অতিরিক্ত চেয়েছি পূর্ণতায় পর্ব-১১

0
297

#অতিরিক্ত_চেয়েছি_পূর্ণতায়
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_১১

রুমের দরজা ভেঙ্গে ভেতরে এলো রুজহান। রাফিয়ার আহত চিৎকারে যেন সে উত্তেজিত হয়ে অস্থির হলো। রুমের ভেতর এক কোণায় মনমরা হয়ে হাটুঘেরে বসে আছে রাফিয়া। রুজহান তার মা-বাবাকে আসতে দেখে দরজা আঁটকে দেয়। এতে তারা মাঝরাস্তায় থেমে যায়। দুজন একে অপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করে পুনরায় পা ফিরিয়ে সোফার রুমে চলে যায়।
গলা খাকড়ি দিয়ে রাফিয়ার কাছে গিয়ে দাঁড়ায় সে। মজার ছলে বলে,

‘আজ উড়নচুন্ডীর বুঝি তেজ কমে গেছে। কই রে তোর জ্ঞান আছে তো। নাকি জ্ঞানশূন্যতায় ভোগচ্ছিস। যাই হোক আমার একটা তুইই পছন্দ। খালি ইফতি ইশরাক না করে নিজের মনে একটু রুজহান রুজহানও বরাদ্দ করতে শিখ বুঝলি।’

কথার সমাপ্তি হতেই জোরালো চ’ড় পড়ে রুজহানের গালে। রাগে ফোঁস ফোঁস করে উঠে রাফিয়া। হাত জ্বলছে তার ব্যক্তিটার গালে চ’ড় লাগানোর ফলে। চোয়াল স্বাভাবিক রেখে মৃদু হেসে তাকায় রুজহান। অথচ চোয়াল শক্ত করে রাফিয়া বিরক্তির গলায় বলে,

‘তোকে কতবার বলেছি আমার কাছ থেকে দূরে থাকবি। তা নয় বারে বারে এসে জীবনটা শুধু নরক বানাচ্ছিস। আচ্ছা বলতে পারবি কেন পিছে পরে আছিস। ভার্সিটির মধ্যে কেউ আমার সঙ্গতা পছন্দ করছে না। বরঞ্চ অন্য সময় আমাকে না পেয়ে তারা গল্পের আসরও জমাতো না। আজ সেই বন্ধুগণ আমাকে সহ্য করছে না একমাত্র তোর কারণে। কেনো আমার শান্তি,হাসিখুশি কি তোর কাছে সহ্য হয় না বল! কি দোষ করে ছিলাম আমি! ইশরাক শুধু বন্ধুই ছিল। কেনো তুই থাকে মা’রলি! শুধু যে মা’রলি তা নয় একদম হাড়গোড় ভেঙে মেডিক্যাল ভর্তি করিয়েছিস বল আমায়! কেন করলি!’

ক্রোধের সঙ্গে তার গলা কেঁপে উঠছে বারংবার। তবুও সে রুজহানের গলায় নখের দাগ বসিয়ে আচড়ে দেয়। সে নিশ্চুপ ভঙ্গিমায় রাগান্বিত রাফিয়ার কার্যাদি দেখছে। ব্যথা হলেও পাত্তা দিল না। ভাবল ভালোবাসার মানুষটিই যদি ব্যথা না দেয় তবে সে ব্যথাই বা কেমন ব্যথা! রোবটের মত নিরব থাকা রুজহানকে দেখে রাফিয়ার মাথা বিগড়ে গেল। তার বাহু ধরে দরজার বাহিরে গিয়ে ঠেলে দেয়। ধড়াম করে দরজা আঁটকে দেয়। রাফিয়ার করা ব্যবহারে রুজহান নিসাড়পূর্ণ মনে তার নিজের রুমে গেল।
আয়নার সামনে এসে নিজের গলা পরখ করতে লাগে রুজহান। দেখতে পেল গলার মধ্যে র’ক্ত জমাটবদ্ধ স্থান। সেখানে হাতের পরশ বুলিয়ে নিস্তদ্ধ স্বরে বলে,

‘রাফু তুই আজও আমায় বুঝলি না! দোষ না করেও বুঝি দোষী হতে হলো। কেন রে আমাকে কি দেখেছিস কোনো দোষ করতে! তাহলে কেন এই চ’ড় এই মিথ্যা অপবাদ আমার নামে বলেছিস। চ’রিত্র নিয়ে কথা উঠা আমি মোটেও পছন্দ করিনা। আজ তুই সেই চরম অপবাদ দিলি। এই অপবাদের সত্যতা বের না করতে পারলে আমার নামও তাওসীফ রুজহান না।’

রাফিয়া ফুপিঁয়ে কাঁদছে। তার করা কাজটি সঠিক কিনা সে জানে না! তবে তার কষ্ট হচ্ছে রুজহানের সেরুপ কষ্টময় চাহনী দেখে। তপ্ত শ্বাস নিয়ে ওয়াশরুমে যেতে নিলে তার ফোনে একটি কল চলে আসে। কল পেয়ে সে থেমে ফোনটি হাতে নেয়। ফোনের স্ক্রিনে ‘ডাক্তার’ লিখা শব্দটি দেখে হৃদস্পন্দন তেজ হয়ে যায় তার। কল রিসিভ করে সালাম দিতেই এক নির্মম ঘটনার সম্মুখীন হয়ে পড়ে। দিগিদ্বিক হারিয়ে তৎক্ষণাৎ এক কাপড়ে বাসা থেকে ছুটে বেরিয়ে যায়। রুজহান জানালা দিয়ে ছুটে যাওয়া রমণী অর্থাৎ রাফিয়াকে দেখে চমকে গেল। তাকে বিধ্বস্ত দেখাচ্ছিল। এতে ভয় হলো তার। ফলে সেও চিন্তাহীন দৌড়ে গেল।
____

মেডিক্যালের কেবিনে পায়চারী করছে রাফিয়া। অসুস্থ মানসিক ভারসাম্যহীন সামিয়া হঠাৎ সুইসাইড করল। কিছু বুঝতে উঠতে পারছে না সে। অপারেশনের কেবিন হতে চিৎকার ভেসে আসল। ভয়ে যেন জমে গেল রাফিয়া। কি হলো ভেতরে ভাবতেই তার জান বেরিয়ে পড়ার উপক্রম! সে নিজের অধৈর্যতা পুষে রাখতে পারল না। কেবিনের দরজা টেলে ভেতরে চলে গেল।
ডাক্তাররা ভয়ার্ত দৃষ্টিতে রাফিয়ার দিকে তাকায়। অন্যত্রে রাফিয়ার দৃষ্টি নার্সের হাতে থাকা ছোট লোহার ট্রের উপর। যেখানে ছোট একটি প্রাণ রাখা আছে। র’ক্তে মাখামাখি তার সে প্রাণের উপর। রাফিয়া নির্বাক দৃষ্টিতে এগিয়ে গেল ট্রের কাছে। কাঁপা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে।

‘সামিয়ার কি হয়েছে ডক্টর! তার মাত্রাতিরিক্ত সাদা কেনো লাগছে!’

ডাক্তাররা নিশ্চুপ। নার্সগণ ছলছল দৃষ্টিতে মাথানত করে আছে। রাফিয়া এবার গর্জে উঠে। ডাক্তারের কলার চেপে ধরে বলে,

‘তোরা ডক্টর হলি কিসের জন্য দুটা প্রাণের জীবন রক্ষা করতে পারলি না। তোদের লাইসেন্স কেটে দেওয়া উচিৎ। সবগুলো গর্দভভরা পড়াশুনা করেছিস। বেক্কল ফিরিয়ে দেয় আমার বোনকে বলছি না ফিরিয়ে দেয়।’

ডাক্তাররা পাগলের মত করা রাফিয়ার কর্মে ভয়ে নেতিয়ে উঠল। যদি কোনো ক্ষতিপূরণ করে দেয়। নিরব ডাক্তারদের কাছ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া না পেয়ে তেঁতে উঠে সে। অন্য ট্রের মধ্যে থাকা কাঁচি নিয়ে ডাক্তারদের দিকে এগিয়ে যায়। তারা নিজেদের বাঁচানোর জন্য বলে,

‘ম্যাম প্লিজ বিশ্বাস করুন আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। সামিয়া ম্যাম যে নিজেকে মে’রে ফেলবে তা ভাবতেও পারিনী। জানি না কেমনে ভুলবশত কাঁচি ছিল সেখানে। যার ফলে একমাসের বাচ্চাকে পেটে থাকা অবস্থায় কাঁচির আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করে আত্মহত্যা করে নিল। ম্যাম সত্যি আমাদের দোষ নেই।’

রাফিয়ার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। তার ছোট বোনের মত মেয়েটি আর নেই সঙ্গে ছোট নিষ্পাপ বাচ্চাটি তার মায়ের হাতেই মৃত্যু হয়েছে শুনে হিতাহিত জ্ঞান লোপ পেল তার। ‘নাহ’ বলে জোরসরো চিৎকার দিয়ে কাঁচি ডাক্তারের চোখে ঢুকাতে নিলে কেউ এসে তাকে জাপ্টে নেই। যার কারণে তার ছাড় পাওয়ার চিৎকার পরিণত হলো কান্নায়। ‘সামিয়া’ বলে বলে কাঁদছে সে ঐ ব্যক্তিকে জড়িয়ে ধরে। তার মাথায় আশ্রয়ের হাত বুলিয়ে দিচ্ছে ব্যক্তিটা। তার চোখ-মুখ শক্ত হয়ে আছে। কাঁদতে কাঁদতে কবে যে রাফিয়া জ্ঞান হারিয়ে ফেলল তার খবর নেই। ব্যক্তিটি রাফিয়ার মুখে বার দুয়েক মৃদু চ’ড় লাগিয়ে ‘রাফিয়া উঠ, রাফুরাণী কি হলো!’ বলে উঠে। উত্তেজিত মন তার প্রেয়সীকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে সিক্ত হলো। তৎক্ষণাৎ রাফিয়াকে কোলে উঠিয়ে নেয়। তার দিকে চেয়ে আহত কণ্ঠে আওড়ায়।

‘কেন লুকিয়ে রাখিস নিজের কষ্ট রাফু ! আমাকে কি নিজের শূন্যতার স্থানে পূর্ণতা আনার সুযোগ দিতে পারবি না! এই যে কাতর আমি তোর রুজহানের প্রাণ ছটপট করে যে। তোর হালকা জ্ঞান হারানোও আমার কাছে মারাত্মক বিষয় বলে মনে হয়। প্লিজ ছেড়ে যাস না রে। পাঁচবছর আগে ছেড়ে গিয়েও ম’রে যাবার মত দশা ছিল আমার।’

নিজের আবেগ বলাতে রুজহানের চোখে অশ্রু জমাট হলো। তবে সে অশ্রুসিক্ত করল না। শক্ত মনে রাফিয়াকে অন্য কেবিনে নেওয়ার ব্যবস্থা নেয়। সামিয়ার চিকিৎসায় মননিবেশিত ডাক্তারগুলো আজ রেহাই পেল। তবুও কোনো এক কারণে তাদেরও সামিয়ার প্রতি টান বা মায়া ছিল বলেই মেয়েটার অকাল মৃত্যু সহনশীল লাগছে না। ব্যথিত মনে তারা লাশ দাফনের প্রতিকর্ম আরম্ভে ব্যস্ত হলো। কেননা রুজহান এর অনুমতি প্রদান করেছে। সে রাফিয়ার লোকেশন ট্র্যাক করার পর তার মেডিক্যাল আসার কারণ জানতে পারে। এও জানল যে সামিয়া নামের মেয়েটি ইফতিয়াসের লালসার স্বীকার। তথাপি প্রতারণার ঘটনা জেনে নিজের মানসিক ভারসাম্য হারায়। অতঃপর রাফিয়া তার দেখভালের দায়িত্ব নেয়। কড়া নজরদারির জন্য সে সুস্থ হওয়ার পথে ছিল। কিন্তু যখন সে জানল তার গর্ভে এক প্রাণ এসে পড়েছে যা ইফতিয়াসের র’ক্ত। সেই থেকে ডিপ্রেশনের মত ক্ষতিকারক চিন্তার সম্মুখে পড়ে। প্রতিদিন ইফতিয়াসের কথা ভেবে শারীরিক ও মানসিকভাবে দূর্বল হয়ে আজ এই আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় সামিয়া। প্রতিটা কথা সে অক্ষরে অক্ষরে জানতে পারে রাফিয়ার লুকায়িত গোপন কথ্য আলাপ থেকে। সে তার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী কে নিজের মধ্যে জমায়িত প্রতিটা কথা ভাগাভাগি করে। অথচ রুজহান নিজে যে সর্বদা চেষ্টা করে তার মন পেয়ে মনের কথা জানার। তা পেড়ে উঠতে পারে না রাফিয়ার নিজের উপর জেদ থাকার কারণে। সে ইফতিয়াসকে ভালোবেসে ছিল এতে সে প্রতারণার শামিল হলেও প্রতিক্ষাবদ্ধের ন্যায় নিজেকে দৃঢ় রুপে শক্ত করে রেখেছে। রাফিয়ার শান্ত নিসাড় মুখশ্রীর দিকে চেয়ে রুজহানও নিজের সঙ্গে প্রতিক্ষাবদ্ধ হলো।
অজ্ঞানরত রাফিয়ার মাথায় সুপ্ত হাতের পরশ দিয়ে বলে,

‘এবার থেকে তুই যত দূরে যাওয়ার চেষ্টা করবি আমি ততই তোর কাছাকাছি এসে হাজির হবো। খুব তো জেদ আর তেজ তোর তাই না! ঠকেছিস তার মানে এই না যে আমার কাছ থেকেও ঠকবি। এমন ভাবলে ভুল ভাবছিস মেরিজান। আমার থেকে এবার দূরে যাওয়ার চেষ্টা করলে তোকে নিজের বন্দিনী বানিয়ে ফেলব। দ্যাটস উইল বি হ্যাপেন্ড সুন ইন শা আল্লাহ।’

বাঁকা হেসে রাফিয়ার কপালে ঠোঁট চড়াও করে চুমু খায় সে। অজ্ঞানরত দশায় বুঝতে পারেনি রুজহানের কোনো কথা। ডাক্তার চিকিৎসা করে বলে,

‘ম্যামের শরীর আজ বড় সংবাদ নিতে না পারায় জ্ঞান হারিয়েছে। আমি দূর্বলতা কাটানোর ইঞ্জেকশন দিয়েছি। দেড় ঘণ্টা পরে তার জ্ঞান ফিরে আসবে।’

রুজহান মাথা নেড়ে সায় দেয়। ডাক্তার চলে যেতে গিয়ে পুনরায় ফিরে এসে বলে ‘এক্সকিউজ মি মিস্টার রুজহান!’। রুজহান ডাক্তারের দিকে চাহনি নিক্ষেপ করতেই তিনি বলে,

‘সামিয়ার দেহকে কবর দেওয়ার ব্যবস্থা কবে করবেন!’

সামিয়ার কথাটা শুনেই রুজহানের মনটা বিষিয়ে উঠে। ছোট মেয়েটার জীবন নষ্ট করেছে ঐ শু’য়ো*** বাচ্চা। যদি হাতে পায় নিষ্পাপ মেয়ের জীবন নেওয়ার শোধ নিবে!

‘স্যার।’

সম্বিত ফিরল তার। সে ডাক্তারের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে রাফিয়ার ক্লান্ত চেহারার দিকে চেয়ে বলে,

‘জ্বি ব্যবস্থা করুন।’

রাফিয়ার দিকে ভাবান্তর থেকে নিজ জ্ঞানে সামিয়ার পরিবারে থাকা সদস্যদের খবর দেয়। এতে ওখানের পরিবেশটাও শোকে পরিণত হলো। নিজের মনে কাঠিন্যতা ভরে রাফিয়ার হাত ধরে বলে,

‘তোর নিজেকে শক্ত করতে হবে মেরিজান! এই শক্ত হওয়ার মূল কারণ হলো তোকে ভেঙ্গেগুড়ে দেওয়া। তোকেও সেই ওষুধ খেতে হবে যা আমি দে।।’

চলবে…..