হলদে প্রজাপতি পর্ব-৪৬+৪৭

0
231

#হলদে_প্রজাপতি
(প্রাপ্তমনস্কদের জন্য )
— অমৃতা শঙ্কর ব্যানার্জী ©®

ছেচল্লিশ

ধীরে ধীরে অন্ধকার স্নেহের আলিঙ্গনে আঁকড়ে ধরল জঙ্গলকে । কিন্তু তা মাত্র কিছুক্ষণের জন্য । তারপরেই চন্দ্রিমার নরম ছোঁয়ায় হেসে উঠলো রহস্যময়ী অরণ্য । হ্যাঁ আমরা পূর্ণিমা দেখেই এসেছি । শুনেছিলাম পূর্ণিমায় এখানে নাকি একখণ্ড স্বর্গ নেমে আসে। তা যে মিথ্যা নয় , তা কিছুটা অনুভব করতে পারলাম । এইখানে এই ফরেস্ট বাংলোর চাতালে চেয়ার নিয়ে বসে সেই চাঁদের আলো ধোয়া মানস নদী আর ওপারের রয়াল ভুটান ন্যাশনাল পার্কের ছায়াঘন রহস্য ! শুধু যদি ট্যুরিস্টদের অবাঞ্ছিত গোলযোগটুকু আর সন্ধ্যাবেলার ব্যাটারীতে চলা কৃত্রিম আলোটুকু গেস্টহাউস থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া যেত – । কিন্তু নাহ্ ! এটুকুর জন্যেই প্রকৃতির সমস্ত আয়োজন বৃথা গেল ।

কোথা থেকে যেন হু হু করে হাওয়া ছুটে আসছে । যত সময় গড়াচ্ছে, হাওয়ার বেগ বাড়ছে। ঝোড়ো হাওয়া । কি তার কারণ জানি না । অরন্যের বাকি সব কিছুর মতন বাতাসও যেন রহস্যময় । ভালো করে চাদর মুড়ি দিয়ে বসলাম । কোন কথাই বলতে ইচ্ছা করছে না । মা আর বান্টি গুনগুন করে কথা বলছে । পাশ থেকে আমি চুপচাপ তাকিয়ে রয়েছি সন্ধ্যার অরন্যের দিকে। তবে মা বেশিক্ষণ সেই হাওয়া নিতে পারল না । ঘরের ভেতরে চলে গেল । আমি আর বান্টি বসে আছি। তবে বিশেষ কোনো কথা বলছি না । বান্টি মাঝেমধ্যে দু-একটা কথা বলার চেষ্টা করছে । আমার দিক থেকে তেমন সাড়া শব্দ না পেয়ে গল্প জমে উঠতে পারছে না । আশেপাশে সমস্ত পর্যটকদের হই-হুল্লোর , হট্টগোল গায়ে এসে যেন সূচের মত বিঁধছিল । এরা এই প্রকৃতির সামনে দাঁড়িয়ে তাকে উপভোগ করতে পারে না কেন ? এভাবে প্রকৃতির সৌন্দর্যকে অবহেলা করে কৃত্রিমতায় মধ্যে ডুবে থাকার জন্য কি এখানে আসা ? এতো সৌন্দর্যের হত্যা ! এভাবেও এই অপার্থিব সৌন্দর্যকে উপেক্ষা করা যায় ? গভীর বিস্ময় , রহস্যের ডালি উপচে দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রকৃতি । হয়তো খুব কাছেই কোথাও চাঁদের আলো পিঠে মেখে সদর্পে এগিয়ে চলেছে কোনো ডোরাকাটা । মানস বিশাল অঞ্চল অধিকার করে থাকা এক টাইগার রিজার্ভ । এখানে এসেও মূর্খ মানুষ নিজেদের মধ্যে কৃত্রিম উপভোগের অরণ্যে এসে যে তার সঙ্গে মিশে যেতে হয়, তার ভাষায় কথা বলতে হয়, তার ছন্দেই সুর মেলাতে হয় – এসব এরা কবে বুঝবে ?
গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করলো – ‘ ঈশ্বর তুমি আমাকে আজ রাত্রের জন্য বধির করে দাও । আমি সহ্য করতে পারছিনা এত কোলাহল । আমি এই অসীম সৌন্দর্যের মাঝে বসে তারই কম্পনে কম্পিত হতে চাই ।’

খাবার জন্য ডাক পড়ল। উঠে পড়লাম । রাতের খাওয়া সেরে তিনজনে যখন ফিরে এলাম , তখন প্রায় সাড়ে ন’টা । রাত বাড়ার সাথে সাথে দুটো জিনিস সমান হারে বেড়ে চলেছে । এক হলো হাওয়ার বেগ । দুই, কোলাহলের বেগ । পাগল পাগল লাগছে আমার । এই অমূল্য অরণ্যবাস এভাবে বয়ে চলেছে ? ধৈর্য ধরে ঠায় বসে রইলাম । কখন কোলাহল শান্ত হয় –

একসময় কৃত্রিম আলোগুলো সব নিভে গেল । একটা করে লন্ঠন গেস্ট হাউসের রুমে রুমে দরজার পাশে দিয়ে দেওয়া হল। আর তখনই ম্যাজিকের মত ভিড়টা ভ্যানিশ হয়ে গেল । সেই নিঝুম অরণ্যে একফালি চাতালে নরম জোছনা মেখে বসে রইলাম শুধু আমি আর বান্টি। সময় এখানে যেন চাঁদের আলোর মত গলে গিয়ে ভেসে চলে যায় । কোথা থেকে আসে, কোথায় চলে যায়, বোঝা যায় না। হাওয়ার বেগ আরো বেড়েছে । তবে এখন আমার শুধুমাত্র চোখ দুটো ছাড়া আর কোন ইন্দ্রিয়ই কাজ করছে না । এই নিশুতি রাতে গভীর অরণ্যের বুকে রাত্রি যাপন করছে কত ধরনের বন্য পশু । তাদের সাথে একইভাবে পিছলে যাওয়া জোৎস্না মেখে যাপন করছি আমিও। অগুন্তি রূপোর রেখা নদীর জলে ফুটে উঠছে, আবার মিলিয়ে যাচ্ছে । আমরা দুজনে বসে আছি, অথচ কোন কথা বলছি না । এই পরিবেশ যে কথা বলার নয় । কথা বলতে দেয় না । অবশ্য বান্টি প্রথমটায় বলতে আরম্ভ করেছিল । তারপর আমার ভাবগতিক দেখে চুপ করে গেছে । বেশ কিছুক্ষণ এভাবে কেটে যাওয়ার পর ও আমাকে তাড়া দিতে লাগল ।
বলল , তরুদি কেউ কোথাও বাইরে নেই। এখানে এভাবে বসে থাকাটা সেফ নয় ।
আমার মোটেই ওঠার ইচ্ছা ছিল না । ও খানিক টানাটানি করেই আমায় নিয়ে গেল রিসোর্টের ভেতরে । শুলাম । তবে ঘুম আসেনা । জীবনে অনেক বিনিদ্র রজনী কাটিয়েছি, সুখে-দুঃখে বিভিন্ন কারণে । তবে আজকের মত এমন কারণ কখনো দেখা দেয়নি । বাইরে আমার জন্য অপেক্ষা করছে আস্ত একটা স্বর্গ । আর আমি এখানে এই ঘরের ভেতর অন্ধকার হাতড়াচ্ছি । বাইরে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে জোছনা । ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে । রাত্রি গভীর থেকে গভীরতর হয়ে একসময় পূব গগন লাল হয়ে আসবে। আমি সেসব কিছুই দেখবো না । এ কিভাবে সম্ভব ? বুঝতে পারছি, বাইরে হাওয়ার বেগ আরো বেড়েছে। মনে হচ্ছে যেন ঝড় বইছে । তবুও আমি পারছি না । কিছুতেই পারছি না । অনেকক্ষণ অন্ধকারে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে মটকা মেরে পড়ে রইলাম বিছানার ওপরে । তারপরে আস্তে আস্তে বিড়াল পা’য় নামলাম। সাবধানে খুললাম দরজাটা । অল্প একটু আওয়াজ হলো । যাকগে যাক, মায়ের বা বান্টির ঘুম ভাঙেনি । আলতো করে বাইরে থেকে দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে সেই অপার সৌন্দর্যের দিকে চোখ মেলে চাইলাম ।

যা কিছু রয়েছে চোখের সামনে, সবখান থেকে গলে গলে পড়ছে রুপো। রুপোর সূক্ষ্ম চাদরে ঢেকে গেছে দুনিয়াটা। ঝোড়ো হাওয়ায় আশেপাশের গাছগাছালি ঝিরঝিরিয়ে বাদ্যযন্ত্রে সুর তুলেছে। আর তার সাথে সাথেই হাজার হাজার রুপোর ফোঁটা গলে গলে পড়ছে। এত ভয়ঙ্কর সুন্দর যে গায়ে কাঁটা দেয় ! বেশিক্ষন তাকিয়ে থাকলে মনে হয় যেন আমি এমন এক দুনিয়ায় পৌঁছে গেছি যেখান থেকে আর কোনভাবেই ইঁট-কাঠ-পাথরের সেই বাস্তব দুনিয়ায় ফিরে যাওয়া সম্ভব নয় । এই নতুন পৃথিবী আমাকে তার কাছে বন্দি করে রাখবে । আমি যে বন্দী হতে চাই । হে প্রকৃতি , হে অনিন্দ্য সুন্দর প্রকৃতি ! তোমার এই ভয়ঙ্কর সৌন্দর্যে আমায় তুমি কোনো এমন মায়াজালে বেঁধে ফেলো , যেখান থেকে আমাকে আর সেই নিষ্ঠুর বাস্তব জগতে যেন কোনদিন ফিরে না যেতে হয় । শুনেছি তুমি যে মায়ের মতোই । তুমি কেন তোমার এই অভাগী সন্তানকে চিরজীবনের মতো কোলে তুলে নাও না ? আমি তোমার মাঝে থাকতে চাই । তোমার কোলে এমনভাবে মুখ লুকিয়ে বসে থাকতে চাই , এই নিষ্ঠুর বাস্তব জগৎ যেন আমায় কোনদিন আর খুঁজে না পায় । কংক্রিটের জঙ্গল থেকে সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে গিয়ে তোমার এই স্নেহের আশ্রয়ে আমি জীবনের বাকি বছরগুলো বাঁচতে চাই । বাঁচার মত বাঁচতে চাই ।

মানস নদীর উপর রূপোর স্রোতে সে যেন কোনো রূপকথার নদী সৃষ্টি হয়েছে । নদীর ওপারে নরম আলো ধোয়া অনিন্দ্য সুন্দর নদীর চর .. অরণ্য .. ধোঁয়াটে অন্ধকারে রুপোলী মুকুট পরে সারে সারে দাঁড়ানো সুন্দরী পাহাড়ের ঢাল । ওরা নাকি আমাদের প্রতিবেশী দেশের । মানুষ নিজের মতো করে দেশের সীমারেখা টেনে দিল, আর অমনি তা হয়ে গেল আমাদের প্রতিবেশী দেশ । কোথায় সীমানা ? কিসের সীমানা ? এপার-ওপারের বন্য বাসিন্দারা কি তা জানে ? তবে না জেনেও তা মানে । ভৌগলিক সীমারেখা আছে যে একটা , প্রবহমান মানস নদী । এই অসীম প্রকৃতির মাঝে কোথাও কি আজ আর এতটুকুও বাবার অস্তিত্ব বাকি নেই ? বিপুলা এ পৃথিবীর কত বৈচিত্র । তার মাঝে একটুখানি মাত্র , এত্তটুকুনি জায়গাতেও কি সে আর বাবাকে লুকিয়ে রাখতে পারেনি ? সবটুকু বিলিয়ে দিতে হল কোনো এক মহাশূন্যের বুকে ?

খেয়াল হলো দুচোখ বেয়ে অবিরল ধারায় ঝরে পড়েছে জল । বুঝলাম তার অনেকটা বাবার স্মৃতিচারণে আর বাকিটা অসীম অরণ্যছর গা শিরশিরে সৌন্দর্যের ঠেলায় । আমি নতজানু হয়ে বসে পড়লাম । দশ আঙ্গুলের ফাঁক গলে অজস্র ধারায় ঝরে পড়তে লাগলো মনের ক্লেশ । হু হু করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে আমার। ডুকরে উঠে গড়াগড়ি দিতে ইচ্ছে করছে প্রকৃতির শীতলতায় । খোলা চুলের গোছাগুলো এসে চাবুকের মতো ঝাপটা মারছে চোখে, নাকি মনে কে জানে !
রবি ঠাকুর বলেছিলেন , ‘মানুষ একদিকে মৃত্যুর অধিকারে, আর একদিকে অমৃতে, একদিকে সে ব্যক্তিগত সীমায় , আর একদিকে বিশ্বগত বিরাটে । এই দুইয়ের কোনোটিকে উপেক্ষা করা চলে না ।’
আমি জানিনা কখন থেকে কিভাবে যেন এই ভয়ঙ্কর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাঝে আমি বরাবর বাবাকেই খুঁজে চলেছি । প্রতিটি কোণায় , প্রতিটি রুপোলি খাঁজে, প্রতিটি অন্ধকারে, প্রতিটি আলোর শিহরণে ! বাবা আজ নেই কোথাও ! নেই , কোনোখানে নেই !

হঠাৎ করে কাঁধের কাছে হাতের স্পর্শ পেয়ে চোখ তুলে তাকালাম । দেখি বান্টি কখন উঠে এসেছে । ও আমার পাশে বসে পড়ল ।
ফিসফিসিয়ে বললো, কিরে তরুদি ! এই রিসোর্টে কোথাও কোনো বাউন্ডারি ওয়াল রয়েছে কি ? এখানে এইভাবে ওপেনলি চাতালে বসে থাকার মানে কি হয় জানিস ? এটা একটা টাইগার রিজার্ভ রে ! তুই এভাবে একা একা এত রাতে বাইরে বসে রয়েছিস ? একটা জনপ্রাণী রয়েছে বাইরে ?
অসহায় ভাবে তাকালাম ওর দিকে । বলতে চাইলাম , জনপ্রাণী নেই বলেই তো এখন এসেছি বাইরে । কিন্তু, বলা হলো না কিছুই । কিকরে হবে ? বুকের কষ্টটা উঠে এসেছে গলার কাছে, তারপর দলা পাকিয়ে গেছে । তবে, আর একজন মানুষের আবেগের সান্নিধ্যেই হলো কিনা জানিনা, ভেতরে জমে থাকা সমস্ত বাষ্প গলে গলে জল হয়ে বেরিয়ে আসতে লাগলো হু হু করে কেঁদে চলেছি আমি বান্টির কাঁধে মাথা রেখে । ও আমাকে আলতো হাতে জড়িয়ে ধরেছে । মাথার চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে । এখন মনে হচ্ছে যেন ও আমার দিদি হয় । কাঁদছি আমি । কেঁদেই চলেছি । কেঁদে খুব শান্তি পাচ্ছি । মেয়েটার সান্নিধ্যে কোথায় যেন আবেগ আছে । স্নেহ আছে , মমতা আছে । ওর বুক ভেসে যাচ্ছে আমার চোখের জলে । ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছি । ফুলে ফুলে উঠছি ।

বেশ অনেকক্ষণ পর , তখনকার মতো চোখের জল ফুরিয়ে গেল । আস্তে আস্তে ওর বুকের ভেতর থেকে মাথা তুলে নিয়ে আবার সেই অসীম সৌন্দর্যের দিকে চোখ ফিরিয়ে নির্বাক হয়ে বসে রইলাম ।

কিছুক্ষণ পরে বান্টি বলল , ঘরে যাবি না তুই ?
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে খুব আস্তে আস্তে উত্তর দিলাম , ঘরেই তো আজ এতগুলো বছরের প্রতিটা রাত কাটালাম । কিন্তু আজকের রাত আর কতক্ষণ ?
বেশ কিছুক্ষন দুজনেই চুপ । তারপর বান্টি আমার দিকে চোখ ফিরিয়ে আমার কাঁধের ওপর আলতো করে ওর ডানহাতটা রাখল ।
বলল , একটা প্রশ্ন করব তোকে ?
নদীর রূপোলী রেখাচিত্রের দিকে তাকিয়ে থেকেই বললাম, বল্ ।
ও একটু যেন ইতস্তত করলো । কিছু একটা ভেবে বললো , তুই আবার কিছু মনে করবি না তো ?
ঠোঁট দুটো নিজের অজান্তেই যেন কিছুটা হাসিমাখা হয়ে উঠলো । কিছু কিছু হাসি থাকে, শুধুই কষ্ট দিয়ে আঁকা । ও বোধহয় বুঝলো সেই হাসির অর্থ । মন বলে কি আর অবশিষ্ট আছে আমার কিছু, যে মনে করবো ? আছে কি নেই, তাও বা কি ঠিক করে জানি ? কোথায় যে কখন কি ফুরিয়ে যায় , আর কিভাবে কোথায় কতটুকু বাকি রয়ে যায় – সে হিসাব কি মানুষ করতে পারে ?
অল্পক্ষণ চুপ করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো ও । তারপর বললো, কই, আমার দিকে ফিরে তাকা ।
— তুই বল্ না, আমি শুনছি ।
— না, এভাবে হবে না । তুই তাকা আমার দিকে ।
দীর্ঘশ্বাস চেপে ওর দিকে তাকালাম ।
ও আমার দুটো চোখের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে বললো , তুই ইন্দ্রদা’কে বিয়ে করতে চাস্ না , তরুদি ?
চমকে উঠলাম ওর কথা শুনে। ও যে এমন একটা অভাবনীয় প্রশ্ন করে বসবে, ভাবতেও পারিনি। বিস্ময়ের রেশ লাগলো গলায় ।
বললাম , তুই .. মানে তুই ইন্দ্রাশিষ বাবুকে .. মানে কি তুই ওনার কথাই বলছিস ?
— হ্যাঁ আমি ইন্দ্রদা’র কথাই বলছি । ডক্টর ইন্দ্রাশিষ গাঙ্গুলী । তুই কি তাকে বিয়ে করতে চাস না ?
— তুই ওনাকে চিনিস ?
— হ্যাঁ চিনি ।
মুখ নামিয়ে বললাম , তুই হঠাৎ আমাকে এখন এসব প্রশ্ন করছিস কেন ?
— প্রয়োজন মনে হল , তাই করলাম । এই প্রশ্ন এখনো যদি না করি , আরো অনেকটা সময় পেরিয়ে গেলে, করে কি আর কোনো লাভ হবে ?
— তুই কি করে চিনলি ?
— সেটা আমি তোকে নাহয় পরে বলব ইন ডিটেইলস । এখন যে প্রশ্নটা করেছি, তার উত্তর দে তো –
আমি চুপ করে রইলাম । এ প্রশ্নের উত্তর দিয়ে কি হবে ? সব প্রশ্নের কি উত্তর হয় ? উত্তর হলেও কি সবসময় তা জানানো যায় ? ও কিছুক্ষণ আমার উত্তরের জন্য অপেক্ষা করলো ।
তারপর আমার গালের ওপর আস্তে করে হাত ছুঁইয়ে বললো, বল্ তরুদি । আমার জানাটা খুব প্রয়োজন ।
চাপা দীর্ঘশ্বাসটা বেরিয়ে এলো এতক্ষণে ।
— বলবি না, তাই তো ?
কি বলবো জানি না । কেন বলবো, তাও জানি না ।
— ইন্দ্রদা খুব খুব ভালো মানুষ, এটুকু আমি তোকে বলতে পারি ।
— ওঁরা এখন আছেন কোথায় ?
নিজের অজান্তেই প্রশ্নটা বেরিয়ে এলো ।
— তুই আমার প্রশ্নের উত্তর দে আগে । তারপর সব বলবো ।
কিছু বলছি না আমি । বলার কিছু নেই, তাই । বান্টিও চুপ করে বসে আছে । কটা বাজে এখন ? রাত কি শেষ হয়ে আসছে ? পুব আকাশে কি রং লাগছে ? কে জানে !

একসময় বান্টি উঠে দাঁড়িয়ে আমার হাত ধরে টানলো । বলল , আর না । ঘরে চল্ ।
আমিও ডানহাতের ওপর ভর দিয়ে ক্লান্ত শরীরটাকে নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম । ঘরেই ফিরে যাওয়া যাক । ফিরে এসে বিছানায় পাশাপাশি দুজনে শুলাম । নিশ্ছিদ্র অন্ধকার । মুখ দেখা যায় না , দেখাতেও হয় না ।
সেই অন্ধকারে মুখ লুকিয়ে প্রায় ফিসফিস করে ওকে প্রশ্ন করলাম, পাতা কেমন আছে জানিস তুই ?

ক্রমশ..

#হলদে_প্রজাপতি
(প্রাপ্তমনস্কদের জন্য )
— অমৃতা শঙ্কর ব্যানার্জী ©®

সাতচল্লিশ

মানস ঘুরে আবার নিজের ডেরায় ফিরে এসেছি আজ পাঁচদিন হলো । সত্যি কথা বলতে কি, প্রকৃতির স্পর্শ এক অরূপ রতন । মনের কত ক্লেশ, কত গ্লানি, কত যন্ত্রনা, যে নিজের মতো করে ধুয়ে নিয়ে চলে যায়, তা একমাত্র তাকে নিবিড় ভাবে ভালোবেসে তার ছায়াঘন আশ্রয়ে গিয়ে না দাঁড়ালে বোঝা যায় না । শীতের ঝরা পাতার মরসুম শেষে বসন্তের নব উন্মেষের মতই আমার মনের বিভিন্ন কোণে সবুজের ছোঁয়া লেগেছে। ম্যাজিকাল টাচ অফ নেচার ! আর, একটা খবর পেয়েছি । খবরটা পেয়েছি জাস্ট গতকাল । অনলাইনে একটা ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম । ওদের হেড অফিস সল্টলেকে । ওরা ফাইনালি সিলেক্ট করেছে । সেই অর্থেই মেইল পাঠিয়েছে । আমায় যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জয়েন করতে বলেছে। ইমেইলটা দেখার পর অবশ্য আমার স্বস্তি অবসাদ দুইই হয়েছে। চেয়েছিলাম এই চাকরিটা ছেড়ে কলকাতার দিকে চলে যেতে । সে সুযোগ মিলেছে , তাই স্বস্তি। আবার এই অনাবিল সবুজ ক্ষেত ছেড়ে সেই আবার ইঁট-কাঠ-পাথরের যান্ত্রিক শব্দের রাজ্যে । চোখের শান্তি ফুরিয়ে যাবে। মন কিছু চাইতে ভুলে যাবে ।

আজ ভোরবেলাতে উঠেছি । ছাদের উপর উঠে আমার সাম্রাজ্যে একবার চোখ বুলিয়েছি । ছোট-বড় যাই হোক , আমি এখানকার সাম্রাজ্ঞী ছিলাম বটে । ছিলাম বলছি কেন ? এখনো আছি । তবে আর বেশিক্ষণ নয় । আজকে না হলেও, দু-তিন দিনের মধ্যে , বা খুব বেশি হলে এক সপ্তাহের মধ্যে রিজাইন করব । এখনো অফিশিয়ালি মেইল সেন্ড করিনি মালিকপক্ষকে । তবে খসড়া তৈরি করে রেখেছি । দুচোখ কেমন যেন ঝাপসা হয়ে এসেছিল । ভোরের নরম আলোয় চোখ মেলেই এই সবুজের সমারোহ আর কি কখনো দেখতে পাবো এই জীবনে ? যাক্ , অবশেষে আমার উত্তরবঙ্গ আর চা বাগানের সঙ্গে এ জীবনের মতো যাবতীয় সম্পর্ক চুকেবুকে যাবে । এই অনাবিল সবুজ আমার মনকে বারে বারে মরুভূমি করে দিয়েছে । সব সবুজ , সব রস শুষে নিয়ে ছিবড়ে করে দিয়েছে। ফিরে গেছি রিক্ত হাতে । অথচ এই সবুজই আমায় স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছিল । স্বপ্ন বুনতে শিখিয়েছিল । স্বপ্নের সঙ্গে বসতি গড়তে শিখিয়েছিল। স্বপ্নের হাটে নিত্যনতুন রংচঙে জিনিসপত্র কেনাবেচা করেছি। শেষ প্রাপ্তিটুকু ছিল ‘পাতা’ । যাক গে । ও ওর মতো থাক । স্বপ্ন জড়িয়ে বেঁচে থাকুক আমার পাতা। আমি আমার স্বপ্নের কঙ্কাল এখানে এই চা বাগানের মাটিতে কবর দিয়ে সারা জীবনের মতো এই যে চলে যাব , আর কখনো এখানে আসব না । এই উত্তরবঙ্গ, এই চা বাগান, আমায় কষ্ট ছাড়া আর কিছুই দেয়নি।

চাদরটা জড়িয়ে নিয়ে সোনালী রোদ পিঠ পেতে নিতে নিতে আমার বাগানের চা’য় চুমুক দিচ্ছিলাম। হারানদা বসে আছে সামনে। টগর যখন থেকে শুনেছে আমি এখানকার চাকরি ছেড়ে কলকাতায় চলে যাব, তখন থেকে আমার সঙ্গে আর একটাও কথা বলেনি । অভিমান হয়েছে ওর। ঠক করে দুকাপ চা টি টেবিলের ওপর নামিয়ে দিয়ে চলে গেছে ভেতরে । হারানদা শীতের মরসুমী ফুল নিয়ে এসে ফুল এনার্জি নিয়ে আয়োজন শুরু করে দিয়েছে।
আমি চলে যাব শুনে মাটির ওপর উবু হয়ে বসে মানুষটা দুটো হাত জড়ো করে হাঁটুর ওপর রেখে দুলতে দুলতে মরসুমী শীতের চারাগুলোর দিকে তাকিয়ে থেকে বললো , তা যাবা কোথায় দিদিমণি ? কলকেতা ?
— হ্যাঁ সেখানেই-
তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে মানুষটা বললো, তোমরা কেনে হেথা হাঁপিয়ে মরো বলবা ? আমি কলকেতা দেখছি । এই বড় বড় বাড়ি, ঘর, ফিলাট , বিরিজ । তবে গাছ কোথায় ? গাছ কেটে কেটেই তো সব হচ্ছে ।
আমি আর কি বলব ? চুপ করে রইলাম। একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল ।
হারাণদা বললো, আমাকে বুঝছেন , কেউ টেকা দিয়েও কলকেতায় ধরে রাখতে পারবা না । মাটির আর গাছের গন্ধ বিনে কোত্তাও মোটে তিস্টুতে পারি না ।
আমি বললাম , আমরা পারি । আমরা যে সব সংকর প্রজাতির ।
জিজ্ঞাসু চোখে আমার দিকে তাকাল হারানদা , আজ্ঞে দিদিমুণি ?
বুকটা বেশ হালকা করে লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, আমরা সব সংকর প্রজাতির বুঝলে কি না ? মন চায় , মাথা চায় না । মনের কথা খুলে বলার আমাদের ক্ষমতা নেই। তুমি যেমন সুন্দর করে বলে দিলে কলকাতায় গিয়ে তুমি থাকতেই পারবে না। আমিও কোথাও হয়তো পারি না , বুঝলে হারানদা ? কোথাও বড় হাঁফ ধরে । তবুও এভাবে বলতে পারি না তোমার মত সহজ করে।

মা আমার কাছে কথাটা শুনে অস্থির হয়ে উঠল । বলল , যা করছিস ভেবে চিন্তে করছিস তো ?
কি জানি ভেবে চিন্তা করছি কিনা । আমি নিজেই তো জানি না । সব প্রশ্নের উত্তর হয় না।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মা বলল , আবার তো সেই ফ্ল্যাটের মধ্যে। তোর বাবার সব জিনিসপত্র । সেই ঘরটা । অথচ মানুষটা নেই । ভালো লাগবে কি সেখানে?
কথাটা সত্যি। ভীষণ রকম সত্যি । যেন যেচে যেচে অশান্তিকে ঘাড় পেতে নেওয়া । তবুও সব অবসাদটুকু মেনে নিয়েই এই চাকরিটাই রিজাইন করার সিদ্ধান্ত নিলাম । নতুন করে যাত্রা শুরু হোক। এখানে থাকার ভরসা পাচ্ছি কই ?

মন ঠিক করে ল্যাপটপের ডালাটা খুলে বসলাম । মেলের খসড়াটা ফাইনালি একবার চেক করে নিয়ে পাঠিয়ে দিতে হবে । খসড়াটা দেখলাম । একবার, দুবার, তিনবার, চারবার .. । চোখ বুলিয়েই চলেছি । কোথাও কোনও ভুল নেই । পাঠিয়ে দিলেই হল । যদিও এটা রেজিগনেশন লেটার নয় । তবে আভাস দেওয়া আছে । কিন্তু, পাঠাতে হাত সরছে না । টুকরো টুকরো কত ছবি —
বাবার হাত ধরে মর্নিং ওয়াক .. পাতার সঙ্গে সেই পিকনিক .. ইন্দ্রাশিষ বাবুর গাওয়া গান .. রাত্রিবেলা রিসোর্টের ব্যালকনি থেকে দূর আবছায়ায় আলতো তাকিয়ে থাকা .. হালকা গোলাপি বেগুনি ফুলে মাখামাখি জারুল গাছটার পাতার ফাঁক দিয়ে ঝুপ করে দিনের শেষ আলোটুকু মিলিয়ে যাওয়া .. চা বাগানের বুক চিরে মেঠো পথে দিগন্তের দিকে হারিয়ে যাওয়া .. জ্যোৎস্নার বৃষ্টিতে ধুয়ে যাওয়া চা গাছের পাতাগুলো .. এসবই আমার বড় আপন হয়ে উঠেছিল । কি জানি হয়তো বা এখানে ম্যানেজার হয়ে আসার জন্যই এ সমস্ত কিছুর ওপর আমার একটা স্বাভাবিক অধিকারবোধ জন্মেছিল। এ সমস্ত আয়োজন যেন আমার জন্যই । আমার বড় কাছের । শুধুমাত্র প্রকৃতি বা ব্যক্তি , বস্তুসমষ্টি যেন নয় । প্রত্যেকে আলাদা আলাদা জীবন্ত অস্তিত্ব নিয়ে জ্বলজ্বল করতো । শুধুমাত্র একটা মেইল বডিতে টাইপ করা এই অংশটুকু নিমেষের মধ্যে গন্তব্যস্থলে পৌঁছে গিয়ে আমাকে এই সমস্ত কিছুর থেকে আলাদা করে নেবে !

তাকিয়ে আছি ল্যাপটপের আলো জ্বলা পাল্লাটার দিকে । কি মনে হতে ইমেইলটা পাঠালাম না । হাত চলে গেল মোবাইলের দিকে । নটা বাজছে। ফোনটা তুলে নিয়েছি । বি আদ্যক্ষরের নামগুলোয় এসে থমকে দাঁড়িয়েছি। ফোনটা করেই ফেললাম ।
— কিরে আজ একেবারে সাতসকালে মনে পড়েছে আমার কথা ?
— হ্যাঁ একটু কথা ছিল। টাইম আছে তোর ?
— কি কথা বলতো ?
— পাঁচ মিনিট কথা বলার সময় আছে তো ?
— বল্ রে । ইম্পরট্যান্ট কিছু বলবি মনে হচ্ছে ?
— না তেমন ইম্পর্টেন্ট কিছু নয়। তবে তোকে একটা খবর দেওয়ার ছিল।
— কি খবর ?
— আমি এখানকার টি এস্টেটের চাকরি থেকে রিজাইন করছি ।
— কি বলছিস !
— হ্যাঁ , বেটার একটা অপশন পেয়েছি। কলকাতায় ফিরে যাব ।
— বেটার অপশন ?
কথাগুলো কেটে কেটে বলল বান্টি । তারপর বলল , তা কবে জয়েন করছিস ?
— এই ধর্ , সপ্তাহখানেকের মধ্যেই । আজকেই একটা ইমেইল সেন্ড করে ব্যাপারটা জানাবো । তারপরে অফিশিয়ালি রিজাইন করতে যেটুকু টাইম লাগে । তার আগে একবার কলকাতায় গিয়ে ওদের সাথে ফেস টু ফেস কথা বলে আসতে হবে । মানে , ওই যেখানে নেস্ট জয়েন করছি ।
— এটা কি তোর ফাইনাল ডিসিশন ?
— হ্যাঁ ফাইনাল ।
— হুম বুঝলাম । আর কিছু বলবি ?
— না , আর কিছু –
— ঠিক আছে । রাখ্ তাহলে এখন । আমি একটু বিজি আছি রে । তোকে ফ্রি টাইমে কল ব্যাক করছি ।

বান্টি রেখে দিলে ফোনটা । একটু কি রাফ শোনালো ওর কথাটা ? কে জানে ? যা শোনালো, শোনালো । ওর সঙ্গে হয়তো জীবনে আর কখনো দেখাই হবে না আমার । ফোনটাকে বিছানার ওপর ছুঁড়ে ফেলে মেলটা সেন্ড করে দিলাম । সেন্ট মেল । যা করার করে দিয়েছি। যদিও এটাতে ফাইনালি রিজাইন করার কোনো উল্লেখ আমি করিনি । কারণ অফিশিয়ালি রিজাইন এই মুহূর্তে করতে পারি না ।

দুপুরবেলার দিকে শুধু একবার বেরিয়েছিলাম । অফিসে বেশিক্ষণ কাজ করিনি । বিকেল হওয়ার আগেই ঘরে ফিরে এসেছি । শীতের বেলা । ঝুপ করে সন্ধ্যে নেমে আসবে । ছাদে উঠে পশ্চিমী রোদ মেখে চুপটি করে কার্নিশে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে জারুল গাছের পাতার ফাঁক গলে অস্তগামী কমলা বলটাকে দেখছিলাম । কাছাকাছি একটা বটগাছ থেকে লাল একখানা বটফল ঠোঁটে চেপে নিয়ে, একটা বসন্তবৌরি জারুল গাছটার ডালে এসে বসল । পায়ের নখে ফলটাকে চেপে ধরে ঠুকরে ঠুকরে তার সদ্গতি করে নিয়ে পাতার আড়ালে মিশে গেল । সবুজের সঙ্গে সবুজ। ন্যাচারাল ক্যামোফ্লেজ । কুক কুক্ কুক কুক্ .. ! পাতার ফাঁক থেকে ফুলে ফুলে উঠছে গলার কাছে লাল গুঁড়ি গুঁড়ি পালকগুলো । কিছুটা নেমে গিয়ে একটা অপেক্ষাকৃত মোটা ডালে ঠোকরাতে লাগলো । হয়তো ডালের ফোঁকরটাকে একটু বড় করে বাসা বাঁধার ইচ্ছা আছে । হঠাৎই মাথার গ্রে আর হোয়াইট ম্যাটারের মধ্যে ঘষাঘষি হয়ে ছিয়াশি বিলিয়ন নিউরোন সেলের মধ্যে একটা সুরের ঝঙ্কার উঠলো । মান্না দে’র মায়াময় গলায় সেই কালজয়ী গানের লাইনটা ! আহা !
‘ও কোকিলা তোরে শুধাই রে / সবারই তো ঘর রয়েছে , কেন রে তোর বাসা কোথাও নাই রে ..’

হঠাৎ একটা গাড়ির শব্দ । নিচে তাকিয়ে দেখলাম যদু গেট খুলছে । যদু মাঝে বেশ কিছুদিন ছিল না । এই কয়েকদিন হল আবার কাজে জয়েন করেছে । একটা আকাশ নীল কালারের সিডান ঢুকলো। এটা কার গাড়ি ? কে’ই বা এখন গাড়িতে করে আসতে পারে ? নিচের দিকে ঝুঁকে তাকালাম । গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে এসেছে বান্টি । ওর সাথে সাথে পেছনের সিটের আরেকটা দিকের দরজাও খুলে গেল । কে নামছে ওটা ! পাতা ! বেবি পিংক কালারের , অনেকটা ঘের দেওয়া এমব্রয়ডারি কাজ করা একটা ফ্রক গা’য় । সামনের দিকে ড্রাইভারের পাশের দরজাটা খুলে নেমে দাঁড়িয়েছেন ইন্দ্রাশিষ বাবু ! এসব কি দেখছি আমি !

বান্টি গাড়ি থেকে নেমে চিৎকার করছে – তরুদি .. তরুদি .. তরুদি .. । থামছে না , ডেকেই যাচ্ছে । ডাকটা অবিশ্রাম ঝংকার তুলছে আমার মাথার অবশ নিউরোনগুলোর মধ্যে । ডাকাডাকি হাঁকাহাঁকি শুনে টগর প্রায় ছুটতে ছুটতে বেরিয়ে এলো ।
বললো , দিদি ছাদে আছে ।
বান্টি এবার ওপরের দিকে মুখ তুলে দেখতে পেল আমায় । প্রায় দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে বলল , তখন থেকে চিৎকার করে যাচ্ছি , ওখানে গ্যাঁট হয়ে দাঁড়িয়ে আছিস যে ! শিগগির নেমে আয় !
অফিস থেকে ফিরে সালোয়ার কামিজটা তখনো চেঞ্জ করা হয়নি । গায়ের ওপর আলতো হাতে চাদরটা টেনে নিয়ে গুটি গুটি পায়ে নেমে এলাম নিচে । দাঁড়িয়ে আছি বারান্দার দরজার কাছে ঠেস দিয়ে । সামনে সবকিছু কেমন যেন ঝাপসা লাগছে । বান্টির মুখটা ঝাপসা হয়ে আসছে .. পাতার মুখটাও ..
আরেকজনের দিকে তাকাইনি আমি মোটেও । বড় অভিমান , বুকের ভেতর ঢেউ তুলেছে । চোখে সেই ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে । দুটো চোখ জলে ভরে আসছে আমার ..

ক্রমশ..