অতিরিক্ত চেয়েছি পূর্ণতায় পর্ব-১৩

0
344

#অতিরিক্ত_চেয়েছি_পূর্ণতায়
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_১৩

রাফিয়াকে থামানোর কোনো উপায় না পেয়ে রুজহান এসে এক ঝটকায় তাকে কোলে উঠিয়ে নেয়। যার ফলশ্রুতি ভেবাচ্যাকা খায় দুজনে। আহত মিজবান মা’ইর খেয়ে কাহিল। সে আপাতত চোখে সরষে ফুল দেখছে। চোয়াল শক্ত করে রাফিয়া কি’ল ঘু’ষি হাত দিয়ে মা’রতে নিলে রুজহান শান্ত নজরে তাকায়। থেমে যায় তার হাতজোড়া। রুজহানের ভয়ানক চাহনী পেড়িয়ে আঘাত করার মত সাধ্য আজও রাফিয়ার হয়নি। তবুও সে কাঁপা গলায় বলে,

‘এ এ আমাকে উ উঠালেন কেন ছাড়েন নিচে নামান বলছি।’

রুজহান বিনা শব্দে নাবিলের আসামী রুম থেকে রাফিয়াকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। নাবিল ভ্রু কুঁচকে লাভ বার্ডস কে দেখে মৃদু হাসল। অপরপাশ্বে রাফিয়া চিৎকার করে মিজবান কে যা নয় তা বলে নিজের মনের গালমন্দ করে চলেছে। কান যেন পেকে গেল রুজহানের। পট করে রাফিয়াকে ছাড়ল ফুয়ারার পানিতে। ভিজে জুবুথুবু হয়ে গেল। পানির উপর মুখ বের করে জোরে শ্বাস ছাড়তে লাগে। রুজহান চর্তুপাশ্ব গাড় দৃষ্টিতে পরখ করে নেয়। কোনো ছেলে বা মেয়ে আছে কিনা দেখল। নেই দেখে সে নিজে ফুয়ারার সঙ্গে এটার্চ লোহার চেয়ারে বসে বলে,

‘রাগ কমছে মহারাণীর! গরুর মত এত হাত পা চালাস কেমনে হে! খালি ছাগলের মত ম্যা ম্যা করে কানের বারোটা বাজিয়ে ছাড়িস। মানুষ না যেন একটা গাভী!’

রাফিয়া পানির উপর থেকে উঠে লোহার চেয়ারে ধপ করে বসে পড়ে। তার শরীরের দিকে কারো দৃষ্টি পড়ার পূর্বেই রুজহান কোথার থেকে একটি তোয়াল এনে তার পেছন থেকে জড়িয়ে নেয়। মাথা পাতলা লাগছে এ মুহুর্তে রাফিয়ার। নাবিলের সঙ্গে সেও ছিল মিজবানের বয়ান শুনতে। কারণ নাবিল জানিয়ে ছিল আসামীর পক্ষ থেকে তাদের ঘনিষ্ঠ কাউকে পাওয়া গেছে। শুনে রাফিয়া ছুটে আসে। কিন্তু আসামীর পক্ষত্বকারী ব্যক্তিকে দেখতে পেয়ে যতটা না খুশি হয়ে ছিল ততটা কষ্ট পেয়েছে। কারণ বন্ধুগণের মাঝে মিজবান ছিল খুবই শান্ত ছেলে। যাকে বিশ্বাস করতো রাফিয়া। তার সঙ্গে মজা করতো ঠিকি তবে ছলনার স্বীকারোক্তি করেনি তাকে। তাই তো জেদ ধরে এলোপাথাড়ি আঘাত করে ছিল সে রুমে।

‘ভাবনা যদি শেষ হয়ে থাকে তবে বাইকে উঠবেন মহারাণী! না দিনের আলোতে গরমে ফ্রেন্স ফ্রাই হওয়ার ইচ্ছে আছে।’

মুখ ভেটকিয়ে রাফিয়া দ্রুত পায়ে হেঁটে বাইকে উঠে বসে। রুজহান মিটমিটিয়ে হেসে বাইকে উঠে হেলমেট পরল। বাসায় আসা অব্দি রাফিয়া টু শব্দটুকু করল না লজ্জার কারণে। ছুটে নিজের রুমে গিয়ে দরজা আঁটকে দেয় সে। মিসেস আরজিয়া ভ্রু কুঁচকে তাকায় ছেলের দিকে। আবার কি করল ছেলেটা তার ফুলের মত মেয়েটার সঙ্গে জিজ্ঞেসাসূচক দৃষ্টিতে এগিয়ে যায়। মাকে এগোতে দেখে রুজহান কে আর পায় কে! ভৌদৌড়ে সেও তার বাইক চালু করে বেরিয়ে যায়।

কাপড় পাল্টে মাথা মুছতে থেকে আয়নার সামনে এসে দাঁড়ায় রাফিয়া। তখনি টুং করে ফোনের মধ্যে একটি বার্তা এলো। সে দৃষ্টিকোণে চেয়ে ফোনের স্ক্রিনে চাপ দেয়। উজ্জ্বল স্ক্রিনে পরিলক্ষিত হলো ব্যারিষ্টার গন্ডালের বার্তা। চোখ পাঁকিয়ে বার্তাটি খুললে দেখতে পেল রুজহানের অপূরণীয় ইচ্ছে।

‘ও প্রিয় প্রাণচঞ্চলী আসবে আমার জগৎ এ! দেখবে একটি সুরেলা গীতময় দিবস!
দেখবে একটি সুদূর নীলঘেরা নীড়।
ছুটে যেতে চাই যে তোর সঙ্গে ঐ নীড়ালা আকাশে।
এক তীব্র বাতাসের বেগে তোকে নিয়ে হাঁটতে চাই রে পাগলী। কেন বুঝিস না এই পাগল কড়া মানুষটির মন!
ভয় হয় কেন তোর বল তো আমায়!
সব ভয়টুকু ভাগ করতে দেয় আমায়।
বিশ্বাস করে একবার হাতটুকু ধরে দেখ।
নিরাশ করার সাধ্য হবে না একবারো।’

বার্তাটা পড়ে কিঞ্চিৎ সময়ের জন্য আবেগী হয়ে পড়ে রাফিয়া। সে আজও ইফতিয়াসকে ভালোবাসে এমন কথাটা ভাবা বোকামী নয় কি! সে তো ইফতিয়াসকে ঐদিনই মন থেকে বের করে দিয়ে ছিল। স্থানটি রুজহানকে সে দিতে চাই। তবুও কোথাও এক বাঁধা অদৃশ্যভাবে এটেঁ রয়েছে তাদের মাঝে।

____

মিস এরিশার কোর্টের মামলা শেষমেষ অন্য এক এডভোকেট হাতে নেয়। বেশ ক্ষোভ থাকলেও মামলার কারণে সে নিজের ক্ষোভ দমে নেয়। মামলার পক্ষ থেকে এও জানতে পারল ব্যারিষ্টার তাওসীফের গার্লফ্রেন্ড আছে। এমন কথাটা শুনে কেনো যেন স্বেচ্ছায় রুজহানের উপর থেকে নিজের রাগ মিটিয়ে নেয় সে।
অন্যত্রে মার্কেটে ছন্দবেশে এসেছে ইফতিয়াস ও ইশিতা। আজ ইশিতার ভীষণ ইচ্ছে জেগেছিল স্বামীর জন্য নতুন কাপড় নেওয়ার। বার বার এক কাপড় ধুয়ে পড়া তার কাছে ইরেটেটিং মনে হয়। ইফতিয়াস রীতিমত বিরক্ত হলেও ভাবভঙ্গিমায় প্রকাশ করছে না। বরং তাল মিলিয়ে স্ত্রীর সাথে হাহা হিহি করে বেড়াচ্ছে। সে জানেও না তার কারণে তারই অজান্তে থানায় জেলবন্দি দিন কাটাচ্ছে তার বাবা নাহিরউদ্দীন সাহেব। বাড়িতে একলা যাবত কয়েকদিন অসুস্থতায় জীবন পাড় করছে মিসেস রহমানা। তার বোন অর্থাৎ রাফিয়ার মা ও বোন একা করে চলে গিয়েছে তাকে।
এসবের প্রতি বিন্দুমাত্র কোনো ধারণা নেই তার মাথায়।

ইফতিয়াস ইশিতাকে কাপড় নিতে বলে নিজে বাহানা দিয়ে শপ থেকে বের হয়। একটা শাড়ির দোকানে ঢুকে দামি একটা জরজেট শাড়ি কিনে। মনে মনে তৃপ্তির হাসি দেয় সে আর বলে,

‘রাফুর শরীরে শাড়িটা বেশ মানাবে। এমনেও আমার রাফু সুন্দর এই শাড়িতে পুরুই সুন্দরের দেবী লাগবে।’

প্যাকেট করে চোরা দৃষ্টিতে এক পলক ইশিতার দিকে চেয়ে তৎক্ষণাৎ কুরিয়ার অফিসে গেল। সেখানে রাফিয়ার নামে প্যাকেটি কুরিয়ার করে। যখন রিসেপশনিস্ট জিজ্ঞেস করে ‘আপনার নাম’। তখন ইফতিয়াস কৌশলে তার নাম ‘প্রিয়তম’ বলে। এতে লোকটাও বিনা সংকোচে প্যাকেট মোড়া করে কুরিয়ারের জন্য কাজে লেগে পড়ে। খোশমনে শপে ফিরে এলে দেখতে পেল রাফিয়ার মা ও বোন সিএনজির পাশে দাঁড়িয়ে আছে। এতে তার মাথার টনক নড়ে। বাবা-মার খবরাখবরের কথা মনে উঠে। তাদের কাছে পেয়ে ক্ষমা চেয়ে পুনরায় রাফিয়াকে ফিরে পাওয়ারও তীব্র লোভ জাগে ইফতিয়াসের। বিনিময়ে দৌড়ে তাদের সন্নিকটে পৌঁছানোর চেষ্টা করে। তবে পেরে উঠেনি। সময়ের মাঝে সিএনজিতে বসে রাফিয়ার মা ও বোন চলে যায়। ইফতিয়াস ঘেমে একাকার। সুযোগ হাতছাড়া হলেও সে বিষন্ন মনে চুপছে যাবে না বলে দৃঢ় পণ করে রেখেছে। মাথায় হাত রেখে বিড়বিড়ে বলে,

‘যাই হোক আমি রাফিয়াকে ফিরে আনব। ইশিতা কেমন মেয়ে আমার বোঝা হয়ে গেছে। অল অফ মাই ফল্ট! রাফিয়ার মত হিরার টুকরোকে আমি কাঁচা মালের জন্য ছুড়ে ফেলছিলাম। কেন কেন!’

পাগলের মত নিজের কপালে চা’প্পড় দেয় ইফতিয়াস। নিজেকে শান্ত করে পুনরায় বলে,

‘এখনো সময় আছে। রাফুর জীবনে আসা ঐ রুজহানকে আমি আঘাতে জর্জরিত করেছি। সে আর ফিরবে না। পথের মধ্যে কাঁটা হিসেবে শুধু ইশিতা আছে। একেও সরিয়ে ফেলব। তবেই আমি আর রাফু সুখের সংসার করব। মেয়েটা অভিমান করবে সমস্যা নেই তাও আমি অভিমান ভেঙ্গে নিজের করব। ছোট ছোট বাচ্চাও হবে আমাদের। রাফিয়া বলতো তার বাচ্চা খুব পছন্দের। আমিও বাবা হয়ে বাচ্চার মায়ের সঙ্গে লেপ্টে থাকব। হে হে এটা গ্রেড আইডিয়া!’

‘ইটস অনলি ইউর ড্রিম স্যার! আমার জিনিসে কারো নজর দেওয়া পছন্দ করি না আমি।’

কণ্ঠটা শুনে চমকে উঠে ইফতিয়াস। পিছু ঘুরে চেহারাটা দেখে সন্দেহের কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে।

‘মানে কি বলতে চাইছেন আপনি!’

‘ব্যারিষ্টার তাওসীফের হবু বউ রাফিয়ার দিকে নজর দ্যাটস নট পসেবল!’

‘তাওসীফের হবু বউ রাফিয়া’ কথাটা যেন ঝংকার তুলে ইফতিয়াসের কানে। ঠোঁট কেঁপে উঠায় ঢোক গিলে বলে,

‘মিথ্যে বলছেন আপনি আমার রাফিয়া আমি ছাড়…।’

বাকি কথা সম্পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই বড়জোড় ঘু’ষি দেয় তার গালে রুজহান। ইফতিয়াস মুখ থুবড়ে পড়ে। ঠোঁট ফেটে যাওয়ায় গাল বেয়ে র’ক্ত বইতে লাগে তার। রুজহান অগ্নি দৃষ্টিতে চেয়ে চোয়াল শক্ত করে বলে,

‘কি বললি হা’রামজাদা! তোর রাফিয়া এই সাহস কত বড় রে তোর! আমারই বউয়ের নাম নিজের নামে বলিস। উঠ শা’লা।’

নাবিলও হাজির সেখানে! রুজহানকে মারাত্মক ভাবে ইফতিয়াসকে আঘাত করতে দেখে ভয় পেয়ে যায়। দৌড়ে গিয়ে তাকে ছাড়িয়ে নেয়।কনস্টেবল ইফতিয়াসকে গ্রেফতার করে। নাবিল রুজহানকে শান্ত করে। তবে সে শান্ত নয় বরং অগ্নি মিশ্রিত কণ্ঠে চেঁচায়।

‘তোর কলিজা কাঁপানো জেলবন্দি করব তুই দেখ কেমনে তোর মরণ প্রায় জ্বলন হয়। স্পেশাল রুমে তোকে বন্দি করা হবে। কনস্টেবল নিয়ে যান কু*কে।’

কনস্টেবল টেনে হিচড়ে জিপে বসায় ইফতিয়াসকে। সে ঘোরের মধ্যে চর্তুপাশ্ব চোখ বুলাচ্ছে। ইশিতার দেখা পাওয়ার জন্য। তবে পেল না। মাথা নুয়ে গেল তার। বিপদের সময় মেয়েটা হাত গুটিয়ে পালাল। অথচ এতদিন তার সঙ্গে শুয়ে,চাহিদা মিটিয়ে রঙতামাশা করেছে। মেয়েটার জায়গায় রাফিয়া হলে জীবনেও হাত তো কি সঙ্গও ছাড়তো না। নাবিলের দিকে চোখ পাঁকিয়ে চেয়ে শাঁসায়।

‘কু**কে মে’রে একদম হাড়গোড় ভেঙ্গে দিবি। ঐ ইশরাকের মত নির্দোষ মানুষটার উপর আক্রমণ করেছে, রাফিয়াকে নিয়ে কুদৃষ্টির সঙ্গে বাজে ইচ্ছে পোষণ করেছে। একদম মরণপ্রায় দশায় পরিণত করবি। আজ ভাগ্য ভালো বাসায় থাকেনি। শপের সামনে বাইক থামালে সুইমিং পুলের মাঝে ইফতিয়াসের মত কাউকে দেখতে পায়। ভাবছি অন্য কেউ তবে মনের সন্দেহ দূর করতে এগিয়ে গেলেই আসল ব্যক্তির রুপ ভেসে দেখথে পায়। তখনি গিয়ে তার বাজে মন্তব্য শুনছি আর রাগে ইচ্ছেমত গা’লে দিছি।’

‘হয়ছে তুই থাম ব্যাটা! এত অস্থির হলে বুঝি সব ঠিক হয়ে যাবে! এখনো মূল কালপ্রিটকে পাওয়া যায়নি। মানে ইশিতাকে। যে আসল খেলার মালিক।’

ইশিতা সকলের অগোচরে মুখে উড়না পেঁচিয়ে বসে ছিল। সব তার চোখের সামনে হলেও তার মনটা ইফতিয়াসের জন্য ছটপট করছিল। রাফিয়াকে নিয়ে কোনো মামলা, কথা সে পছন্দ করে না। তবুও বন্ধুত্ব বলে চুপ করে রইল। ইশিতা তার পার্স থেকে টাকা বের করতে নিলে একটি কার্ড জমিনে পড়ল। কার্ডটা কি ভেবে যেন নিজের হাতে নেয় সে। কার্ডের উপর মিস্টার সাবের লিখাটি দেখে দাঁড়িয়ে যায় ইশিতা। পার্স থেকে টাকা বের করে রিকশা নেয়।
অন্যত্রে রুজহান তার মন প্রান্তে লুকিয়ে থাকা কথা পুষে রাখে। কাল সে সারপ্রাইজ দেবে তার প্রাণচঞ্চল কে।

চলবে………