অ সামাজিক পর্ব-০২ এবং শেষ পর্ব

0
603

গল্প- “অ সামাজিক”
পর্ব- ২য় বা শেষ পর্ব

আজ দুপুরে রান্না হয়েছে পাকা মিষ্টি কুমড়োর সাথে চিংড়ি, কাঁচা পেঁপে ঘন্ট, মশুর ডালের চচ্চরি আর ইলিশ মাছ ভাজা। প্রেমা খেতে বসে পড়েছে, ঘ্রাণ পেয়ে নিহালও চলে এলো খাবার টেবিলে। সায়লা এখনো রান্নাঘরে কাজ করছে। নিহাল খাবার ঘরে এসে প্রেমাকে বললো-
তোর স্কুলে না আজ পিকনিক ছিলো, তুই এখানে কেন? যা ভা গ।
-হ্যাঁ পিকনিক ছিলো, পিকনিক হচ্ছেও, আমি চাঁ দা ও দিয়েছি কিন্তু যেতে ইচ্ছে করেনি তাই যাইনি।
-যাবিই না যখন, তাহলে চাঁ দা দিতে গেলি কেন?
-বা ধ্য তা মূলক তাই।
-ও আচ্ছা। তাহলে তো টাকাটা জলে গেলো। গেলেই পারতিস।
-আমাদের স্কুলে আমি সহ মোট আটজন শিক্ষক-শিক্ষিকা চাকুরি করে। একমাত্র আমি বাদে সবাই বিবাহিত। এমনকি কারো কারো একের অধিক বাচ্চাও আছে। স্কুলের পিকনিকে সবাই পরিবার সহ’ই আসবে। আর তখন সবার হাসি গল্পের আসরে প্রসঙ্গক্রমে আমাকে নিয়ে মজা ঠা ট্টা হবে, যেহেতু এখনো আমি বিয়ে করিনি। কেউ কেউ তো তাদের দূর সম্পর্কের কোনো এক অ কর্মণ্য চাচাতো, মামাতো ভাইয়ের জন্য আমাকে প্রস্তাবও দেবে, যেন তারা আমাকে উ দ্ধা র করতে আসছে, বিয়ে না করে আমি যেন মহা পা প করে ফেলেছি।
-আমাদের সমাজের মানুষের চিন্তাধারা বদলালো নারে। এরা ভাবে, জীবনে বিয়ে করা আর সন্তান উৎপাদন করা ছাড়া মানুষের, বিশেষ করে মেয়ে মানুষের আর কোনো কাজ নেই।
-বিয়েটা জীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, কেননা একা বেঁচে থাকা কঠিন। তবে কেউ চাইলে বিয়ে নাও করতে পারে, কারো বিয়ে দেরিতে হতে পারে কিংবা ভাগ্যে না থাকলে বিয়ে নাও হতে পারে। এটা যার যার ব্যক্তিগত বিষয়, যার যার ভাগ্য। এসব নিয়ে হাসি তা মা শা করাটা আমার পছন্দ নয়। স ম স্যা টা সেখানেই। শোন, তোকে একটা কথা বলি। তুই চাকুরি পাবার কয়েক মাসের ভেতরেই বিয়ে করে ফেলিস বুঝলি। কারণ, আমাদের সমাজ একটা গ ৎ বাঁ ধা সিস্টেমের ভেতর আবদ্ধ। একটা সময়ের পর বা নির্দিষ্ট একটা বয়সের পরও যখন তুই বিয়ে করবি না, তখন সমাজ তোর সাথে এমন আ চ র ণ করবে, নিজেকে কেমন এক ঘরে অ সামাজিক জীব মনে হবে, এ সমাজের মানুষগুলোর আ চ র ণ তোকে মানসিকভাবে রোজ ভা ঙ তে থাকবে, তোকে অ শুভ মনে করবে, সর্বত্র বিচরণ করা তোর নিজের মতো জীবনটা কেমন স ং কী র্ণ হয়ে যাবে। আমি চাই না, আমার মতো তোকেও প স্তা তে হোক।
-দ্যাখ, প্রথমত এ সমাজ যেহেতু পুরুষ তা ন্ত্রি ক, তাই পুরুষের বিয়ে করা বা না করা নিয়ে ওতটা স ম স্যা নেই। আর পুরুষদের বিয়ের ক্ষেত্রে বয়স ততোটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, একজন পুরুষ সমাজে কতটা প্রতিষ্ঠিত সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। তাই আমাকে নিয়ে চিন্তা করিস না।
-হ্যাঁ তা অনেকটা ঠিক বলেছিস বটে। যাই হোক, এখন এসব কথা না বলে মন দিয়ে খা। এসব ভাবনা চিন্তাগুলো আমাদের স্বাভাবিক জীবনধারা ব্য হ ত করছে রোজ।

নিহাল আর প্রেমা ভালোভাবে খাওয়া শুরু করলো। সায়লা রান্নাঘর থেকে ছেলে-মেয়েদের কথোপকথন শুনছিলো, কিন্তু সে কিছুই বলেনি। কীইবা বলার আছে। এ সমাজ যে ঘু ণে ধরা ন ষ্ট সমাজ, তাকে কী আর এত সহজে বদলানো যাবে।

কিছুদিন পরের কথা। প্রকৃতিতে শীতকাল আসি আসি করছে। এক ঋতুর বিদায় আর আরেক ঋতুকে স্বাগত জানানোর সন্ধিক্ষণের দিনগুলো অদ্ভুত সুন্দর হয়। বিশেষ করে প্রকৃতিতে যখন শীত আসে, তখনকার পরিবর্তনটা সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ার মতো। এমনই এক মনোমুগ্ধকর বিকেলে বারান্দায় বসে চা খাচ্ছে সায়লা আর আসাদ প্রামাণিক, অর্থাৎ নিহাল প্রেমার বাবা-মা। নিহাল’ই চা বানিয়েছে। এ পরিবারে সবচেয়ে ভালো চা বানাতে পারে নিহাল। যদিও প্রেমা তার কাছে চা বানানোর স্পেশাল রেসিপিটা চেয়েছে, কিন্তু নিহাল দেয়নি। এত ভালো চা বানানোর কৃতিত্ব সে হাত ছাড়া করতে চায় না কখনোই। প্রেমা মাঝেমাঝে বলে, একটা টংঘর দিলে কিন্তু তোর রমরমা ব্যবসা চলবে, চা বানিয়ে মাসে যা আয় হয়, তা অনেক চাকুরিজীবীর বেতনের চেয়ে বেশি। কথাটা কিন্তু প্রেমা ভুল বলে না। গ্রামে বা বিশেষ করে শহরে যারা চা বানায়, তাদের বেশিরভাগেরই মাসিক উপার্জন শুনলে চ ম কে যেতে হয়। তখন ক্ষণিকের জন্য মনে হয়, কেন তাহলে এত টাকা পয়সা খরচ করে, এত সময় ব্যয় করে পড়াশুনা করলাম ধু র।

চা খেতে খেতে অতীত-বর্তমান-ভবিষৎ নিয়ে নানান ধরণের গল্প আর চিন্তা ভাবনা করছিলেন দু’জন। জীবনের এই বেলায় চিন্তা ভাবনা করা ছাড়া আর কীইবা করার থাকে। আর বাবা-মা হয়ে যাবার পর তো সবাই নিজেদের ব্যক্তিগত জীবন শি কে য় তুলে দেয়, শুধু সন্তানদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে ভেবে ভেবে জীবন পার করে দেয় তারা। নিহাল প্রেমার বাবা-মাও তার ব্যতিক্রম নয়। সন্তানদের নিয়ে চিন্তাভাবনা করা তাদের কোনোদিনও ফুরোয় না। এমনকি মৃ ত্যু শয্যায়ও তারা নিজেদের কথা না ভেবে সন্তানদের কথাই ভাবে। তারা চলে গেলে সন্তানরা কীভাবে বেঁ চে থাকবে সং গ্রাম করে, এসব ভেবে ভেবেই শে ষ নিঃশ্বাস ত্যা গ করে। অথচ, জীবনে কেউই যে অপরিহার্য নয়, এ কথা তারা মানতে না রাজ।

চা খাওয়া প্রায় শেষ, এমন সময় একজন অতিথি এলেন, গ্রামেরই বাসিন্দা, পাঁচ ছয় ঘর ওপাশের এক প্রতিবেশী। তাকে বসতে বলে সায়লা নিহালকে বললো আরেক কাপ চা দিতে।
সে বললো, কেন প্রেমা বাড়িতে নেই, নিহাল চা বানাবে কেন?
নিহালের বাবা উত্তরে বললো, চা তো যে কেউই বানাতে পারে, বাড়ির মেয়ে বউকেই বানাতে হবে, এমন তো কোনো বিধিমালা জা রি করা নেই, অন্তত আমার পরিবারে নেই।
তিনি উত্তরে সন্তুষ্ট হলেন না বোঝা গেলো, তবু আর কথা বাড়ালেন না। কিছুক্ষণ পর নিহাল চা বানিয়ে আনলো, প্রেমাও বারান্দায় এসে বসলো গল্প করতে। কথা প্রসঙ্গে তিনি বললেন, নিহাল বা প্রেমাকে তো দেখাই যায় না, আশপাশের মানুষদের সাথে না মিশলে তো সবাই অ সামাজিক ভাববে, এভাবে সারাক্ষণ ঘরের ভেতর থাকাটা কী ভালো দেখায়?
প্রেমা স্মিত হেসে বললো, কারা অ সামাজিক বলবে? আপনারাই তো বলবেন, কেননা আমরা আপনারা মিলেই তো সমাজ।
তিনি প্রেমার কথায় একটু অ প মা নি ত হলেন। বললেন, তুমি নাহয় মেয়ে মানুষ, ঘর থেকে কম বের হও, নিহাল তো বের হতে পারে। বাইরে পাড়ার ছেলেদের সাথে আড্ডা দিবে, বাজারে যাবে, খেলবে। ছেলেদের এভাবে ঘরে বসে থাকা মানায় না যাই বলো।
নিহাল হেসে বললো, আমি যাদের সাথে মিশতাম বা যারা আমার সমবয়সী, কেউ এখন নেই গ্রামে, কেউ আছে দেশের বাইরে, কেউ ঢাকাতে, কেউ আবার অন্য জেলায় কাজের প্রয়োজনে, তাই আর বের হই না তেমন।
নিহালের কথা শুনে তিনি বললেন, তোমার বয়সীরা অনেকেই তো চাকরি করে, কেউ কেউ পড়াশুনা বাদ দিয়ে হাতের কাজ শিখে বিদেশেও গেছে, তুমি এখনো কিছু করছো না যে, বাপের হোটেলে আর কতদিন খাবে, কথায় বলে বসে বসে খেলে রাজার গোলাও ফুরিয়ে যায়, আমার কথায় কিছু মনে করো না আবার, যা সত্যি তাই বললাম।

এবার সায়লা মুখ না খুলে পারলো না। বললো, আপনি না একটু আগে বলছিলেন, ওরা কেন বাইরে যায় না, কেন সবার সাথে মেশে না, ওদেরকে মানুষ অ সামাজিক বলবে। কেন যায় না বা কেন কারো সাথে মিশতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না আর জানেন? ঠিক এ কারণেই। আমরা তো সবাই কমবেশি জানি, বাংলাদেশের মতো অতিরিক্ত জন বহুল দেশে চাকরি পাওয়া কতটা ক ঠি ন, সবাই এখানে চাকরি পাবে না ঠিক সময়ে এটাই স্বাভাবিক, অনেক মেধাবীরাই পায় না তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি, এটা তো আমাদেরই বুঝতে হবে। নিহাল যে চেষ্টা করছে না, তা তো নয়। ও হাত গু টিয়ে বসে নেই একদম। কিছুদিন পার্ট টাইম চাকরি করেছে, এখন আবার বিসিএস এর জন্য পড়ছে, আশা করি কোনো একটা ব্যবস্থা হয়েই যাবে, সেই সময়টা পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতেই হবে। অযথা ওকে দো ষ দিয়ে বা এত জিজ্ঞাসা বা দ করে তো লাভ নেই। সবাই এসব নিয়ে কথা বলতে বলতে ওকে ত্য ক্ত বি র ক্ত করে তুলেছে, এজন্যই এখন ও কারো সাথে মিশতে চায় না।

আসাদ সাহেব সায়লাকে থামিয়ে দিয়ে বলতে শুরু করলেন, আবার প্রেমার কথাই ধরুন। ও চাকরি করছে ঠিকই, কিন্তু ওর এখনো বিয়ে হলো না কেন, এটা নিয়ে চারপাশের মানুষের স ম স্যা র অন্ত নেই। বাবা-মা হিসেবে আমরা যতটা না চিন্তিত, তারচেয়ে বেশি চিন্তিত আমাদের পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন সবাই। ওর যদি বিয়েও হতো, তাদের আবার এটা নিয়ে চি ন্তা হতো যে কেন ওর বাচ্চা হচ্ছে না বা কেন বাচ্চা নিচ্ছে না। আসলে চারপাশে এত শুভাকাঙ্ক্ষী আর তাদের এত চিন্তা যে, আমাদেরই হাস ফাঁ স লাগে। প্রেমা যেখানে যায় বা আমরা যাই, আমাদের এসব নিয়ে কথা শুনতে হয়, এত এত প্রশ্নের জবাব দিতে হয়। এরপরেও কী মানুষের সাথে মেশার রু চি থাকে বলুন? তবু সামাজিক জীব হিসেবে তাদের সাথে পথ না চলে উপায় নেই, তাই চলতে হয়৷ আশা করি, আমাদের কথায় কিছু মনে করবেন না।

এত কথা তার বোধয় হ জ ম হলো না। কারণ, এভাবে ভাবার বা বলার মানুষ তো খুব কম। তিনি কৃত্রিম হাসি দিয়ে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। কথা বাড়ানোটা বি প জ্জ ন ক হতে পারে ভেবে আর কথা বাড়ালেন না। হয়তো ভবিষ্যতেও আর এ ব্যপারে কথা বলার সা হ স দেখাবেন না।

দেখতে দেখতে অনেকগুলো ক্যালেন্ডার বদলে গেছে। জীবনও বদলেছে অনেকখানি। প্রেমার ভালো ঘরে বিয়ে হয়েছে, স্বামীও বড় চাকুরিজীবী, সুদর্শন, সুখেই আছে ওরা। নিহাল সরকারি চাকুরি পেয়েছে অনেক পরিশ্রম করে, সেও এখন সংসার আর ক্যারিয়ার দু’টোই সামলাচ্ছে সমান তা লে। কিন্তু পাড়াপ্রতিবেশী বা আত্মীয়স্বজনদের সাথে যেই দূরত্বটা তৈরি হয়েছিলো, তা আর কাটিয়ে উঠতে পারেনি, একটা অ স্বস্তির কাঁ টা আজো রয়ে গেছে। তবু জীবন তো প্রবাহমান, জীবন চলছে তার নিজস্ব গতিতে ভালো-ম ন্দ মিলিয়ে।

সমাপ্ত