রোড স্টেশন নেমে গাড়িতে করে সবুজের বুক চিরে যখন মানস ন্যাশনাল পার্কের গেটের সামনে গিয়ে পৌঁছলাম, তখন প্রায় বেলা দুটো বাজে । এখানেও সেই চা বাগান । গেটে ঢোকার আগে দু’পাশে চা-বাগান চেরা রাস্তা । সত্যি কথা বলতে কি, ভালো লাগছে বেশ। বুঝতে পারছি , বান্টি যে আশ্বাস দিয়ে জোর করে আমাকে আর মাকে নিয়ে এসেছে , তা যেন সত্যি হতে চলেছে। জঙ্গলের এরিয়ার ভিতরে প্রায় ঘণ্টা দেড়েকের কাছাকাছি গাড়ি নিয়ে ঢুকলে তবে মাথাঙ্গুরি ফরেস্ট বাংলো পৌঁছানো যায় । আমাদের বুকিং সেখানেই ছিল । এ সমস্ত জায়গায় বুকিং পেলেও তা ক্যান্সেল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রচুর। তবে বান্টি ইনফ্লুয়েন্সিয়াল সোর্স কাজে লাগিয়ে বুকিং করেছিল । আমাদের বুকিং ক্যানসেল হয়নি। এবড়োখেবড়ো জঙ্গলের রাস্তা। দুপাশে কখনো লম্বা গাছের সারি , ঘন জঙ্গল। তবে তা অল্পই । মানস ন্যাশনাল পার্ক মূলত গ্রাস ল্যান্ড ফরেস্ট। আমাদের ড্রাইভার যেতে যেতে গল্প করছিল, গত সপ্তাহেই সে নাকি কয়েকজন টুরিস্টকে নিয়ে আসছিল , তখন এই ফরেস্ট বাংলো যাওয়ার পথেই একটা বাঘের দর্শন পেয়েছে । আমরাও উদগ্রীব হয়ে তাকিয়েছিলাম বাইরের দিকে সম্পূর্ণ পথ। মাঝে মাঝে হঠাৎ খেয়াল পড়লে এও ভাবছিলাম , এইতো জাগতিক ব্যাপারে আকর্ষণ অল্প অল্প করে ফিরে আসছে । এই ভাবেই হয়তো মানুষ শোক কাটিয়ে ওঠে । আমরা বাঘের দর্শন পাইনি । তবে , একটা বেশ বড় দাঁতালের দর্শন পেলাম । কি তার ডাক ! কি তার তেজ ! কি তার উপস্থিতি !

ফরেস্ট বাংলোয় এসে পৌঁছানোর পর চোখ জুড়িয়ে গেল। মন ভরে গেল । সামনে দিয়ে কুলকুল শব্দে বয়ে চলেছে নীলবসনা মানস । যেন এক তন্বী নারীর আলুলায়িত স্বচ্ছ আঁচল বাতাসের তরঙ্গে বয়ে চলেছে কোন সুদূরের পথে । একত্রিত করেছে সমস্ত সৌন্দর্য। নদীর ওপারে ভুটান। রয়েল মানস ন্যাশনাল পার্ক । কিছুটা পর থেকে ধূসর পাহাড় শুরু হয়েছে। কিছু কিছু ছবি যখন মূর্ত হয়ে চোখের সামনে ধরা দেয়, তখন অবিশ্বাস্য মনে হয় । আমারও এই সৌন্দর্য অবিশ্বাস্য লাগলো । অপার্থিব । ইন্টারনেট কানেকশন নেই , এ বন্যপ্রাণীদের অঞ্চল । এখানে আসতে হলে প্রয়োজন পড়ে একটা বন্য মন। সব কৃত্রিমতাকে বাইরে ফেলে রেখে দিয়ে এখানে আসতে পারলে প্রকৃতি তার আত্মার সন্ধান দেয়। প্রথমে বাঁচার, পরে বিলাসিতার তাগিদে আমরা তো পৃথিবীর প্রায় বেশিরভাগ অঞ্চলই কৃত্রিম খোলসে ঢেকে ফেলেছি । অন্তত যেসব অঞ্চল আজও রয়েছে বন্য, সেগুলো থাক না কেন, এমনই ? আদিমতার গন্ধ মেখে –

তবে ট্যুরিস্টদের বড় শোরগোল। এইটাই যেন সমস্ত সৌন্দর্যকে অনেকখানি শুষে নিয়েছে । তন্ময় হয়ে গিয়েছিলাম । পিছন থেকে ডাক পড়ল ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং রুমে যাওয়ার জন্য । রুমে ঢুকে দেখলাম , মোটামুটি ফুটবল খেলা না গেলেও টেনিস ইজিলি চলতে পারে । ডাবল বেডেড দুটো খাট । বেশ কিছুটা ডিসটেন্সে রাখা । ভালোই হবে । মা একটা খাটে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারবে। আমরা দুজন যত খুশি রাত জেগে গল্প করতে পারব । ফ্রেশ হয়ে খাওয়া দাওয়া সেরে রুমে এসে কিছুক্ষণ রেস্ট নিতে গিয়ে দুটো চোখের পাতা বুজে এলো । কিছুটা শারীরিক ক্লান্তিতে, কিছুটা মানসিক । চটকা ভেঙ্গে উঠে দেখলাম, প্রায় চারটে বাজে । তাকিয়ে দেখি, মা আর বান্টিও ঘুমিয়ে পড়েছে। ডেকে তুললাম ওদের । তিনজনে মিলে বের হলাম । এখানে ভোরবেলা আর দুপুরবেলা দুটো সাফারি বুকিং করা যায় । আমরা কালকে ভোরের স্লটে বুকিং করেছি । ফরেস্ট রেঞ্জ অফিসিয়ালরা যদিও জানাচ্ছিলেন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হওয়ার মুখে বাঘমামার দর্শন পাওয়ার চান্স বেশি থাকে, তবুও অনেকখানি জার্নি করে এসে আজকেই আবার সাফারিতে বেরোনোর মত এনার্জি ছিল না ।

তিনজনে বেরোলাম । শিরশিরে ঠান্ডা হাওয়া । ওদিকে ভুটানের কোলে পশ্চিমে হেলেছে সূর্য । নদীর উপর নানা ধরনের সুবর্ণরেখা আঁকছে , মুছছে । আবার নতুন আঁকছে । পাথরের উপর পা রেখে সাবধানে এগোতে লাগলাম । মা বেশি দূরে যেতে পারছে না। পারার কথা নয়। হাঁটুর সমস্যা রয়েছে। বসলাম একটা জায়গায় তিনজনে । অদ্ভুত লাগছে। নদীর ওপারে জঙ্গলের হাতছানি, এপারে রহস্য ! তবে প্রচুর টুরিষ্ট । কিছু ফরেস্ট বাংলোয় রয়েছে । কিছু আবার স্থানীয় টুরিস্ট । তারা সাফারি কার বুক করে এসেছে । কয়েক ঘণ্টা এখানে কাটিয়ে আবার ফিরে যাবে । হইচই , হট্টমেলা । সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী দুটো ব্যাপার। একদিকে গম্ভীর প্রকৃতি তার অপার্থিব সৌন্দর্যের ডালা মেলে বসে আছে, আর একদিকে মানুষের ক্যাচরম্যাচর , কোলাহল । এরা যে কেন একটু শান্তি দেয় না ? আনমনে কখন উঠে দাঁড়ালাম। মা আর বান্টি সেখানেই বসে রইল। আমি এগিয়ে চললাম । নদীর ঢালু পার বেয়ে উঠে এসে পায়ে পায়ে এগিয়ে চললাম নদীর ধার ধরে । একটা সময়ে এসে পর্যটকদের কোলাহল মিলিয়ে গেল ।

চারিদিকে ধীরে ধীরে নেমে আসছে জংলি আঁধার । ওদিকে সূর্য পাটে যেতে বসেছে। এখনো দেরি আছে, তবে তোড়জোড় চলছে । সোনা রঙ গায়ে মেখে এগিয়ে চলেছে মানস । বেশ খানিকক্ষণ বসে রইলাম আনমনে । বুঝিনি কখন ফোঁটায় ফোঁটায় নেমেছে অজস্র ধারা । খেয়াল হল বান্টির ডাকে ।
— এখানে একা একা বসে আছিস ? কোন টুরিস্ট নেই। সন্ধ্যে হবে কিছুক্ষণের মধ্যেই। এখান থেকে আয়।
ভিজে দুটো গালের ওপর হাতের তেলো বুলিয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম । প্রথমে যেখানে এসে বসেছিলাম, সেখানে আবার ফিরে এলাম তিনজনে । শিরশিরে ঠান্ডা । হাওয়ার বেগ বাড়ছে। নদীর ওপারের জঙ্গলে গোল কমলা থালাটা ঝুপ করে লুকিয়ে পড়বে। কিছুক্ষণের মধ্যেই খানিকগুলো ওয়াইল্ড বাফেলো নদীর ওপারের জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এলো। জল খাচ্ছে । একখণ্ড অ্যানিম্যাল প্লানেট। নদীর স্রোতে দুটো পায়ের পাতা ডোবালাম । উফ্ , অসম্ভব ঠান্ডা ! ঠিক যেন বরফ গলা । তবে কোনো শীতলতাই আপনজনের মৃত্যুকে শীতলতার নিরিখে পিছনে ফেলে আসতে পারে না। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে । গুটি গুটি পায়ে ফিরে এলাম রুমে ।

ক্রমশ..