অতঃপর প্রেমের গল্প পর্ব-১৫

0
405

#অতঃপর_প্রেমের_গল্প❤
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন
#পর্ব_১৫

-আফরা আপু , কি হয়েছে তোমার?

ইলার ডাকে হঠাৎ আফরার ধ্যান ফিরলো। ইলা ওর দিকে কিছুটা ঝুঁকে আছে। চোখে মুখে কৌতুহলতার ছাপ। যেন কোনো কিছুর উত্তর জানার জন্য মনে অধীর আগ্রহ। আফরা শুকনো কাশি দিলো একবার। হতভম্ব গলায় বললো,

-আমিতো ঠিক আছি। কি হবে আমার?

ইলা যেন আফরার কথা কোনোক্রমেই বিশ্বাস করতে পারলো না। সে তখনও আফরার দিকে তাকিয়ে আছে চোখজোড়া ছোট করে। তারপর বলে ওঠলো,

-উহু! আমার তো তা মনে হয় না। আচ্ছা বাদ দাও এসব কথা। কোথায় ছিলে এতক্ষণ?

বলেই ইলা বালিশ নিয়ে শুয়ে পড়লো আফরার পাশে। আফরা বিস্ময় নিয়ে ইলার কার্যকলাপ দেখেছে। কন্ঠস্বর স্বাভাবিক রেখে বললো,

-ফারহানের হন্টেড হাউজে ছিলাম।

ইলা এবার যেন নড়াচড়া করা বন্ধ করে দিলো। এতটাই অবাক যে চোখের পলক ফেলে নিজেকে স্থির করার চেষ্টা করছে বারবার। আমতা আমতা করে এবার বলার চেষ্টা করলো,

-ক-ক-কি? কি ব-বললে তুমি? ফারহান ভাইয়ের সাথে ছিলে! আই কান্ট বিলিভ।

-কেন বিলিভ করতে পারবে না?

আফরার সন্দিহান কন্ঠ। ইলা গায়ে কাথা মুড়িয়ে প্রতিউত্তরে বললো,

-কারন ফারহান ভাই এমন একজন মানুষ যার সাথে মানুষ দু’মিনিটের বেশি থাকতে পারেনা তার দাম্ভিক আর চাপা স্বভাবের জন্য। ভাইয়ের কাছে মুখ্য বিষয় হলো রাজনীতি আর এটাই তার বউ বাচ্চা সব। সেদিকে ফারহান ভাই কিভাবে তোমার সাথে এত আলাপ চালাচ্ছে তা তো আমি ভেবেই পাচ্ছিনা।তো কি করলে এতক্ষণ ?

বলেই আফরার দিকে আরও চেপে শুয়ে পড়লো ইলা। আফরা ঠোঁট কামড়ে হাসছে। ইলার কৌতুহল দেখে মজা রাখছে বেশ। তারপর সে বললো,

-তেমন কিছু না। আমরা জাস্ট একসাথে ডিনার করেছি। যদিও আমি নিজ থেকেই আগ্রহী ছিলাম এ ব্যাপারে কারন ফারহান অমন মানুষ না। এন্ড ইউ আর রাইট ,,,ফারহান খুবই গম্ভীর আর চাপা স্বভাবের মানুষ। প্রয়োজন ছাড়া মুখে দু’তিনটা কথা বেশি বলে না। এরকম মানুষদের আমি বরাবরই এড়িয়ে চলি কিন্ত এই প্রথম আমি আমার লাইফ রুল ব্রেক করলাম ফারহান জুবায়ের নামের এক মানুষের প্রতি মোহে পড়ে।

বলেই থামলো আফরা। ইলা কৌতুহল না দমিয়ে প্রশ্ন করলো,

-এর মানে তুমি প্রেমে পড়েছো ভাইয়ের…..তাই না?

আফরা নিশ্চুপ। এর উত্তর সে নিজেও জানেনা। বসার ঘরের গ্রান্ড ফাদার ক্লক থেকে ঢং ঢং শব্দ হচ্ছে বারবার। এর মানে এখন মধ্যরাত। ঠিক ১২ টা বাজে। এসময় ভুতুড়ে পরিবেশ সৃষ্টি হলেও আফরার হৃদয়ে চলছে অন্যকিছু। তপ্ত শ্বাস ফেলে আফরা মৃদু গলায় বললো,

-আমি ফারহানের মোহে পড়েছি ইলা,,,,প্রেমে না। মোহ আর প্রেম এক জিনিস না। তাছাড়া ফারহান এমন একজন মানুষ যে সবার নজরই কেড়ে নিতে পারে।

-আচ্ছা তা তো বুঝলাম। কিন্ত ফাহিম ভাইকে তোমার কেমন লাগে?যেকোনো একটাকে ধরে ফেলো আপু। তুমি কত লাকি বসে বসেই এত সুন্দর দুইজনকে পেয়ে যাচ্ছো…….

হেসে ফেললো আফরা। তারপর ইলার কান টেনে বলে ওঠলো,

-বেশি পাকনামি করতে হবে না। আমার কাছে প্রেম ট্রেম সব টাইম পাস। কিছু দিনের জন্য এসেছি। তারপর আমার আসল জায়গায় ফিরে গিয়ে কাজে মন দেবো। তখন না থাকবে কোনো ফারহান,,,,,,না থাকবে কোনো মোহ!

—————-

আজ ২২ ই জুন। বাংলা তারিখ হিসেব করলে আষাঢ়ের ৬ তারিখ। অন্যান্য দিনের তুলনায় আজ সকালটা বেশ পরিষ্কার। ক্ষণে ক্ষণে পাখিরা শুভ্র আকাশে উড়াল দিচ্ছে বিরতিহীনভাবে। আফরা সিদ্ধান্ত নিলো আজ মর্নিং ওয়াক করবে এই পিচঢালাই চা বাগানের পথ দিয়ে। ফাহিমের সাথে আগেই কথা বলে রেখেছিলো এ ব্যাপারে যাতে আফরার সাথে সঙ্গ দিতে পারে। কেননা ফাহিম বরাবরই স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ। তাই সকালে এরকম একটা মানুষের সাথে মর্নিং ওয়াক করলে মন্দ হবেনা।

আফরা ট্রাউজারের পকেটে মোবাইল ঢুকিয়ে কানে ইয়ারফোন গুজে দিলো। পায়ে হোয়াইট কেডস পড়ে দ্রুতপায়ে সিড়ি বেয়ে নেমে গেলো বাহিরের দিকে।অল্পবিস্তর নীল আকাশের মাঝ দিয়ে উড়ে যাওয়া শুভ্রমেঘের দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ আফরা। দেখতে ভালোলাগছে এই পুন্জ পুন্জ মেঘ।আফরা এবার আশেপাশে তাকালো ফাহিম আছে কিনা। একপাশে পেয়েও গেলো। আফরা সেখানে দ্রুতপায়ে যেতেই হঠাৎ পা থামিয়ে দেয় ফাহিমের পাশের ব্যাক্তিটিকে দেখে। মানুষটা ফারহান। ধূসর রঙের ট্রাউজার আর সাদা টিশার্ট পড়েছে। বুকের একপাশে ‘Adidas’ এর লোগো ঝুলানো। পায়ে কালো কেডস পড়েছে। আফরা জানতো ফর্সা মানুষদের নাকি কালোরঙে চমৎকার মানায়। তবে শ্যামবর্ণের মানুষদের ধূসর আর সাদা রঙের সংমিশ্রনে এতটা দুর্দান্ত লাগে ফারহানকে দেখে তা আয়ত্ত করে নিলো সে।

গতরাতের ওদের কাটানো মুহুর্তগুলোর কথা মনে পড়ে লজ্জাও লাগছে বেশ। ইসস! তখন ওরকম করে না বললেই মনে হয় ভালো হতো। সকল অস্বস্তির বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আফরা এগোলো ফাহিম আর ফারহানের উদ্দেশ্যে। মুচকি হেসে বলে ওঠলো,

-গুড মর্নিং এভরিওয়ান!

-মর্নিং!

প্রতিউত্তরে বললো ফাহিম। তবে ফারহান নিশ্চুপ। আফরার দিকে চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ ফারহানকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভড়কে গেলো আফরা। নিজেকে দেখে নিলো একপলক। না! সবকিছু তো ঠিকই আছে। তবে মানুষটা এভাবে তাকিয়ে আছে কেনো? আফরা তাই সরাসরি প্রশ্ন করলো,

-এনি প্রবলেম ফারহান? এভাবে তাকিয়ে আছেন কেনো?

-আপনিও কি মর্নিং ওয়াকে যাচ্ছেন আমাদের সাথে?

ফারহানের কাট কাট প্রশ্ন। ফাহিম হঠাৎ ফারহানের এরূপ আচরণে অবাক। তাই বিষয়টা সামাল দেওয়ার জন্য বললো,

-ওহ! তোমায় বসতে ভুলে গিয়েছিলাম। আফরাও আসলে আমাদের সাথে মর্নিং ওয়াকে যাবে।

ফারহান আবার নিজের বড় বড় চোখ দিলে পর্যবেক্ষণে করে নিলো আফরাকে। এই দৃষ্টিতে কোনো অশ্লীলতা না থাকলেও একরাশ তীব্রতা ছিলো। একজন বাঙালি মেয়ে স্বাভাবিকভাবেই বিব্রত হয়ে পড়ে এমন দৃষ্টিতে । তবে আফরার মধ্যে এমন কোনো বিষয় লক্ষ করা গেলো না।সে দাঁড়িয়ে আছে ঠায়ভাবে। বেশ কিছুক্ষণ মৌনতা কাটানোর পর আফরা বিরক্তি নিয়ে ফারহানকে বললো,

-গতকাল আমি আপনাকে এভাবে দেখছিলাম বলে কেমনটা করেছিলেন। এবার আমায় এভাবে দেখছন কেন? খেয়ে ফেলবেন নাকি?

ফাহিম বোকার ন্যায় আফরা উদ্ভট কথার শুনে ফারহানের দিকে তাকালো। ফারহান একটু অপ্রস্তুত হলেও সামলে নেয় নিজেকে। এই মেয়ে ভারি সাংঘাতিক। অন্য চার-পাঁচটা মেয়ের মতো লজ্জার ছিটাংশ এর মধ্যে নেই। যা বলে কাঠ কাঠ গলায় বলে ফেলে। এই পর্যন্ত বেশ কয়েকবার নিজের কথা দিয়ে ফারহানকে বাকশূণ্য করে ফেলেছে আফরা যা এই রাজনীতির জীবনে অন্য কেউ করতে পারেনি। আর এই ভিনদেশী মেয়েতো অন্যরকম।

-আপনি কাইন্ডলি আপনার টপসটা চেন্জ করে আসুন।এটা বাংলাদেশ। আপনি চাইলেই স্লিভলেস টপস পড়ে যেখানে সেখানে মর্নিং ওয়াক করতে বেরোতে পারবেন না।

মৃদু গলায় বলে ওঠলো ফারহান। মনোহরী চোখের প্রখর দৃষ্টি এখনও নিবদ্ধ করে রেখেছে আফরার দিকে। আফরা অল্পবিস্তর অবাক হয়ে নিজেকে পরখ করে নিলো পুনরায়। মর্নিং ওয়াকের জন্য বরাবরের মতো ট্রাউজার আর স্লিভলেস টপস পড়েছে। ফারহানের কথাটি অজান্তেই ইগোতে লেগেছে ওর। অপমানে থমথম করছে ওর মুখখানা। দাঁতে দাঁত চেপে এবার বললো,

-টপস না পড়লে পড়বোটা কি শুনি?

-হাফ হাতা টিশার্ট পড়ুন।

-আমার সব টিশার্ট লন্ড্রিতে দিয়েছি আজ। যদি জানতাম যে আপনার জন্য স্লিভলেস টপস পড়তে পারবো না তবে আগেই আর এখানে আসতাম না।

আফরার রাগ লাগছে প্রচন্ড। এককথায় রাগে শরীর রি রি করছে। ওর কোনো কাজে বাঁধা দেওয়াটা কখনোই সে পছন্দ করেনা। আর এই অসভ্য মানুষটা কিভাবে ইনডাইরেক্টলি ওকে বাধা দিলো। ফারহান বুঝতে পারলো না এখানে রাগ করার মতো কি আছে। মুখ দিয়ে অস্ফুটস্বরে তাই বলে ওঠলো, ‘স্ট্রেইন্জ গার্ল!’

আফরা বাংলোর ভেতর ঢোকবে তখনই ফারহান ফাহিমকে বললো,
-ফাহিম ! তুমি এখানে দাঁড়াও আর আফরাকেও দাঁড়াতে বলো। আমি আসছি।

বলে নিজের ছোট কুটিরটির দিকে পা চালানো ফারহান। আফরাকে সরাসরি না বললেও ফাহিমকে বলাতেই আফরা দাঁড়িয়ে গেছে। দু’মিনিটের মধ্যে একটা ডার্ক চকলেট টিশার্ট নিয়ে আসলো ফারহান। আফরাকে তা ছুড়ে মারতেই আফরা তা ক্যাচ করে ধরে ফেললো। হঠাৎ এভাবে টিশার্ট ছুড়ে মারাতে আফরা হতভম্ব হয়ে গিয়েছে। ফারহান পকেটে হাত গুজে শীতল গলায় বললো,

-পাঁচ মিনিটের মধ্যে এটা পড়ে আসুন। আমি আর ফাহিম গেটের কাছে অপেক্ষা করছি। জলদি!

আফরা কিছু বলতে যাবে ফারহান পা চালিয়ে চলে গেলো গেটের কাছে। ফাহিমও গেলো সাথে সাথে। আফরার ফারহানের কথাগুলো বুঝতেই সময় লাগলো বেশ। কপালে পড়েছে সামান্য ভাঁজ। উহ্! মানুষটা এমন কেনো? এতক্ষণ উল্টাপাল্টা কথা শোনালো আর এখন নিজেই ওর টিশার্ট পড়তে দিলো আফরাকে। ভাবতেই আফরার গালে রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়লো অজান্তেই!!!
.
.
.
#চলবে……..ইনশাআল্লাহ!!

ভুলক্রুটি ক্ষমাসুলভ চোখে দেখবেন।