অথৈ জলের পুষ্পমাল্য পর্ব-১+২

0
709

#অথৈ জলের পুষ্পমাল্য ০১

১)
রীমা মাঝরাতে এসে শাওনের দরজায় টোকা দিল। একটা, দুইটা, তিনটা! চারটা দেয়ার সাহস আর করতে পারেনি। পাছে রুপাই যদি দরজার টোকার আওয়াজে জেগে যায়। ছেলেটার এমনিতেই রাতেরবেলা ঘুম হয় না। আজ অনেক কষ্টে ঘুম পাড়ানো হয়েছে। ছয়মাসের নিশাচর একটা বাচ্চাকে রাতেরবেলা ঘুম পাড়ানো যে কতটা কষ্টকর, সেটা কেবল একজন মাই বলতে পারেন।

রীমা দরজার ফাঁক দিয়ে শাওনের রুমের ভিতর উঁকি দেয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করল। সেগুন কাঠের দরজার ফাঁক দিয়ে ভিতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখা গেল না।

রাত দু’টো বাজে। শাওন হয়তো ঘুমাচ্ছে। সকালে অফিস আছে। এই অফিসের অজুহাতেই তো রুপাইয়ের জন্মের পর শাওন বিছানা আলাদা করল।

রীমার ভীষণ কান্না পেল। সে হাঁটু মুড়ে শাওনের দরজার সামনে বসে হু হু করে কেঁদে ফেলল। কতদিন, কত মাস হয়ে গেল শাওনকে আর আগের মতো আপন করে পাওয়া হয় না।

শাওন বেরিয়ে যায় সকাল ৮ টায়, ফিরে রাত নয়টা। সারাদিন ফোনে টুকটাক কথা হয়। বেশির ভাগ কথা থাকে রুপাইকে নিয়ে আর থাকে সংসারে প্রয়োজন নিয়ে। সকালে উঠতে হবে তাই শাওন সাড়ে দশটার মধ্যে ঘুমাতে চলে যায়। শাওনের সাথে আর রীমার আলাদা করে কোনো কথা হয় না। রাতে শাওন মোবাইল অফ করে ঘুমায়।

কথা যে হয় না সেটা নয়। ছুটির দিনে অনেক কথাই হয়। যেমন বেসিনের কলটা নষ্টে হয়ে গেছে। মেকানিক এনে ঠিক করাতে হবে। ডায়াপার পরতে পরতে রুপাইয়ের কোমরে রেশ হয়ে গেছে। অন্য ব্যান্ডের ডায়াপার কিনতে হবে।
আজ ছোট মাছে ঝাল বেশি হয়ে গেছে। দুটো সেদ্ধ আলু দিয়ে ঝাল কমিয়ে নিলেই হতো। সীমাপা কবুতর পালতে চায়। কাঁটাবন গেলে আপার জন্য খাঁচাসহ একজোড়া বাজিগর কবুতর নিয়ে এসো। এসব কত কথা।

শুধু খোঁজ নেয়া হয় না নিজেদের মনের, খোঁজ নেয়া হয় না নিজেদের দেহের। রীমা মাঝেমধ্যে ভীষণ হতাশ হয়। নিজেদের মধ্যে দূরত্বের জন্য সে কাঠগড়ায় দাঁড় করায় নিজের মাতৃত্বকে। পরক্ষণেই আবার নিজের ভুল বুঝতে পেরে নিজেই অনুতপ্ত হয়। মাতৃত্বের মতো সৌন্দর্য আর পৃথিবীর কোথাও নেই। মাতৃত্ব কখনো স্বামী -স্ত্রীর প্রেমময় সম্পর্কের মাঝে অন্তরায় হতে পারে না।

তাহলে সমস্যা কোথায়? কী সে অদৃশ্য সমস্য যার কারনে তাদের স্বামী – স্ত্রী মধ্য দূরত্ব বাড়ছেই। এই দূরত্ব দেখা যায় না, বোঝা যায় না, শুধু অনুভব করা যায়। সেই অনুভূতি প্রখর হয় গভীর রাতে। তখন রীমা হতবিহবল হয়। ছুটে আসে শাওনের রুমের বন্ধ দরজার পাশে। কখনো নিশ্চুপ হেঁটে চলে যায়। কখনো মন চাইলে টোকা দেয়।

চলবে…..

#অথৈ জলের পুষ্পমাল্য
কামরুন নাহার মিশু

তাহলে সমস্যা কোথায়? কী সে অদৃশ্য সমস্য যার কারনে তাদের স্বামী – স্ত্রী মধ্য দূরত্ব বাড়ছেই। এই দূরত্ব দেখা যায় না, বোঝা যায় না, শুধু অনুভব করা যায়। সেই অনুভূতি প্রখর হয় গভীর রাতে। তখন রীমা হতবিহবল হয়। ছুটে আসে শাওনের রুমের বন্ধ দরজার পাশে। কখনো নিশ্চুপ হেঁটে চলে যায়। কখনো মন চাইলে টোকা দেয়।

২)

হঠাৎ খট করে পাশের রুম থেকে দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন শর্মিলি আহমেদ। শর্মিলি আহমেদ রীমার শাশুড়ি। থাকেন গ্রামে অন্য ছেলেদের সাথে। মাঝেমধ্যে ডাক্তার দেখানোর নাম করে ছোট ছেলে, ছেলের বউ আর নাতিকে দেখতে আসেন। ডাক্তার দেখানোর নাম করে আসলেও তিনি আজ পর্যন্ত কোনোদিনও কোনো ডাক্তারের কাছে যাননি। উনার একমাত্র ভরসা উত্তর পাড়ার হরিনাথ বদ্যি আর দক্ষিণ পাড়ার লোকমান কবিরাজ। জ্বর থেকে মাথা ব্যাথা, কোমর ব্যাথা থেকে পিঠ ব্যাথা সব রোগের চিকিৎসা তারাই করেন।

তাদের চিকিৎসায় না-কি গ্রামের ফ্রেশ খাবার আর ফ্রেশ বাতাসের কারণে আলহামদুলিল্লাহ্ শর্মিলি আহমেদ এখনো তার বয়সি অন্য নারীদের থেকে বেশ ভালো আছেন। ডায়াবেটিস নেই, প্রেশার নেই। ঘুম ভালো হয়। কোনো খাবারে অরুচি নেই। এখনো মুখ ভর্তি দাঁত। গোটা সুপারি চিবিয়ে পান খান।

ব্যস্ত শহরের স্বার্থপর মানুষের উপর উনার নানান অভিযোগ। দুইদিনের জন্য বেড়াতে এলেও উনার অভিযোগের ঝুড়ি ভারি হতে থাকে। এসব অভিযোগ নিচক মিথ্যা নয়। আসলে শহরের বসবাস করা মানুষগুলো সত্যি আত্নকেন্দ্রিক আর স্বার্থপর।

শর্মিলি আহমেদের সমস্যা একটাই, তিনি ভীষণ সন্দেহপ্রবণ একজন মহিলা। রীমর ধারনা তিনি রীমার বাবার বাড়ির লোকদের মোটেও পছন্দ করেন না। অকারণে খুত খঁজে বের করে নানান কথা বলেন।

সীমাপা থাকার কারণে তাই রীমা চায়নি তার শাশুড়ি বেড়াতে আসেন। রীমা না চাওয়ায় অবশ্য তেমন কিছু হয়নি, গতকাল বিকালে তিনি রীমার বড় ননাশের ছেলে রাজিবকে নিয়ে হাজির হয়েছেন বাসায়। থাকবেন কয়েকদিন ছেলের কাছে। রাজিব পড়ে ভার্সিটিতে, থাকে হোস্টেলে। ভীষণ ভালো ছেলে। নানুকে নামিয়ে দিয়েই চলে গেছে। রীমা অনুরোধ করেছে তারপরও একটু চা খেয়েও যায়নি। কখনো কোনো প্রয়োজনে আসলেও মামা, মামীর প্রতি তার আন্তরিকতার অভাব থাকে না। শ্বশুর বাড়ির অন্য সদস্যরা বেশ চমৎকার।

শাশুড়ি মাকে দেখে রীমা মুহুর্তে নিজেকে প্রস্তুত করে হাসি মুখে বলল,

” মা আপনে ঘুমাননি এহনো?”

রীমার প্রশ্নের সরাসরি কোনো উত্তর না দিয়ে শর্মিলি আহমেদ বললেন,

“শাওন কি দরজা বন্ধ করি ঘুমাইছে?”

” হয়তো! বাদ দেন। রুপাই ঘুমাইছে। আপনের আপত্তি না থাকলে চলেন আপনের রুমে, আমরা কিছুক্ষণ গপ্প করি। আমার ঘুম আইতাছে না।”

” বাদ দিমু! আচ্ছা দিলাম। তবে বিষয়ঢা আমার মোঢেও ভালা লাগতাছে না। ”

রীমা লজ্জা পেয়ে দৃষ্টি অবনত করে ফেলল মেঝেতে,

মা কী মনে করেছেন! ছিঃ!

হঠাৎ কী মনে করে শর্মিলি আহমেদ সরাসরি সীমাকে প্রশ্ন করলেন,

” তোমরা কি আলদা বিছনায় ঘুমাও?”

” না মা, আসলে আপনের ছেলের সকালে অফিস থাহে তো! আর রুপাই হারারাত কাঁন্দে, চিল্লায়। ”

” তো কি অয়েছে! রুপাই কাঁনব না-কি তুমি কাঁনবা! তাই বলে শাওন আলাদা রুমে থাকব! ”

” না মা, হে যাইতে চায় নয়। আমিই কইছি শুধু ঘুমের সময়…..”

” হুনো মাইয়া, স্বামীর থাইকা বিছনা আলাদা করা কোনো ভালা কতা নয়। এসবের ফল কহনো ভালা অয় না। ”

রীমা কী বলবে বুঝতে পারছে না। মাঝ রাত্রিতে এভাবে তাকে জেরার মুখোমুখি হতে হবে জানলে সে জীবনেও শাওনের দরজায় টোকা দেয়ার মতো মারাত্বক ভুল করতো না।

” জে, মা। চলেন ঘুমাইবেন। আমি আপনারে শোয়াই দিয়ে আহি।”

” লাগব না। আমি শুইতে জানি। তুমি শুধু নিজের শোয়ার ব্যবস্থাটা ভালাভাবে কইরো।”

শর্মিলি আহমেদের কথায় রীমার চোখে পানি চলে এলো। ছিঃ কী নোরাং ইঙ্গিত করলেন মা। একারণেই মেয়েরা শ্বশুর বাড়ির লোকদের পছন্দ করে না। আট চল্লিশ ঘন্টাও হয়নি শর্মিলি আহমেদ এসেছেন, ছেলের বাসায়। এদিকে দুই, দুই বার তিনি রীমাকে অপমান করলেন।

বিকালে একবার শাওন রীমাকে ফোনে না পেয়ে সীমাকে ফোন করেছে। এই কারণেও তিনি ভীষণ রাগ করেছেন।

“ফোন সঙ্গে রাহ না ক্যান? তোমাকে ফোনে পাওন যায় না ক্যান?”

আরও কত কথা। মায়ের ঝুড়িতে কি কথার অভাব আছে না-কি!
আশ্চর্য রীমা কি উনার মতো সারাক্ষণ বিছানায় বসে থাকে না-কি! তাকে কতদিক সামলাতে হয়। সবসময় কি বাঝার সাথে সাথে ফোন পিক করা সম্ভব!

রীমা এখনও বুঝতে পারেনি মায়ের রাগ করার কারণ কি! হয়তো ছেলে মায়ের নাম্বারে কেন ফোন করেনি? এটাই রাগ।

রীমা অভিমান করে শাওনকে বলে দিয়েছে,

“মা যতদিন বাসায় থাকবেন, তুমি মায়ের নাম্বার ছাড়া অন্য নাম্বারে প্রয়োজন হলেও ফোন দেবে না। মা মন খারাপ করেন।”

শাশুড়িকে শোয়াই দেয়ার প্রস্তাব করলেও রীমা আর সাহস করতে পারেনি, আরও কিছুক্ষণ এই মহিলার সামনে দাঁড়িয়ে থাকার। তাই নিজের রুমে ফিরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল।

হঠাৎ কী মনে করে শর্মিলি আহমেদ রীমার রুমের দরজার সামনে এসে ফিসফিস করে বললেন,

” তেমার বোইনটার কী যেন নাম! ও আইচ্ছা সীমা। ওর তো স্বামী নাই না?”

” না মা। ”

” ওহ্। হেও কী শাওনের মতনই আলাদা রুমেই ঘুমায়? ”

” না মা। আমার সাথেই থাকত। গত কয়েকদিন আগে আমিই কইছি সামনের রুমে ঘুমাইতে।”

” ওহ্! ঠিক আছে শুয়ে পড়। অনেক রাইত অইছে। তোমার এহন খাওন দাওনের পাশাপাশি প্রচুর ঘুমেরও প্রয়োজন। অহেতুক মধ্য রাইতে হাঁটাহাঁটি কইরবা না।”

রুমে ফিরে গিয়ে রীমা আর চোখের পানি আটকে রাখতে পারল না। ইচ্ছে মতো কাঁদল কিছুক্ষণ। মেয়েদের জীবন এমন কেন? অকারণেও অপমানিত হতে হয়, অসম্মানিত হতে হয়।

চোখ মুছে ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে রীমা ঘুমাতে যাবে, এমন সময় সীমা এলো।

” শুয়ে পড়। অনেক রাত হয়েছে।”

” হুম ঘুমাব। ”

” তুমি ঘুমাওনি? ”

” ঘুমুতে যাচ্ছিলাম। দরজার টোকার আওয়াজ শুনে বের হবো ভেবেছিলাম। তোর শাশুড়ির কণ্ঠ শুনে আর বের হইনি।
মহিলাটা কেমন যেন! কীভাবে আমার দিকে তাকায় মনে হয় বুকের ভেতরটা পর্যন্ত দেখতে পায়।”

সীমার কথা শুনে রীমার শুকিয়ে যাওয়া আত্মায় পানি এলো। যাক সীমাপা মায়ের উদ্ভট কথাগুলো শুনতে পায়নি।

” কী বলছ আপা! আমার শাশুড়ি ভীষণ ভালো মানুষ। দেখলে না আমার জন্য খুঁজে খুঁজে চালতার আচার থেকে শুরু করে শিমের বিচিগুলো পর্যন্ত গ্রাম থেকে এনেছে।”

” সেটা তো দেখলাম।”

“আচ্ছা দরজার টোকার আওয়াজ তোমার রুম থেকে! কী বলো!”

” হুম। আমি জেগেই ছিলাম। বই পড়ছি। ”

” ওহ! তাই বলো। আমি কিন্তু খুব একটা জোরে আওয়াজ করিনি।”

সীমার কথায় রীমার ভীষণ সন্দেহ হলো। সে এত আস্তে টোকা দিয়েছে যে অন্য মনস্কভাবে জেগে থাকলে সেটা শাওনেরও শোনার কথা নয়। অথচ পাশের রুম থেকে সেই টোকার আওয়াজে মা বেরিয়ে এলেন, সীমাপা বেরিয়ে এলো!

যাকগে হয়তো জোরেই আওয়াজ করেছে। মধ্যরাতে রাতের নিস্তবদ্ধতা ভেদ করে ছোট খাট আওয়াজও বেশ প্রকট মনে হয়। আজ অবশ্য অত গরমও নেই। সন্ধ্যার দিকে বৃষ্টি হয়েছে, তারপর থেকে ঠান্ডা ঠাণ্ডা একটা ভাব। সীমাপার হয়তো রুমের ফ্যান বন্ধ ছিল। মা তো কখনো ফ্যানের বাতাস সহ্য করতেই পারেন না।

রীমার অবশ্য গরম বেশি। সে ফ্যান বন্ধ করে রাখতে পারে না। রুপাই বুকের দুধ খায়। বুকের দুধ খাওয়া বাচ্চার মায়েদের মনে হয় গরম বেশি। না হয় সবাই যখন ঠাণ্ডা ঠান্ডা বলে তখনও রীমা গরমে দরদর করে ঘামতে থাকে।

চলবে……