অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব-০৩+০৪

0
647

#অনুবদ্ধ আয়াস
#ইফা আমহৃদ
পর্ব: ০৩+০৪

মাঝরাতে বুকের উপরে ভারী কিছু আবিস্কার করলাম। নাকে ভেসে এলো বিচ্ছিরি গন্ধ। ঘুমের মাঝে তিঁতঘুটে ঢেকুর উঠলো। ফট করে চোখ মেলে তাকালাম। আমার দুপাশে হাত রেখে রৌধিক নির্ভাবনায় ঝুঁকে আছে। গলা খাঁকারি দিয়ে অশান্ত কন্ঠে বললাম,

” কী? কী হচ্ছে কি মিঃ? উঠুন আমার উপর থেকে।”

নিভু নিভু চোখে অবলোকন করলো আমায়। ঘুমু ঘুমু চোখ তার। হাত বাড়িয়ে আমার মাথার অগোছালো চুলগুলো ললাটের উপর থেকে সরিয়ে দিচ্ছে। হুট করেই অধর ছুয়ে দিল ললাটের মাঝবরাবর। কেঁপে উঠলাম আমি। খামচে ধরলো তার হাত। তিনিও কেঁপে উঠলো। রক্ত গড়ালো হাত বেয়ে। তিনি নিজের হাতের দিকে চেয়ে নেশালো মানুষের ন্যায় টেনে টেনে বললেন,
” আমাকে আঘাত করছিস তুই? রিভেঞ্জ নিতে শিখে গেছিস দেখছি। তুই জানিস না রৌধিক কাউকে অহেতুক আঘাত করে না। তাহলে..

ঠোঁট উল্টে বললেন তিনি। নাকের ডগায় নিজের নাক ঘসলেন। তীব্র গন্ধ আরো তীব্রতর হয়ে উঠলো। বিদেশি মানুষ। জানতাম, রৌধিক এইসব খেয়ে আসবে। তবুও কেমন বিশ্বাস যোগ্য হতো না। হাত ধরে টেনে বসিয়ে দিলো আমায়‌। নিজের বলিষ্ঠ পুরুষালী হাতটা পিঠের ক্ষত স্থানে রাখলো। হাত বোলালেন কিয়ৎক্ষণ। নয়ন যুগল আপনাআপনি গ্ৰথণ হয়ে এলো। আমার মাথার সাথে নিজের মাথা ঠেকিয়ে দম বন্ধ শ্বাস নিলেন। হুট করেই আমাকে ছেড়ে ব্লাঙ্কেট মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লেন। সেকেন্ড দুই অতিবাহিত হওয়ার পরে মাথা বের করে সহজতর ভাষায় বললেন,

” যাও! সোফায় গিয়ে ঘুমিয়ে পরো। আমার কথার অবাধ্য হলে কি হতে পারে, তা তোমার ধারণার বাইরে!”

অধর দিয়ে জিভ ভিজিয়ে নিলাম। ঘনঘন পলক ফেলে আমতা আমতা করে বললাম, ” মা-মানে?

হুস বলে ভ্রু কুঁচকালেন তিনি। উঠে গিয়ে কাবার্ড হাতরাতে লাগলেন। নিজের কাঙ্খিত জিনিসটা হাতে নিয়ে বসলেন আমার সন্নিকটে। আমার হাত টেনে নক গুলো স্বযত্নে কেটে দিতে লাগলেন। হাত সরানোর চেষ্টা করতেই চোখের ভ্রু কেটে দেওয়ার দেয়ার চেষ্টা করলো। অসহায় হয়ে চেয়ে রইলাম। আমার এতো সাধের নক। ভাঙা গলায় বললাম, ” প্লীজ! ছাড়ুন। কি করছেন?”

” হুস! দেখেছো আমার হাতের কি অবস্থা? তোমার এই সুন্দর রুপের মাঝে এই বড় বড় অপদার্থ নখগুলো বেমানান।”
হাতের পিঠ দেখিয়ে বললেন। সেখানে রক্ত জমাট বেঁধে রয়েছে। অনুতপ্ত হলাম আমি। আমিই বা কি করতাম, তিনি হুট করে ওমন করেছেন বলেই তো?
অস্থিরতা মেশানো কন্ঠে বললেন,” আমি কখনো কোনো নারী জাতির গাঁয়ে হাত তুলি নি। তুইই প্রথম যাকে আঘাত করেছি। বিশ্বাস করো, আমি ইচ্ছে করো কিছু করিনি। ভালোবাসা আমাকে অসহায় করে দিয়েছে।”

আমি চুপ করে রইলাম। মুগ্ধ হলাম আরো একবার। মিনমিনে বললেন,” জানো আজ তোমাকে কতোটা সুন্দর লাগছিল? একদম পরীর মতো। আমার ঘরেও একটা পরী রয়েছে, আমি জানতাম না। বিলিভ মি!
তুমি আমার জোনাকি পোকা। আমার আঁধার ঘরের জোনাকি। নিভু নিভু আলোয় জ্বলে উঠ তুমি। আমার অনুবদ্ধ আয়াসের সমাপ্তি।”

কিংকর্তব্যবিমূঢ় হলাম আমি। তারমানে এই ছেলেটা সকালে আমাকে বকার ফাঁকে ফাঁকে দেখছিল। ছিঃ ছিঃ কি লজ্জা। তখন এমন ভাব নিচ্ছিল, যেন ভাজা মাছটা উল্টে খেতে জানে না। অতি সাহস সঞ্চয় করে বললাম,
-” তাহলে সকালে আপনি আমাকে ঐ নজরে দেখছিলেন?”

” কোন নজরে? আমি বউ বউ নজরে দেখছিলাম! আমার বউ। আমার যেভাবে ইচ্ছে সেভাবে দেখবো। তুমি বলার কে?”

” আমি কে মানে?”

“সেই তো? তুমি কে?”
আমি কিছু বলতেই চাইলেই হাতের ইশারায় থামিয়ে দিলেন। আঙুল তুলে সোফার দিকে দেখিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লেন। ঘুমের ঘোরে কিসব বললেন। অথচ আমাকে দুই চোখে সহ্য করতে পারে না। সকালে বললে, একদমই বিশ্বাস করতে পারবে না। এই ছাই পাশ যদি হারাম না হতো, তাহলে আমি নিজে তাকে কিনে খাওয়াতাম।

রুমের বাতি নিভিয়ে ড্রিম বাতি জ্বলিয়ে দিলাম। কাবার্ড থেকে ব্যাগ বের করলাম। সেখানে স্বযত্নে রাখা ডাইরীটা হাতে নিলাম।

উপরে লেখা আছে অনুবদ্ধ আয়াস 💚। বেশ কিয়ৎক্ষণ হাত বুলিয়ে নিলাম লেখাটার উপর। অনুভূতিতে দেহের সর্বাঙ্গ পূর্ণ হয়ে গেল। চোখ জোড়া গ্ৰথণ করতেই কার্নিশ গড়িয়ে পড়লো অশ্রুধারা। টেবিলের উপর বসে লিখতে বসলাম মনের ভেতরের চাপা আর্তনাদ গুলো। টেবিল ল্যাম্প জ্বলছে। দক্ষিণা হাওয়া বইছে জানলা দিয়ে। শাড়ি আঁচল টেনে কলম চালালাম ডাইরীর ফাঁকা পৃষ্ঠায়।

বাবা,
জানি না কেমন আছো তুমি? আমি সর্বদা তোমার কথা মেনে জীবনের প্রতিটি ধাপ এগিয়েছি। আজ তুমি আমার পাশে নেই, জীবনের সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্ত টা আমি নিয়ে ফেলেছি। তোমার ইচ্ছে ছিল, লাল টুকটুকে বউ সাজিয়ে একটি ছেলের হাতে তোমার মেয়েকে তুলে দিবে। কিন্তু সেই ইচ্ছে টা নাহয় স্বপ্নই রয়ে গেল। ইচ্ছে টা পূরণ করতে হলে তোমাকে বাঁচাতে হবে। তোমার ইচ্ছে পূরণ হবে, তবে আমার মাধ্যমে নয়। জয়ার মাধ্যমে হবে।
জানি না কিভাবে তোমাকে সত্যি টা বলবো। তবে একটু ধৈর্য ধর, ঠিকই বলবো..

পায়ের কাছে কিছু একটা বিকট শব্দে পড়ল। কলম পড়ে গেল হাত থেকে। ফট করে চাইলাম। রৌধিক বেডের উপর বসে ক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। চেঁচিয়ে বললেন,
” এইভাবে কাঁদছ কেন তুমি? সিমপ্যাথী জন্য। তাই তো! তোমার সিমপ্যাথীতে আমাকে ভুলাতে পারবে না। নিজের ইনোসেন্স দেখিয়ে সবাইকে পুতুল বানাতে পারলেও, আমাকে পারবে না। তাই এই নাটকটা একলিস্ট ঘরে বসে করো না। নেক্সট টাইম ভাববো না। সোজা বের করে দিবো। স্টপ..

শেষের শব্দ টা চেঁচিয়ে বললেন তিনি। কেঁপে উঠলাম আমি। তিনি ত্রুব্ধ চোখে আমার দিকে চেয়ে বেলকেনিতে চলে গেলেন। আমি আগের ন্যায় বেলকেনির দিকে চেয়ে আছি। এইতো ভালো ব্যবহার করেছিলেন, তাহলে হঠাৎ কি হলো তার? আমি কাঁদছি বলে তার কষ্ট হচ্ছে না-কি আলোর কারণে তার ঘুমে ব্যাঘাত ঘটেছে? ডাইরীর মাঝে কলম রেখে ব্যাগে ভরে রাখলাম। অতঃপর ফাঁকা জগ নিয়ে বেরিয়ে এলাম। আন্টি বারবার বলে গেছেন, রৌধিক আসলে তাকে খাবার এনে দিতে। আত্মীয়-স্বজন চলে গেছে, তাই তাড়াতাড়িই শুয়েছে তারা।

ট্রে নিয়ে হাজির হলাম। রুম ফাঁকা। নাকে বিচ্ছিরি গন্ধ আসছে। রুম স্প্রে দিয়ে গন্ধ দূর করার চেষ্টা করলাম। বেলকেনির দিকে পা বাড়ালাম। রৌধিক বেলকেনির রেলিং এ দুই হাত রেখে দূর আকাশে চেয়ে আছেন। হয়তো নিজের অতীত মনে পড়ছে। আমার জায়গায় শেফাকে মনে পড়ছে‌। কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,
” শুনছেন? আপনার খাবার এনেছি! খেয়ে নিন।”

রৌধিক চাইলো আমার দিকে। তার চোখে অসহায়ত্ব খুঁজে পাচ্ছি। চোখে চোখ রাখার মতো সাহস নেই আমার। শান্ত গলায় বলল,
” আমি খাবো না। যাও! তুমি খেয়ে নাও।”

” রাত তো অনেক হলো। সারাদিন কিছু খান নি। বেশি না, একটু কিছু খেয়ে নিন।”

” তোমাকে আমি যেতে বলেছি। জাস্ট গো! এইধরনের মেয়েদের সাথে একটু ভালোভাবে কথা বললেই, মাথায় চড়ে বসে।”

হাতের পিঠ দেখিয়ে থামিয়ে দিলাম তাকে। সন্দিহান স্বরে বললাম,” ওয়াট ডু ইট মিন বাট এই ধরনের মেয়ে। সম্মান এবং সামলে কথা বললেন। এই ধরনের মেয়ে আপনার বউ হতে আসে নি। আপনার বাবার সম্মানের কথা ভেবে বিয়েতে বসেছে। আমি এক্ষুনি এই বাড়ি থেকে চলে যেতে পারি। কিন্তু আমি স্বার্থপর নই। অন্যের উপকারের মূল্য দিতে জানি।”

আর কথা না বাড়িয়ে সোফা এসে শুয়ে পড়লাম। এই মানুষটা গিরগিটির মতো। গিরগিটির চেয়েও বেশি রং বদলায়। গিরগিটির রং বদলাবে এটা স্বাভাবিক। গিরগিটিও এতো তাড়াতাড়ি নিজের রং বদলাতে পারে না। যেটা সে পারে। শাড়ির লম্বা আঁচল টেনে শরীর ঢেকে ঘুমিয়ে পড়লাম।

“তুমি কি জানো, শাড়ি পড়ে তোমাকে ফুটবলের মতো লাগছে? আমাকে ইমপ্রেস করার কথা ভুলে ঘুড় ঘুড় না করে যাও চেঞ্জ করে নাও। যাও!”

রৌধিকের ঘুম ঘুম কন্ঠ। চুল টাওয়াল দিয়ে মুছে নিচ্ছিলাম আমি। তার কথা শুনে হাত থেমে গেল। ভ্রু কুঁচকে তাকালাম। রৌধিক ব্লাঙ্কেট টেনে বসে আছে। দুইটা ছাড়া যে ছেলের ঘুম ভাঙ্গে না, সে এতো তাড়াতাড়ি উঠে গেছে। আটটা পনেরো। অর্থাৎ দুটোর ট্রেন আটটায়। চুলগুলো মুখের উপর ছড়িয়ে গেল। টাওয়াল মাটিতে পড়ে গেল। আমার বাম পাশের বড় আয়নাতে তাকালাম। আমাকে তো দেখতে বেশ সুন্দর লাগছে। তাহলে ফুটবল কেন বলল? চোখের সামনে থেকে ভেজা চুলগুলো সরিয়ে বললাম,

” আপনার চোখে কি সমস্যা আছে? তাহলে গিয়ে ঠিক করে নিন।”

বলেই ভেংচি কাটলাম আমি। রৌধিক ভ্রু কুঁচকালো। তা এড়ালো না আমার থেকে। আয়নাতে ঠিক দেখতে পেলাম। উঠে গেল সে। আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“তোমাকে কি বললাম, শুনতে পাও নি? যাও চেঞ্জ করে নাও। গো ফাস্ট”

“আশ্চর্য তো! শাড়ি ছাড়া কি পড়বো আমি? থ্রী পিছ, টপস্ কিছুই তো নেই।”

কাবার্ড হাতরে খুঁজে দেখলেন। পেলেন না। নিজের কাবার্ড থেকে ট্রাউজার আর টি শার্ট বের করে ধরিয়ে দিলেন।
” আমি ওয়াশরুমে যাচ্ছি। ঘরেই চেঞ্জ করে নাও। এসে যদি দেখি না পড়ে বসে আছো। তাহলে আমিই পড়িয়ে দিবো।”

বলেই হনহনিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলেন। ফোঁস করে দম ছাড়লাম আমি। এই লোকটাকে বিশ্বাস নেই। সবকিছু করতে পারে। কিন্তু আমিই বা কিভাবে এগুলো পড়ে ঘুড়ে বেড়াবো।
তবুও মুখ ভার করে পড়লাম। ভেজা টাওয়াল দিয়ে চুল মুছে বেলকেনিতে মেলে দিলাম। গ্ৰিলে রাখতেই হাওয়া এসে উড়িয়ে ফেলে দিল নিচে। ধরতে গিয়েও ব্যর্থ হলাম। দ্রুত নিচে নেমে এলাম। টাওয়াল নিয়ে পেছনে ফিরতে নিলেই ধাক্কা খেলাম কারো সাথে। পায়ের কাছে এসে পড়লো কেউ। কেঁপে উঠলাম আমি। পিছিয়ে গেলাম কয়েকপা। কালো পোশাক ধারী গার্ড পড়েছে। তার সামনে রৌধিক দাঁড়িয়ে আছে। নীলাভ রঙের চোখ জোড়া অসম্ভব লাল। আমাকে গিলে খেয়ে ফেলবে এমন। আমতা আমতা করে বললাম,
“আপনি? আপনি এখানে আর ইনি পায়ের কাছে কেন, উঠুন?”

” একদম না। ওকে টার্চ করবে না। এন্ড ইউ। গো! গেট আউট অফ হেয়ার। দা নেক্সট টাইম ইউ সি আওয়ার গার্লস, কিপ ইউর হেড ডাউন। আদার-ওয়েজ আই কুড নেভাব থিংক অফ গেটিং আইট। গট ইট। নাউ গেট আউট।

ছেলেটি বন্দুক তুলে মাথা নিচু করে চলে গেল। রৌধিক আমার সামনে এসে দাঁড়াল। কর্কট কন্ঠে বলল,
“তুমি এই জামা কাপড়ে বাইরে বেরিয়েছো কেন? হোয়াই?”

নিজের দিকে তাকাতেই লজ্জায় কুঁকড়ে উঠলাম আমি। ভেজা চুলগুলো একটু সামনে এনে বললাম,
” টাওয়াল টা নিচে পাওয়া পড়ে গেছিলো। সেটা নিতে এসেছি।”

” তারজন্য এই অবস্থায়?”
” আপনিই তো শাড়ি পড়তে বারণ করেছিলেন।”

“আমি এসে নিতে পারতাম না‌। আমি কি বাড়িতে ছিলাম না?”

“আপনি তো ওয়াশরুমে ছিলেন।”

“সারাজীবন ওয়াশরুমে বসে থাকতাম। জীবনেও বের হতাম না! আবার কথা বলছো। স্টুপিড যাও এখান থেকে।”

আমি চলে আসার জন্য পা বাড়াতেই হাত ধরে ফেললেন তিনি। ডান হাতে ঝুঁলে থাকা টাওয়াল টা নিয়ে শরীরে পেঁচিয়ে দিলো আমার। ক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,” নাও! গো!’

রৌদ্রের তাপে রৌধিককে অগ্নির ন্যায় লাগছে আমার কাছে। ভীত হলাম আমি। তাকে ভয়ংকর ঠেকছে আমার কাছে। আমি আগে পেছনে না চেয়েই বাড়ির ভেতরের দিকে ছুটে এলাম। এতোটায় অনুতপ্ত ছিলাম কিছু খেয়াল করলাম না। ঘরে ঢোকার আগেই ধাক্কা খেলাম কারো সাথে। থেমে গেলাম আমি। বিপরীত মানুষটির হাত থেকে ফোনটা মৃদু শব্দে নিচে পড়ে গেল। নিজেকে সামলে নিলাম আমি। আমার দিকে হিংস্র চোখে তাকালো বিপরীত তরুণী। দেখতে অসম্ভব সুন্দর। এই বাড়িতে প্রথম তাকে দেখছি। এর আগে দেখা হয়নি বললেই চলে। আমি তরীগড়ি করে ফোনটা তুললাম। ফ্লোরে পড়ার কারণে স্ক্রিনের কিছুটা অংশ ফেটে গেছে। ফোনটা তার দিকে এগিয়ে দিলাম। টেনে নিল হাত থেকে। নত কন্ঠে বললাম,
” স্যারি আমি আসলে..

আর উচ্চারণ করতে পারলাম না। তার আগেই বিকট শব্দে চ’ড় পড়ল গালে। পুড়ে উঠলো জায়গাটা। মনে হলো কোনো গলিত আগ্নেয়গিরির লাভা গালে এসে পড়ল। হাতটা আপনাআপনি গালে চলে গেল। সামান্য একটা ভুল হওয়ার জন্য গাঁয়ে হাত তুলতে পারে জানা ছিলো না। আঙুল তুলে রুদ্ধ কন্ঠে বললেন,
” অস’ভ্য মেয়ে। চোখে দেখো না? চোখ কি মাথায় তুলে রাখো? আমার কতো দামী ফোনটা ভেঙে ফেলেছো ধারণা আছে? রাস্তা থেকে তুলে এনেছে বলেই এমন চলাফেরা। দুদিন হয়েছে আনতে না আনতেই জামা কাপড় ছেড়ে এইসব পড়া শুরু করেছে। দুই মাস এগুলোও থাকবে না।”

বলেই হনহনিয়ে চলে গেল। আমি অশান্ত মনে নিয়ে ঘরে চলে এলাম। দরজা বন্ধ করে দিলাম। আয়নার সামনের দাঁড়ালাম। চার আঙুলের কালচে দাগ পড়েছে। পরিবারের বড় মেয়ে হওয়ার কারণে, চ’ড় কিংবা মার আমার ভাগ্যে কখনোই ছিলো না। জীবনের প্রথম চ’ড় খেয়ে চিরতরে শিক্ষা হয়ে গেছে। কাবার্ড হাতরে মলম বের করে গালে লাগালাম। মাথা টা জিম জিম করছে। পেটেও প্রচুর ক্ষুধা লেগেছে। কিন্তু এভাবে নিচে গেলে সবাই আমাকে নিয়ে পড়বে। ব্লাঙ্কেট মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম।
.
সূর্য তখন আকাশের অন্য প্রান্তে গেছে। সূর্যের রক্তিম আভা অন্ধকারে আকাশে নেই। সন্ধ্যার মিটিমিটি তারা জ্বলছে। ধীরে ধীরে আরো আঁধারে ছেড়ে গেল। ঘড়ির কাঁটা গিয়ে ঠেকলো নয়টা তিপ্পান্ন তে। সেকেন্ডে সেকেন্ডে যখন দশটা কাঁটা ছুঁলো তখন দরজা নক পড়লো। ক্লান্তির মাঝে দরজা খুলতেও কষ্ট হচ্ছিল আমার। ঘুমু ঘুমু চোখে দরজার দিকে চেয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। ধীরে ধীরে আওয়াজ বাড়তে লাগল। কন্ঠস্বর শুনতে পেলাম। কিন্তু নিদ্রার সমাপ্তি ঘটাতে পারলাম না। মনে হচ্ছে শরীর টা পুড়ে যাচ্ছে। কেটে গেল আরো মিনিট পাঁচেক। হুট করেই কেউ টেনে বসিয়ে দিল আমায়। তখনও চোখের পাতা ঝাঁপসা। পরিস্থিতি বুঝে উঠার আগেই চ’ড় পড়ল একই গালে। ভেতরটা পুড়ে উঠলো। মুখটা বাম দিকে বেঁকিয়ে গেল। চুলগুলো মুখে জুড়ে ছড়িয়ে গেল। জ্বলে উঠলো স্ক্রিন টা। তিক্ত চাপা স্বরে আহ্ করলাম ঠিকই কিন্তু স্বর বেরিয়ে এলো না। গালে হাত দিয়ে ঘসলাম। সবকিছু স্পষ্ট হতেই বুঝতে পারলাম রৌধিক আমার সামনে দাঁড়িয়ে। তার দম বন্ধ সূচালো দৃষ্টি। সকালের চেয়েও ভয়ঙ্কর লাগছে। অধর চেপে কিয়ৎক্ষণ নিজের ভেতরের রাগ দমন করার চেষ্টা করলো। অতঃপর ঝাঁঝালো কন্ঠে বললেন,
“এতোক্ষণ ধরে দরজা ধাক্কা দিচ্ছিলাম। জানো কতো চিন্তা হচ্ছিল? ইউ হ্যাভ এনি আইডিয়া? তুমি কী করছিলি? সকালের বিহেবিয়ার জন্য না খেয়ে দরজা বন্ধ করে রেখেছো। এসে দেখি দরজা বন্ধ করে ঘুমাচ্ছো, হাউ ফানি।”

দরজার দিকে তাকালাম আমি। এখনো দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করা। আমি তো দরজা বন্ধ করে একটু শুয়ে ছিলাম। আর উঠি নি। তাহলে তিনি ভেতরে এলেন কী করে। ভূত নয় তো। পিছিয়ে গেলাম আমি। ভীত গলায় বললাম,
“কে আপনি? দরজা তো বন্ধ ছিলো। তাহলে আপনি এলেন কী করে? হাওয়ার মতো আসেন নি তো? দেখতে রৌধিকের মতো। ভূত নয় তো? সরুন আমার থেকে।”

পিছিয়ে গেলাম আমি। দেয়ালের সাথে বিঁধে গেলাম। বিরাগী হলেন তিনি। রৌধিক আমার দিকে চেয়ে রইল। আমার সামনে বসে দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
“ঢং না দেখিয়ে চুপচাপ বসো। আমি বেলকেনি দিয়ে রুমে এসেছি। দেখো, হাতে ছুলে গেছে।”
হাত দেখিয়ে বললেন তিনি।

আমার মধ্যে কোনো ভাবাবেগ হলো না। রৌধিক আমার হাত ধরলো। অন্যহাত গালে রাখল। মুহুর্তেই কেঁপে উঠলাম আমি। আহ্ করে উঠলাম।
রৌধিক সরে গেল। আমাকে টেনে নিজের কাছে নিয়ে নিল। অসহায় কন্ঠে বলল,”স্যরি। আ’ম স্যরি।”

সূক্ষ্মভাবে ভাবলেন তিনি। আমার গালে হাত রেখে বললেন,” কি হয়েছে গালে?”

আমি সাথে সাথে চুল দিয়ে গাল ঢাকার চেষ্টা করলাম। সন্দিহান চোখে চাইল। ফট করে আমার হাত সরিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন। গালে হাত বুলিয়ে দিলেন। অতিশয় স্বাভাবিক কন্ঠে বললেন,

[চলবে ইনশাআল্লাহ]