অথৈ জলের পুষ্পমাল্য পর্ব-০৫

0
300

#অথৈ জলের পুষ্পমাল্য

কামরুন নাহার মিশু

৫)

রীমা ফোন দেয়ার কিছুক্ষণ পর শাওন ফোন ব্যাক করল। অফিসের কাজে আজ সে বড় স্যারের সাথে চট্রগাম যাবে। রাতে বাসায় ফিরবে না। রীমার খুব মন খারাপ হয়ে গেল। বলা নেই, কওয়া নেই হঠাৎ শাওন চট্রগাম যাবে! কিন্তু কেন? এমন তো কখনো হয়নি।

কোনো না কোনো যৌক্তিক কারণে হোক বা অযৌক্তিক কারণে হোক শাওন দূরে সরে যাচ্ছে। কী দরকার ছিল আজ চট্রগাম যাওয়ার! দুইদিন পরেই যেতে পারত।

রীমার ঘুম আসছে না। সে কিছুক্ষণ বারান্দার এমাথা থেকে ওমাথা পায়চারি করল। শাওনকে মোবাইলেও পাওয়া যাচ্ছে না, সে মোবাইল পিক করছে না। যদিও আগেই বলা আছে বাহিরে কোনো জরুরী কাজে শাওন ব্যস্ত থাকলে অকারণে যেন ফোন করা না হয়।
আজ বাসায় শাওন নেই। রীমা চাচ্ছে ছোটবেলার মতো আজ রাতেও তারা দুইবোন সারারাত গল্প করে কাটাবে। তাই সে সন্ধ্যার সময় রুপাইকে সীমার রুমে রেখে এলো।

রীমা হাতের কাজ শেষ করে রুপাইয়ের কাছে গেল। ছেলেটা এখনো বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। মধ্যরাতের আগে উঠবে না। রুপাইয়ের পাশে কাত হয়ে শুয়ে আছে সীমাপাও। চোখ বন্ধ। পাশে পড়ে আছে কী একটা গল্পের বই। রীমা আসার সাথে সাথে সীমা উঠে বসল।

” কাল রাতে ঘুমাতে পারিনি একদম। শীর্ষেন্দুর দূরবীনটা পড়ে শেষ করেছি। আজ ধরেছি মানবজমিন। শাওনকে বলেছি পাঠাগার থেকে আরও কিছু বই এনে দিতে। তোর বাসায় আসার পর বই পড়াই হচ্ছে না একদম।”

বইয়ের প্রসঙ্গে না গিয়ে রীমা বলল,

” আপা আমার এখানে থাকতে কি তোমার খুব অসুবিধা হচ্ছে?”

” এই কথা কেন বললি?”

” না মানে! আমার অসুস্থতার অজুহাতে আজ প্রায় বছর হতে চলল তুমি আমার কাছে এসেছ। আমি সুস্থ হওয়ার পর রুপাই হলো। তোমার এতদিন বোন ছিল, এবার ভাগ্নে হলো। খালা হওয়ার অজুহাতে তোমারও দায়িত্ব বাড়ল, আর বাড়িতেই ফেরা হলো না তোমার। আর কত দায়িত্ব নেবে আমার। এবার আমি সব ঠিক সামলে নিতে পারব। মাও তো আছেন। ”

” কী যে বলিস পাগলের মতো! মা বেঁচে থাকলে যে কাজটা তিনি করতেন মায়ের বিকল্প হিসাবে সে কাজটা আমি করছি। ”

” সেটা ঠিক বলছ। মা বেঁচে থাকলে তোমাকে এত কষ্ট করতে হতো না।”

” আমি কি তোর জীবনে মায়ের চেয়েও কোনো অংশে কম। বলতে গেলে তোর জন্মের পর মা অসুস্থ হওয়ার কারণে তোকে কোলে পিঠে করে আমিই মানুষ করেছি। তুই আমার বোন কম সন্তান বেশি।”

কথা বলতে বলতে সীমার গলা ধরে এলো।

হঠাৎ এত ছোট কথায় সীমা রিয়্যাক্ট করবে রীমা ভাবেনি। সে ভীষণ অপ্রস্তুত হলো।

” দুঃখিত আপা। আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি। আসলে ভাইজান ফোন করেছেন তোমাকে নিতে আসবেন। আমিও চাই তুমি এবার বাড়ি যাও। তোমার কারণে দেখ না কেমন অলস হয়ে গেলাম। আজও শাওনের নাস্তাটা নিজে বানিয়ে দিতে পারলাম না। রাত জেগেও সকালের নাস্তাটাও তোমাকেই বানাতে হয়েছে।”

” বোকা তুই উঠলি কেন? গত ছয়মাস যে উঠতে পারিসনি। শাওনের কি কোনো অসুবিধা হয়েছে? ”

” না সেটা হবে কেন? তুমি ছিলে না ! আজ দেখলে না আমার শাশুড়ি কেমন রিয়্যাক্ট করল।”

” তা তো দেখলামই। তোর শাশুড়ি মনে হয় বেশিদিন থাকবেন না। বয়স হলে মানুষ এমন খিটখিটে মেজাজের হয়ে যায়। ”

” উনি সারা জীবন থাকলেই বা কি! এটা উনার নিজের বাসা। থাকলে থাকবেন। সেটা নিয়ে আমি ভাবছি না। আমি তোমার বাড়ি যাওয়ার কথা বলছি।”

” আমার যাওয়ার কথা যে বললি, আমার আর বাড়ি কই? যেখানে ফিরে যেতে বলিস। সেটা ভাইয়ের সংসার, এটা বোনের। আমি তো যাযাবর। তবে তোর এখানে থাকতে আমার ভালোই লাগছে।”

” তাহলে থাক। আমি ভাইয়াকে বারন করে দেব। তোমাকে যেন নিতে না আসে। তোমার কোথাও যাওয়া চলবে না। তুমি আমাদের সাথেই থাকবে যতদিন খুশি। ”

মুখ ফসকে কথাটা বলে ফেললেও রীমা আর চায় না সীমা তার সংসারে থাকুক। রীমা সবটা বুঝতে না পারলেও এটুকু বেশ বুঝতে পারছে, সীমাপার এখানে থাকা মা পছন্দ করছেন না। এটা সেটা বলে রীমার মনটা সীমার উপর বিষিয়ে তুলতে চাইছে। এসব করেও তিনি শান্ত হবেন না। ভীষণ মুখ পাতলা মহিলা কখন সীমাপাকে না অপমান করে বসে। সীমাপা তো অভাবের তাড়নায় বোনের বাসায় পড়ে নেই। সে থাকায় বরং রীমার উপকারই হয়েছে। কিন্তু কে বুঝাবে রীমার শাশুড়িকে এসব কথা।

” ঠিক সেটা ভাইজান আসলে তখন দেখা যাবে। এখন তোরা মা ছেলে থাক এই রুমে। আমি একটু নিরিবিলি বইটা পড়ে শেষ করব আজ রাতে।”

” তুমিও থাক না আজ আমাদের সাথে। ”

” পাশে থাকলে শুধু গল্প করতে ইচ্ছে করবে। আমাদের গল্প শুনে রুপাই জেগে যাবে। আমি তো আছিই পাশের রুমে। কোনো প্রয়োজন হলে ডাকিস। চলে আসব। ”

নানান অজুহাতে সীমা যে এভাবে রীমাকে রেখে আলাদা রুমে চলে যাবে রীমা যেন সেটা ভাবতেই পারেনি।

রীমা বোকার মতো হতভম্ব হয়ে বসে থাকল কিছুক্ষণ। কী হচ্ছে এসব! তার নিজের সংসার, নিজের স্বামী, নিজের বোন অথচ সব কিছু কেমন যেন নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলে যাচ্ছে দিন দিন। কিন্তু কেন?

রীমার ভীষণ হতাশ লাগল। ঘুমন্ত ছেলের নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে রীমা কষ্ট ভুলে থাকার ব্যর্থ চেষ্টা করল। মায়াময়, নিষ্পাপ একটা মুখ। শাওন কী করে তাকে একবার ভিডিও কলে না দেখে ঘুমুতে গেছে! শাওন কি একটাবার কল দিয়ে ছেলেটার খোঁজ নিতে পারত না। কী এমন ব্যস্ততা!
স্ত্রী -সন্তানের খোঁজ নিতে চাইলে ইচ্ছেটাই প্রয়োজন। ব্যস্ততা তো অজুহাত মাত্র। কিন্তু শাওন কেন অজুহাত খুঁজবে? মা যাই বলুক, রীমা নিশ্চিত তাদের স্বামী-স্ত্রীর মাঝে তৃতীয় কোনো ব্যক্তি নেই। যার কারণে শাওন নিজেদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টির জন্য অজুহাত খুঁজবে।

রীমা ঘুমুতে যাওয়ার আগে প্রতিদিন একবার ঘরের দরজা, জানালা, লাইট, ফ্যান,চুলা,ফ্রিজ সব চেক করে ঘুমুতে যায়। এটা তার রুটিন ওয়ার্ক। বিয়ের পর এই কাজটা তার শ্রদ্ধেয় শাশুড়ি মা শর্মিলি আহদেম তাকে শিখিয়েছেন। যত ব্যস্ততাই থাকুক এই কাজটা না-কি তিনি বিয়ের পর আজ পর্যন্ত নিজের বাড়িতে করেন। শাশুড়ির কথাকে শ্রদ্ধা জানাতে শত ব্যস্ততা আর অসুস্থতার মাঝেও রীমা একদিনের জন্যও এই দায়িত্বে অবহেলা করেনি। আজ তো করার সুযোগই নেই, কারণ মা বাসায় উপস্থিত আছেন।

আজও যথারীতি রীমা সব চেক করে, শাওনের রুমের দরজা বন্ধ করে নিজের রুমে ফেরার পথে দেখতে পেল সীমার রুমের লাইট জ্বলছে। তার মানে সীমাপা সত্যি সত্যি এখনও জেগে বই পড়ছে।

রীমা মনে মনে বলল,

” ও আচ্ছা এই কারণেই সীমাপা রাত আমার সাথে থাকতে চায়নি। ”

অসুবিধা কি, রুপাইয়ের কারণে তো সারারাত রুমের লাইট জ্বালানোই থাকে। সীমাপা ইচ্ছে করলে একই রুমে বসেও বই পড়তে পারত। রীমা প্রয়োজনে কথা বলত না। তাহলে অন্তত এতটা মন খারাপ রীমার লাগত না। সে মাঝেমধ্যে সীমার সাথে কথা বলতে পারত।

রীমা এগিয়ে গেল সীমার রুমের দরজার দিকে। হঠাৎ হাসির শব্দে সে থমকে দাঁড়াল।
সীমাপা কার সাথে ফোনে কথা বলতে বলতে হাসছে। রীমা বুঝতে পারল না এতরাতে সীমাপা কার সাথে কথা বলছে। রাত প্রায় দুটো বাজে। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া এই সময় কেউ জেগেই থাকে না। ফোনে কথা বলার তো প্রশ্নই আসে না।
যেমন ছেলের জন্য রীমা জেগে আছে, বই পড়ার জন্য সীমা জেগে আছে। তারমানে সীমাপার সাথে যে কথা বলছে, সে কথা বলার জন্য জেগে আছে।

রীমার মনে সন্দেহ হলো। মধ্যে বয়সে এসে সীমাপা আবার কোনো অনৈতিক সম্পর্কে জড়ায়নি তো! তারমানে কি বিশেষ কারো সাথে রাত জেগে কথা বলার অজুহাতেই সীমাপা বিছানা আলাদা করে অন্য রুমে ঘুমাচ্ছে!

এটা সীমাপা কী করছেে! বিপাকে পড়ে যাবে তো! কোনো অসৎ ছেলে ফাঁদে ফেলেনি তো আপাকে! বাবা নেই, মা নেই। ভাইজান থেকেও নেই। আজ পনেরো বছর সীমাপার ডিভোর্স হয়েছে, কই ভাইজান তো একটা ছেলের সন্ধান করে সীমাপার বিয়ে দেয়নি।উল্টো তাকে নিজের সংসারে রেখে বাড়িতে কাজের লোক বিদায় করে দিয়েছে।

এভাবে সীমাপার মতো একটা সুন্দরী বিধবা মেয়েই বা কতদিন একা একা থাকবে। তারও তো ইচ্ছে করে সংসার করার। স্বামীর সোহাগ নেয়ার, সন্তানের মা ডাক শোনার।

রীমার খুব মায়া হলো সীমাপার জন্য। সীমাপার কী দোষ! ভাইজানেরই বা একার দায়িত্ব কেন হবে? রীমাও তো ভাইজানের মতো একই কাজ করছে নিজের অসহায় ডিভোর্সী বোনকে কাজের জন্যই নিজের কাছে এনে ফেলে রেখেছে।
কই একটা বারের জন্যও তো শাওনের সাথে সীমাপার বিয়ের ব্যাপারে আলোচনা করেনি।

নিজের স্বার্থপর আচরণের জন্য নিজেকেই দোষারোপ করল রীমা। দেখি এবার চট্রগাম থেকে শাওন ফিরলেই এই ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করে দেখতে হবে।
যার সাথেই কথা বলছে বলুক। রীমা আর বোনকে বিরক্ত না করে নিজের রুমে ফিরে গেল। রুপাই ঘুমে থাকতে থাকতে নিজেও কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিবে। রুপাই জাগলে তো আর ঘুমানো যাবে না।

রুমে এসে কী মনে করে রীমা শাওনের মোবাইলে কল দিল। যদিও রীমা জানে শাওন মোবাইল সাইলেন্ট করে ঘুমায়। তারপরও মন মানছে না। শাওন কি করে জানার জন্য মন উদগ্রিব হলো।

মোবাইলে রিং ঢুকার সাথে সাথে অপর প্রান্ত থেকে সুরেলা কণ্ঠে এক মহিয়সী বসে উঠল।

“আপনার ডায়লকৃত নাম্বারটি এই মুহূর্তে ব্যস্ত আছে। অনুগ্রহ করে আবার কল করুন।”

শাওনের নাম্বার বিজি! এত রাতে শাওন কার সাথে কথা বলছে? সকাল ৬ টায় না তার মিটিং! শাওন কি কোনো বিপদে পড়েছে? তার মোবাইল কি হারানো গিয়েছে? যে কারণে ঘুমানোর আগে একটা ফোন পর্যন্ত করতে পারেনি। রীমার মনের ভিতর কু ডাকতে শুরু করল।

কিছুক্ষণ পর সে আবারও কল দিল। এবার রিং হয়ে বন্ধ হয়ে গেল। কেউ ফোন পিক করেনি।

চলবে…..