#অথৈ জলের পুষ্পমাল্য
কামরুন নাহার মিশু
৪)
শর্মিলি আহমেদ ছেলের বাসায় পা দিয়েই বুঝতে পেরেছেন, এবাসার সব আর আগের মতো নেই। কোথায় যেন এক ছন্দ পতন ঘটেছে। তাঁর ছেলের সংসারে ছেলে, ছেলের বউ আর নাতি ছাড়াও অন্য কেউ শিকড় পুঁতে ফেলেছে বেশ গভীরে।
সত্তর বছর বয়সি শর্মিলি আহমেদ অভিজ্ঞতার আলোকে যে সন্দেহ করেছেন, সেটা নিশ্চিত হয়েছেন, বউমার মোবাইলে একবার না পেয়ে ছেলে অন্য নাম্বারে ফোন দিয়ে কথা বলায়। বিষয়টা আপাত দৃষ্টিতে স্বাভাবিক মনে হলেও শর্মিলি আহমেদের কাছে সেটা মোটেও স্বাভাবিক মনে হয়নি।
ছেলে বউকে না পেলে মাকে ফোন দেবে। সংসারের প্রয়োজনীয় কথা বউয়ের সাথে বলবে, দরকার হলে মা। অন্য অতিথির সাথে এত কিসের কথা! দীর্ঘদিন থাকলেও অতিথি ঘরের লোক হয়ে যায় না। অথচ তিনি লক্ষ্য করেছেন ছেলের আশেপাশে কোথাও বউ মা নেই। আজ রান্না করেছে কে? সীমা! শাওনের সুন্দর শার্টটা কে পছন্দ করেছে? সীমা! ঘরের ডেকোরেশান কে পরিবর্তন করেছে? সীমা!
বারান্দায় গাছ কে লাগিয়েছে? সীমা!
বুকশেলফে পছন্দের বইগুলো কার? সীমার! পুরো বাড়ি জুড়ে সীমা আর সীমা। অথচ সীমা এ বাসায় অতিথি ছাড়া কিছুই না। কোথাও বউমা নেই। সে যেন ছেলে হওয়ার অজুহাতে একঘরে হয়ে আছে অন্যের হাতে নিজের সংসার ছেড়ে দিয়ে।
এভাবে সংসার ছেড়ে দিতে গেলে না সংসারের প্রধান উপকরণ স্বামীই হাতছাড়া হয়ে যায়!
শর্মিলি আহমেদের মনের মধ্যে দানা পরিমান যে সন্দেহ ছিল সেটা সম্পূর্ণ পোক্ত হয়েছে মধ্য রাতে। আশ্চর্য সন্তান হওয়ার অজুহাতে বাবা কেন আলাদা বিছানায় ঘুমাবে? আলাদা ঘুমাতে চাওয়া কোনে অজুহাত নয় তো! সন্তান মায়ের একার নয় যে, সব কষ্ট, সব ত্যাগ মাকে শিকার করতে হবে। বাবার অফিস থাকলে মায়েরও সংসারে কাজ আছে।
যে ভুল চল্লিশ বছর আগে স্বামীর বিছানা আলাদা করে শর্মিলি আহমেদ করেছেন, সে একই ভুলের পুনরাবৃত্তি তাঁর ছেলের বউ করেন সেটা তিনি মোটেও চাননি। তাই নিজেকে সামলাতে না পেরে মাঝ রাত্তিতে ছেলের বউয়ের উপর তিনি বেশ মেজাজ দেখিয়ে ফেলেছেন।
তিনি লক্ষ্য করেছেন শাওন মায়ের সাথে কথা বলে নিজের রুমে ঘুমুতে চলে গেছে। শেষ বারের জন্য একটাবার স্ত্রীর সাথে দেখা পর্যন্ত করতে যায়নি। তিনি বেশ বুঝতে পেরেছেন ছেলে আর ছেলের বউয়ের মাঝে একটা সুক্ষ্ম দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। রুপাই এই দূরত্ব সৃষ্টির একমাত্র কারণ নয়।
একটা উপযুক্ত মেয়ে মানুষ সারাক্ষণ বাসায় থাকে। শাওন জাগার আগে জেগে উঠে। নিজে গিয়ে শাওনের নাস্তা রেডি করে দেয়, চা বানিয়ে দেয়। দরজা খুলে দেয়। ছুটির দিনে শাওনের পছন্দের মজার মজার খাবার রান্না করে দেয়। একসাথে টিভি দেখে, গল্প করে, বই নিয়ে আলোচনা করে। খুব সাবলিল সব আলোচনা।
এখানে আপত দৃষ্টিতে সন্দেহের কিছু নেই।
সন্দেহের কিছু আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে শর্মিলি আহমেদের পরিবারেও ছিল না। বাসন্তি শুধু সকালবেলা কাপড় ধুতে আর দুপুরবেলা ঘর মুছতে আসত। তেল চিটচিটে বাসি চেহারা, মাথা ভর্তি উকুন, এলোমেলো হলুদ দাঁত যার দিকে সেচ্ছায় দুবার তাকাতে ইচ্ছে করত না। শর্মিলি আহমেদের উদাসিনতার সুযোগ পেয়ে সেই….. কিনা ঘরের রাণি হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিল।
এরপর থেকে শর্মিলি আহমেদ স্বামী – স্ত্রীর পবিত্র সম্পর্কে মাঝে তৃতীয় কোনো ব্যক্তির ছায়া সহ্য করতে পারেন না। হোক না সে নিজের ছেলে, পুরুষ মানুষের চরিত্রে খোয়াতে দুইদিনও লাগে না।
শর্মিলি আহমেদের খুব মন খারাপ অহেতুক বউমাকে বকেছেন। মেয়েটা নিশ্চয়ই ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না, কেন এমন হচ্ছে! কারণ রূঢ় আচরণ তো তার শাশুড়ির স্বভাব বিরুদ্ধ।
শর্মিলি আহমেদ বউমার মনের ভয় কাটানোর জন্য রুপাইকে কোলে নিয়ে রীমার পাশে গিয়ে বসলেন,
” আমার রুপাই ভাইকে বাড়তি কি খাবার দিচ্ছ বউ মা?”
” একটু কলা, সামাণ্য ডিমের কুসুম। খিচুড়িও দেয়ার চেষ্টা করছি। কিন্তু কিছু খেতে চাচ্ছে না।”
” অসুবিধা নেই খাবে। আস্তে, আস্তে চেষ্টা করবে ঘরের খাবারে অভ্যস্ত করে তুলতে। বাহিরের সেরেলাক, সুজি এসব দেবে না কিন্তু। ”
” না, মা দেব না।”
” ঘরের কাজ করতে গিয়ে আমার দাদু ভাইয়ের যেন কোনো অবহেলা না হয়।”
” না, মা আপনি এসব নিয়ে চিন্তা করবেন না। ”
শর্মিলি আহমেদ বিড়বিড় করে বললেন,
” আমার চিন্তা তো অন্য জায়গায়।”
শাশুড়ির কথা ভালোভাবে বুঝতে না পেরে সীমা প্রশ্ন করল,
” কিছু বলছেন মা?”
” রীমা একটা কথা বলব? তোমাকে ইদানিং ভীষণ ডিষ্টার্ব মনে হয়। শাওনের সাথে তোমার সম্পর্কে ঠিক আছে তো!”
” এসব কেন বলছেন মা? বেঠিক হওয়ার মতো কি কিছু আপনার চোখে পড়েছে?”
” আমাকে না তুমি মা বলে ডাকো! মায়ের চোখ কি ফাঁকি দেয়া এত সহজ?”
হঠাৎ মায়ের এমন নেতিবাচক কথাবার্তায় রীমা ভীষণ হতবম্ভ হয়ে গেলে। শাওনের সাথে রীমার সম্পর্ক স্বাভাবিক নয়। দুইদিনের জন্য এসে মা বুঝতে পেরেছেন অথচ মাতৃত্বে রীমা এতাটাই নিমজ্জিত হয়ে গিয়েছিল যে একটাবারের জন্যও বুঝতে পারেনি।
একটা সময় শাওন স্বামীর অধিকারের জন্য মরিয়া হয়ে যেত। সারাক্ষণ পিছে পিছে ঘুর ঘুর করত কখন রীমার মনে দয়া হবে, রীমা শাওনকে কাছে টেনে নেবে। স্বামীর মন রক্ষার্থে একদিন রীমা কাছাকাছি আসলে, শাওন আপ্লুত হয়ে যেতে। পরেরদিন রীমার জন্য অফিস থেকে সারপ্রাইজ গিফট নিয়ে ফিরত। কখনো কখনো রীমার উপর রাগারাগি করত, জোর করে নিজের অধিকার আদায়ের চেষ্টা করত।
অথচ গর্ভধারণের কারণে হরমোনাল চেইঞ্চ সাথে শারিরীক কষ্টের কারণে রীমার মোটেও ইচ্ছে করতো না শাওনের কাছে যেতে। সে বিভিন্ন অজুহাতে দূরে থাকার চেষ্টা করত।
সেই যে শারিরীক চাহিদার ব্যাপারে রীমার অনিহা সৃষ্টি হয়েছে সেটা আজও পুরোপুরি ঠিক হয়নি। তবে ইদানিং আর শাওন পাগলামি করে না। রীমা না চাইলে শাওন কাছে আসে না। রীমা চাইলেও শাওন অনেক সময় অজুহাত খুঁজে এড়িয়ে যায়।
হঠাৎ মায়ের কথায় রীমার হুশ ফিরে এলো। সে ছুটে গিয়ে মোবাইল এনে শাওনকে ফোন দিল। নাম্বার বিজি। পাঁচ মিনিট পর আবার দিল, তখনও নাম্বার বিজি। অফিসের কাজ রেখে শাওন কার সাথে এত কথা বলছে।
শাওন ফোন রিসিভ না করায় রীমা মায়ের সামনে আবেগ ধরে রাখতে পারেনি। গলগল করে তার চোখ থেকে পানি বেরিয়ে।
শর্মিলি আহমেদ রীমার নির্বুদ্ধিতায় হতভম্ব হলেন,
” কী হলো রীমা?”
” জানি না মা।”
” শান্ত হয়ে বসো। এত অস্থির হচ্ছো কেন? কিছুক্ষণ পরেই শাওন বাসায় ফিরে আসবে। শোন মেয়ে স্বামী হচ্ছে একজন নারীর জন্য মূল্যবান সম্পদ, নারীরা মূল্যবান সম্পদ যেমন আলমারিতে আগলে রাখে স্বামীকেও তেমনি ভালোবেসে বুকের ঘরে যত্ন করে আগলে রাখতে হয়। না হয় মূল্যবান গয়নার মতো হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার ভয় থাকে।”
চলবে….