অচিত্তাকর্ষক পর্ব-১৯

0
220

#অচিত্তাকর্ষক
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
|১৯|

পুরোটা দিন ঐ অন্ধকার রুমে কাটানোর পর স্মৃতির মন অচেতন হয়ে পড়ে। সে আর এখানে থাকতে পারছে না। অস্থির লাগছে, অসহ্য লাগছে সবকিছু। এই এত সময়ের মাঝে জুভান আর একবারের জন্যও এই রুমে আসেনি। স্মৃতির এত এত চিৎকার সবই বৃথা গিয়েছে। মানুষটা যে কী করতে চাইছে সেটা স্মৃতির ধারণার বাইরে। কিন্তু তার এখন নিজের চেয়েও বেশি ভয় হচ্ছে তার ছোট ভাই আর মা’কে নিয়ে। এই খারাপ লোকটা রাগের মাথায় আবার ওদের সাথে না খারাপ কিছু করে বসে।
স্মৃতি কী করবে বুঝতে পারছে না। এই রুম থেকে বের হবার কোনো উপায়ও সে আওড়াতে পারছে না। চোখ বুঁজে নিজেকে যথেষ্ট শান্ত রাখার চেষ্টা করলেও মন তার শান্ত হচ্ছে না। আসরের আযান হয়ে এখন মাগরিবের আযান হচ্ছে। সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। রুমটাতে আরো বেশি আঁধারে ছেয়ে গিয়েছে। কিন্তু স্মৃতির ভয় বাড়ার আগেই এবার রুমে লাইট জ্বলে উঠল। অবশেষে সে যেন কিছুটা স্বস্তি পেল। আশে পাশে ভালোভাবে তাকিয়ে দেখল একটা খাট ব্যতিত রুমে আর কিছুই নেই। স্মৃতি আর বসে না থেকে আবারও রুমের দরজায় গিয়ে ধাক্কাতে লাগল। কিন্তু বরাবরের মতোই সে কোনো সাড়াশব্দ পেল না। ব্যথিত হৃদয়ে সে গিয়ে তার জায়গায় বসল। আর তখনই সে বাইরে থেকে কারোর হৈ চৈ শুনতে পেল। মনে হয় বাইরে কেউ আছে। স্মৃতি আবারও দরজার কাছে দৌড়ে গেল। চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ডাকতে লাগল। দরজা খুলল তখন। স্মৃতি দু কদম পিছিয়ে দাঁড়াতেই জুভান সেই রুমে প্রবেশ করল। এতটুকু ঠিক ছিল। কিন্তু তার পেছনেই আরো কিছু লোক ভেতরে ঢুকল তার মধ্যে দুজন মানুষকে দেখে স্মৃতির বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠল যেন। স্মৃতি বিচলিত হয়ে বলতে লাগল,

‘আপনি উনাদের কেন এনেছেন জুভান?’

জুভান হেসে জবাব দিল। বলল,

‘তোমার তো এখানে একা একা বোর লাগছিল, তাই মা বাবাকেও এখানে নিয়ে এলাম; এখন আর তোমার বোর লাগবে না।’

স্মৃতি দাঁতে দাঁত চেপে নিজের রাগকে আয়ত্তে এনে বলল,

‘উনাদের ছেড়ে দিন জুভান।’

জুভান ভ্রু উঁচিয়ে অবাক কন্ঠে বলল,

‘আরে আমি উনাদের ধরে এনেছি নাকি যে ছেড়ে দিব? উনারা আমার শ্বশুর শাশুড়ি, উনাদের আমি যথেষ্ট সম্মানের সহিত এখানে নিয়ে এসেছি, তাই না বাবা?’

বৃদ্ধ লোকটা নাক মুখ কুঁচকে দাঁড়িয়ে রইল। উনি এখনও কিছু বুঝে উঠতে পারছেন না। স্মৃতি বলল,

‘দেখুন জুভান, আপনি সব জেনে বুঝে ইচ্ছে করে এসব করছেন। আপনার সাথে আমার কোনো শত্রুতা ছিল না। এই পাঁচ বছরে নিজের সবটুকু দিয়ে আমি আপনার আর আপনার পরিবারের জন্য আমি করেছি। যদিও তখন আমি কিছুই জানতাম না। যদি জানতাম আপনি আমার বাবার খুনী তাহলে কখনোই আমি আপনাকে বিয়ে করতাম না। বরং তখন নিজ হাতে আপনাকে খুন করে আমি জেলে যেতাম। আফসোস, এত বছর পর এই সত্যটা আমি জানতে পেরেছি। সন্দেহ ছিল, তবে আমি কখনও চাইনি আমার সন্দেহ টা সত্যি হোক। কিন্তু ভাগ্য সেটাকেই সত্যি করে দিল। অনেক অন্যায় করেছেন আপনি। আপনাকে আমি কখনো ক্ষমা করতে পারব না জুভান। দয়া করে এখন আর অন্যায় করবেন না। এমনিতেই আপনার করা অন্যায়ের ভার আপনি সইতে পারবেন না, সেই ভার আর বাড়াবেন না দয়া করে। ছেড়ে দিন উনাদের।’

জুভান কপাল চুলকে বিছানায় বসল। অনেকক্ষণ ভেবে বলল,

‘মানলাম সব অন্যায় আমি করেছি। কিন্তু আমার বোনকে তোমরা কিসের ভিত্তিতে আটকে রেখেছ? ও তো কিছু করেনি, ওকে লুকিয়ে লাভ কী?’

স্মৃতি জোরে নিশ্বাস নিল। বলল,

‘আমার বাবার জমিটা আমাকে ফিরিয়ে দিন, আমিও আপনার বোনকে ফিরিয়ে দিব।’

স্মৃতির কথা শুনে জুভান সশব্দে হেসে উঠল। তার হাসার ধরণ দেখে স্মৃতি প্রচন্ড বিরক্ত হলো। সে চোখ মুখ কুঁচকে জুভানকে প্রশ্ন করল,

‘হাসছেন কেন?’

জুভান হাসি থামাল। বলল,

‘এই জমি তো তোমাকে আমি এমনিই দিয়ে দিতাম, শত হলেও, আমার একমাত্র বউয়ের বাবার জমি বলে কথা। এর জন্য এত কাহিনী করার কী দরকার ছিল? আমার কাছে চাইলেই তো পারতে, আমি কি তোমাকে ফিরিয়ে দিতাম বলো?’

স্মৃতি রেগে গিয়ে বলল,

‘যদি এত সহজেই আপনি ঐ জমি ফিরিয়ে দিবেন তাহলে এই জমির জন্য আমার বাবাকে এত কষ্ট কেন দিলেন? কেন একটা সামান্য জমির জন্য আমার বাবাকে মেরে ফেললেন? কেন? এত কেন লোভ আপনার? আপনার জন্য আমাদের পরিবারটা ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। আপনি একটা নিকৃষ্ট মানুষ, জঘন্য একটা লোক আপনি। আমাদের জমি আপনি আজই আমাদের ফিরিয়ে দিবেন। আর তার সাথে আপনি নিজে থানায় গিয়ে আপনার সব অন্যায় স্বীকার করবেন। আপনাকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলতে দেখলে তবে গিয়ে আমার শান্তি লাগবে।’

কথাটা শেষ করে স্মৃতি কাঁদতে আরম্ভ করে। কষ্ট হচ্ছে তার, খুব কষ্ট। জুভান শাস্তি না পেলেও যেমন তার কষ্ট লাগবে, সে শাস্তি পেলেও তার তেমনই কষ্ট লাগবে। মানুষ একবার মায়ার কাছে হেরে গেলে দ্বিতীয় বার আর উঠে দাঁড়াতে পারে না। ভালোবাসা কিনা জানেনা, তবে জুভানের প্রতি তার একটা মায়া আছে। আর থাকবে নাই বা কেন, পাঁচ বছর যাবত এই মানুষটা তো তার স্বামী ছিল।

জুভান স্মৃতির কাছে গিয়ে হাত দিয়ে তার গাল স্পর্শ করতেই স্মৃতি ঠাস করে সেই হাতটা সরিয়ে দিয়ে দূরে সরে দাঁড়ায়। জুভান শান্ত গলায় বলে,

‘আমি জানি, তুমি আমাকে ভালোবাসো। আমি ফাঁসিতে ঝুললে তুমি যতটা না খুশি হবে তার থেকে অনেক বেশি কষ্ট পাবে। দেখো, মানছি আমি অনেক অন্যায় করেছি। একটা খুন না হয় করেই ফেলেছি, কিন্তু সেটা তো কেউ জানে না তাই না। আর আমি তো তখন জানতাম না উনি তোমার বাবা, তখন আমি তোমাকেও চিনতাম না। জমিটা যদি তোমার বাবা আমাকে সহজে দিয়ে দিত তাহলে কি আর এত ঝামেলা করতাম বলো? তোমার বাবাও ছিলেন একজন ঘাড়ত্যাড়া মানুষ, কোনোভাবেই মানছিলেন না আমাদের কথা। তাই বাধ্য হয়েছি এসব করতে। যদিও আমি নিজ হাতে উনাকে মারিনি, জিহাদকে দিয়ে মারিয়েছি। এক কাজ করো, ওকে পুলিশে দিয়ে দাও। তাতে তোমার বাবার খুনের প্রতিশোধ নেওয়াও হয়ে যাবে আর তুমিও জমিটা পেয়ে যাবে। আর আমরা আবার নতুন করে নিজেদের একটা সংসার শুরু করতে পারব।’

‘লজ্জা করছে না আপনার এসব বলতে? এতকিছুর পরও আপনার মাঝে এইটুকুও আফসোস নেই, কোনো অনুতপ্ত নেই। যেন খুন করাটা একটা স্বাভাবিক ব্যাপার। আপনি একটা মানুষ মেরেছেন, এটা কি নিতান্তই একটা সাধারণ ব্যাপার? আজকে যদি ঐ লোকটা আমার বাবা না হয়ে অন্য কেউ হতো তাও তো আমি আপনাকে ক্ষমা করতাম না। আমি নিজে গিয়ে থানায় আপনার নামে কমপ্লেইন করতাম। আপনি ভাবলেন কী করে যে এত সব কিছু করে আপনি এত সহজেই রেহাই পেয়ে যাবেন? ভালোবাসা তো দূরে থাক আপনার দিকে তাকাতেও আমার এখন ঘৃণা হচ্ছে। এটা ভেবে এখন আমার গা গুলাচ্ছে যে আপনার মতো একটা মানুষের সাথে আমি এত বছর সংসার করেছি।’

স্মৃতি তার কথা শেষ করে জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে থাকে যেন দম ফুরিয়ে যাচ্ছে তার। জুভান তার বুড়ো আঙুল দিয়ে কপাল কষতে কষতে বিরক্ত গলায় বলল,

‘অনেক কিছু বলেছ। এবার এসব নাটক ফাটক বন্ধ করে ভালো ভালোই বলো, জারা কোথায় আছে? ওর ঠিকানাটা ঠিক মতো দিয়ে দাও তাহলে আমি তোমার এই সাজানো মা বাবাকে ছেড়ে দিব আর তা না হলে দুজনকেই কিন্তু আমি তোমার বাবার কাছে পাঠিয়ে দিব। এবার তাড়াতাড়ি ভেবে বলো কী করবে?’

রাগে ক্ষোভে স্মৃতি গর্জে উঠছে। হাত জোড়া মুষ্টিবদ্ধ করে সে বলে,

‘আপনি আগে উনাদের ছেড়ে দিয়ে নিজেকে আত্মসমর্পণ করুন, তারপরই আমরা আপনার বোনকে ছাড়ব।’

জুভান হেসে বলে,

‘খুন করেছি সেই কবে। এত খোঁজা খুঁজির পরও যেখানে পুলিশই আমাদের কোনো পাত্তা পেল না সেখানে তোমার মতো একটা মেয়ের কথা শুনে আমি নিজে গিয়ে আত্মসমর্পণ করবো? এটা ভাবলে কী করে তুমি? আত্মসমর্পণ করার প্রশ্নই আসেনা। দরকার পড়লে আরো চারটা খুন করবো। আর ঐ চারজন কে কে জানো? এই যে দুজন তোমার সাজানো মা বাবা। আর একজন তোমার আসল মা আর বাকি আমার শালাবাবু। এই মোট চারটা খুন। তোমাকে মারবো না, তোমাকে মারলে আমি বউ কোথায় পাবো বলো? তোমাকে নিয়ে আমি দেশের বাইরে চলে যাবো। সেখানে গিয়ে দুজন মিলে ছোট্ট একটা সংসার পাতব, কেমন?’

স্মৃতি রাগে চেঁচিয়ে উঠে বলল,

‘আপনার মতো লোকের সাথে থাকার চেয়ে আমার মরে যাওয়া ভালো। আপনি উনাদের ছেড়ে দিন জুভান। নয়তো কিন্তু খুব খারাপ হয়ে যাবে।’

‘কী খারাপ হবে শুনি? আমি চাইলে এই মুহূর্তেই উনাদের মেরে ফেলতে পারি। তবে মারব না, আরো দুজন বাকি ওদের আগে ধরে আনি; তারপর চারটা খুন এক সাথেই করবো।’

এই বলে সে স্মৃতির নকল বাবা মাকেও সেখানে রেখে দরজা আটকে চলে গেল। স্মৃতিকে ধরে উনারা কাঁদতে লাগলেন। স্মৃতি অনুতপ্ত হয়ে বলল,

‘আমাকে ক্ষমা করো আন্টি আংকেল, আমার জন্য তোমাদের কষ্ট পেতে হচ্ছে।’

তার আংকেল তাকে আশ্বাস দিয়ে বললেন,

‘ভয় পেও না মা, আল্লাহ অবশ্যই আমাদের সাহায্য করবেন।’

চলবে…